আঠারো তলা ভবনের ছাদে উঠলে মনে হয় সূর্যটা হাতের নাগালে। সূর্য্যের তাপ এত দ্রুত শরীর ও চোখে এসে পড়ে যে ওসি শহীদুল আলমের মনে হচ্ছিল সব জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। রোদের তাপে শহীদুল ঠিক মতো তাকাতেই পারছে না।
আজকে ভুলে সানগ্লাসটাও রেখে এসেছে বাসায়। কেন যে এমন ভুল হলো কিছুতেই মেলাতে পারে না। সচরাচর এমন ভুল শহীদুল করে না। এবারই প্রথম। আধঘণ্টা আগে হুট করেই তাকে জানানো হলো ১৮ তলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে একটি লোক পড়ে আত্মহত্যা করেছে। খবরটা পেয়েই গাড়ি স্টার্ট করে এক টানে ঘটনাস্থলে। নিচে এখনও লাশটি পড়ে আছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানও নিয়েছে শহীদুল। তারা কেউ বলছে আঠারো তলা থেকেই পড়েছে। কেউ বলছে অন্য কোনও তলার বারান্দা দিয়েও ঝাপ দিতে পারে। তবে ছেলেটার শরীরের যে দশা তাতে নিশ্চিত বলা যায়– পড়েছে আঠারো তলা থেকেই।
স্পট ডেড।
তাই তাকে এখনও হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন কেউ অনুভব করেনি। পড়ে আছে।
এক প্রত্যক্ষদর্শী জানালে– পড়ার পর যে আওয়াজটা ছিল ভয়াবহ। মানুষের এত করুণ মৃত্যু নাকি সে দেখেনি কখনও।
শহীদুল আঠারো তলার ছাদ থেকে নিচে উঁকি দেয়। দেখা মাত্রই তার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। জোরে জোরে শ্বাসও নিতে থাকে। কী ভয়াবহ।
তার পাশে সাব ইন্সপেকটর মোক্তার উদ্দিন দৌড়ে এসে শহীদুলকে ধরলো।
‘স্যার কী হয়েছে?’
‘মোক্তার সাহেব,এত উঁচু থেকে একটা লোক লাফ দেয় কেমনে? ভয় লাগে না?’
মোক্তার উঁকি দিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধই করেনি। তার হাইট সিকনেস আছে। উপর থেকে নিচে তাকালে বমি আসে, মাথায় ঘুরায়। অজ্ঞান হয়ে পড়ারও সম্ভাবনা থাকে। মোক্তারের এই মুহূর্তে অজ্ঞান হওয়ার ইচ্ছে নেই।
শহীদুলকে সে শুধু বললো, ‘স্যার সুইসাইড কেস শিওর?’
শহীদুল একটু ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ ভাবে।
আঠারো তলা ভবনের ছাদে শেওলায় ভরা। বহুকাল মনে হয় কেউ হাঁটেনি। কেমন অবহেলায় পড়ে আছে ছাদটা। খাঁখাঁ করছে। খুব মায়াও হলো ছাদের জন্য। কেউ আসেনি,কেউ দেখেনি। তার কাজ এই খরতাপে সূর্য্যের দিকে চেয়ে থাকা। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আঠারো তলা ভবন।
অথচ একটা লোক হয়তো বহুকাল পরে এলো। তাও আপন হলো না। বিচ্ছেদ নিয়ে পড়ে গেলো।
এসব যখন ভাবছে শহীদুল তখন আবার মোক্তার তাকে প্রশ্ন করে।
‘স্যার সুইসাইড কি শিওর?’
শহীদুলের চোখ দুটি তখনও ছাদ আর ওই ছেলের ভাবনায় মশগুল। তবুও ধীরে ধীরে বললো, ‘আপাতত তাই মনে হচ্ছে।’
মোক্তার বললো, ‘স্যার সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে। পকেটে।’
‘এসব থাকতেই পারে। কেউ মেরে সুইসাইড নোট পকেটে গুজেও দিতে পারে। আমাদের আগে দেখতে হবে অন্য কোনও ইস্যু আছে কিনা। ছেলেটার পুরো পরিচয় বের করো। কী করে, কোথায় থাকে, পরিবারে কয়জন। ফেসবুক অ্যাকটিভিটিজ সহ তার মোবাইল ফোন কল লিস্টও দরকার।’
এসব কথা বলার সময় তারা ছাদ থেকে সরে গিয়ে সিড়ি বেয়ে এক ফ্লোর নিচে আসলো। কোনও আলামত পাওয়া যায় কিনা সেটাও দুজনের চোখ কথার ফাঁকে ফাঁকে খুঁজে বেড়ায়।
লিফটে ওঠার সময় শহীদুল আবার বলে, ‘ছেলেটার বাসায় যান। ভদ্রভাবে কথা বলে একটু সার্চ করবেন। কারও সঙ্গে কোনও বাজে ব্যবহার করবেন না। আর হ্যাঁ ফোন রেকর্ডও বের করার চেষ্টা করেন।’
নিচে নেমে ছেলেটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শহীদুল। মাথাটা এক পাশে ফাটা। মগজ বের হয়ে আছে। একটি পা ভেঙে উল্টে আছে, নাক মুখ গড়িয়ে গলগলিয়ে রক্ত ঝরেছে। বোঝা যাচ্ছে। এখন মনে হয় রক্ত আর অবশিষ্ট নেই। যা ছিল তা গড়িয়েছে, বাকি সব নিশ্চয় শরীরে এপাশ ওপাশ করতে করতে প্রাণ না পেয়ে জমাট বেঁধে গেছে।
ছেলেটা যখন পড়েছে তখন নাকি আশেপাশের মানুষ শুরুতে বিস্ময়ে ক্ষাণিক দাঁড়িয়ে থাকলেও দ্রুত এগিয়ে গিয়েছিল তার দিকে। একটু গোঙানোর শব্দ নাকি হয়েছিল। মাথাটা এমনভাবে ফেটেছে যে গোঙানোর কথাও নয়। তবুও হয়তো শক্ত প্রাণটা বেঁচে থাকার কিঞ্চিৎ লড়াই চালিয়েছিল।
ওখান থেকে লাশটা ময়না তদন্ত করে হাসপাতালের মর্গে পাঠানোর নির্দেশ নিয়ে চলে আসে শহীদুল। তার সঙ্গে ছেলেটির দুই বন্ধুকে গাড়ি তুলে আনে কথা বলার জন্য।
২.
