১.
প্রথম যেদিন তৃষাকে বলে দিলাম যে তাকে আমার ভালো লাগে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করে খুব। সে কেমন করে যেন তাকিয়েছিল। অদ্ভুত লাগলো দেখতে। ও মনে হয় ভেবেছিল আমি কেন ওকে ভালবাসার কথা বললাম। এইটা ঠিক হয় নাই৷
গলায় একটু ঝাঁঝ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো—
” এত দ্রুত কি করে ভালোবেসে ফেললেন? আমার সাথে মজা করছেন, না?”
তৃষার সাথে আমি মজা করতে যাব কেন এই কথা আর সেদিন বলতে চেয়েও বলা হয়ে ওঠেনি।
“আচ্ছা! আমাকে কেন ভালো লাগে আপনার?”
” তোমার ঠোঁটের জন্য ভালো লাগে। ওটা দারুণ সুন্দর!”
আমার এই কথায় কেন যেন ফোঁসে উঠেছিল তৃষা। চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়েও থাকলো কিছুক্ষণ। আমি ওর চোখে থেকে চোখ সরিয়ে দূরে একটা মরা গাছের একটা ডাল অর্ধেক ভেঙ্গে ঝুলে আছে সেটা দেখছি।
“আপনার চোখে আমি প্রেম দেখতে পাচ্ছি না। আপনি মিথ্যা বলছেন।”
খানিকটা হাসি আসলো আমার ঠোঁটে। কিছু বলার আগেই তৃষা আবার বলে উঠলো—
” আপনি আমার কাছে আসলে কি চান?”
” তোমার ঠোঁট।”
” আপনি আসলে একটা বাজে লোক। আপনার সাথে আলাপ হয়ে ওঠাই আমার জন্য খারাপ ছিল।” — বলে ভ্যানিটি ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে আমার কোন কথা না শুনিয়েই রাস্তা পার হয়ে চলে যেতে লাগলো সে। অবশ্য আমারও যে কিছু বলার আছে তেমনও নয়। আমি আবারও সেই ভাঙা ডালের দিকে তাকালাম। এবার দেখলাম সেই ডালের গাঁ চুয়ে কিছুক্ষণ আগে হওয়া বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটা এখনও টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে। আরও কিছুক্ষণ বসে থাকা হলো সেখানে। সন্ধ্যায় হলে এসে শুনতে পেলাম রুমমেট ওয়াই-ফাই কোম্পানিকে দেদারসে গালাগাল করতেছে। নেট নাই। শুয়ে আছি কিছুক্ষণ। অনেক্ষণ বাদে নেট আসলে ফেইসবুক ম্যাসেঞ্জারে দেখলাম তৃষা আমারে ব্লক করে রাখছে। মন খারাপ লাগলো না। কেন যেন মনে হল যা হওয়ার তাই হয়েছে। এই মন খারাপ না হওয়ার পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করলাম আমি কি আসলেই তৃষাকে ভালোবাসি? যদি ভালোবাসি তাহলে আমার খারাপ লাগছে না কেন?
২.
দিন চলে গেল অনেকগুলো। তৃষার সাথে আমার আর যোগাযোগ নাই। পড়াশোনা, রাজনীতি আর লেখালেখির মধ্য দিয়ে নির্ভার এক একাকিত্ম ঝেঁকে বসেছিল ভেতরে। মানুষের একাকিত্ব যখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় তখন এটা আসলে বেদনার মত মধুর লাগা শুরু হয়। এই রকম অনুভূতির মাঝখান দিয়ে খুব সরল পথে এগিয়ে চলছিল সময়।
একদিন একটা খারাপ খবর ফেইসবুক থেকে পাইলাম। ক্যাম্পাসের একজন মেয়েরে তার প্রেমিক রেইপ করে ফেলে রেখে গেছিল নাকি রাস্তায়। হাসপাতালে আইসিইউ তে আছে এখন মেয়েটা। অবস্থা সংকটজনক। বাঁচতে নাও পারে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার নাম জানতে পারলাম না। মিডিয়াগুলোর এই কাজটা ভালোই লাগলো আমার কাছে। নাম গোপন রেখে নিউজ করে গেছে। মেয়েটার পরিবারটাকে তাও কিছুটা হইলেও বিব্রত হওয়া থেকে রক্ষা করা গেল।
৩.
