এক সকালবেলা ঘুম ভাঙার পর তার মনে হলো, জীবনের সব সমস্যার মূলে রয়েছে নাক। অনেক বছর আগে, নিকোলাই গোগলের ‘নাক’ নামে সে এক গল্প পড়েছিল। আজ সকালবেলা সেই স্মৃতি হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার। আজকের সকালবেলাটা খুব চমৎকার। অদ্ভূতও বটে। ঝলমলে রোদ তার গায়ে লেপ্টে আছে। গত রাতের ছিঁচকাদুনে বৃষ্টির কোনো ছিঁটেফোঁটা গন্ধ নেই কোথাও। অবশ্য গন্ধ থাকলেও, সে টের পাচ্ছে না। রাতে সিগারেট আনতে সে বাইরে গিয়েছিল। রাস্তার মোড়ে রাতে কয়েকটা চায়ের দোকান খোলা থাকে সবসময়। ছয়তলার সিঁড়ি ভেঙে একবার নিচে নামা, আরেকবার উপরে। বাইরের বৃষ্টি থেকেও রেহায় পায়নি সে। ঠান্ডাও সুযোগ পেয়ে গেঁড়ে বসেছে নাকে। জ্যাম হয়ে হয়ে নাকের দুই ফুঁটো। টানেলে যেন কেউ শত্রুতাবশত পাথর ফেলে রেখেছে, শ্বাস নেওয়ার সময় বাতাস তাতে ধাক্কা খেয়ে আটকে যাচ্ছে। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সে নাকের দুই ফুটোতে সর্ষে তেল মাখল সামান্য।
.
গত তেইশদিন ধরে সে তিন রুমের এক ফ্ল্যাটে একা। ঢাকা শহরে এখন সম্পূর্ণ ভূতুড়ে পরিবেশ। গাড়ি চলাচল বন্ধ। মানুষজনের ভিড় কমে গেছে। কমারই কথা। সরকার লকডাউন ঘোষণা দেওয়ার পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামে ফিরে গেছে অনেকে। কেউ থেকে গেলেও পরিবার পাঠিয়ে দিয়েছে গ্রামে। করোনা এসে পৃথিবীর চেহারা সম্পর্ণ পাল্টে দিয়েছে। তার ব্যাচেলর বাসায় যারা থাকে তারাও বাড়ি চলে গেছে ব্যাগ গুছিয়ে। সে যেতে পারেনি। অবশ্য তার যাওয়ার কোনো জায়গাও নেই। আগামী ২৭ এপ্রিল তার ব্যাচেলর জীবনের ১৫তম বার্ষিকী। ইচ্ছে ছিল ঘটা করে পালন করার। কিন্তু একা একাই দিনটা উদযাপন করতে হবে এখন।
করোনার দিনগুলোতে সে চাল-ডাল-আলু স্টক করে রেখেছে। কোথাও যাওয়ার নেই। রান্না করো। খাও আর ঘুমাও। এক বদ্ধ ঘরে বাঁচতে হচ্ছে তাকে। একটুর জন্য বাইরে গেলেও মাস্ক পরার নিয়ম। এমনকি সে এতই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছে, বাসার ভেতরেও মাস্ক পরে থাকে। কখনো কখনো মাস্ক পরা অবস্থাতেও ঘুমিয়ে পড়ার রেকর্ড আছে তার। অভ্যাস এক ভয়াবহ অসুখ। আজকের সকালটা তার শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। আজকেই তার ঘুম ভেঙে মনে হলো, যত সমস্যা ওই নাকে। কেননা সে-ই তো শ্বাসের মাধ্যমে করোনার জীবাণুকে আহ্বান করে শরীরে। রোগ প্রতিরোধের জন্য সকালবেলা সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, নাক কেটে ফেলায় সবকিছুর সর্বোত্তম পন্থা।
শরীর ভালো লাগছিল না তার। হাড়ের জয়েন্টেও ব্যথা হচ্ছিল। কোনোকিছর ঘ্রাণও পাচ্ছিল না। সর্দি হলে ঘ্রাণ না পাওয়ায় স্বাভাবিক। কিন্তু নাকের যন্ত্রণা ধীরে ধীরে কপালে উঠে এলো। পরে ভনভন করতে লাগল কানে। এসব যন্ত্রণা যখন তাকে ঘিরে ধরল শত্রু সৈন্যের মত, তখন ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, সব সমস্যার মূলে রয়েছে ওই নাক।
কোনোকিছু আর ভাবতে চায় না সে। অনেক কষ্টে শার্টটা গায়ে দিয়ে, টলতে টলতে ছয়তলার সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল। থামল বাসার নিচের সামান্য দূরে এক মুদি দোকানের সামনে। সবচেয়ে ধারালো ব্লেডটি কিনে ফের সে ছয়তলা বেয়ে রুমে এলো। আর তীব্র ধারালো ব্লেডটা নিয়ে ঢুকল বাথরুমে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একদম কোনোকিছু না ভেবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘ্যাচাং করে নাকের মুণ্ডটি কেটে ফেলল সে। শুরুতে সামান্য ভয় যে লাগেনি তা নয়। কিন্তু এসব কাজে ভয় হলো মহাশত্রু। শত্রুকে শত্রু দিয়ে বিনাশ করতে হয়। কাটা মুন্ডু বেয়ে গলগল করে রক্ত বেরুতেই তার ভেতর পৈশাচিক আনন্দ হতে লাগল। যত ভেবেছিল অত ব্যথা লাগেনি। তবে মেঝেতে রক্ত দেখে কয়েকটা চিৎকার সে করেছে। তারপর একেবারে নীরব। বুক ধড়পড় করলেও এখন ঝামেলা হচ্ছে না শ্বাস-প্রশ্বাসে।
