সিজলার

ইংরেজীতে ভ্যালেন্টাইন ডে, বাংলায় ভালোবাসা দিবস। দিনটি নিয়ে হৈ চৈ এর অন্ত নেই। বাংলাদেশে নতুন বয়সীরা আর এ লন্ডনে এটা সব বয়সিদেরই প্রেমের এক আড়ম্বরপূর্ণ আনুষ্ঠানিক বিশেষ দিন। ক্লাবে-বারে উত্তেজনার আবেগ, রেস্টুরেন্টে বুকিং জোড়ায় জোড়ায়; সাজ অপরূপ। চতূর্দিকে হৃদয়ের ঝালর, বেলুন উড়ছে হৃদয়ের, হৃদয়ের চকোলেট বিতরণ। কর্মীদের হৃদয় শিশিরভেজা ঘাসের মায়াময় গায়ে রোদের ঝিলমিল নয়তো রাতের সমুদ্রে জ্যোৎস্নার ঢেউ। মালিকের মনে বেশি কাস্টমার আগমনের উচ্ছাস গড়ের কুয়ায় কৈ মাছের মতো খলবল।
অথচ সকাল থেকেই দীপ্তির মনটা লন্ডনের আকাশ। ভালোবাসা দিনে মনে রক্তক্ষরণ বিষণ্ন বিবশ। ভাষাহীন কান্না গুমরে গুমরে বুকের ছোট্ট খাঁচাটায় ধড়ফড় করছে। ‘ভালোবাসা দিবস। হৃদয় যাদের শুষ্ক তাদের ভালোবাসা দিবস পালন করতে হয়। আমাদের ভালোবাসা প্রতিদিনের, প্রতিমুহূর্তের, প্রতিসেকেন্ডের। আমরা একে অন্যকে স্পর্শ করি প্রাণ দিয়ে’-কারও পুরনো কথার ডানা-গুঞ্জন। রেস্টুরেন্টের ব্যস্ততা, হট্টগোলও মনকে স্বাভাবিক করতে পারছে না। স্থবির থ্যাৎলানো আহত মন যোগ দিতে পারছে না কাজে। দীপ্তি রেস্টুরেন্ট সিঙ্কে হাঁড়ি-পাতিল, প্লেট-বাটি পরিস্কার করে। রেস্টুরেন্টে এ পোস্ট কিচেন পোর্টারের। সে পুরো নয় হাফ কিচেন পোর্টার। শুধু বেশি ব্যস্ততম দিনে কাজ করে। ব্যস্ততাকে এখানে বলে বিজি–ইংরেজের দেশের সহজ নাম।

পেনের মহাপোড়া প্রাণপনে তুলতে থাকে দীপ্তি। তাড়াতাড়ি খাবার দেবার জন্য বেশি আগুনে পুড়ে পুড়ে রান্না হয়। নাকি পোড়াই আলাদা কোন রসনার স্বাদ! পোড়া তুলতে তুলতে ওষ্ঠাগত প্রাণ আর অয়্যারের তারে হাত ঝাঁঝরা। গ্লাবস ড্রয়ারে; হেলথ সেফ্টির ইন্সপেকশনের শো। তাছাড়া গ্লাবস পরে এত দ্রুত প্লেট-বাটি-পেন দেয়াও সহজ নয়। সাবান গুড়ার সাথে প্রচুর লিকুয়েড মিশালে কষ্ট কিছুটা কমে। আগে শুধু সাবান গুড়া দিয়ে ঘষে ঘষে ধুত। বেশি কষ্টে বুকে ব্যথা হত, হাড্ডিতে ধরত জ্বালা। বুঝতে দিত না, মুখ ফুটে বলত না দুর্বলতা টের পায় যদি। পাছে মেয়ে মানুষের সমালোচনা করে, হারাতে হয় চাকুরি। মেয়েদের তো রেষ্টুরেন্টে কাজই দেয় না কেউ! মনে মনে গাবনারের কাছে কৃতজ্ঞও সে।

-‘সিজার, সিজার’ আফা সিজার দেন চেঁচাতে থাকে তন্দুরি শেফ ফখর আলী। অসহায়ভাবে তাকায় মাথার উপর স্তূপিকৃত ডিস, প্লেট ও বাটির দিকে। সর্বনাশ এত তাড়াতাড়ি এত প্লেট-বাটি জমেছে ভাবাই যায় না। ভিরু পায়ে প্লেট বাটির ফাঁকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে খুঁজতে চেষ্টা করে সিজ্লার। ছোট নৌকার মতো লোহার তাওয়া। যা একটা সমান ডিজাইনের চেপ্টামত কাঠের উপর রেখে সরাসরি পরিবেশন করে খাবার। তাওয়ার তাপে ছড়িয়ে পড়ে মাংসমাখা কাঠপোড়া ধোঁয়ার গন্ধ। বেশ আভিজাত্যপূর্ণ বিষয়!
