জায়গাটা যথেষ্ট খোলামেলা – জংলি গাছপালা আচ্ছাদিত এলাকা আমার ভীষণ ভালো লাগে , তাই জিলাসানে এসে শেষমেশ এদিকটাতেই উঠেছি । অফিসের সবাই বলেছিল শহরতলীর দিকেই থাকতে – পাঁচ মিনিটের দূরত্বে অফিস , তাছাড়া সন্ধ্যাবেলা পার্ক – লাইব্রেরি – সিনেমা – শোরগোল , সময় হুরহুর করে কেটে যাবে ।
আমি অবশ্য বললাম , ঠিক তার উল্টোটা চাই ! শহুরে আমোদ লাগবে না । লোকের জোয়ার নাই, সকাল সন্ধ্যায় হৈ হৈ অবিশ্রান্ত কলরব নাই – এমন একটা ‘শান্তির নীড় শান্ত কুটির ‘ মতো কিছু পেলেই বরং বাঁচি ।
সুলতান সাহেব বললেন, তাহলে শুনুন – আপনি রেলুখুনের দিকে আস্তানা গাড়ুন ।
রেলুখুন ? যেমন চাচ্ছি মিলবে ?
পাক্কা – ও জায়গার উত্তর থেকে খরিতুনের সরকারি ইকো-জংগল । বুঝতেই পারছেন কেমন ফাঁকা । শহর থেকে মাইল দশেক হওয়ায় ভিড়ভাট্টা পাবেন না ।
রেলুখুন জায়গাটা পছন্দ হল । গাছগাছালির অভাব নাই – রাস্তা বাড়ি সমস্ত ছায়ায় ঢাকা – একটা স্নিগ্ধ ভাব পুরো অন্ঞলে ছড়িয়ে আছে । গাট্টাগোট্টা একতলা দোতলা বাড়ি – সবগুলোতে লাগোয়া বিশাল আঙ্গিনা – নানান অর্কিডে ছাওয়া – বেশ ছিমছাম । এখানকার বাড়িগুলোর বেশিরভাগই ভাড়ায় চলে । আশপাশের প্রভিঞ্চে দায়িত্ব পড়েছে এমন চাকুরে ব্যবসায়ী – যাদের দূরের শহরে থেকে যাতায়তে অনেক ঝক্কি – তারা পরিবার নিয়ে আস্তানা গাড়ে ; জায়গাটার গুণ আছে বটে । অনেকে আবার আসে এক দুই তিন মাস থেকে যায় – নিরিবিলি বলে ছুটি কাটাতে- আবার পাশেই ইরিকান হেলথ – অনেকে চিকিৎসার জন্যও আসে – সেরকম বন্দোবস্তের অস্থায়ী বাসাও আছে । দেখেশুনে সেরকম একটাই ঠিক করলাম । যদিও আমার এখানকার স্থায়িত্বকাল বছর তিনেকের হবার সম্ভাবনা – ক্ষেত্রবিশেষে বেশিও হতে পারে , তবু আমি কিছুটা যাযাবরের মতো থাকতেই ভালোবাসি কিনা – তাই উঠলাম শেষে সন্দ্বীপে । সন্দ্বীপ নামটা হল একটা দুইচারী বাসার পয়লা নম্বর – যেটায় আমি থাকি । আরেকটায় কিছুদিনের জন্য কেউ কেউ আসে – চলে যায় – কিছুদিন ফাঁকা থাকে – আবার নতুন অতিথিরা আসে ।
সেদিন ভোরবেলা হাঁটতে বের হয়েছি । রাতে বৃষ্টি ছিল – পিচরোড ভেজা । আকাশ তখনো খানিকটা গুমোট , ঘড়িতে দেখি – ৫.০৪ । ফজরের নামাযের পরেপরে নিত্যদিন এই রোড ধরে হাঁটি । আধো আলো আধো অন্ধকারের সময়টা এত মোলায়েম , যারা অনুভব করে , পারতপক্ষে এর লোভ ছাড়ানো মুশকিল । রাস্তাটাও থাকে নির্জন , বেলা সাত আটটার আগে রাস্তায় বলতে গেলে কিছু চলে না ।
খরিতুনের সীমানার কাছে এসেছি, হঠাৎ দেখি আককাস দূর থেকে দৌড়ে আসছে । বলল,
স্যার সুকুনির চাবিটা দ্যান – লোক আসছে !