‘আপনারা খবর পেলেন কিভাবে?’ থানায় এসে প্রথম প্রশ্নটা করা হয় দুই বন্ধুকে।
শহীদুল শুরু থেকেই দুই বন্ধুর দিকে নজর রেখেছে। তাদের চোখ, কথা বলা কোনো কিছুই এড়ায়নি শহীদুলের চোখ। বোঝার চেষ্টা করছিল যদি হত্যা হয়, তবে এরা জড়িত কিনা।
দুই বন্ধুর একজনের নাম জোবায়ের আহমেদ আরেকজন মুনির চৌধুরী। মুনির শহীদুলের প্রশ্নের উত্তরে জানালো তাদের এখান থেকে ফোন দেয়া হয়েছে ছেলেটির মোবাইল ফোন থেকে নম্বর নিয়ে।
শহীদুল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। সে কোনো মতেই বুঝতে পারছে না চল্লিশের কাছাকাছি বয়সের একটা ছেলে কেন আত্মহত্যা করবে?
তবুও প্রশ্ন করে, ‘আপনার বন্ধুর নাম কী?’
মুনির নামটি বলে- ‘নিকোলাস। সায়মুন মাহমুদ নিকোলাস।’
শহীদুলের পরের প্রশ্ন, ‘এটা কি হত্যা নাকি আত্মহত্যা? আপনাদের কী মনে হয়?’
তখন জোবায়ের উত্তর দেয়।
‘নিকোলাস সিজোফ্রেনিয়ার রোগী ছিল। হাসপাতালেও ভর্তি ছিল অনেকদিন। গত মাসেও সে দুই সপ্তাহ হাসপাতালে ছিল। এখন হত্যা নাকি আত্মহত্যা তা আমরা আসলে নিশ্চিতও হতে পারছি না। আবার মনে হচ্ছে আত্মহত্যাটাই বোধ হয় স্বাভাবিক। তবুও তদন্ত হওয়া দরকার।’
নিকোলাসের চিরকুটটা শহীদুলের হাতে। দুই বন্ধুকে সামনে বসিয়েই চিরকুটটার দিকে তাকায়। কী অপূর্ব হাতের লেখা। আর কী অমিলিনভাবে লেখা, ‘আমার চোখদুটো সন্ধানীকে দিও। আর দেহটি ঢাকা মেডিকেলে দান করো। অন্তত দেহটি কাজ করে যাক। প্রাণ না হয় উড়ে যাক।’
কখনও শহীদুল বিমর্ষ হয় না। তবুও নিকোলাস ছেলেটার লাশ দেখার পর থেকে তার প্রতি কেমন যেন দুর্বলতাও অনুভব করছে।
কেন আসে? কেন আসবে? এই চাকরি জীবনে বিভৎস লাশ দেখার কম অভিজ্ঞতা তো নেই! এই তো ২০১৪ সালের রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত আহত কত বিভৎসতা দেখেছে শহীদুল। কই? এতো মেঘ তো জমেনি তার মনে! এবারই কেন এত মেঘ চারিদিকে? কেন মুশুল ধারে বৃষ্টি বয়ে চলছে তার ভেতরে?
চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল জমে গড়িয়ে পড়ার আগেই শহীদুল উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আজ চলে যান। আপনাদের নম্বরগুলো দিয়ে যান। আমরা যোগাযোগ করবো। আর একটা তথ্য লাগবে। সেটা হলো তিনি কোন ডাক্তারের চিকিৎসা নিতেন তার নামও দিতে পারলে ভালো।’
জোবায়ের একটি কাগজে সব তথ্য লিখে বের হওয়ার সময় প্রশ্ন করে, ‘ভাই নিকোলাসকে কবে পাবো?’
শহীদুল কী বলবে প্রথমে বুঝে উঠতে পারে না। বলে, ‘পাবেন। ময়না তদন্ত হোক। ওনার পরিবারের সঙ্গে আলাপ করেই দিয়ে দেব।’
৩.
নিকোলাস মারা যাওয়ার পরদিন মোক্তার সব তথ্য তৈরি করে শহীদুলের টেবেলে পৌঁছে দিয়েছে। শহীদুল থানায় এসেই ফাইল নিয়ে বসেছেন। আজ নিকোলাসের বন্ধু জোবায়ের বাইরে অপেক্ষমান।
জোবায়েরের সঙ্গে দেখা করার আগেই শহীদুল ফাইল খুলে বসলেন।
সেখানে তথ্যগুলো লেখা।
পুরো নাম: সায়মুন মাহমুদ নিকোলাস।
বাসা: মীরপুর এক নম্বর।
বাবার নাম: সুজন মাহমুদ। (মৃত)
শুধু মা আছেন পরিবারে। আর কেউ নেই।
ফেসবুক অ্যাকাউন্ট: গত এক সপ্তাহ বাদে ফেসবুকে খুব বেশি পোস্ট নেই। কিন্তু গত এক সপ্তাহ প্রচুর কবিতা শেয়ার করেছে।
সবশেষ তিনটি ফোন কলের প্রসঙ্গও আছে ফাইলে। একটি নম্বরের পাশে লেখা নিকোলাসের মা। দ্বিতীয় নম্বরের পাশে লেখা মৌনতা নামে একজন নারীর নাম। তৃতীয় নম্বরটির পাশে লেখা জোবায়ের। ব্র্যাকেটে লেখা কল মিসড,ধরেনি। কলরেকর্ড পেতে সময় লাগবে এই নোটও দিয়ে রেখেছে মোক্তার। আর বাসাতেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।
ফাইল দেখে মোক্তারকে ডাকা হলো।
‘কী ব্যাপার কল রেকর্ড পেতে দেরি হবে কেন?’