-আফা ফান তোলেন, খেঁকিয়ে ওঠে রেস্টুরেন্ট শেফ বা প্রধান রাঁধক। একটা রেস্টুরেন্ট শেফের উপরই নির্ভর। এ শেফ পনের বছর ধরে কাজ করছে। তাকে সমীহ করে রেস্টুরেন্ট মালিকও বা গাবনার। দীপ্তি তাকিয়ে দেখে এখনো চারটি পেন বাঁকি আছে। আজকাল শেফের প্রত্যেক কথায় ঝাঁঝ। বিনা কারণেই ধমকায়। হঠাৎ বলে উঠবে, চারমাস থেকে কাম করতেছেন কোন কিছুই শিখলেন না! আগে বলত,‘আফার ব্রেন আছে কি বলেন আপনারা! এত তাড়াতাড়ি কুন জিনিস কুতায় রাখন লাগব আইজ পর্যন্ত কেউ ধরবার ফারে নাই’। বলা যায় না সেকথা, এও বলা যায় না কাজের আগে একমাস পরীক্ষা করে নেয়া হয়েছে। কিছু বলার বা অতিরিক্ত কিছু করার নিয়ম নেই যে! শুধু যেভাবে আছে ঠিক রেখে কাজ করে যাওয়া। ছোট ডিঙির মতো বয়ে চলা নিঃশব্দ ।
-ক্যালেন্ডারে ছোট ডিস আছেনি আফা, সেকেন্ড শেফের নরম মিউ স্বর?
দৌড়ে কলিয়েন্ডার থেকে কতগুলো ছোট ডিস দিয়ে আসে।
-কিতা অইছে সিজার দেন না খ্যানে, তন্দুরি শেফের কর্কশ-কণ্ঠ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বহু প্লেট, বাটির নীচে একটি সিজ্লারের গলুই দেখা যাচ্ছে। উপর থেকে প্লেট সরানোর চেষ্টা করে। ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। ছুটে আসে তন্দুরি শেফ। চারদিকে বাড়ে সোরগোল।
-গাবনারে আর কাম ফায় না ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টো দিব বেটি মাইনস! নান
বানানেওয়ালা চাচার উঁচু গলা, চোখ খ্যানখ্যানে তন্দুরি আগুনের মতো জ্বলছে। চাচা প্রথম থেকেই দীপ্তিকে সহ্য করত না। কিচেনে মহিলা মানুষ হলে নানা অসুবিধার কথা প্রায়ই বর্ণনা হত। এই যেমন কিচেনে একটু রঙ্গরসের কথা বলা লাগে। খাছরা কামে খাছরা মাত না হলে জমে না। এক একজন এক এক রকম কথা বলে চাচাকে উস্কে দিত। শুধু গাবনার মাঝেমাঝে থামাত, ‘কিতা চাচা খালি বেটি মাইনস নিয়া মাত। বুড়া অইছ খাইছলত গেল না’। আজ চাচা মওকা ভারী।
-সরি এইখানে এত প্লেট-বাটি জমলে তো মানুষ রাখনের দরকার নাই, স্বয়ং গাবনারের ধমক! দীপ্তির বুক ভেঙে উত্তরি ঝড় ওঠে; হতাশা-অপমান বিদীর্ণ রাত। সাবধানতার তরী উজান স্রোতে আটকে যাচ্ছে গো!
