বেলা নামার পরে মহাজন মজুরি দিল। পাঁচশ টেকা মজুরি।
সারাদিনের খাটুনি শ্যাষে যখন মজুরিটা হাতে পাই তখন এক নিদারুন শান্তি লাগে। যেন পুরা দুনিয়া হাতের মধ্যে আইসা পড়ে। মনে অয় পুরা দুনিয়া কিন্না পালাইতে পারমু। আমারে ঠেকায় কেডা!
মনের আনন্দে বাজারে ঘুরতে লাগলাম। মেলা জিনিসপাতি দ্যাখতে লাগলাম।
মা’র ওষুধ কিনতে অইব। পান কিনন লাগব। কতদিন আগে জোলেখা হাজি বিরিয়ানি খাইতে চাইছে। মাইয়াটা শুনে জোলেখারে জিগায়,’মা, হাজি বিরিয়ানি কি?’
মাইয়াটা রোজ পেছন থিকা ডাইকা কইব,’বাবা, আঁর লাই লালফিতা অলা জুতা আইনবা। আইনবা কইছি!’
এমুনভাবে কয়, মন চায় সারা দুনিয়ার বেবাক জুতা অরে কিন্না দিই।
হে আল্লাহ! বাবাও বানাইলা তুমি, গরীবও বানাইলা তুমি।
ঘুরতে ঘুরতে মাছ বাজারের সামনে আইসা পড়লাম।
কত রকমের মাছ। নদীর মাছ, চাষের মাছ। ছোট মাছ, বড় মাছ।
মাছ দেখলেই মাথা আউলা হই যায়। জিব দিয়া পানি পড়ে পড়ে অবস্থা। মাইনষের জিবে পানি আইয়ে টক দেখলে, আমার আইয়ে মাছ দেখলে। আজব!
নদীর কোরাল উঠছে বাজারে।
মা’র বড্ড পছন্দের মাছ এই কোরাল। চিকন চিকন লতি দিয়া রানলে অমৃত স্বাদ। মা সেদিন রানুকে এই তরকারির গল্প শুনাইছে। এখন রানু প্রতিদিন তার দাদিরে কয় চিকন লতি তুইল্লা আনতে। আমারে কয়,’বাবা, আইজ আইতে কোরাল মাছ আইনবা, দাদি লতি দি রাইনব।’
এর আগেও অনেকবার বাজারে কোরাল মাছ উঠছে। সাহসে কুলায় নাই দাম জিগাইতে। মাইনষে কিনছে, দেখছি, ম্যালা দাম!
লুঙ্গির কাছায় ভাঁজ করে রাখা পাঁচশ টাকার নোটটার উপস্থিতি টের পাইলাম।
দাদা, কোরাল মাছ কত করে?
বুকে সাহস নিয়া দাম জিগাইলাম। গলাটা একটু কাঁপল বোধহয়।
মাছওয়ালা আমার দিকে ঠান্ডা চোখে চাইল। বলল,’একদর পাঁচশ! মূল নাই, নিলে নিবি না নিলে নাই। দিমু?’
মাছওয়ালার কথা শুনে মাথা ঘুরানি দিল। -পাঁচশ!
তড়িৎ গতিতে ট্যাকে গোঁজা টাকার নোটটার উপর হাত রাখলাম। বুকের মধ্যে যেন ইয়া বড় হাতুড়ি বাড়ি মারতে লাগল।
চোখের সামনে মা আর রানুর মুখটা ভাইসা উঠল।
সবচেয়ে ছোট মাছটার দিকে তাকাইলাম। এইটার ওজন কত হইতে পারে? এক কেজির বেশি হইব না ত? বেশি হইলে কিনতে পারমু না।
খানিক্ষণ নানা ভাবনা চিন্তা কইরা, বুকে সাহস নিয়া, যা থাকে কপালে, এই ভাইবা, কইলাম-
দাদা, এই মাছটা মাপ দেন। সবচেয়ে ছোট মাছটা দেখাইয়া তারে কইলাম।
মাছওয়ালা ডিজিটাল নিক্তিতে তুলে মাপ দিল। আর আমার বুক ধড়পড় করতে লাগল।
এক কেজি একশ গেরাম। দাম আইছে পাঁচশ পঞ্চাশ টেকা। দে টেকা দে।
আমার সারা দুনিয়া ঘুরতে লাগল। পায়ের নিচের শক্ত মাটি আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল। আমি যেন ক্রমশ তলিয়ে যাইতে লাগলাম।
এই মাছ কিনতে হইলে আরও পঞ্চাশ টেকা বেশি লাগব।
নাহ! আজও রানুর মুখে হাসি ফুটল না।
কিরে কথা কস না ক্যান!
মাছওয়ালার ধমকে তার দিকে তাকাইলাম। একটু ডর লাইগা উঠল।
কইলাম,’দাদা, কিছু মনে কইরেন না, মাছটা নিতে পারমু না।’
‘ঐ বেটা, ফকিন্নি! মাছ নিবি না তয় মাপলি ক্যান, দরদাম ভাংলি ক্যান! তোরে দেইখাই আমার বুঝার দরকার ছিল তুই ফকিন্নি। খাড়া, মাছ নিবি না মানে? তুই নিবি না তোর বাপ নিব!’