মোক্তার একটু আমতা আমতা করে বললো, ‘স্যার আসলে অপারেটরকে বলেছি। তারা দরখাস্ত দিতে বলেছে। আমি দরখাস্ত রেডি করে পাঠাবো আজই।’
এটা শুনে খুবই বিরক্ত হয় শহীদুল। ভুরু কুচকে বলে, ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিদের তো কল রেকর্ড সেকেন্ডে বের হয়ে ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। ওসব কিভাবে সাপ্লাই হয়? কাজের সময় এত নিয়ম,ওসবের সময় কি কোনও নিয়ম নাই?’
মোক্তার চুপ করে থাকে।
শহীদুল আবার বলে, ‘পোস্ট মোর্টেম রিপোর্ট কবে দেবে?’
‘আজ বিকেলে ফুল রিপোর্ট পাবো স্যার।’
‘ঠিকাছে এক কাজ করেন–বাইরে জোবায়ের সাহেব নামে একজন বসে আছেন, ওনাকে পাঠান।’
জোবায়ের ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
শহীদুল আবার চিরকুটটা পড়ছে। কী অদ্ভুত সুন্দর হাতের লেখা। কেমন যেন সম্মোহনী ক্ষমতা আছে লেখায়। শুধু তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে।
মাথা উঁচিয়ে জোবায়েরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আসলে আমাদের কিছু ইনভেস্টিগেশন করতে হবে। এজন্য আপনাদের সহযোগিতা দরকার।’
জোবায়ের খুব দ্রুতই উত্তর দিয়ে বলে, ‘অবশ্যই, আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করবো।’
‘আমাদের আসলে একটু জানতে হবে ওনার সম্পর্কে। ওনার কললিস্টে শেষ তিনটি কলে আপনার নামও আছে। বাট মিসড, আপনি ধরেননি। তার আগে মৌনতা নামে একজনকে ফোন দিয়েছিল। আট মিনিট বারো সেকেন্ড কথা বলেছে। মৌনতা কে?’
‘জোবায়ের চোখ দুটি বড় বড় হয়ে গেলো। সে আবার জিজ্ঞেস করলো,মৌনতা?’
‘হ্যাঁ। চেনেন?’
‘চিনি। কিন্তু খুব অবাক হচ্ছি। মৌনতার সঙ্গে নিকোলাসের বহু বছর আগে প্রেম ছিল। তাও সেটা দশ বছর আগের গল্প হবে। মৌনতার তো বিয়ে হয়ে সংসারও হয়ে গেছে। বাচ্চাও আছে। কীভাবে সম্ভব বুঝতে পারছি না।’
‘প্রেম নিয়ে কোনও হতাশা ছিল?’ প্রশ্ন করে শহীদুল।
‘এক সময় ছিল। বললাম তো দশ বছর আগের কথা। কিন্তু ওই বিষয় চুকে গেছে। তখন যে হতাশাটা ছিল তা তো তার ভেতরে ছিল বলে মনে হয় নাই। প্রেমে ছ্যাকা খেলে যেটা হয় আর কী। ওই হতাশা সে কাটিয়ে উঠেছিল কয়েক মাসের মধ্যেই। তবে এরপর সে আর কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি।’
‘তাহলে হতাশার জায়গাটা কী ছিল? বন্ধু হিসেবে সেটা কখনও ফাইন্ডআউট করতে পেরেছিলেন?’
‘আমরাই তো তার পাশে সবসময় থেকেছি। পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি পাচ্ছিল না। সেটা একটা হতাশা ওর মধ্যে ছিল। নিকো অধিক মাত্রায় সৎ ছিল। অন্যায় সহ্যই করতে পারতো না। অসততাও সহ্য করতে পারতো না। তবে সহ্য না করতে পারার একটা বিষয় হলো–সে প্রতিবাদও করতে পারতো না। ভেতরে ভেতরে রাগে দুঃখে ক্ষোভে সে মুষড়ে পড়তো। এগুলো শেয়ারও করতো মাঝেমাঝে। চাকরি পেলেও টিকতে পারতো না।’
জোবায়ের যখন এসব বলছিল তখন শহীদুল অবাক হয়নি। তার পরিচিত এমন অনেক মানুষ আছে। যারা প্রতিবাদ করতে পারে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যায়। এই ক্ষয় কেউ চোখে দেখে না। শুধু কাছের মানুষরা বোঝে। যেমন জোবায়ের বুঝেছে নিকোলাসকে।
‘আচ্ছা তারপর। আর কোনও তথ্য?’
‘নিকোলাসের হঠাৎ একটা অদ্ভুত রোগ দেখা দেয়। যেটা প্রথম আবিষ্কার করে ওর মা। একদিন খালাম্মা কাঁদতে কাঁদতে আমাদের ফোন করে বলে, আমার নিকো পাগল হয়ে গেছে, তোমরা আসো বাসায়, তোমরা আসো। আমরা তখন তিন চারজন ওর বাসায় যাই। গিয়ে দেখি খালাম্মা কাঁদছে আর নিকোলাস আপন মনে মোবাইলে ইউটিউব ছেড়ে গান শুনছে। তার সঙ্গে কথা বলার আগে খালাম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম বিষয়টা। উনি বললেন, নিকোলাস ঘুম থেকে উঠেই নাকি বলছে আজ তার বাবা আসবে। বাবা নাকি ফোন দিয়ে বলেছে¬– বিরিয়ানি খাবে।
এটা শুনেই খালাম্মা কান্নাকাটি শুরে করে দিয়েছিল। আমরা গেলাম নিকোলাসের রুমে। গিয়ে বললাম,কিরে হারামজাদা কী করিস?
সে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে,আব্বা আসবে আজকে। আমি বললাম,তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? খালু মারা গেছে কবে ভুলে গেছিস নাকি?