সুকুনি হল আমার সেই দুইচারী বাসার দ্বিতীয় নম্বর । অনেকদিন আছি বলে, যখন কোনো পরিবার থাকে না , চাবি আমার কাছেই থাকে । দুই বাসার মেইনগেট একটা – মাঝখানে একটা মাঝারি সাইজের ঘাসের মাঠ – বাগানও আছে , তাই এই বন্দোবস্ত । বললাম,
কারা এসেছে আককাস ?
ওজুনির থেকে – বড়সর ফ্যামিলি । থাকবে মনে হয় বেশ কিছুদিন –
আককাসকে চাবি দিই । জংগল থেকে বিচিত্র সব ডাক ভেসে আসছে । খানিকক্ষণ হাঁটাহাটি করতে করতে দেখি – পূর্ব দিকের আকাশে মেঘ সরে গেল । লাল আভার অদ্ভুত সাজ পরল কিছুক্ষণ । তারপর গোলগাল কমলা রঙের সূর্যটা ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে , আকাশের নিচের সবাইকে যেন কুশল জিজ্ঞাসা করতে লাগল ।
বাসার চত্বরের কাছে এসে গেট পেরিয়ে দেখি , ওদিকের কটেজের মূল-দরজা ভেজানো । সামনে গোটাকয়েক খালি ব্যাগ – ছেঁড়া বড় বড় প্যাকেট – জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে বিস্তর , বোঝা যাচ্ছে । এখনও সবকিছু গুছিয়ে তোলা হয়নি – একজন লোক ব্যাগগুলোর উপরই ঝিমাচ্ছে, সম্ভবত রাতভর সওয়ার করে এসেছে । এগোলাম না – ভাবলাম বাতচিত করার সময় বহু আছে ।
অফিস থেকে ফিরে অনেকটা সময় নিয়ে গোসল করলাম । ঝক্কি গেছে । লাইব্রেরি থেকে আনা একটা উপন্যাস কিছুদূর পাতা উল্টিয়ে রেখে দিলাম । তারপর হাঁটতে হাঁটতে অপর দিকের আঙ্গিনায় পা রাখি । দেখলাম, বাইরে ছায়ার নিচে একটা টেবিল পাতা , কয়েকটা চেয়ার – ওনারা বিকেলের চা খাচ্ছেন সম্ভবত । আমাকে ইতস্তত করতে দেখে একজন মধ্যবয়সী লোক বললেন, আসুন আসুন , অসুবিধা কিছু নাই –
আলাপ হল । ভদ্রলোকের নাম নাজিবুস সেলিম । বাড়ি গুসিনিতে । এখান থেকে সাড়ে ছয়শ মাইল । কাজ করেন জিগানুপ ফার্মের একটা শাখায় । বৃদ্ধ মাকে নিয়ে এসেছেন মূলত – লিভারের কি একটা জটিলতা , অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে । স্ত্রী – দুই ছেলেমেয়ে – ছোটো ভাই আর ভাইবউ – গোটা সংসার নিয়ে এসেছেন । মাস দুয়েক থাকবেন তারা । ছোটো ভাই নতুন ব্যবসা ধরেছে – এই বহুদূর প্রবাস অন্ঞলের হাল হকিকতও বুঝতে চায় – এ যাত্রা তারও কাজে লাগবে ।
নাজিব সাহেবের স্ত্রী ঐটুকু সময়ে যথাসাধ্য অ্যাপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন । বারবার বলতে লাগলেন, রাতের ভাতখাবারটা যেন আজ ওখানেই করি । গুসিনির লোকদের আতিথেয়তার সুনাম এমনি এমনি হয়নি, বুঝলাম । নিশ্চয়ই – আরেকদিন – ইত্যাদি বলে বিদায় নিয়ে বাগানের কাছে আসতেই দেখি – গেটের কাছের দেয়ালে হেলান দিয়ে একটা চার পাঁচ বছরের ছেলে গভীর মনোযোগে ঝোপের দিকে তাকিয়ে আছে । ওলুপের ঝোপ – বিকেলের তেজহারা আলোয় ফুটন্ত হয়ে আছে , তাতে দুচারটা ফড়িং ঘুরে ঘুরে খাবারের খোঁজ করছে – শিশুর নজর সেইদিকে ।
বললাম, বাবু তোমার নাম কী ?