বিকেলে রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে গেছিলাম সেই ধর্ষণ বিরোধী মানবন্ধন করতে। মলচত্ত্বর পার হয়ে কলাভবনের পাশ দিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যাওয়ার সময় অনেক দিন পর তৃষারে দেখলাম রোকেয়া হলের গেটে দাঁড়িয়ে আছে একা একা। আমার দিকেই তাকালো সে। মনে হলো যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। তাকানোর স্টাইলটা এমন, যেন তার মনে অনেক দুঃখ যেটা চেহারা দিয়ে চিৎকার করে বের হয়ে আসতে চাইতেছে। এর আগে কখনো আমি তৃষার এমন মলিন মুখ দেখি নাই। আকাশ খারাপ। বৃষ্টি হয়তো হবে একটু পরেই। তারপরও দেখলাম হাজার হাজার মানুষ রাজু ভাস্কর্য আর টিএসসির আশপাশ ভরে গেছে।
নানান রকম ফেস্টুন, প্লাকার্ড আর ব্যানারে ছেঁয়ে গেছে আশপাশে। সবাই রেইপকে ঘৃণা করে। অপরাধীর বিচার চায়। এই হাজার হাজার মানুষের মাঝে একটাও রেপিস্ট নাই ভেবে নিলে আমাদের এইখানে আশাবাদী হওয়ার অনেক কিছুই তো থাকে। স্বোপার্জিত স্বাধীনতার পাশ থেকে হঠাৎ একটা ডাক শুনে পিছনে তাকাইলাম। দেখি তৃষা দাঁড়িয়ে আছে ওখানে একটা গাছের নিচে। কালো জামায় বরাবরই তৃষাকে সুন্দর লাগতো কিন্তু আজকে কেমন তারে মলিন মলিন লাগতেছে। মন হয়তো খারাপ। মন খারাপ থাকলে বুঝি পোশাকও খারাপ লাগে। মন খারাপ থাকার কারণ তো আছেই। ক্যাম্পাসেরই একটা মেয়ের রেইপ হয়ে গেছে।
কাছে যেতেই সে টিএসসির গেট দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো তৃষা। ভীড় এড়িয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎই একজন বলে উঠলো—
“পাগলা হইছেন নাকি ভাই”
কে আর সেই কথা নিয়ে মাথা ঘামায়। তৃষা আমার আগে আগে কি দারুণ টেকনিকে ভীড়গুলো পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেখতে ভালোই লাগছে। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। উদ্যানের মানুষগুলো পশ্চিম পাশের গোল ঘরটাতে আশ্রয় নিয়ার জন্য দৌড়ে আসতে শুরু করছে। কিন্তু আমি যাচ্ছি না। আমি ভিজতেছি। কারণ তৃষাও ভিজতেছে। ও আমারে ইশারা করলো উত্তর দিকের গাছগুলোর দিকে যাইতে। এইবার আমি ওর হাত ধরলাম। কেন ধরলাম জানি না। ও তো আমারে হাত ধরতে বলে নাই। আর এমনও না যে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। তাহলে হাত ধরলাম কেন? এইটার উত্তর আমার কাছে ছিল না। তৃষার কাছেও না। এই কারণে হয়তো সেও কিছুই বলল না। এমনও হতে পারে তৃষাও চাইছিল আমি ওর হাতটা ধরি।
