**কত মজাই না ওরা করতো****
**মূল- আইজ্যাক আসিমভ
**অনুবাদ– কামরুন নাহার তানিয়া
**
[The Fun They Had, আসিমভের এই গল্পটা পড়ে মনে হলো, আমার প্রিয় শিক্ষার্থীদের জন্য অনুবাদ করি। ১৯৫১ সালে গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়। সেই হিসেবে এই গল্পের বয়স ৭০!]
মার্জি সে রাতে ডায়েরি লিখছিলো৷ ডায়রির ১৭ মে, ২১৫৫ এই তারিখের পৃষ্ঠায় সে লিখেছিলো, “আজ টমি একটা সত্যিকারের বই পেয়েছে!”
সত্যিই খুব পুরনো ছিল বইটা। মার্জির দাদা একবার বলেছিলেন, তিনি যখন ছোট ছিলেন ঐ সময়ে তাঁর দাদার গল্প। মার্জির দাদার দাদার সেই সময়ে নাকি কাগজে গল্প ছাপা হতো। তাঁরা পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পড়তেন। কাগজগুলো ছিল হলুদ আর কুঁচকানো৷ সত্যি সে সময়ে বই পড়া একটা দারুণ মজার ব্যাপার ছিল। সত্যিকারের শব্দ পড়ার মত। শব্দগুলো স্ক্রিনে চলন্ত অবস্থায় নয় বরং স্থির হয়ে থাকতো! এমন কি বই বন্ধ করার পর আবার পরে সেই পৃষ্ঠাটা খুললে ঐ শব্দটা ঠিক সেই আগের জায়গাতেই থেকে যায়, প্রথমে যেখানে ছিল!
“ধ্যাৎ “টমি বললো, ” কেমন ফালতু! এই বই একবার হাতে নিলেই তুমি একদম ছুঁড়ে ফেলে দিতে। আমার তাই মনে হচ্ছে৷ আমাদের টিভি স্ক্রিনেও এমন মিলিয়ন মিলিয়ন বই আছে। তবুও আমি এটা ফেলবো না। ”
–” আমারও একই অবস্থা “– ১১ বছরের মার্জি বললো। সে অবশ্য ১৩ বছরের টমির মত এত টেলিবই দেখে নি।
“এই বই কোথায় পেলে তুমি?”– জানতে চাইল মার্জি।
— “আমার বাসায়”– বই থেকে চোখ না তুলে, পড়তে পড়তে টমি বলল, ” চিলেকোঠায়।”
— কিসের বই এটা?
— স্কুল।
— স্কুল??!! মার্জি নাক শিঁটকালো, “স্কুল একটা লেখার বিষয় হলো? আই হেইট স্কুল!”
মার্জি সবসময় স্কুল ঘৃণা করে তবে, এখন ঘৃণাটা সব থেকে বেশি উগড়ে দিলো।
ওর যান্ত্রিক শিক্ষক ভূগোল বিষয়ে একটার পর একটা পরীক্ষা নিচ্ছেই আর সে পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করছে তো করছেই, যতক্ষণ না তার মা দুঃখে মাথা নাড়বেন এবং জেলার পরীক্ষকের কাছে পাঠাবেন।
সেই পরীক্ষক একজন ছোটখাটো গোলগাল মানুষ। মুখটা লাল। তার একটা বক্স আছে যেটা অনেক রকম যন্ত্রপাতি আর তারে ভরা। তিনি মার্জির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে একটা আপেল খেতে দিলেন। একটুকরো নিজেও নিলেন। মার্জি ভেবেছিল যে, তিনি কিছুই ঠিক করতে পারবেন না । তিনি ঘন্টাখানেক পর একটা বিরাট কালো জঘন্য স্ক্রিন নিয়ে আসলেন। সেখানে সব লেসনগুলো দেখানো হচ্ছিল আর প্রশ্ন করা হচ্ছিল। মার্জির অবশ্য এতটা খারাপ লাগছিল না। তবে ওর খুব বিরক্ত লাগছিল যখন স্লটগুলোতে বাড়ির কাজ আর পরীক্ষার প্রশ্ন দেওয়া হচ্ছিল। মার্জি পাঞ্চ কোডে সেগুলোর উত্তর দিলো,,যেই কোড সে ৬ বছর বয়সে শিখেছে। আর একজন যান্ত্রিক শিক্ষক তখন তার নম্বর হিসাব করে নিয়েছেন।
সব শেষ হলে পরীক্ষক একটু হেসে নিজের মাথা চুলকাতে চুলকাতে মার্জির মাকে বললেন, “মিসেস জোনস, এটা কিন্তু মোটেও এই ছোট্ট মেয়েটার দোষ নয়। আমার মনে হচ্ছে ওর ভূগোলের উপকরণগুলো খুব দ্রুত দেখানো হয়েছে। এমন হয় অনেক সময়। চিন্তা করবেন না। উপকরণগুলো ১০ বছর বয়সীদের উপযোগী করে ওকে আবার দেখাবো, আরেকটু ধীরগতিতে। এতে নিশ্চয়ই ওর অগ্রগতির পুরো প্যাটার্ন সন্তোষজনক হবে। “
এই বলে তিনি মার্জির মাথায় হাত বোলালেন।
মার্জি ভীষণ হতাশ হলো। মার্জি ভেবেছিলো ওর সব শিক্ষককে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। এইতো কিছুদিন আগেই, টমির সব শিক্ষককে এক মাসের জন্য বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ টমি ইতিহাসে একদম শূন্য পেয়েছিল।
তাই সে টমিকে জিজ্ঞেস করলো, “স্কুলের কথা কেউ লিখতে যাবে কেন? “
ওর কথা শুনে টমি অবাক হলো, “আরে বোকা! এটা আমাদের স্কুলের মত না। শত শত বছরের পুরনো স্কুল”—সে বেশ জোর দিয়ে উচ্চারণ করলো, “বহু শতাব্দী আগে।“
মার্জি একটু দুঃখ পেলো, “ঐ স্কুল সম্পর্কে যে আমি কিছুই জানি না।“
তারপর টমির ঘাড়ের ওপর উঁকি দিয়ে বইটা পড়তে লাগলো সে। পড়তে পড়তে বললো, “আশ্চর্য ব্যাপার, ওদেরও শিক্ষক ছিলো! “
— হ্যাঁ, তবে আমাদের শিক্ষকদের মত ছকে বাঁধা ছিলো না। ওদের শিক্ষকেরা ছিলো মানুষ।
–মানুষ! মানুষ আবার শিক্ষক হয় কিভাবে? কি আশ্চর্য কথা!