শিশুটি চমকে তাকালো । সরল মুখে ধীরে ধীরে বলল, আমার নাম – আমার নাম অভি ।
অভি ! সুন্দর নাম – কী করো তুমি ?
শিশুটি হাত তুলে ঝোপের দিকে দেখায় ।
ফলিং ধরি ।
আসো আমি ধরে দেই ।
এক পা এগোতেই শিশুটি দৌড়ে ভেতরে চলে গেল ।
রাতে শুতে দেরি হল । প্রচুর কাজ জমে আছে । দুটোর দিকে ঘুম এলো কি এলো না – তারপর অন্ধকার ভোরেই অফিসের লরি এসে হর্ন বাজাতে লাগলো । দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠলাম ঘুম চোখে । আসবাব আর ডেকোরেশনের অর্ডারে আমার একটা সই দরকার নাকি । লরি এসেছে দুশ মাইল থেকে । তারা মালামাল পৌঁছে দিয়েই ফিরতি পথ ধরবে । তাই দেরি সয়নি ।
লরি সইসাবুদ নিয়ে অফিসের দিকে রওনা হলো । ভাবলাম, আর ঘুমিয়ে কাজ নাই । মুখে এক আজলা পানির ঝাপটা দিয়ে গেটের কাছে বকুল গাছের নিচে বসে রইলাম । নানান পাখির নানান ধাঁচের ডাকডাকালিতে এ সময়টা ভরে থাকে । শুনতে মন্দ লাগে না । কিছুটা তন্দ্রাও এসে গেছে – হঠাৎ একটা ঢিল এসে পায়ের কাছে পড়ল । এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না । খানিকক্ষণ পর আবার একটা মাটির ঢেলা – গুড়াগুড়া হয়ে ছিটিয়ে পড়ল দূরে ।
বকুল গাছটার গোড়া থেকে কয়েক হাত পর্যন্ত সানুশের ঘন লতানো বেড়া – প্রায় এক মানুষ সমান উঁচু । সেটা পার হতেই দেখি – নতুন রাচনার ঝোপ লাগানোর জন্য আককাস অনেকটা জায়গা খুঁড়ে রেখেছিল – দু ফুট উঁচু মাটির স্তুপ হয়ে আছে – তার চুড়ায় বসে আছে কালকের সেই ছেলেটা । চারপাশের কলরব কূজন মন দিয়ে শুনছে । একেকবার উঠে দু একটা গাছের গোড়ায় দৌড়ে গিয়ে বোধহয় পরখ করছে ঠিক কোন পাখিটা ডাকছে – আর মাঝে মাঝে আনন্দেরই আতিশয্যে হয়তো , দুই হাতে মাটির ঢেলাগোলা জড়ো করে সর্বশক্তি দিয়ে আকাশে ছিটিয়ে দিচ্ছে ।
আমি কাছে গিয়ে নরম গলায় বললাম, অভি – কী করছো ?
শিশুটি ধরমর করে উঠে বসে । দৌড়ে পালানো নিরাপদ কি না ভাবলো বোধহয় । তারপর একটা কিলুন গাছের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল, পাখি ! ওই দ্যাখো –
আমি সেই ঢিবির উপর গিয়ে বসি । বললাম, হুঁ পাখি ! কী পাখি বলোতো ?
শিশুটি কিছুক্ষণ ভাবে । বলল, ময়না !
না , ময়না না – এর নাম তুরানির । কী বলোতো ?
শিশুটি বড় বড় চোখে বলে, এর নাম – তুরানির ?
হাঁ ।
আমার – আমাদের বাড়িতে একটা ময়না আছে ।
তাই নাকি !
হ্যাঁ – শিশুটি মাথা দোলায় । চুল ছোটো করে কাটা । বেশ স্বাস্থ্যবান । মুখটা ভীষণ মায়াবী । যখন কথা বলে, ধীরে ধীরে – সময় নিয়ে – আধো আধো ঠেকো ঠেকো উচ্চারণ করে শব্দগুলো । চোখে থাকে সরল বিস্ময় – প্রগাঢ় আনন্দ ।
বলল , হুঁ – ময়নাটা আমার নাম জানে ।
আমি শিশুটিকে পাশে বসিয়ে দিই । বললাম, কে শিখাইছে ? তুমি ?