-রাখছ তো বাবা বেটি মাইনষ: বেটিরা কাম করব গরের কিচেনত-চাচার গলায় ফূর্তি। দয়ারামকে ডেকে দিয়ে গাবনার মুখ গম্ভীর করে সামনে চলে যায়।

দীপ্তির বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় পুরো বিষয়টার প্ল্যান। শেফকে চটানোর ফল পেতে শুরু করেছে। আগে এর থেকে কম বিজি’র দিনেও দু’জনে কাজ করতো সিঙ্কে। নেপালি দয়ারাম সব সময় পেন তোলায় বা ডিস তোলায়, নয়ত এঁটো প্লেট-বাটি সাজিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে। কিছুদিন থেকে তাকে সিঙ্কের কাছে আসতে দেয়া হয় না। আজও যতবার এখানে আসতে চেয়েছে কোন না কোন অজুহাতে ডেকে নেয়া হয়েছে। দয়ারাম ফাঁকি দিচ্ছে বলে ধমকে দিত। বিশেষ দিনগুলোতে আরো বাড়তি একজন আসত যে এখানে কাজ করত। আজ আসেনি।
পুরো ঘটনায় অস্বস্থির সাথে সাথে অসহায় বোধ করে দীপ্তি। কাউকে বলার মতো কোন ভাষা নেই। পিটপিটিয়ে তাকায় শেফ। দীপ্তি কাজ করে যায় নিরবে। এক এক করে এঁটোখাবার পরিস্কার করে থালাবাটি একপাশে গুছিয়ে রাখে। ডিসগুলো দ্রুত ধুয়ে দেয়। অন্য-সিঙ্কে চলে পেন এর অবিরত পরিস্কারকরণ।

সবার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় কাজটা আর থাকছে না। লন্ডনে একাকী মহিলা রেস্টুরেন্টের কিচেনে কাজ করবে এমনি এমনি! এই শহরে একটা মেয়ে কারও অনুগত না হয়ে কাজ করতে পারে না। গাবনার, শেফ বা আর কারও দেহসঙ্গী হতে হবে তাকে। তারা শব্দটিকে সম্মান দেয় বলে, ‘ফ্রেন্ড’। আকারে ইঙ্গিতে শেফ অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছে গত তিন মাস ধরে। তিন মাস কেন এক বছর ধরেই সে একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বহুবার।
-আফা যান একটু রেস্ট নিয়া আসেন, শেফের উদার ডগোমগো গলা। বেশি অই গেছে কি কন আক্কাস ভাই, জিহ্বায় টিস শব্দ করে চোখ মারে শেফ। যান একটু বেড়াই আসেন। ফরে কইরেন; আপনে তো মিয়া কুনতাই বুঝবার চান না! সবার চোখ কৌতুক জমা করে।
বাইরে বেরিয়ে এসে জোরে দম ছাড়ে দীপ্তি। খোলা-ঠাণ্ডা বাতাস শরীরে ঝাটকা মারে। কিচেনের গরম ও গ্যাসে জ্বালা করা চোখে একটু আরাম বোধ করে। কিছু সময়ের জন্য মা’র কথা মনে আসে। ছোট ছোট ভাইবোনগুলোর কচিকচি মুখ ও কলকাকলির সুর রাতের এ শহরের স্তব্ধ পাড় ভাঙে। মান অভিমান, আদর আহ্লাদের জীবন ছেড়ে এ কোন অন্ধকারে পা! এর শেষ কোথায়? মানুষগুলো যেন প্রস্তরমূর্তি, মানুষগুলোর হাতে যেন পুতুল নাচের ইতিকথা সে। আগে শুনেছিল বিদেশে বাঙালি মানে বাঙালির অতিথি। বাস্তবতার আকাশগঙ্গায় অন্ধকারের ভেলা দোল খায়।