— হ্যাঁ, তিনি ছেলেমেয়েদের পড়াতেন, বাড়ির কাজ দিতেন, এমন কি পরীক্ষাও নিতেন!
— মানুষ অত স্মার্ট হতে পারে না।
— পারে, পারে। তুমি জানো না। একজন শিক্ষক যা জানে, আমার বাবাও তা-ই জানেন।
— অবশ্যই না। মানুষ কখনোই শিক্ষকের সমান জানতে পারে না।
— অবশ্যই হ্যাঁ! আমার বাবা শিক্ষকের সমানই জ্ঞান রাখেন। বাজি ধরে বলতে পারি।
মার্জি আর এ নিয়ে তর্ক করতে চাইলো না।শুধু বললো, “নাহ, আমার বাসায় কোন অদ্ভুত লোক এসে পড়াবেন, এটা ভাবতেও পারছি না।এমন যেন না হয় কখনো। “
কথা শুনে টমি জোরে হেসে উঠলো, “উফ! মার্জি, তুমি জানো না, শিক্ষকেরা বাসায় আসেন না। তারা একটা বিশেষ ভবনে থাকেন। আর ছেলেমেয়েরা সেখানে সবাই মিলে পড়তে যায়।“
–সব ছেলেমেয়ে একই পড়া পড়ে?
— অবশ্যই। যদি তাদের বয়স একই হয়।
–কিন্তু আমার আম্মু যে বলে, প্রত্যেক শিশু আলাদা, তাই তাদের মন ও ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী আমাদের শিক্ষক পড়ানোর বিষয় ঠিক করে নেয়। তারপর শিশুদের আলাদা করে নিয়ে পড়ান।
–ওরাও ঠিক এটাই করে। তবে তাদের পদ্ধতি অন্য। তুমি যদি না চাও, তবে এই বই পড়ার দরকার নেই তোমার।
–আমি কি বলেছি যে, পড়বো না?
মার্জি একদম ক্ষেপে গেলো। আসলে ওর খুব ইচ্ছে করছিল এই মজার স্কুল সম্পর্কে পড়তে।
বইয়ের অর্ধেকও পড়া হয় নি, এমন সময়ে মার্জির আম্মু এসে ডাক দিলেন, “মার্জি! তোমার স্কুল!”
–প্লিজ আম্মু, এখন না, একটু পরে।
–না এখনি।
মিসেস জোনস এবার টমিকেও তাগাদা দিলেন, “টমি, এখন তো মনে হয় তোমারও স্কুল আছে।“
মার্জি টমিকে বললো, “ছুটির পর আমরা একসাথে বসে বইটা পড়তে পারি?
টমি খুব একটা উদাসিনতার ভাব নিয়ে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ, পড়া যায়।“ তারপর শিষ বাজাতে বাজাতে বইটা বগলের নিচে নিয়ে চলে গেলো।
মার্জি তার স্কুলে এলো। ওর বেডরুমের ঠিক পাশেই এই স্কুল। যান্ত্রিক শিক্ষক আগে থেকেই এসে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শনি-রবি, এ দুদিন বাদে প্রতিটা দিন ঠিক এই সময় এভাবে বসতে হয় ওর৷ কারণ মার্জির আম্মু মনে করেন, প্রতিদিন নিয়ম করে একই সময়ে পড়লে ছেলেমেয়েরা ভালো ভাবে পড়া শিখতে পারে।
স্ক্রিন আলোকিত হয়ে গেলো, “ আজ গণিত ক্লাস। আজ আমরা শিখবো ভগ্নাংশের যোগ কিভাবে করতে হয়। গতকালের বাড়ির কাজের স্লটগুলো ইনসার্ট কর। “
মার্জি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার মন পড়েছিলো সেই পুরনো দিনের স্কুলে, যেখানে তার দাদার দাদা ছোট্টবেলায় পড়তেন। পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা সবাই একসাথে হাসতে হাসতে স্কুলে আসতো। স্কুলের মাঠে সবাই একসাথে হাসতো, খেলতো, হৈচৈ করতো। স্কুলরুমে একসাথে সবাই বসতো৷ ওরা সবাই একসাথে একই জিনিস শিখতো৷ আর বাড়ির কাজ করতে একে অপরকে সাহায্য করতো। তারচেয়েও বড় কথা,,শিক্ষকেরা ছিলেন মানুষ!
যান্ত্রিক শিক্ষক স্ক্রিনে আলো ফেলছে…”যখন আমরা ১/২ আর ১/৪ যোগ করবো…”
মার্জি তখনও ভাবছে, সেই যুগের ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই স্কুলে পড়তে খুব ভালোবাসতো। ইস, কত মজাই না ওরা করতো!