নিকোলাস তখন হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। কোনও কথাই বলতে পারছিল না। হঠাৎ করে দৌড়ে সে খালাম্মার রুমে বিছানায় গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
সেদিন আমরা চলে আসলাম। তার দুইদিন পর আমাকে ফোন দিয়ে বললো,আমি একটা মহা সমস্যায় পড়ে গেছি। আমাকে একটু ডাক্তার দেখাবি? আমি জিজ্ঞেস করলাম– কেন কী হয়েছে? তখন নিকোলাস বললো, আমি না কোনটা স্বপ্ন কোনটা বাস্তব বুঝতেই পারছি না। গুলিয়ে ফেলছি। আবার কখনও মনে হয় আব্বা আমার সামনে। আমি আব্বার সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। হঠাৎ যখন মনে হয় আরে আব্বা তো মারা গেছে। সঙ্গে সঙ্গে দেখি আব্বা নাই। কী এক মুশকিলে পড়লাম দেখতো! আমার মনে হয় মানসিক কোনও সমস্যা হয়েছে। একটু ডাক্তার দেখা না। আমার কাছে তো টাকা নাই। আম্মার কাছে টাকা চাইলে বুঝে ফেলবে।
আমি আজ নিব কাল নিব করে সময় বের করতে পারছিলাম না। পরে আমি প্রায় দেড় মাস পার হওয়ার পর হঠাৎ একদিন নিকোলাস আমার অফিসে চলে আসে।
আমি খুবই লজ্জা পেলাম। বন্ধু একটা সহযোগিতা চেয়েছে আমি করতে পারছি না সময়ের অভাবে। তাই ওকে বললাম, চল আজকেই তোকে ডাক্তার দেখাবো।
নিকোলাস অবাক করে আমাকে বলল, ওমা ডাক্তার তো দেখালমই। সেদিন না তুই নিয়ে গেলি! আজ এমনেই এসেছি। আড্ডা দিতে।
শুনে আমি হতভম্ব। ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বললাম, আচ্ছা ঠিকাছে আজকে আবার চল।
আমরা ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার সব সমস্যা শুনে নিকোলাসের সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাইলেন। ডাক্তারের সঙ্গে কী কথা হয়েছে সেটা আর জানি না। তবে এরপর থেকেই ওর ট্রিটমেন্ট চলছিল।’
জোবায়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল শহীদুল। তার জীবনে এই প্রথম কোনও অদ্ভুত কেস ধরা দিল। এমন কেস আসেনি। সে প্রশ্ন করলো, ‘এই সমস্যা কবে থেকে শুরু?’
জোবায়ের জানালো, ‘এটা এই বছর থেকেই শুরু হয়েছে।’
‘তার আগে সবকিছু কি স্বাভাবিক ছিল?’ আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে শহীদুল।
জোবায়ের জানালো, ‘নিকোলাস উচ্ছল প্রাণবন্ত ছেলে ছিল। চাকরি বাকরি ঠিকমতো করতে পারছিল না, ব্যবসা করেও লস করেছে– এসব বিষয় ওকে অনেকটাই নিশ্চুপ করে দেয়। কথা বলাও কমে যায়। কারও সঙ্গে মিশতো না, আমরা কয়েকজন বন্ধু ছাড়া কারও সঙ্গে যোগাযোগও করতো না। আমাদের কোনো আড্ডায় আসলেও এক কোণে চুপচাপ পড়ে থাকতো। মাঝে মাঝে আমাদের কোনও কথায় হেসে উঠতো। কিন্তু ম্যাসিভ আকারে যদি বলি তবে এই বছরের শুরু থেকেই। ট্রিটমেন্টে ছিল। হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছিল।’
শহীদুল তার ডাক্তারের সম্পূর্ণ ডিলেটসটা আবারও দেখলো। ডা. আহসান কবির, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
জোবায়েরকে বলা হলো মৌনতার সঙ্গে দেখা করা যাবে কিনা। জোবায়ের বলো উঠলো, ‘ভাইয়া মৌনতার বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে। এখন এই বিষয়টাতে জড়ালে তার পারিবারিক ঝামেলা হতে পারে।’
শহীদুল তবুও বলল, ‘বিষয়টা আমিও বুঝতে পারছি কিন্তু আমাকে তদন্ত তো করতে হবে। রিপোর্টে এসবও থাকবে ফ্যাক্টর হিসেবে। তাই আমি যাওয়ার চাইতে আপনারাই কোনোমতে যোগাযোগ করেন। বলেন, এখানে একদিন এসে কথা বলে যেতে।’
৪.
মৌনতা থানায় এসেছে একটা কালো বোরকা পরে। জোবায়েরকে সঙ্গে নিয়ে। মুখটাও ঢাকা। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। আর চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়াচ্ছে।
শহীদুল প্রথমেই বোঝানোর চেষ্টা করলো যে এখানে ভয় কিংবা নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই। সে বোঝানোর চেষ্টা করলো, মৌনতার কোনো ক্ষতি হবে না।
পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত করে শহীদুল বলল, ‘আমরা শুধু জানতে চাচ্ছিলাম নিকোলাস আপনাকে ফোন দিয়েছিল এবং প্রায় ৮ মিনিট আপনাদের কথা হয়েছিল। কী কথা হয়েছিল জানতে পারি?’
মৌনতা চুপ করে থাকে। তার কান্না থামে না।
শহীদুলও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মৌনতার দিকে। ভাবে কী অপূর্ব চোখ মেয়েটির।
অনবরত সেই চোখ দিয়ে ঝর্ণাধারা বেয়ে চলেছে।
অনেক মায়া হয় শহীদুলের।
তাও তাকে বলতে হয়, ‘আপনি কাঁদবেন না। দয়া করে বলেন নিসঙ্কচে।’
মৌনতা তখন কথা বলে।
‘আট মিনিট না,আট মিনিট দশ সেকেন্ড কথা হয়েছে।’
শহীদুল অদ্ভুত এক প্রেমের সন্ধান পায়। যেখানে প্রেমিকা গুণে রেখেছে তাদের কথোপকথনের সময়।
‘কী কথা হয়েছে বলবেন?’