মুন্ডুহীন নাক নিয়ে কেটে গেলো একটা সপ্তাহ। শরীর এখন আগের চেয়ে ঝরঝরে। নাকে ঘ্রাণ ফিরে এসেছে। রুচিও বেড়েছে বেশ। কিন্তু তার মনের খচখচানি থেকে গেলো। কেননা চোখও তো করোনার গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে। তার গরুর মতো মায়াবী চোখ দুটোও যে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করবে না তার কী বিশ্বাস! হতে পারে তারা পৃথিবীর সুন্দর সবকিছু দেখে। কিন্তু অসুন্দরও কী তারা দেখে না? সুতরাং এবার সে নিজের মনকে বুঝিয়ে দোকান থেকে আনল সবচেয়ে তীক্ষ্ণ এক কাঁচি। বাথরুমে ঢুকে আয়নায় নিজেকে দেখল কিছুক্ষণ। সেই কিছুক্ষণ কেবল তিনবারের পাপড়ি ফেলা সময়ের সমান। কোনোভাবে কোনোকিছুতে সে মায়া জন্মাতে দিতে চায় না। এবং তারপরই কাঁচির গুঁতোই উপড়ে ফেলল দুই চোখ। প্রথমে বাম চোখ, তারপর ডানটা। রক্তে পিচ্ছিল হয়ে গেল বাথরুমের ফ্লোর। চিৎকার করল সে। ভয়াবহ চিৎকার। অবশ্য সেই চিৎকার পৌঁছাল না কারও কানে। এই খরদুপুরে চারদিকে এখন ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। পানির কল ছেড়ে দিয়ে সে সজোরে অনেক্ষণ কাঁদলো ভবিষ্যতে কোনোকিছুই দেখতে না পাওয়ার দুঃখে। অশ্রুজলের পরিবর্তে বাথরুমের ফ্লোর ভেসে গেলো রক্তে। তবুও সে মনকে মানালো এই বলে যে, এখন থেকে আর অসুন্দর কোনোকিছু দেখতে হবে না। পড়তে হবে না দুনিয়ায় ঘটে যাওয়া নেগেটিভ কোনো নিউজ। যাদের চোখ নেই তারা তো অন্তরের চোখেই সব দেখে।
সেইদিন থেকে সে অন্তরের চোখ দিয়ে দেখা শুরু করলো। হাতড়াতে হাতড়াতে সে সওদাপাতি করে। রান্নাবান্না করে। খায়। নাক ও চোখ ছাড়ায় এভাবে সে সবকিছুতে অভ্যস্ত হয়ে গেলো। কিন্তু তারপরও একটা অভ্যাস কমলো না তার। বিনা কারণে নাক ও চোখে হাত দেওয়া। হঠাৎ হঠাৎ অসাবধানবশত তার হাত এমন বিটলামি ও বিট্রে করা শুরু করলো তার সঙ্গে। যেন হাতদুটো হুটহাট জানতে চায়, নাক-চোখ গেল কোথায়!
তার মনে হলো, হাতের এসব জানার আগ্রহ নয়; প্রশ্ন। কিন্তু সে জবাবদিহি করতে অপারগ এবং কখনো মরে গেলেও তা কারও কাছে করতে চায় না। অবশেষে সে দেরিতে হলেও বুঝলো, সব দোষ দুই হাতের। হাতই যদি না থাকে তবে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কোনো ভয় নেই বললেই চলে। যে চিন্তা সেই কাজ। আগের মতো আরেকটি সকালবেলা হাতড়াতে হাতড়াতে মাছ ও মাংস কাটার দা নিয়ে সে ঢুকে পড়লো বাথরুমে। যেহেতু সে ডানহাতি সুতরাং ডান হাতেই দা ধরে বেসিনে বসানো লম্বা করে দেওয়া বাঁ হাতের কব্জিতে সে এক জোরে কোপ বসালো। অন্ধ হলেও প্রথম কোপ ঠিকঠাক পরলো হাতে। কেননা অন্তরের চোখ কখনো মিথ্যা নির্দেশনা দেয় না। পিচকারি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে সুন্দরভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো বাম কব্জি। আঙুলগুলো সামান্য একটু কেঁপে অতঃপর নিস্তেজ হয়ে গেলো। আবারও সে চিৎকার করল। কিন্তু এখানে এমন কেউ নেই যে, কারও চিৎকার কেউ শুনতে পাবে।
বিপত্তি বাঁধলো ডানহাত কাটা নিয়ে। কীভাবে ডান কব্জি বিচ্ছিন্ন করবে এই ভাবতে ভাবতে তার তন্দ্রা এলো। কিন্তু এখন ঘুমানোর সময় নয়। সে যদিও দু’পায়ে দা ধরে চেষ্টা করলো ডানহাত কাটতে, কিন্তু সম্ভব হলো না। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেলো মাথায়। রক্তাক্ত হাত নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। ডানহাতে দা নিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় দ্রুতবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এলোমেলো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় কয়েকবার সে গড়িয়ে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু এখন গড়িয়ে পড়ার সময় নয়। হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোভাবে গলির মোড়ের কসাইয়ের দোকানে গিয়ে বললো, ‘ভাই, দয়া করে আমার ডানহাতটা একটু কেটে দেন।’