-কিতা আফা কিছু আলামত ফাইছননি? আধো অন্ধকারে সিগারেটের আগুন এগিয়ে আগে–‘আপনি বাঙলাশেত বড় ডিগ্রি নিছইন ইতা বুলি যান। এটা লন্ডন শহর, পইসা আর ইনজয়ের শহর। শিক্ষিত মানুষ এত বোজান যায় না। সব মেয়েরাই ইনজয় করে। এত কষ্ট করনের দরকার কি? টাকা কামানোর সহজ পথ ধরেন। আমার ফ্রেন্ড হন। আপনারে আমার ভাল লাগছে। টাকার অভাব হইব না। আমার বন্ধু-বান্ধব দু’একজন আছে। কোন অসুবিদা হইব না। কাজও করবেন টাকাও কামাইবেন মেলা। কাজ কামে শরিল বিষ অয় সামটাইমস ম্যাসাজ দিবেন। আমিও দিমু। হা হা হা’- শেফের আনন্দের সুর নিরবতা ভঙ্গ করে। আজ শেফ স্বরূপে আবির্ভূত, ‘আফনে রাজি তো গাবনারকে কই চাকুরি ঠেকানোর দিমুনে। আইজই ডিসিশান দেওন লাগবো না, আরও সময় নেন।’
-অনেক ধন্যবাদ আমার জন্য না ভাবলেই খুশি হব, দীপ্তি কিচেনে চলে যায়।
-ফুলিশ গার্ল, স্লেসাত্মক উক্তি জমা পড়ে রাতের জলসায়…
সিঙ্কের কাজে ফিরে আসে দীপ্তি। মনে পড়ে নীলিমার কথা-‘এই কাজ কর তুমি- ওয়াক’?
-রেস্টুরেন্টের কিচেনে আর কি করতে পারি। স্ট্যাটার এর প্লেট সাজাই, ভাতের বক্স ভরে দেই; ছমোছা সিঙ্গারা বানাই, ভালো কাজের ফিরিস্তি গাঁথে।
-ইছ খাছরা প্লেট মনে হয় ধুইছি হাযার হাযার, পেন ধুইছি পাঁচশত।
যা নীলিমার চোখে এত নোংরা ও কষ্টকর তা মনেও আসেনি কখনো। প্লেটের আধখাওয়া, না খাওয়া উচ্ছিস্টগুলো সযত্নে হাত দিয়েই ডাস্টবিনে ফেলত। কখনো প্লেট-বাটি আছাড়-পাছাড়ও নয়।
নীলিমা এসেছিল র্থাটিফাস্ট নাইটে। এখান থেকে যাওয়ার পর কোন এক লোককে তার ফোন নম্বর দেয়। সে এক নম্বর থেকে অনেক নম্বর দীপ্তির দুঃখ গোছানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু দূর্ভাগ্য গোছেনি দীপ্তির। দুইশত সিটের এ রেস্টুরেন্টে ব্যস্ততা মাকড়শার সুতোর মতো টানটান থাকে। সবার হাঁটা-চলায় শব্দহীন ছোটাছুটি। দশটি চুলা, দুটি তন্দুরি দম আটকে চলে আখমাড়াইয়ের পর গুড়ের আগুনের মতো। আজ অনবরত সিজ্লারের খাবার দিতে হয়েছে। সিজ্লার মাত্র সাতটা। কেনার কথা গাবনার বলেনি যে তা নয়; কেনা হয়নি। ওয়েটাররা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে, অভিযোগ উঠেছে বার বার। অন্যদিন এতটা হত না। আজ ভালোবাসার জুটিদের পোড়া খাবার বেশি খেতে হয়েছে। গরম সিজ্লার ধুতে ধুতে হাত তো জ্বললোই, জ্বলতে লাগলো জীবনও।

রাতে বিছানায় ছটফট করে। চোখে ঘুম নাই। মনের ভিতর ঘুরপাক চাকুরিটা আর নাই। দৌড় দৌড় বিয়ের ক্যাটারিং, মেনু বাটা ঘরে, দোকানে। হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ফোস্কা, মনে জমতে থাকা বরফকুচি। গায়ের ব্যথায় পরদিন বিছানা থেকে ওঠা যায় না। অনেক যব সেন্টার- চাকুরি থাকলেও দেয় না। আকারে ইঙ্গিতে দেয় অন্যপ্রস্তাব। কেউ কেউ সরাসরি বলে, এখানে টাকা কামাইতে আইছেন এত ভাবনার কি আছে সতী-সাবিত্রী। এখানে সব স্বাধীন কেউ কাউকে কেয়ার করে না। এদের কি বলা যায়-বলেই বা লাভ কি? এসব ব্যবসায় অনেক টাকা কামানো অহঙ্কারী মুখে হাসির কলরব।