‘নিকোলাস মরে গেছে সত্যি?’ মেয়েটি উল্টো প্রশ্ন করে।
শহীদুল চুপ করে থাকে। এর কোনো উত্তর দিতে পারে না।
মৌনতা বলা শুরু করে।
‘নিকোলাস মরেছে ভালো হয়েছে। এই বিভৎস দুনিয়ায় ওর মতো মানুষের বেঁচে থেকে লাভ কী। ভালো হয়েছে। কেউ কি ওকে ভালোবাসতে পেরেছে? কেউ কি ওকে কাছে টানতে পেরেছে? কেউ কি ওর মনের কথাগুলো শুনতে চেয়েছে? মরে ভালোই করেছে। আমিও তো ওকে ভালোবাসতে পারলাম না। আমার এই শাস্তিটাই দরকার ছিল।’
শহীদুল মাঝপথে থামায় মৌনতাকে।
‘আপনি অন্য কথা বলছেন। আমি আপনাদের কনভারসেশনে ইন্টারেস্টেড।’
মৌনতা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। মুখের নেকাবটা সরিয়ে বলে। ‘কী কথা হবে? পাগল একটা লোক। আমাকে বলে,মৌনতা কাল তুমি বিয়ে করো না। চলো আমরা পালিয়ে যাই। আমি আর তুমি একসঙ্গে থাকবো, বিয়ে করবো।’
বিয়ে হয়েছে আমার দশ বছর হয়ে গেছে। দশ বছর আগে বিয়ের আগের দিন আমি তাকে ঠিক এই কথাটিই বলেছিলাম। সে তো শুনে নাই। সে শুধু ভয় পায়। এখন হয়েছে না? পাগল হয়ে গেলি? দশ বছর পর হুট করে এমনভাবে ফোন দিল যে মনে হলো এই তো গতকাল আমি বললাম, আর আজ নিকোলাস বলছে। আমি কী বলবো ওসি সাহেব? একটা মানুষ তার জীবনের দশবছর হুট করে ভুলে যাবে? নাকি ভেবে ভেবে ভেতরে ক্ষয় হয়ে গেছে। কী ভাববো ওসি সাহেব? আমাকে বলবেন?’
শহীদুল বুঝতে পারে মৌনতা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে পেরে উঠছে না। তার আবেগ-প্রেম-অভিমান সব একাকার হয়ে পড়েছে। শহীদুলেরও তখন মনে পড়ে তার ফেলে আসা প্রেমের কথা। যদি মনে না হতো তাহলে শহীদুল আনমনে তার সেই প্রেমিকার কথা তো মনে হতো না।
৫.
‘আপনার পেশেন্ট নিকোলাস। তার সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছে দীর্ঘক্ষণ। তার ট্রিটমেন্ট করেছিলেন। কেন তার এই সমস্যাটা হয়েছে বলতে পারেন?’
ডাক্তার তখন একটি রেকর্ডার বের করেন।
ডাক্তার বলে, ‘আমি রোগীদের সঙ্গে কথোপকথনগুলো রেকর্ড করে রাখি কেস স্ট্যাডি করার জন্য। আপনি এটা শুনলে সব জানতে পারবেন।’
শহীদুল তখন ডাক্তারকে রেকর্ডটি ছাড়তে বলেন।
দুজনের কথোপকথন শুনতে থাকে শহীদুল।
ডাক্তার: আপনার কী সমস্যা নিকোলাস সাহেব?
নিকোলাস: স্যার আমি স্বপ্ন কোনটা আর রিয়েল কোনটা বুঝি না। এই যে আমার মনে হচ্ছে এখন ঘুমিয়ে আছি আর স্বপ্ন দেখছি। আচ্ছা স্যার, এটা কি স্বপ্ন নাকি বাস্তব?
ডাক্তার: নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করুন। পারবেন।
নিকোলাস: আমি কি আর সুস্থ হবো না স্যার?
ডাক্তার: কেন হবেন না? অবশ্যই হবেন। নিয়ম মানলেই সুস্থ হয়ে যাবেন।
নিকোলাস: কেমনে সুস্থ হবো স্যার। আমার শুধু ভয় লাগে।
ডাক্তার: কিসের ভয়?
নিকোলাস: মানুষকে ভয় লাগে স্যার। এই যে আপনাকেও ভয় লাগছে। আপনাকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
ডাক্তার: কেন?
নিকোলাস: মনে হচ্ছে আপনি আমার শত্রু। আমার বিরুদ্ধে কিছু পেলেই আমাকে মেরে ফেলবেন।
ডাক্তার: ডাক্তার কি কখনও রোগীকে মারে?
নিকোলাস: কে বলেছে মারে না? এই দেশে বহু রোগীকে তো ডাক্তাররা মেরে ফেলে ভুল চিকিৎসা কিংবা অবহেলা করে। চট্টগ্রামে একটা বাচ্চাকেও ভুল চিকিৎসা করে আপনারা মেরে ফেলেছেন। আপনাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে প্রশাসন বিপদে পড়েছিল। আপনারা সব প্রাইভেট হাসপাতালে কাজ করা বন্ধ রাখছিলেন।
ডাক্তার: সব ডাক্তার তো খারাপ না। খারাপের সংখ্যা খুবই কম। আর আপনি যেই ঘটনার কথা বলছেন। সেটার তো শাস্তি হয়েছে।
নিকোলাস: কচু হয়েছে। তার ডাক্তারি কি বন্ধ হয়েছে? একজন বাবা-মা তো তার ফুটফুটে সন্তান হারালো। এই ব্যথা আমিও অনুভর করতে পারি।
ডাক্তার: বাবার বেদনা বুঝেন কিভাবে? আপনি তো বিয়েই করেননি।
নিকোলাস: কেন বুঝবো না? বাবা হিসেবে নিজেকে চিন্তা করেছিলাম। তখন ইচ্ছা করছিল শালাকে ছিলে ফেলি।
ডাক্তার: ছিলে ফেলবেন? বিচারের ব্যবস্থা করেন। মারামারির কী দরকার।
নিকোলাস: তাও ঠিক স্যার। ওই ডাক্তারও তো কারও না কারও সন্তান।
ডাক্তার: আপনি লেখালেখি করতে পারেন?
