‘তোকে নিয়ে আর পারি না!এটা খাব না, ওটা খাব না!হাঁসের মাংস খেলে কি হয়?বাসার সবাই আজ হাঁস খাওয়ার জন্য হামলে পড়েছে। তোর জন্য কি আরেকটা তরকারি রান্না করব?”আম্মুর বিরক্তি ভরা কণ্ঠস্বর।
‘ডিম ভাজি দিয়ে খেতে পারব.. একটা ডিম ভাজি করে দাও। পোচ না কিন্তু আবার!’ আমার নির্বিকার উত্তর।
ছোটবেলা থেকে আমি কখনোই হাঁসের মাংস খাইনি স্বজ্ঞানে। অজ্ঞানে তো নয়ই!কেউ যদি আমাকে অজ্ঞান করে তাহলে বড়জোর টাকা পয়সা, কিংবা দামি জিনিস নিয়ে যাবার জন্য করবে ।জোর করে হাঁসের মাংস খাওয়ানোর জন্য অজ্ঞান করবে না -নিশ্চিন্তেই বলা যায়।
শুধু হাঁসের মাংস নয়, আরেকটু নির্দিষ্টভাবে বললে আমি কোন পাখির মাংস খাইনা যেমন : কবুতর,কোয়েল।তবে ‘এই পাখি’ গোত্রে মুরগি পড়বে না।আমার মতে, মুরগি যেহেতু বেশি উড়তে পারে না, তাই আমি স্বাভাবিকভাবে প্রচুর মুরগি খেয়ে ফেলি খুশি মনে।হাড্ডিগুলো খুব সুন্দর করে চিবিয়ে খাই,বোন প্লেটের তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না। হাড্ডির ভেতরে অনেক ‘আয়রন’ আছে তাই এভাবে খাই (আম্মুর কাছে শুনে বড় হয়েছি)!
তো ছোটবেলা থেকে মোটামুটি এভাবেই চলছিল আমার হাঁস কিংবা পাখি না খাওয়ার ব্যাপারটা।আস্তে আস্তে যখন স্কুল-কলেজের গণ্ডি পার হয়ে ‘বড়’ হতে শুরু করলাম, তখন ‘হাঁসের’ ব্যাপারটা অন্য মাত্রায় চলে এল। বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম এবং সেখানের জীবন শেষ করে অফিস-আদালতও শুরু করলাম।স্কুল কলেজের পারিপার্শ্বিকতায় আলোচনার বিষয়বস্তুতে ‘হাঁস খাওয়া’ ব্যাপারটা থাকে না।সেখানে থাকে নানা হাঁসফাঁস ব্যাপার স্যাপার: স্কুল পালিয়ে খেলাধুলা করা, সিনেমা দেখা, লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম ইত্যাদি।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন কোন বন্ধু বা বান্ধবী এসে ‘আজ সুমন ভাইয়ের দোকানে হাঁসের মাংসটা সেই ছিল,মামা!’ অথবা ‘মিস করতে না চাইলে এখনই খেয়ে আয়, লাগে টাকা দেবে তোর আব্বা’ ইত্যাদি বলতো-তখন বুঝতাম হাঁস খাওয়া বিষয়টা সিরিয়াস!এটা রসিয়ে গল্প করার এবং অন্যকে লোভ দেখানোর মত একটা ব্যাপার।
অফিস শুরু করার পরও লক্ষ করলাম একই ব্যাপার!
‘কাল আমার শ্বশুর সুনামগঞ্জ থেকে দুই হালি হাঁস নিয়ে এসেছে- তেলতেলে চর্বি ভর্তি! উফফ!’
‘সালেহ ভাই!খালি হাঁসের গপ্পো বলবেন,খাবেন আর চর্বি বাড়াবেন, আমাদেরকেও একটু চর্বি বাড়াতে দিন। ভাবি নিশ্চয়ই ‘সেই-ই’ রান্না করে।’
‘শীতকালটা এলেই ম্যানেজিং ডিরেক্টর স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাইক্কা বিলে যাব শুধু হাঁস খেতে। যাবেন নাকি, অনিক ভাই!ওখানে গিয়ে হাঁস খাওয়ার মজাই আলাদা, লাইভ মিউজিক এনজয় করার মতো!”
বুঝতে পারলাম ‘হাঁস খাওয়াটা’ একটা বিরাট কিছু যে অভিজ্ঞতা আশেপাশের মোটামুটি সবার থাকলেও আমি তা থেকে স্বেচ্ছায় বঞ্চিত। আমি এর গল্পেও নেই,কল্পেও নেই!আমার কল্পে যে জিনিসটা আসে তা হলো-
‘কী সুন্দর পাখি, কী সুন্দর রং, পালক! কত সুন্দর করে হাঁটছে,হাঁটে!’
আমার বড্ড মায়া হয়!
আমার বড্ড মায়া হয়!
ধারাল ছুরি দিয়ে জবাই করে রক্তের ফিনকি ছুটিয়ে সুন্দর পালক ছাড়িয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে মাংসগুলো কেটে কেটে কেটে খেয়ে ফেলব?