আগের দুই মাসের বেকারত্ব। দু’মাস মানে আট সপ্তাহ। কী দুর্দশাগ্রস্ত-পীড়িত সময়! এখনও আগের বাড়ীওয়ালা চল্লিশ পাউন্ড পায়। এ কাজটা পাওয়ার পর দমটা এসেছিল। দুই দিনে আশি পাউন্ড অনেক টাকা। এত টাকা অন্য জায়গায় পুরো সপ্তাহেও মেলে না।
গোঁৎ গোঁৎ করে নাক ডাকছে পাশের মহিলা। দু’বার নেড়ে চেড়ে দিয়েও লাভ হয়নি। মহিলা এপাশ থেকে ওপাশ ফিরে আবার বিভিন্ন সুরে নাক ডাকে। ইন্ডিয়ান লেন্ডলর্ড ভাড়া দেওয়ার সময় বলেছিল প্রথম সপ্তাহেই বেড কিনে দিবে। দু’সপ্তাহের অগ্রিমও নেয়। তিনমাস পার হয়ে গেল কোন খবর নেই। সপ্তাহ শেষে পয়তাল্লিশ পাউন্ড নিয়েই লাপাত্তা। ঘুম আসে না …‘ইস এত নড়লে ঘুমায় কেমনে!’ ঘুমের ভেতর মহিলা ধমকায়।

পরদিন বিকাল চারটায় চার রাস্তার মোড়ে দীপ্তি। বেশ বাতাসের ঝাপটা, বৃষ্টিও ছিটাছিটা; ঠাণ্ডায় দাঁত ঠকঠকি। হাত দু’টো কোটের পকেটের ঢুকিয়ে যথাসম্ভব রক্ষার চেষ্টা। প্রধান ওয়েটার আসিফের গাড়ি এসে তুলে নেয়। আসিফ আরো কয়েকজনকে নেয় সাথে। রেস্টুরেন্ট যেহেতু লন্ডনের বাইরে তাই সবার ভাড়াটা বাঁচে। আজ শনিবার আজ অতিরিক্ত একজন আছে। যার গতকাল যাবার কথা ছিল। লন্ডনের হালকা যাম এড়িয়ে গাড়ি চলছে দ্রুত।
‘মন খারাপ করার কিছু নাই আপা এটা দেশই এ রকম। কাজ আজ আছে তো কাল নাই। আপনার ‘এন আই’ ঠিক আছে তো কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অনলাইনে সার্চ করলে ম্যাগডোনাল্ড বা পিজা হার্ট অথবা শপিং সেন্টারগুলোতে কাজ পেয়ে যাবেন’। ড্রাইভিং করতে করতে একটানে কথা বলে জোরে দম ফেলে আসিফ। আবার বলে, প্রথম দিকে একটু কষ্ট হয় যা। ইংলিশটা একটু চর্চা করবেন। দীপ্তি বুঝতে পারে রফিক ভাই মানে যার মাধ্যমে কাজটা হয়েছে উনি বলেছে ‘এন আই’ ঠিক থাকার কথা। উনি দীপ্তিকেও বলতেন কখনো কাউকে যেন না বলে ন্যাশনাল ইনসিউরেন্স নাম্বার নাই। বলা যায় না কেউ পুলিশকে বলে দিতে পারে। অতীতে অনেক ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের সোর্স হিসাবে বাঙালি এলাকায় বাঙালিদেরই কাজ দেয় পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। দীপ্তির মনে হয় শেফ বিষয়টা ধরতে পেরেছে। ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকে সে। কি কুক্ষণেই যে দালালকে এদেশে আসার কথা বলেছে। কোন টাকা দেও য়া লাগলো না সুড় সুড় করে হিথ্রো এয়ারপোর্ট। কাউকে বলতে পর্যন্ত দেয়নি। আগেরদিন রাত এগারটায় জানিয়েছে। পাশপোর্ট দিয়েছে ঢাকা বিমানবন্দরে ঢোকার পর। কে জানে ফিরে গেলে স্কুলের চাকুরিটা ফিরে পাবে তো? শুধু দালালের টাকাটা জোগাড় করতে পারলেই দীপ্তি ফিরে যেতে চায়। জানেনা তখন লন্ডনি বলে সবাই নাকি ঠাট্টা করে; করলে করুক ফিরে যাবে সে।
দীপ্তিকে মনমরা থাকতে দেখে আসিফ আবার বলে, শেফ ভাই’র সাথে আসা বন্ধ করায় সে ক্ষেপে গেছে। বেশি খারাপ কিছু করছিল? সে যাক দেখেন কি হয়। গত দু’সপ্তাহ থেকে দীপ্তি আসিফের সাথে যাওয়া আসা করছে। আগে আসিফের ফিরতে দেরি হত দেখে শেফের সাথে ফিরত।