নিকোলাস: জ্বি পারি।
ডাক্তার: মনে যখন ব্যথা থাকবে তখন সেগুলো লিখে ফেলবেন। দেখবেন হালকা লাগছে।
নিকোলাস: কী লিখবো? লিখলেই তো ধরে নিয়ে যাবে।
ডাক্তার: কারা ধরে নিয়ে যাবে?
নিকোলাস: যারা ধরে নিয়ে যায় তারা। যারা ধরে নিয়ে হাওয়া করে রাখে। দুইদিন পর কোর্টে হাজির করে।
ডাক্তার: এগুলো তো থাকবেই। তবুও লেখা চালিয়ে যেতে হয়।
নিকোলাস: এগুলোর মধ্যে লেখা মুশকিল স্যার। আপনি যখন লিখতে বসেন তখন কত চিন্তা মাথায় রাখবেন। সেলফ সেন্সরশিপ নিয়ে আর যাই হোক লেখালেখি হয় না।
ডাক্তার: প্রকাশ করবেন না। ডায়েরিতে লিখে রাখবেন।
নিকোলাস: সেটাও ভয় লাগে। যদি কারো হাতে ডায়েরিটা পড়ে যায়!
ডাক্তার: তাই বলে কেউ তো লেখালেখি বন্ধ রাখেনি। অনেকেই তো লিখছেন।
নিকোলস: হ্যাঁ লেখেন। কী যে লেখে। ওগুলোকে লেখা বলে নাকি? বলে স্রেফ দালালি।
ডাক্তার: সেটা কেমন?
নিকোলাস: একদল সরকারি দালালি করে,একদল বিরোধী দলের দালালি করে। আবার অনেকে নিরপেক্ষতার ভঙ মেরে ইনিয়ে-বিনিয়ে ঠিকই কোনো না কোনো পক্ষের স্বার্থ হাছিলের চেষ্টা করে। দেশে কত কিছু হয়, কত বড় বড় লেখক, অধ্যাপক, গবেষক, সুশীল সমাজ। অথচ দেখবেন এদের মধ্যে মেরুদণ্ড আছে পাঁচ ছয়জনের। অধিকাংশের মেরুদণ্ড বিক্রি হয়ে গেছে।
ডাক্তার: তাহলে আপনিই বলেন, সমস্যা কোথায়?
নিকোলাস: ওহ স্যার। আমার এসব সমস্যা বলতে ভালো লাগে না। খুব কষ্ট হয়। সমস্যা বলাটাও এই দেশে অপরাধ। কিছু বললেই কোনো না কোনো পক্ষ বানিয়ে দেওয়া হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তো এক দল দলকানার উদ্ভব হয়েছে যারা সব অপকর্মের একটা যুক্তি দাঁড় করায়। সব পক্ষেই এই শিক্ষিত দলকানাদের আধিপত্য। সত্য কথাটা তো কেউ বলতে পারে না।
ডাক্তার: তাহলে আপনি বলবেন সত্যকথাগুলো।
নিকোলাস: সেখানেই ভয় স্যার। সত্য তো কেউ পছন্দ করে না। সবাই প্রশংসা শুনতে চায়। সত্য বলতে গেলে তো শুধু প্রশংসা করা যাবে না। সমালোচনাও করতে হয়।
ডাক্তার: কয়েকটা উদাহরণ দেন তো শুনি।
নিকোলাস: কেন? যারা ধরে নিয়ে যায় তাদের এই রেকর্ড দিয়ে দেবেন?
ডাক্তার: আমি রেকর্ড করছি আপনি বুঝলেন কিভাবে?
নিকোলাস: আমি দেখেছি আপনার সামনে একটা রেকর্ডার ছিল। ওটা হাতে নিয়েই আপনি আমাকে চোখ বন্ধ করতে বলেছেন।
ডাক্তার: আপনি দেশ নিয়ে খুব ভাবেন?
নিকোলাস: জি ডাক্তার। খুব ভাবি। দেশকে নিয়ে আমার মনে অনেক কষ্ট। দেশের মানুষকে নিয়ে অনেক কষ্ট। আমরা সবাই নিজেরা নিজেরা মারামারি করি। একে অপরকে ঘৃণা করতে বলি। ঘৃণায় ঘৃণায় দেশটাকে ভরে যাচ্ছে। চারিদিকে ঘৃণার পাহাড় জমে যাচ্ছে স্যার। কোনোদিন কোনো এক ঝড়ে পাহাড় ধসে সবাই চাপা পড়বে স্যার।
ডাক্তার: ইদানিংকালে কোন বিষয়টাকে মনে হলো ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে?
