টিকা নেওয়ার পর একটু-আধটু গা গরম লাগবে।
চশমার উপর দিয়ে সামনের গ্লাসের দেয়ালে চোখ মেলে রেখেছে ভ্যাকসিনোলজিস্ট বনয়া। ওপাশে বসে থাকা একুশের তরুণকে স্ক্যান করে নিচ্ছে। গ্লাসটা আসলে বিশাল একটা মনিটরিং স্ক্রিন। ছেলেটার স্পন্দন, রক্তচাপ, গায়ের তাপমাত্রা, অক্সিজেন লেভেল ওঠানামার ডেটা ফুটে উঠেছে ওতে।
প্রথম দুই মিনিট হার্ট বিট বেড়েছিল। বিপি ছিল পড়তির দিকে। তিন মিনিটের মাথায় অক্সিজেন রিডিং দুম করে নেমে পঁচাশি ছুঁলো। সংখ্যাগুলো স্ক্রিনে প্রত্যাশা মাফিক চেহারা নিল চতুর্থ মিনিটে। বনয়া চেয়ারে গা এলিয়ে দেওয়ার আড় ভাঙ্গতে যাবে ওরমধ্যে ছেলেটা বললো, কেমন একটা বুনো গন্ধ নাকে লাগছে।
ভয় পেওনা। পিঠটা চেয়ারে ঠেকলো বনয়ার।
টিকা রক্তে মিশে যায় পাঁচ মিনিটে। পাঁচটা বানরের শরীরে এই টিকা এভাবেই কাজ করেছিল। আরেকটা গবেষণার জন্য একটা মোটে বানরের অনুমতি মিলেছিল। ওই সময়ই মাদারীপুরে বানরদের খাবার সঙ্কটের খবরটা জানতে পারে বনয়া। একজনকে টাকা সেধে সেখান থেকে আরো চারটে বানর নিয়ে আসে। ওগুলো আরো মাস খানেক গ্রো লাইটের নীচে রেখে রেকর্ড নিতে হবে। এরপর ল্যাব ভবনের সামনে সড়ক দ্বীপে লাগিয়ে দিলেই হল। পাঁচটা বাঁদরলাঠি গাছ বড় হয়ে ফুল দিলে কি ভালোই না লাগবে সামনের রাস্তাটা।
ছেলেটার শরীরে টিকা কাজ করা শুরু করেছে। অলফ্যাক্টরি নার্ভ মস্তিস্কে গন্ধটার অনুরণন তুলেছে। এক ঘণ্টা পর মনিটরিং কক্ষ থেকে বার হল ছেলেটা।
হবে তো? এখনও উত্তেজনা কাটেনি ওর।
দিনের রোদটা গায়ে লাগাবে। মানুষ হও অথবা গাছ, রোদই দেবে এনার্জি।
মাথা নেড়ে আগামী কয়েক ঘণ্টার করণীয় লেখা কাগজটা হাতের বড় খামে ভরে পেছন ফিরে হেঁটে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। অতি কল্পনায় ওকে ছাতিম গাছের মত লাগে বনয়ার।
বনয়ার ক্লাসের স্টুডেন্ট সে। টিএসসির সামনে কটা বুড়ো বুড়ো গাছ সড়ক উন্নয়নের বিনিময়ে কাটা
পড়লে ছেলেটা মুষড়ে পড়েছিল। টবের গাছে পানি না পড়লে যেমন নেতিয়ে যায় তেমন।
অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে এলে বনয়া জানতে চেয়েছিল, কী হয়েছে? ছেলেটা যতই মনের কষ্টটা উগড়ে দিচ্ছিল, বনয়ার চোখে ততই উল্লাসের ঝলক।
বনয়া বলে ওঠে, তুমিই তো গাছ হয়ে যেতে পার।
ঝাড়া ষাট সেকেন্ড ছাত্র আর শিক্ষক তাকিয়ে ছিল একে অন্যের চোখে।
ভ্যাকসিনোলজিস্টের যে সম্মোহন করার কলাও রপ্ত করা জরুরি তা ওই সময় বুঝেছিল বনয়া। অবশ্য ছেলেটা ডিপ্রেসড থাকায় বনয়ার তাকে বাগে নিতে বেগ পেতে হল না। ছয় ফুট লম্বা সুঠাম শরীরের ছেলেটা বলে উঠেছিল, ম্যাম, আমি ছাতিম গাছ হব।
ছাতিম গাছের জিনোমকোড বনয়ার কাছে অজানা ছিল। হাতে ছিল আম আর কাঠ গোলাপেরটা। কিন্তু ছেলেটার একই গোঁ; ছাতিমই হবে।
টিকার গবেষণাটা আরো কয়েকদিন বাড়াতে হল। এবার আরো বেশি গোপনীয়তা নিতে হল। টিকার পরীক্ষা চালানোর জন্য ছেলেটাই তার প্রথম মানুষ।