-কাজটা কি চলে যাবে? শূন্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
-ওরা গাবনারকে বোঝানোর চেষ্টা করছে আপনাকে দিয়ে হবে না।
-আগে তো সুনাম করত। আমাকে বলেছে এ সিঙ্কে অনেক ছেলেরা ও পারেনি আমার মতো।
-সে তো আমিও দেখেছি। যাক তাদের কথা বাদ দেন। আমার একটা প্রশ্ন ঐদিন আপনার কি হয়েছিল? ভালোই তো লড়ে যাচ্ছিলেন।
দীপ্তি নীরব হয়ে যায়। বলতে পারে না ভালোবাসা দিনটি কিছু সময়ের জন্য তার চলনে অবশতা মেখে দেয়। অতীতের কোন সুখচাঁদ যন্ত্রণা হয়ে তার বর্তমানটাকে নড়বড়ে করে দিচ্ছে। বলতে চায় না ওরা আজকাল আমাকে একটুও সাহায্য করে না, আমি মেয়ে বলে ষড়যন্ত্রের শিকার। যেখানে অত্যধিক সতর্ক থাকার কথা সেখানে পুরোপুরি অসতর্কতা। ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে কেউটের দল। বার বার উরুতে হাত দেয়ার কারণে ব্রান্ডির বোতলে বেয়াড়া শেফকে মারার কথা চেপে ঝাপসা হয়ে আসা চোখ মেলে বন্ধ কাঁচের জানালায় তাকিয়ে থাকে লন্ডন শহর আর বাইরের সৌন্দর্যের দিকে। কে বলে ঠাণ্ডার দেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নেই। বিল্ডিংগুলোর পাশে, বেলকনির কোণায়, ল্যাম্পপোস্টের গায়ে কত রঙের ফুলের ঝাড়। এখনো পাতা গজায়নি কিন্তু ডাল ভরে থাকা সাদা ফুল, গোলাপি ফুলের চোখ জুড়ানো মনোহর শোভা। সবুজ ঝোপ আর ফুলের শিল্পিত চিত্রপট ভেসে থাকে একদার জ্যোৎস্না আরাধনা করা এখন ভাবনাকাতর মুচড়ানো প্রাণ জুড়ে।

গাড়ি দাঁড়ায়। রেস্টুরেন্টের সামনে গোলাপের বাগানটা এতদিনে অনেক আপন হয়ে ওঠেছে। সামনের কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই সুনসান নিরবতা। অন্যদিন ভিতরে ঢুকতেই শুভেচ্ছা ও সালামের ধুম পড়ে যেত। মালিকের আত্মীয় স্বজন কেউ কেউ উঁচু নাকে তাকালেও বেশিরভাগই তাকে পছন্দ করত। যদিও সে রেস্টুরেন্টের কিচেনে কাজ করে, যদিও সে কিচেনের সবচেয়ে নীচের পোস্টে কাজ করে। আলগোছে কারও কারও চোখের দিকে তাকায়-সবাই টেবিল চেয়ার সাজাতে অধিক মনোযোগী। কিচেনের দরোজা খুলে ভেতরে ঢুকে।
-আফা বালা আছইন, তন্দুরি শেফের লম্বা সুর।
-হ ভাই বালা, আড়ষ্ট কণ্ঠে উত্তর দিতে দিতে পেসেজ ধরে পিছনে দরজা দিয়ে বাইরে যায়। স্টোর রুমে কোট খুলে; শার্টপেন্টের উপর সাদা ঢিলা এপ্রোন তার উপর নীল-সাদা টানা বেল্টের কুকিং এপ্রোন ও মাথায় নীল-সাদা দাবাছক কাগজের টুপি পরে সিঙ্কে এসে দাঁড়ায়। একে একে সবাই আসে। সবশেষে আসে শেফ। বাধ্যগত কর্মী সালাম দেয়। জবাবে শেফ নিশ্চুপ থাকে।