নিকোলাস: এই যে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনে দেখলেন না। সবাই ঢালাওভাবে বাচ্চাগুলোকে রাজাকার বানিয়ে দিল। তারা তো একটা নিয়মের সংস্কারের কথা বলেছে। প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে বসা যেত। বোঝানো যেত। তারা তো এই দেশেরই ছাত্র-ছাত্রী। কিন্তু কী হলো- যারাই কোটা সংস্কারের পক্ষে কথা বললো তাদেরই রাজাকার খেতাব দিল দলকানারা। রাজাকার মানে কি স্যার? কত বড় গালি দিলেন এই শিক্ষার্থীদের? তারা মনের কষ্টে বলল, চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার। আবার একদল আগ বাড়িয়ে বললে ফেললো– হ্যাঁ আমিই রাজাকার। আচ্ছা স্যার কেউ কি নিজেকে রাজাকার বলতে পারে? আমাদের দেশ একটা রক্তগঙ্গার ওপর দাঁড়িয়ে। মা’র কাছে শুনেছি একাত্তরে নাকি একটি পরিবারও পাওয়া যাবে না যারা তাদের স্বজন হারায়নি। সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে কেউ নিজেকে রাজাকার বলতে পারে? অবশ্যই তারা অন্যায় করেছে। কিন্তু এই অন্যায় তারা কেন করলো? কোন ক্ষোভ থেকে করলো। এই প্রশ্ন তো কেউ তোলেনি। দলকানারা বলল, এই প্রজন্ম আমাদের না। তারা হলো নষ্ট প্রজন্ম। তাদের কেউ কি প্রশ্ন করেছে,কেন তারা বুকে ‘আমি রাজাকার’ লিখলো? কেন তাদের হৃদয়ে এই ক্ষোভ জমা হলো? অথচ ওই দলকানারাও জানে কেন তারা রাজাকার লিখেছে। তারা কোনো টু-শব্দ করলো না। উল্টো হালাল করার জন্য বলল- আমরা তো জানতামই তোরা রাজাকার। এই দেশে তো এখন রাজাকারকরণ প্রকল্প চলছে। দ্বিমত হলেই রাজাকার, জামাত। দ্বিমত হলেই সরকারের দালাল। এই দেশটা একদল অসভ্য দলকানাদের নিয়ন্ত্রণে। এরা দেশটাকে খেয়ে ফেলছে স্যার। রাজনৈতিক দলগুলোও ব্যাপক বিনোদনে আছে এসব নিয়ে।
ডাক্তার: তারপর?
নিকোলাস: তারপর দেখেন নাই কী হয়েছে? একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে কয়েকজন ছাত্র এসে আন্দোলনে সম্পৃক্তদের পেটালো। এমনকি একজনকে তো হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে দিল। মিডিয়াতেও ফুটেজ এলো। কারা, কেন পেটালো? তার কোনও উত্তর পেলেন? ওই দলকানারাও কি এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে? এসবের মানেই হলো, এই দেশে কোনো আন্দোলন করা যাবে না। কোনো প্রতিবাদ করা যাবে না। মহাশয়রা যা বলেন মাথা পেতে নিতে হবে। আপনি বলছেন লিখতে? এখন এগুলো লিখলে আমারও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে দেবে। কিংবা তুলে নিয়ে যাবে। চারিদিকে এসব ভয়ই ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেন জুজু চারিদিকে ছড়িয়ে আছে।
ডাক্তার: যাইহোক। অন্যপ্রসঙ্গে আসি– প্রেম করেছেন কখনও?
নিকোলাস: করেছি। কলেজে থাকতে। ইন্টারমিডিয়েটে পরীক্ষার আগে মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়।
ডাক্তার: তারপর কী হলো?
নিকোলাস: বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আমার কাছে এসেছিল। বললো, চলো বিয়ে করে ফেলি। আমি তখন মাত্র স্টুডেন্ট। বাসায় জানলে আমাকে মেরে তক্তা বানিয়ে দিত। ভয়ে ওর কথায় সায় দেইনি। ওখানেই প্রেম শেষ।
ডাক্তার: প্রেমটাতো অনেক দিন আগের তাহলে।
নিকোলাস: অনেকদিন আগের। জানেন স্যার আজও আমি মেয়েটার কথা মনে করলেই তার শরীরের একটা ঘ্রাণ পাই। কী মিষ্টি। এই যে এখনও পাচ্ছি।
ডাক্তার: দেখা হয়েছে কখনও আর?
নিকোলাস: জি-না।
ডাক্তার: কথা বলতে ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে?
নিকোলাস: হয়। তখন নিজে নিজে কথা বলি। শুধু প্রশ্ন করি। উত্তরটা অজানাই থেকে যায়।
ডাক্তার: কী প্রশ্ন করেন?
নিকোলাস: ওকে নিজে নিজে বলি, চলো বিয়ে করে ফেলি। আমি ছাড়া কাউকে বিয়ে কইরো না। আমাকেই বিয়ে কইরো।
ডাক্তার: আপনি চাকরি বাকরি করেন না কেন?
নিকোলাস: করতে পারি না স্যার। চাকরি বিষয়টাতে আত্মমর্যাদা পাই না।
ডাক্তার: কেন?
নিকোলাস: সেখানেও সারাক্ষণ একটা ভয়ে থাকতে হয়। না জানি চাকরিটা চলে যায়। এই ভয়। শত অন্যায় চলে অফিসগুলোতে। কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না। প্রতিবাদ করলেই চাকরি চলে যাওয়ার আশঙ্কা। ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা নিজেদের প্রভু মনে করেন। প্রভুদের নিয়ে তো কথা বলা নিষেধ। তারা চলবেন তাদের মর্জি মতো। তারা যা বলেন তাই করতে হয়।
ডাক্তার: চাকরি কী ছেড়েছেন নাকি চলে গেছে?
নিকোলাস: কোথাও ছেড়েছি। কোথাও চলে গেছে।
ডাক্তার: চাকরি ছাড়াও তো একটা প্রতিবাদ। সেটা কি জানেন?
নিকোলাস: না স্যার। আজকে জানলাম। আমার শুধু মনে হতো এত অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারছি না। তখন দম বন্ধ হয়ে আসতো। তাই ছেড়ে দিতাম। আবার কোথাও দম বন্ধ হয়ে আসলে ঠিক মতো কাজ করতে পারতাম না। তখন আমাকে বের করে দিত।
ডাক্তার: শুনলাম আপনার কথা। আর কিছু কি বলার আছে?
নিকোলাস: স্যার বলার তো শেষ নেই। আমি কি সুস্থ হবো স্যার? এটা নিয়েও ভয় লাগছে।
ডাক্তার: আপনার ভয়টা কোথা থেকে আসে জানেন?