শিশুটি মাথা নাড়ে । না না না – আমার বাবা – শিখাইছে । হুম । বাবা অনেক ছোটোতে – যখন আমি ছোটো মানুষ ছিলাম – তখন আনছে ময়নাটা ।
এখন তুমি বড় মানুষ ?
হুম – অভি গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ে । আর এক দুই তিন – না দুই মাস পরে – আমি তোমার মতো বড় হয়ে যাবো – না ?
আমি মাথা নাড়ি ।
একি ! আপনাকেও জ্বালাচ্ছে দেখি – নাজিব সাহেবের স্ত্রী হাজির হলেন । বললাম, ও তো খুবই শান্ত । জ্বালাবে কেন –
ভদ্রমহিলা হাসেন ।
কিছুদিন সখ্য হোক । তারপর বুঝবেন কেমন নাছোড় –
অভি তার মায়ের সাথে নাস্তা খেতে চলে গেল । ভদ্রমহিলা আমাকেও যেতে বললেন বারবার – জরুরি কাজ পড়েছে , বলে চলে এলাম ।
সেদিন সন্ধ্যায় অভির দাদীকে দেখতে গেলাম । বৃদ্ধাকে পূবের ঘরটা দেয়া হয়েছে । আধশোয়া হয়ে বসে আছেন । সুস্থ স্বাভাবিক চেহারা – সাদা কিন কাপড়ে ভীষণ পবিত্র পরিচ্ছন্ন একটা ভাবমূর্তি যেন । শুধু কথা বলতে গেলে বোঝা যায় , তিনি অত্যন্ত কাহিল । কিছুক্ষণ পরই তিনি ক্লান্ত হয়ে এলিয়ে পড়লেন, আমি বসার ঘরে চলে এলাম । নাজিব সাহেব তাদের দেশ গুসিনির আলাপ শুরু করলেন । এক এক করে নানা প্রসঙ্গই নাড়াচাড়া হলো । এক ফাঁকে অভির বড় বোনটাও এসে বসে রইলো । বারো তের বয়স , বেশ চুপচাপ সে । নাজিব সাহেব হেসে বললেন , ওর নতুন চাচীর সাথেই ওর সখ্য হয়েছে ভালো । সবসময় একসাথে আছে । নাজিব সাহেবের ছোটো ভাই ব্যবসায়ী মানুষ, দুটো কথা পেড়েই আলোচনা ব্যবসায় ঘুরিয়ে নিলেন । এরই মাঝে অভি এসে বারবার তার বহুবিধ খেলনার এটা-ওটা দেখাতে লাগলো । তখন কথা থামিয়ে ওর কথা শুনতে হয় । শেষটায় ওর টানাটানিতে বারান্দায় যেতে হল । চার পাঁচটা টব – নানান রঙের অর্কিড – কোনো কোনোটায় আধফোটা ফুল । বলল,
আজকে আনছে – হুম – কি সুন্দর দ্যাখো –
কে আনছে অভি ?
বাবা – আর মা –
অভি বারবার গাছগুলোর পাতায় হাত বুলায় । বললাম, তোমার অনেক পছন্দ ফুলগাছ ?
অভি গম্ভীরমুখে বলল, হুম – অনেক পছন্দ –
তারপর দৌড়ে কোথা থেকে একটা খেলনা ট্রাক নিয়ে এলো । প্যাঁ প্যাঁ করা একটা এন্টেনা বের হয়ে আছে । বলল,
আমার গাড়ি – দ্যাখো –
বাহ – এটা কীভাবে চালায় ?
