আমার একটা ডিঙি নৌকার শখ।
দাদাজানের একটা ছোট্ট নৌকা আছিলো। একবার বানের জলে মাঠ ঘাট ডুইবা গেছিলো। মাঠের মাঝ দিয়া যে খাল চইলা গেছিলো, তারে চিনবার উপায় ছিল না, পুরা এলাকা দরিয়ার মতন হইয়া গেছিলো। রুপালি পানির মইধ্যে শাপলা, শালুক সহ ম্যালা পাইন্যাগাছ আছিলো। শালুক ফুলের চাইতে শালুক ফলের গ্রহনযোগ্যতা বেশী আছিলো। অইটা খাওন যাইতো, কাঁচা কিংবা পোড়াইয়া।
সে বয়েসে আমি জনসম্মুখে ন্যাংটা না হইলেও, আমার বয়েসি পোলাপাইন পরনের জামা প্যান্ট খুইলা লাফায়া পড়তো, ডুব দিয়া দিয়া শালুকের মূল তুইলা আনতো, আগ্রহ লইয়া খাইতো। আমি দেখতাম। আমার ভিত্রে একটা অভিজাত ভাব আছিলো, সে বয়েসে ডুব দিয়া শালুকের মূল খাইতে আমার ভাল্লাগতো না। আবার সাতার না জানায়, মাঝে মইধ্যে খাইতে চাইলেও ডরে পানিতে নামতাম না।
সেইবার আমার শালুকের মূল খাওনের ইচ্ছা বাড়ছিলো খুব। ভেটফুল খাওনের ইচ্ছা লাগছিলো। দাদাজান মাঠের মাইঝখান দিয়া নৌকা বাইতে লাগলেন। আমি হাফ প্যান্ট পইড়া গলুইতে বইসা আছি। দাদাজান হাফ প্যান্ট পরতেন না, লুঙ্গি পরতেন, তাও তারে কোনো দিন হাফ প্যান্ট লইয়া আপত্তি করতে দ্যাখি নাই। নৌকা বাইতে বাইতে মাঠ পার হইয়া সম্ভবত খালের কাছাকাছি চইলা গেছিলাম। দাদাজান আমারে নৌকায় বসায়া নিজে নাইমা গেলেন পানিতে। ডুব দিয়া ডুব দিয়া শাপলা শালুক তুলতে লাগলেন। আমি নৌকার গলুই থাইকা সইরা মাইঝখানে আইলাম। সদ্যতোলা শাপলা আর শালুক গুলান গুছায়া নৌকায় রাখতাছিলাম।
হঠাৎ কইরা দ্যাখি দাদাজান ডুব দিয়া আর উঠতাছেন না। ডরায়া গেলাম। মুখ বাড়ায়া খুঁজতে লাগলাম, কোনোখানে নাই। ডরে ডরে আছি, কাইন্দা দেমু এমন অবস্থা। মনের ভুলে এর মইধ্যে নৌকার একদম কিনারায় গেলাম গা। নৌকা উল্টায়া গেলো। আমি পানিতে পইড়া গেলাম। দাদাজান ডুব থাইকা উঠলেন, হাতের শালুক ফেলায়া দিয়া আমারে ধইরা তুললেন, নৌকা ঠিক করলেন, ক্যামনে করলেন আমি কইতে পারি না, আসলে আমার মনে নাই। দাদাজান শালুকের কথা ভুইলা গেলেন। আমি শালুক হয়া গেলাম। দাদাজান আমারে তুইলা নিয়া নৌকায় রাখলেন। আমি যেই শাপলা শালুক গুলান ভাঁজ কইরা রাখছিলাম, অইগুলানের পাশে আমারেও রাখলেন, গোছগাছ কইরা।
তারপর থাইকা কেউ ডুব দিয়া থাকলেও আমি ভাবি, আমি পইড়া যাইতে নিলে কিংবা পইড়া গেলে সে উইঠা আসবেন। আমারে ধইরা রাখবেন। দাদাজান আবার যেদিন ডুব দিছেন প্রায় বিশ বছর পর, সেদিন আমার কাছে খারাপ লাগে নাই। আমি জানি সে ডুব দিছে শালুক তুলতে, আমি নৌকায় বইসা আছি। শালুক সাজায়া রাখতাছি। পানিতে পইড়া যাইতে নিলে, কিংবা পইড়া গেলে সে উইঠা আসবে। আমারে ধরবে। আমারে শালুকের মতো সাজায়া রাখবে। গোছায়া দিবে। যতই বান আসুক, দাদাজানের নৌকায় আমি বইসা থাকুম, হাফ প্যান্ট পইড়া। দাদাজান লুঙ্গি পরলেও, কখনোই হাফপ্যান্ট নিয়া আপত্তি করেন নাই।