পথেঘাটে দেখলেও আগে ছাতিম গাছ চেনা ছিল না বনয়ার। এখন অবশ্য জানা হয়ে গেছে ক্যাম্পাসের কোন মোড় আর মাঠে কটা করে ছাতিম গাছ আছে। সমরেশ বাবু এক স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, রবি ঠাকুর না কি জবরদস্ত ছাতিম অনুরাগী ছিলেন। তার কালে শান্তি নিকেতনে সমাবর্তনের দিন ছাতিম গাছের পাতা উপহার পেত শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ছেলেটাকে যতটুকু জানা গেল তাতে ওকে পাঁড় রবীন্দ্র ভক্ত মনে হয়নি বনয়ার।
টিকার প্রথম ডোজের ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পর চূড়ান্ত ডোজটা দিতে হয়। রাত বারোটায় ডোজটা দিতে যাবে বনয়া। তারপরই ঘটবে সেই বিরল ঘটনা। বনয়া যা পেরেছে আর যা করতে যাচ্ছে পৃথিবীতে আর কোনো বিজ্ঞানী তা পারেনি। একটা মানুষ গাছ হয়ে যাবে। সাড়ে সাতশ কোটি মানুষ প্রকৃতিকে কেটেকুটে সাফ করে দিচ্ছে। কালো পিচের সমৃণ রাস্তা আর নতুন ভবন বানানোর উদযাপনে ক্যাম্পাসের গাছগুলোও রেহাই পেলনা। দু্-চারটা করে গাছ লাগিয়ে এই বিনাশ পোষানো যাবে না। এর চেয়ে পৃথিবীর মানুষগুলো বরং গাছ হয়ে যাক একে একে…।
মধ্যরাতে ক্যাম্পাসের এক মোড়ে দাঁড়িয়ে বনয়া। মুখোমুখি ছেলেটা। মোজা খুলে হাঁটু পর্যন্ত বনয়াকে দেখাল। টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার পর দিনের রোদ গায়ে লাগলে পায়ে শেকড় গজাতে শুরু করার কথা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। গবেষণায় যা আউটপুট ভেবেছিল তেমনটাই অংকের মত ঘটছে। বনয়ার চোখ ছটফট করে।
ঠিক এইখানে ম্যাম। শেকড় গজানো দুই পা নিয়ে ছেলেটা খুঁড়ে রাখা মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছে। এমনটাই কথা হয়েছিল দুজনের মধ্যে।
ব্যাগ থেকে টিউব আকারের রেফ্রিজারেটরটা বার করে বনয়া। ওতেই রাখা আছে টিকার ইনজেকশন। বনয়ার কি হাত কাঁপলো একটু?
ছেলেটাকে স্বাভাবিক রাখতে অথবা নিজে স্বাভাবিক হতে বনয়া ওকে বললো, তুমি কি জানো সংস্কৃত ভাষায় ছাতিম গাছকে কী বলে?
না ম্যাম। ছেলেটার গাল বেয়ে শিশির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। সেচ পেয়ে ওর পায়ের শেকড় মাটি আঁকড়ে ধরে।
সপ্তপর্ণা; গাঢ় কণ্ঠে বলল বনয়া। পরের ডোজটা হাতে ধরা।
ছেলেটার নাভির উপরে ইনজেকশনটা ধীরে ধীরে পুশ করছে বনয়া। আনমনে আওড়াচ্ছে কিছু; যেন মন্ত্র।
একদিন এই ছাতিম তলায় বসে,
এক পৃথিবী গল্প বলবে শহর।
বুনো গন্ধে মাখা হলে রাত
গুনবে বাতাস একে একে প্রহর।
আশ্চর্য! এমন কবিতা তো বনয়া কোথাও কখনও পড়েনি। তাহলে এই কবিতা কেন মনে এল ওর?
দুই মিনিট আবারও দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে। তারপর ছেলেটার চোখ ঘোলাটে হতে থাকে। পরের কয়েক মিনিট মনিটরিং ঘড়িতে চোখ রাখতে ভুলে যায় বনয়া। শুধু টের পেল ওর চারপাশে তীব্র হচ্ছে বুনো গন্ধ; আর চোখের সামনে ডালপালা মেলছে কয়েক ফুট দীর্ঘ একটা ছাতিম গাছ।