অভির চোখমুখ উজ্জ্বল হয় । বলে ,
রিমুট আছে তো –
কই দেখি –
এই দ্যাখো – অভি রিমুটের বাটনে চাপ দেয় । গাড়ি সাঁই করে ছোটে ।
এতদিন আমার দিন আর রাত ছিল বেশ খুলতাই – । সকাল নয়টায় অফিসে যাওয়া – কাজেকর্মে চারটা বেজে গেলে কোনোদিন বা শহরের লাইব্রেরিতে যেতাম – খানিকক্ষণ বইটই নাড়াচাড়া করে – দু একটা বই কার্ডে দাগ দিয়ে নিয়ে আসতাম । আবার কোনোদিন বা পার্কের রাস্তায় অনির্দিষ্ট ভাবে একাকী হেঁটে হেঁটে সন্ধ্যা কেটে যেত । কখনো বা ফেরার পথে আকিসান নদীর তীর ধরে খরিতুনের জংগলের পারে চলত পায়চারী । তারপর রাত হলে খেয়েদেয়ে গল্পের বই নিয়ে বসতাম কখনো – অফিসের হিসেবের জন্জাল ছাড়াতেও কোনোদিন হয়ত হতো মধ্যরাত – কোনো রাতে চুপচাপ টিভি ছেড়ে পুরনো দিনের নাটক দেখতাম ।
এখন আমার দিনরাতের অবসর ব্যাপ্ত করে রইলো অভি । সকালে যখন ঝিরঝির বাতাস বইতে থাকে, আলো এসে ধীরে ধীরে আঁধার হটিয়ে মায়াবী দখলে ভরিয়ে দেয় চারপাশ, তখন অভিকে পাশে নিয়ে কোনোদিন নদী দেখিয়ে আনি । অজস্র গাছ আর তাতে বসা বিস্তর পাখি , মুহুর্মুহু ওর ছোট্টো মনে আলোড়ন তুলত । বলত, ওটা – ওটা কী ডাকে – কী গাছ এটা হ্যাঁ ? এইটা কি টারজানের বাঘের জংগল ?মুগ্ধ শিশুর এইসব সরল প্রশ্নে আমার আমোদ লাগত । অফিসের সময়টা কোনমতে কেটে যেত । চারটা বাজলে কোনো কলিগ এসে হয়ত বলছে – আজ অমুক জায়গায় দাওয়াত আছে – চলুন সাঁটিয়ে আসা যাক ! তখন মনে হত, অভি গেটের কাছে অপেক্ষা করছে ।
লাইব্রেরিতে আগে দু এক ঘন্টা অনায়াসে কেটে যেত । এখন তড়িঘড়ি বাচ্চাদের রুপকথা খুঁজি – অভি সন্ধ্যাবেলা ঘাসের উপর বসে গল্প শুনতে ভালোবাসে ।
এমনও হয় – অনেক রাতে নাজিব সাহেব এসে হেসে বলেন – দেখেন তো কান্ড – আপনি নাকি আজকে ওর নতুন ভেকুগাড়ি দেখতে চেয়েছেন – এখন এতরাতে মনে পড়েছে – না দেখিয়ে ঘুমাবে না !
তাকিয়ে দেখি, বুকের কাছে হলুদ ভেকুগাড়ি নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে হ্যান্ডেল ঠিক করছে ।
একেকদিন আবার শোনা যায় – আমার সাথে সেও অফিসে যাবে ! কখনো চকোলেট , কখনো আইসক্রিম দিয়ে ভুলিয়ে আমি রওনা দিই । আর সেই অতিচন্ঞল বালক দুপুরময় ঘুরে বেড়ায় বাগানের ঘাসে ।
একদিন আককাস এক নতুন ধরণের অর্কিড নিয়ে এলো । এহানিল নামের এই ফুলের কয়েকটা চারা মাটিতে গছিয়ে দেয়া হলো । বৃষ্টি এলো ঝুপঝুপ করে – এ অন্ঞলে বৃষ্টি হয় যখন , ঝুম হয়ে ঝরে । ইলশে গুড়ি বৃষ্টি কখনো দেখিনি । ওরই মাঝে ছাতা মাথায় অভি ছোটো ছোটো হাতে টুকটুক করে মাটি গুঁড়া করে – সারের প্যাকেট থেকে মিশমিশে অরগ্যানিক সার ছিটিয়ে দেয় – পানি দেয়ার ব্যারেল তুলতে পারে না – তত শক্তি এখনো আসেনি – তবু আককাস যখন পানি ঢেলে দেয় ব্যারেল দিয়ে – ওর ছোটো ছোটো হাতে ছুঁইয়ে রাখতে হয় – এমনই তার উৎসাহ ।
অর্কিডের লতাগুলোয় কবে ফুল ফুটবে, এ নিয়েও ওর চিন্তার শেষ নেই । আককাস বলেছিল, অভি ভাইয়া – বিশ পচিশদিনের মাঝেই ফুল আসবে !