নিকোলাস: না স্যার।
ডাক্তার: আপনার ভয়টা আসে এই সমাজ থেকেই। প্রতিটি মানুষকেই এই সমাজে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। আপনি ওই যুদ্ধটার একটা সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছেন। সেটার নামই ভয়। আসলে ওগুলো ভয় না। যুদ্ধ। যুদ্ধে নানান বিপদ আসবে, ক্ষোভ আসবে, মান-অভিমান আসবে। সেগুলোর সঙ্গে লড়াই করতে হয়। ওটাকে ভয় ভাববেন না। ভাববেন এটাই জীবনের অংশ।
নিকোলাস চুপ করে থাকে। ডাক্তার আবার প্রশ্ন করেন, বুঝতে পারলেন নিকোলাস সাহেব?
নিকোলাস তখন কেঁদে দেয়। কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় ডাক্তার এবং শহীদুল।
শহীদুল ভাবে এই সমাজে প্রতিটা মানুষের কত লড়াই থাকে, কত গল্প থাকে। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই থাকে। নিজের নীতিগত অবস্থান থেকেও নিজের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। শহীদুলকেও প্রতিদিন করতে হয়। সবাইকেই করতে হয়। কিন্তু একমুঠো শান্তিময় জীবনের আশায় সবাই এসব ভুলে যায়। কিংবা মনের খেয়ালে হারিয়ে যায়। অথচ নিকোলাসরা ভুলতে পারে না। ক্রমাগত ক্ষয় হতে থাকে ভেতরে ভেতরে।
টেপটি শেষটি হয় নিকোলাসের কান্নার মধ্যে দিয়ে।
শহীদুল ডাক্তারের দিকে তাকায়। দু’জন নির্বাক হয়ে থাকে। শহীদুল ডাক্তারকে প্রশ্ন করেন, ‘ছেলেটাকে সুস্থ করা গেলো না?’
ডাক্তার ধীরস্থিরভাবে বলে, ‘আসলে ওইদিন আমার সঙ্গে এসব কথা বলার পর নিকোলাস অনেক হাল্কা হয়ে যায়। আমি ওষুধ দেই। এধরনের রোগীর ক্ষেত্রে সমস্যাটা হলো তাকে ব্যস্ত রাখতে হবে কোনো না কোনো কাজে। তাকে রেস্টও নিতে হবে। বাজে কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে দেওয়া যাবে না। পরিবারের সাপোর্টটা সবচাইতে বড়। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। মাঝে হাসপাতালেও আমি ভর্তি রাখি যেন মানুষের মধ্যে থাকতে পারে। কিন্তু কেন ও এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো বুঝলাম না।’
৬.
নিকোলাসের শেষ ইচ্ছা ছিল তার দেহটা ঢাকা মেডিক্যালে দান করে দেওয়া। আর চোখদুটো সন্ধানীকে দিয়ে দেওয়া। শরীর একটা অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হয়েছে। এনাটমি বিভাগের ডাক্তার দেখেছেন নিকোলাসকে। তার রিপোর্ট আসবে। বাইরে বসে আছে শহীদুল, মোক্তার আর নিকোলাসের বন্ধুরা। আত্মীয়রাও আছে কয়েকজন। এখানের কাজ শেষ হলে তাকে গোসল করিয়ে জানাজারও আয়োজন করা হবে।
তবে শহীদুল চোখ দেয়ালের এক কোণে, যেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন নারী। তিনি নিকোলাসের মা।
শহীদুল একবার চেয়েছিল নিকোলাসের মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে। পারেনি, পারবে বলেও মনে হয় না। ছেলের এমন নির্মম মৃত্যু একজন মাকে কতটা ঘায়েল করে সেটা শহীদুল অনুভব করতে পারে।
মা কাঁদে না। দাঁড়িয়ে থাকে একা একা। এই বিরাট অমানবিক পৃথিবীতে যার কোলটাই ছিল একমাত্র মানবিক সেই কোলে হয়তো শেষবারের মতো মা তার সন্তাকে ক্ষাণিকক্ষণের জন্য জড়িয়ে ধরবে।
এনাটমি বিভাগের ডাক্তার বেরিয়ে আসলেন একটা রিপোর্ট নিয়ে। শহীদুলের দিকে এগিয়ে বললেন, আসলে বডির অবস্থা খুব ভালো নয়। এত উপর থেকে পড়ার পর হাঁড়গোড় অধিকাংশই ভেঙে গেছে। এই বডিটা খুব কাজে দেবে না। উই আর সরি। রিপোর্টে সব লেখা আছে।
৭.
অ্যাম্বুলেন্সটাতে নিকোলাসকে ওঠানো হচ্ছে। কফিনের পাশে গিয়ে বসে নিকোলাসের মা। ঢেকে রাখা কাপড়টার ওপরেই হাত বোলাচ্ছে। সন্তান, সে তো অমূল্য সম্পদ। এই অমূল্য সম্পদের মর্ম শুধু বাবা-মা’ই বোঝে। কার সাধ্য আছে এই অনুভূতি বোঝার?
নিকোলাসের অ্যাম্বুলেন্সটা ছেড়ে চলে যায়। মোক্তার আর শহীদুল দাঁড়িয়ে থাকে।
শহীদুল ভাবে– এই যে এক বিভৎস মৃত্যুইচ্ছা নিকোলাস পূরণ করে নিল। তা কী নিজইচ্ছায়? আত্মহত্যাও তো হত্যা হয়। কেউ না কেউ এই হত্যায় জড়িত থাকে। কোনও মানুষ, কোনও ঘটনা, কোনও সমাজ, কোনও দেশ কিংবা কোনও রাষ্ট্র জড়িত থাকে। এই আত্মহত্যার দায়টা তো হত্যাতেই গিয়ে আটকায়। যদি তাই হয়। তবে নিকোলাসকে কারা হত্যা করলো?
এই প্রশ্ন শহীদুলকে ঘিরে ধরে। শহীদুল ভেবে চলে। হয়তো আজীবন এই প্রশ্ন শহীদুলকে তাড়া করে ফিরবে। ঘিরে রাখবে তার জগৎ। যে জগতে শহীদুল চক্কর কাটতে কাটতে একদিন নিজেই নিকোলাস হয়ে উঠবে।