নাহ… এমন পাষণ্ড আমি নই। জীবনেও পারব না! খেলাম না আমি হাঁস, হাঁসের মাংস।
There are many (other) animals and birds on heaven and earth!
এর মধ্যে আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে প্রায় এক বছরের বেশি।বিয়ের পরে আমি হাঁস খাইনা শুনে বউ আকাশ থেকে পড়ল।সে হাঁসের মাংস খুবই পছন্দ করে।আমি হাঁস না খাওয়াতে তার অনেক সমস্যা হয়ে গেল।সে হাঁস রান্নাও করতে পারছে না,শান্তি মতো খেতেও পারছে না,আমাকেও খাওয়াতে পারছে না।দু’জনের সংসারে এটা বেশ বিপদের কথা। এমনকি যদি হাঁস রান্নাও হয় অগত্যা আমার সেই ‘ডিম ভাজিই’ ভরসা।
কথায় কথায় একদিন বউ আমাকে বলল, ‘এটা তোমার কেমন মানবিকতা? অদ্ভুত!অন্য পশুপাখি সব খাচ্ছ, নিজের চোখে জবাই দিতেও দেখছ, কিনে আনছ-তাদের বেলায় মন খারাপ, মানবিকতা অথবা সৌন্দর্যবোধ কোথায় থাকে? বিষয়টা ‘কন্ট্রাডিকটরি’ হয়ে গেলো না?”
একটু থমকে গেলাম।সত্যিই তো!এটা কেমন ধরনের কথা কিংবা লজিক? আমি আবেগী হলেও, এই ‘সহজ লজিকটা’ না বোঝার তো কোনও কারণ নেই। নিজেকে বোঝাতে পারছিলাম না আসল কারণটা কি আমার ‘হাঁস খাওয়ার এই অনিচ্ছার?এমন লজিক কিংবা চিন্তার? টানা কিছুদিন চিন্তা করেও কোন কুলকিনারা করতে পারলাম না।পরে এক সময় ভুলেই গেলাম ব্যাপারটা।
এর কয়েক মাস পরে কোরবানি ঈদ এল। বিয়ের পর প্রথম কোরবানি ঈদ -গ্রামের বাড়িতে গেলাম বউ,মা,বোনকে নিয়ে..কোরবানির পর ‘প্রথম রান্না মাংস’ নিয়ে টেবিলে বসে খাওয়া হচ্ছে। সাথে সবাই মিলে বেশ গল্পও হচ্ছে।আমার চাচা- চাচী,চাচাতো ভাই-বোনেরাও টেবিলে উপস্থিত। মেজো চাচা সেই খাবার টেবিলে আমি এবং আমার বোনের ছোটবেলার বিভিন্ন দুষ্টামির কথা তুলে ধরল এবং বলতেই থাকল।মেজ চাচার কাছে শুনলাম আমার ছোটবেলার দুষ্টামিসমগ্র।
ছোটবেলায় নাকি আমি কোন একদিন খেলাচ্ছলে ছোট ছোট হাঁসের বাচ্চা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে,মেরে হাঁসের থাকার ছোট্ট ঘরে চুপে চুপে রেখে দিয়েছিলাম!হাসতে হাসতে পুকুরেও ফেলে দিয়েছিলাম কয়েকটা !দুষ্টু ছিলাম বটে কিন্তু তাই বলে এমন দুষ্টু ছিলাম বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।অবিশ্বাস্য! ভয়াবহ লাগল বিষয়টা হজম করতে। তখুনি আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে দুর্বল কন্ঠে চাচাকে বললাম, ‘চাচা, আমি কি এমন করতে পারি?কত্ত নিরীহ, নিষ্পাপ বাচ্চা ছিলাম,সবাই বলত। সবাই আদর করত এজন্য আমাকে।এমনকি খুব ছোটবেলায় আব্বু আম্মু তো আমাকে এমন শাসন বা ধ্বংসাত্মকভাবে মানুষ করেনি যে আমি কাউকে মারব বা কোন কিছু ছুঁড়ে ফেলে দেব এভাবে।’
টেবিলের সবাই চুপ হয়ে গেল।আমার চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারল খুব শক্ড হয়েছি।ছোট চাচী ব্যাপারটা ব্যাকআপ দেওয়ার চেষ্টায় বলল, “আরে!ছোট বয়সে মানুষ কত কি করে,ওইগুলা এখন চিন্তা করে লাভ আছে?”
আমি গভীর অবিশ্বাসের সমুদ্রে পড়লাম।যে আমি হাঁস খাই না সৌন্দর্য ও মায়ার জন্য, আমি কি করে…
হঠাৎ মেজচাচার উত্তরে সম্বিত ফিরে পেলাম,”ভাতিজা,সবাই তো নিষ্পাপ,নিরীহ হয়েই জন্মায় পৃথিবীতে।শুধু হাসতে হাসতে খুন করে কিংবা কাঁদতে কাঁদতে খুন হয়ে যায়!”
নিমিষেই চোখের সামনে যেন হাঁস খেতে না পারার ‘অন্যরকম’ কারণটা ভেসে উঠল!