বিশ পচিশ দিন আসলে কতদিন এবং দিনগুলোর আসতে দেরি হচ্ছে কি না – এ নিয়ে তার বিস্তর প্রশ্ন । প্রায়ই আজকাল অফিস থেকে ফিরে দেখি , বিকেলের ছায়া কটেজের অর্ধেকটা জুড়ে তাবু গেড়েছে, আককাসের পোষা কুকুর লেজ পাকিয়ে শুয়ে আছে আধাফুট ঘাসের উপর – আর সেই এহানিলের চারার পাশে অভি বসে আছে গম্ভীর মুখে , আমাকে দেখেই লাফ দিয়ে ওঠে –
দ্যাখো দ্যাখো – আজকে নোতুন দুইটা পাতা হইছে –
আমি কাছে গিয়ে বসি । সে মুগ্ধ গলায় বলে, এইবার ফুল উঠবে – না ?
হ্যাঁ , আমি মাথা হেলিয়ে সায় দেই, আর দেরি নাই । বোধ হয় সায় জানাতেই এক পশলা বাতাস হৈ হৈ করে গাছগুলোকে নাড়িয়ে দিয়ে চলে যায় ।
রাতে আঙ্গিনায় বসে আকাশের ঝাঁক ঝাঁক নক্ষত্রের দিকে চেয়ে কোনোদিন হয়ত বলি, ঐ ওটা হলো অরুন্ধতী । তার পাশে বশিষ্ঠ । সে বলে,
এহানিলের ফুলগুলা – ওই যে – ওই তারাগুলার মতো হবে – না ? অমন জ্বলে ?
ওর চাইতেও সুন্দর হবে ।
ও – বাবা !
দু চারদিন পরের এক সন্ধ্যাবেলার কথা । বর্ষার কৈয়ালা ফুল খুব সমারোহে ফুটেছে । গন্ধে চারদিক ম ম । চারপাশে ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝির ডাকের কোনো বিরাম নাই । বারান্দায় বসে কবেকার এক পুরনো ম্যাগাজিন বের করে পড়ছিলাম । এমন সময় নাজিব সাহেব এলেন । বললাম,
আসুন – আসুন , নিন চা নিন ।
ভদ্রলোক বসলেন । বললেন,দেখা করতে এলাম । কাল চলে যাচ্ছি –
আমার বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল । বললাম – কালই ?
হ্যাঁ – অপারেশন তো লাগলো না । আর এদিকে ডাক্তারও বললেন – ঝামেলা আর নেই ।
শোকর আলহামদুলিল্লাহ ।
আলহামদুলিল্লাহ তো বটেই । আরো ভালো খবর হল, খোদা না খাস্তা ঝামেলা যদি দেখা দেয়ও, এই শত শত মাইল পেরিয়ে আসতে হবে না । ওখানেই নতুন ব্রান্ঞ হচ্ছে লুইকান হেলথের ।
মাথা নেড়ে আনমনে বললাম,বেশ তো – ভালো –
ভদ্রলোক বললেন, অবশ্য আরো কিছুদিন থাকার ইচ্ছা ছিল এমনিতেই । জায়গাটা ভালো । আবার কখনো তো আসা হবে না । কিন্ত মাস দেড়েক হয়ে গেল – অফিসেও অনেক জট পাকিয়ে আছে – জরুরি যাওয়া দরকার ।
ধীরে ধীরে বললাম, তা ঠিক । অনেকদিন না থাকলে ক্ষতি –
ভদ্রলোক উঠলেন । বললেন,আজ রাতে আমাদের ওখানে খাবেন । অভির মা বারবার করে বলেছে ।
জি আচ্ছা – আমি মাথা নাড়ি ।
ভদ্রলোক চলে গেলে অনেকক্ষণ বসে রইলাম । লোডশেডিং হলো, বাতি জ্বালানোর কোনো ইচ্ছা খুঁজে পেলাম না । বহুদূরে মেঘের গম্ভীর ডাক শোনা গেল । কিছুক্ষণ পর আককাস এসে হারিকেন ধরিয়ে দেয় । বলল, চা দেব স্যার ?