কাজে লেগে যায় দ্রুত। প্রতিদিনের মতো বাইরে থেকে একটা খালি মোটা কাগজের বড় বাক্স কেটে লম্বা করে পায়ের নীচে পাতে। তারপর সকালের বড় বড় পাতিল-ঢাকনা ধুয়ে কিচেনের বাইরে রেখে আসে। বাইরে থেকে ছয়টা চেপ্টা ধরনের খালি বালতি এনে একটা বালতিতে গরমপানি ও প্রচুর লিকুইডসহ শেফের পাশে রাখে এঁটো গরম পেন রাখার জন্য। আরেকটা পরিস্কার করে পানি ও সামান্য লিকুইড দিয়ে সিঙ্কের উপর একপাশে রাখে। সিঙ্কের পিছনের দিকে রাখে দুটো বালতি এঁটো চামচ ও ছুরি রাখার জন্য। সামনের দিকে দুটো বালতির একটিতে পানি ও লিকুইড মিশিয়ে রাখে; অন্যটি খালি এখানে সবকিছু একসাথে থাকে। তারপর কলিয়েন্ডারে রাখা ধোয়া প্লেটবাটি রেকে সাজায়। ধীরে ধীরে ব্যস্ততা বাড়ে। মোটামুটি তালে এগিয়ে চলে। কেউ কারও সাথে অতিরিক্ত গল্পে মেতে ওঠে না আজ। অন্যদিন ব্যস্ততা কমলে নিজেদের মধ্যে বা দীপ্তিকে নিয়ে নানা রসালাপে মেতে উঠত। গতকালের অপ্রীতিকর পরিবেশটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি কেউ। দীপ্তিও একমনে কাজ করে যায়। সবকিছু ঠিকঠাক রাখতে চেষ্টা করে। কেউ কিছু চাওয়ার আগেই দিয়ে দেয়। তাছাড়া আজ নতুন আসা লোকটি তার সাথে কাজ করে। মাঝেমাঝে ভাতের বক্স ভরায় দয়ারামকেও সাহায্য করে। নানরুটির অর্ডার হলে দয়ারাম নান বানায়। আজ নানা আসেনি।

কাজ শেষ করতে করতে একটা বেজে যায়। আজ পুরো কিচেন পরিস্কারও করায় শেফ। দীপ্তির ধোয়া শেষ হতে হতে সবাই খেয়ে নিয়েছে। তার আজ খেতে ইচ্ছেই করেনি। প্রথমে এসেও না খেয়ে কাজ শুরু করে। মাঝখানে একবার ওরা ভাতভাজি’র মতো ছোটবাটিতে একটু দিয়েছে তাও একচামচ মুখে দিয়ে ফেলে দিয়েছে। আশঙ্কা ও ভীতিতে তার ভেতর কাঁপছে। এপ্রোন খুলে ময়লা কাপড়ের গাড়িতে রেখে নিজের কোট পরে টলতে টলতে সামনে আসে। পেছন থেকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করে খাবারের কথা। দীপ্তির সাড়া মেলে না।
‘আপামনি আসেন দেখি আপনার সাথে কথা আছে’ সামনে এসে দাঁড়াতেই বেতনের টাকাটা হাতে দেয় গাবনার।
বুকটা ধ্বক করার সাথে সাথে চতূর্দিকে সাজানো ঝলমলে বেলুন দুলে ওঠে, দুলছে প্রতিটি টেবিলে কাঁচের ফুলদানিতে রাখা টকটকে লাল গোলাপ, সারি সারি মদের বোতল। সাদা শার্ট ও কালো টাই ও পেন্ট পরা ওয়েটারদের অস্ফষ্ট, প্রেতের মতো লাগছে। যা ভেবেছিল তা সত্যি হতে শুরু করেছে। চাকুরি থেকে বাদ দেয়ার আগে বাংলা রেস্টুরেন্টের মালিকও একইভাবে কথা বলতে চেয়েছে।

আসিফ এগিয়ে আসে জুস মেশানো ভদকা হাতে দিয়ে সোফা দেখিয়ে বসতে বলে চোখের ইশারায়। মিলমিশের সময় এটা ভেতরে সিঙ্কের পাশে ছোট ফ্রিজের উপর রাখত। প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে আসিফের দিকে তাকায় দীপ্তি। কোন উত্তর খুঁজে পায় না।
সকলের পেমেন্ট শেষ হলে গাবনার এসে মুখোমুখি সোফায় বসে। আগে এ কাজটা আসিফ করত আজ গাবনার নিজে করার কারণ দীপ্তি মনে মনে আঁচ করে।
-আফনে ভালো আছেন? ভ্যালেন্টাইন ডে তে কি করলেন?