তৃষার ভেজা চুলের একটা ছবি আমার কাছে ছিল। ভেজা চুলে মেয়েদেরকে এত সুন্দর যে লাগে এইটা হয়তো মেয়েরা নিজেরাও জানে না। এতদিন শুধু ঐ ছবিই দেখে আসছি। চোখের সামনে তৃষার স্নিগ্ধ, নির্মল অথচ দুঃখভারাক্রান্ত মলিন মুখটা আমার কাছে এত এত প্রত্যাশিত লাগছিল যে মনে হতে লাগলো এত চেয়ে সুন্দর কী কিছু আল্লার দুনিয়ায় নাই।
আমি ওরে কোমর জড়ায়া ধরলে সাথে সাথে ওর ঠোঁট আমার ঠোঁটের মধ্যে ডুবিয়ে দিল। এইটার জন্য কি আমি প্রস্তুত ছিলাম? নাকি প্রত্যাশায় ছিলাম? জানি না। আমার ভালো লাগছিল। এমন ভালো লাগছিল যে মনে হচ্ছিল তৃষা আমার শরীরের ভেতর থেকে আমার হৃদপিণ্ডটারে শুষে শুষে বের করে তার ভিতরে নিয়া নিচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটার মনে হয় এইটা দেখে খুব আনন্দ হচ্ছিল। গতি বেড়ে গেছে অনেক। কতক্ষণ তৃষারে জড়িয়ে রাখছিলাম কে জানে। হবে হয়তো ঘন্টা খানেক। তারপর বৃষ্টি থেমে গেল। আন্দোলনও সাঙ্গ হয়ে গেছে। যে যার মত হলে চলে গেছে। গাছের আড়াল থেকে হাত ধরে আমি আর তৃষা বের হয়ে আসলাম। ঐ গোল ঘরটার মধ্যে জায়গা নেয়া মানুষগুলো আমার দিকে অদ্ভুত চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। তাদের দৃষ্টির উৎসুকভাব দেখে মনে হতে লাগলো আমি যেন এইমাত্র একটা রেইপ করে আসছি।
৪.
রোকেয়া হলের গেটে তৃষারে রেখে হলে আসলাম। আজকে এত কিছু হয়ে গেল অথচ তৃষার সাথে একটা কথাও হলো না। না হলো তাতে কি যায় আসে। রাতে হবে। এখন হয়তো তৃষা আমারে আনব্লক করছে। মনে আনন্দ ছিল প্রচুর। ফেইসবুক আর ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে দেখি তৃষা এখনো আনব্লক করে নাই আমাকে। মনটা বেজায় খারাপ হয়ে গেল। এইটা কোন ধরনের কথা হল? মেজাজ খারাপ নিয়া নিউজফিড স্ক্রল করতেছিলাম। এর মধ্যে একটা নিউজে চোখ আটকায়া গেল। রেইপ হওয়া মেয়েটা বিশ মিনিট আগে হাসপাতালের আইসিইউতে মারা গেছে। এইবার মেয়ের পরিচয় প্রকাশ করছে মিডিয়া। সে আর কেউ না, তৃষা।
আমার ভেতরে একটা মোচড় দিয়া উঠছিল। তৃষা! আইসিইউ! মৃত্যু! তাহলে আমার সাথে ছিল ঐটা কে? চিল্লায়া উঠছিলাম। রুমমেট লাফায়া উঠে আমারে ধরলো। এই পর্যন্তই মনে আছে। পরে শুনছি আমার জ্ঞান ফিরতে অনেক সময় লাগছে। বুকের মধ্যে ব্যথা হচ্ছিল। ভেতরটা খালি হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ভেতরের হৃৎপিণ্ড থেকে শুরু করে নাড়িভুড়ি কিচ্ছু নাই। মনে পড়লো সেই চুমুর কথা। আমার হৃদপিণ্ড শুষে নেয়া চুমু। এখন আমার শুধু তৃষারে মনে পড়ে। আমার যা ভালোবাসা ছিল তার সবটুকু তৃষা ( অথবা তৃষারূপি কিছু একটা) নিয়ে পালিয়ে গেছে।