আককাস –
জি স্যার
এহানিলের একটা চারা টবে বাঁধো তো দেখি –
কেন স্যার ! আককাস অবাক হয় ।
অভিরা কাল চলে যাবে ।
ওহ ! আককাস ছোটো করে শ্বাস ফেলে । বুঝলাম তারও লেগেছে । বলল, রাতেই করব স্যার ?
একটু চুপ করে থেকে বললাম, হ্যাঁ, ওরা সকালসকাল রওনা দেবে ।
রাতে খাওয়ার পরে সকলের সাথে কথা হল । গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে । তবে কিছুদূর এগিয়ে আবহাওয়া বেশ শুকনো নাকি । সুতরাং যাত্রায় ত্রুটি হবে না । গাড়ি সকাল ছয়টার আগেই চলে আসবে । সন্ধ্যা থেকেই জিনিসপত্র বাঁধাবাধি শুরু হয়েছিল – এখনো চলছে । অভিকে বললাম, অভি – তুমি নাকি চলে যাচ্ছো ?
হুম – অভি গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ে – তুমি যাবে না ?
আমি হেসে বলি , নিয়ে যাবে ?
হ্যাঁ – তুমি যাবে । অভি আঙ্গুলে গুনে গুনে বলে- তোমাকে আমার পিছনের সিটে নিবো – তুমি তো ভয় পাও ।
আমি হাসি । বহুদূর থেকে বাতাসের শো শো শোনা যায় ।
ভোরের আগে আগে খানিকটা বৃষ্টি হলো । গাড়ি এলো ঠিক সময়মতো । বোঁচকাবুঁচকি তোলা হলো । দু চারজন লোক – যারা বাগানে রাস্তায় বাড়িগুলোতে কাজ করে দেয় – তাদেরকে নাজিব সাহেব কিছুকিছু বখশিস দিলেন । এবার যাওয়ার পালা । যদিও বাড়ি যাচ্ছেন , তবু সকলেরই মুখ কিছুটা বিষন্ন – সকলেই জানি – আবার কখনো দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ । কেবল অভি দুরন্ত ছোটাছুটি করছে । বললাম, অভি – কিছু ছেড়ে যাচ্ছো কি না দেখোতো –
অভি কিছুক্ষণ ভাবে – হেসে বলে, কী ?
আককাস এহানিলের টবটা নিয়ে আসে । অভি চোখ বড় করে টবটা বুকের কাছে ধরে থাকে । আমি মৃদুস্বরে বললাম, এই গাছটা তোমার । নাজিব সাহেব এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন , উঠে পড়ো সবাই ।
তখন সময় ৬:০২ । আকাশের পরতে পরতে মেঘ এখনো অন্ধকার মুছতে দেয়নি । অভি বসেছে জানালা ঘেষেই । আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি । অবাক হয়ে সে বলল, তুমি যাবে না ?
আমি কিছু না বলে হাত নাড়াই ।
গাড়ি ছেড়ে দেয় ।
তার পরপরই ঝুপঝুপ করে দেয়া নামলো । কটেজে ফিরে চা বসিয়ে চেয়ারে হেলান দিলাম । হঠাৎ মনে হল, আজকের দিনটা অনেক দীর্ঘ । বাইরে বৃষ্টি পড়ছে ঘন হয়ে । মাঝে মাঝে শিরশির ঠান্ডা বাতাস হু হু করে কটেজ কাঁপিয়ে যায় । আমার লাগলো যেন , এই রেলাখুন তার বাগান – বাড়ি – গাছ সমস্তটা নিয়ে আজ দ্বিগুণ নিস্তব্ধ হল । অনেকক্ষণ পর নয়টা বাজলো । বৃষ্টি তখন ধরে এসেছে । ছাতা মাথায় অফিসে গেলাম । ছুটি হলো চারটায় । তাড়াতাড়ি ফেরার কোনো উৎসাহ পেলাম না । খরিতুনের জংগল পেরিয়ে যখন গেটে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা ঘনিয়েছে । বৃষ্টি আবার পড়তে আরম্ভ করেছে । বারান্দার দিকে যেতে যেতে অভ্যাসবশত একবার তাকালাম বাগানের দিকে । আজ সেখানে কেউ নেই ।