দীপ্তি অপেক্ষা করে আসল কথাটি শোনার। তাকে চুপ দেখেও তার কথা চলে…
-‘কালকে বলতে পারি নাই। আফনি ফাইছিলেন নি ভালোবাসার কোন মানুষ। মনেঅয় ফাইছেন, নায়নি? হালার ইংলিশরা ডে পালন করে আমরা নিজেদের খবরটাই রাখি না। হালার টাকা যে মানুষরে কিতা বানায়। এত টাকা দিয়া কিতা অইব কন? এক বাড়ি থেকে দুই, দুই থেকে তিন। শুধু যা বাড়ে তা হইল কাম’। দীপ্তি ভালো করে দেখার চেষ্টা করে গাবনারের চোখ। ড্রিঙ্ক করে নাই তো? না রেস্টুরেন্ট মালিকেরা নিজের রেস্টুরেন্টে ড্রিঙ্ক করে না।
-কিতা আফা ফাইছেননি কাউরে, এই দেশত আছেনি আফনার কেউ? গাবনারের কৌতুহলী চোখে কৌতুক।
-না মানে এসব নিয়ে ভাবি না…
-কি যে কন? এটা ফুর্তির দেশ। ঐ দেখেন ডেরেক দুই সপ্তাহ থাকি আপনারে একবার দেখার জন্য বসে থাকে। বললে আমি কথা বলি। আমার বন্ধু মানুষ। পয়সা কামান, এনজয় করেন। আমি তো বিশ পঁচিশ বার অইব প্রেম করছি। নিজে তো দেখতে মাশাল্লা, চোখ টিপে হাসে গাবনার। পকেটভরা টাকার দিকে ইঙ্গিত করে বুঝতেই ফারতাছেন। এখন আর বালা লাগে না- হা হা হা। পরক্ষণে গম্ভীর হয়ে বলে, আসলে প্রেম খাঁটি অন লাগে। ডেরেকের প্রেম খাঁটি কি কন হাসান ভাই হা হা হা।
দীপ্তি ঘোরে পড়ে। হাসির রেশ আর একই ধরনের উপদেশের বিচিত্র ব্যঞ্জনা ব্রেইনের কর্মক্লান্ত কোষে কোষে ততক্ষণ যতক্ষণ না আসিফের ডাক–
-আপা যাবেন না, অনেক দেরি হয়ে গেল।

ভবীষ্যৎ সময়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে আপাত স্বস্তির বাতাস ছেড়ে অন্ধকার ফুঁড়ে গাড়ি এগোয় এপিং ফরেস্ট এর নিঝুম-ঘন বন দু’পাশে ধরে। কখনো পাশ, কখনো মাঝ রাস্তায় গাড়ির লাইটে আগ্রহী-মুগ্ধ হরিণ ও হরিণ শাবকদের মুখ ভেসে ওঠে। ডালে ডালে বিরক্ত বানর আর উঁকিঝুঁকি। শীতের বান কাঁপিয়ে তৃতীয়ার বিগলিত জ্যোৎস্না ভরিয়ে দিতে থাকে প্রাণ।
……………………………………….

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত