লাকু রাশমনের ফালতু গল্পের সিরিজ থেকে…
ভেলুয়া সুন্দরীর আখড়ায়
[প্রাক-কথন: ঘটনাগুলোর কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র নেই। কিন্তু বেজায় তাদের দাপট। ধান ভানতে যেমন শিবের গীত গাওয়া এই কথাগুলোও ঠিক তেমনি। গুরুত্ব নেই কিন্তু দায় আছে। মানুষটা খেয়ে পড়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কিন্তু অদ্ভুত মাথার ব্যামোতে ধরলো। কোনো ডাক্তার কবিরাজে কাজ হয় না। ভিমরি খাওয়া রোগ। এ বড় শঙ্কার কথা। এ রোগ কী ছোঁয়াচে! কী জানি বাপু। আমাদের না হলেই বাঁচি। তাই দূরে দূরে থাকি।
তবে শোনা যায়, সে রোগের বাই চাপে শনিগ্রহের ফেরে। শনিগ্রহ থেকে সরাসরি রোগের আকর তার মস্তিকে ভর করে আর পঁই পঁই করে এমন লেখা বের হয় যে, তাকে ধোলাই না দিলে রাতের ঘুম হারাম হবার যোগাড়। তাই পাড়ার মাতব্বররা তাকে ভেলুয়া সুন্দরীর আখড়ায় ভর্তি করে দিলেন। এরপর যা কাÐ ঘটলো! চেনা পৃথিবী গেল উল্টে। ভেলুয়া সুন্দরীর নাম ছড়িয়ে গেল সবখানে, সবখানে, সবখানে…]
ফালতু গল্প- ০৪। তালপাতার মুকুট
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্যান্ডেল। স্থানীয় পার্কে স্থানীয় শিল্পীদের দৌড়ঝাঁপ। মঞ্চের পিছনে প্যানাফ্লেক্সের ব্যানার। তাতে ভুল বানানে লেখা-
‘অগ্নিশিকা বহুমুখি সমবায় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও আলোচদা অনুষ্ঠান’
প্রধান অতিথি: জনাব আলহাজ্ব কুতুব শেখ মোড়ল, ডিসি সাহেবের জ্যেষ্ঠ্য শ্যালক
বিশেষ অতিথি: জনাব বাবু ষষ্ঠাঙ্গ রাখো হরি, সমবায় সমিতি’র যুগ্ম সচিবের পিএস
খুচরো অতিথি: জনাবা মহিলা সুন্দরী, বিশিষ্ট রেডিও টিভির এ গেরেড নন-আওতাভুক্ত সঙ্গীতশিল্পী
সভাপতি: বিশিষ্ট বিশেষ জনাব অ. আ. ফ. ম. জেড. হোসেন মুকুট, অগ্নিশিখার বার বার স্বনির্বাচিত আহবায়ক – সভাপতি
বলাবাহুল্য প্যানা পিছলে লেখাগুলো নিম্নগামী হবার আগেই মাইকে ক্যাঁ কুঁ’র আওয়াজ পাওয়া গেল। মুকুট সাহেব যাকে স্থানীয়রা তালপাতা মুকুট নামে চেনে। এই নামের একটা শানে নযুল আছে। কথিত আছে মুকুট সাহেব একবার বুকে ব্যথা নিয়ে এক্স রে করাতে গেলে তার পাঁজরের হাড় ভেদ করে আলোকরশ্মি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে মানে তিনি এতোটাই রোগা অবয়বের অধিকারী যে ডাক্তার স্টেথিকোপ নিয়ে ফুসফুসের উপর ধরাতে হাড়ের বাড়ি লেগে ডাক্তারের যন্ত্রই বিকল। তো এহেন মুকুট এই শহরের বিশিষ্ট সংস্কৃতি সেবক।
মুকুট সাহেবের সাংস্কৃতিক চর্চা পুরনো ঘিয়ের মতো, বাতজ্বরে কাজে লাগে। মানে হেকিমেরা তাই বলেন! লাগাতার সংস্কৃতির কাজকর্ম নিয়ে তিনি আছেন। ট্যাঁকের অবস্থা সঙ্গীন কিন্তু মাথাভর্তি বুদ্ধি নিয়ে দিনমান ডিসি-এডিসি-পুলিশ কমিশনার- বিভাগীয় কমিশনারের অফিস বারান্দায় ঘুরঘুর-ঘুরঘুর-ঘুরঘুর। তাকে আর আলাদা করে ব্যায়াম করতে হয় না। এই হাঁটা হাঁটিতেই বেশ কাজ হয়। ডিসি সাহেব বদলি হয়ে গেলেন তো মকুট সাহেব ফুলের তোড়া নিয়ে ফেয়ারওয়েলে হাজির অথবা নতুন ডিসি শহরে এলেন তো ওয়েলকাম অনুষ্ঠানে আমরা দেখি তিনি ফুলের তোড়া নিয়ে সেখানে হাজির। তা এই জাতীয় সরকারি অফিসের পিয়ন আরদালী সবাই তারে চেনে। সবাই ঠাট্টা করে বলেন- এমপিওভুক্ত শিল্পী।
মুকুট সাহেবের যে কয়টা সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে তা বোধহয় তিনি নিজেও জানেন না। কোথায় তিনি নেই সঙ্গীত-নাটক-কবিতা আবৃত্তি- বির্তক-সাংস্কৃতিক জোট- ভোটের গান- বাদ্যযন্ত্র নিকেতন- আঁবি বুঁকি- ফিল্ম সোসাইটি- চ্যাট ক্লাব! রবীন্দ্র জয়ন্তী- নজরুল প্রয়াণ- কমিশনার সাহেবের কবিতার বইয়ের উদ্বোধনে- তো এমপি সাহেবের বিবাহ বার্ষিকীতে সব জায়গায় তিনি বিরাজমান! মানে এশহরে যদি কেউ নতুন কোনো সাংস্কৃতির দোকান খোলেন, দেখা যাবে আমাদের মুকুট সাহেব সেখানে পিছলে ঢুকে পড়েছেন। এযেন চুম্বকের টান। ইয়াবার নেশা। ঘরের বউ দিনরাত বাজার নেই, বাজার নেই করে হেঁদিয়ে মরে অন্যদিকে মুকুট সাহেব সাংষ্কৃতিক ময়দায় ময়ান দিয়ে চলছেন আর গরম গরম রুটি ভাজচ্ছেন। তবে তার নিজের কালচারাল ইস্কুলে সদস্য মাত্র আড়াইজন। মানে তিনি, তার শ্যালক ও বছর আটেকের ছেলে। এই নিয়েই আঠারো ইঞ্চি বুক ফুলিয়ে তিনি বিশাল পার্কে অনুষ্ঠান ফেঁেদ ফেলেন। আর ডিসি না সই তার সাগরেদ দিয়েই অনুষ্ঠান করে স্থানীয় পত্রিকা লাল করে দেন। ফটোসাংবাদিকের হাতে দু’শো দিলেই কেল্লাফতে!
এহেন মুকুট সাহেবের আজকাল দিন ভালো যাচ্ছে না। সাংস্কৃতিক ব্যবসায় আর টাকা পয়সা তেমন পাওয়া যায় না। নামও নেই। মানুষজন যেহারে ধর্মকর্ম নিয়ে মেতে উঠেছে যে, মুকুট সাহেব ভাবচ্ছেন অন্য লাইনে যাবেন কিনা! ঠিক এই সময়ে স্থানীয় এক এনজিও-র নেতা মুকুট সাহেবের ত্রাণদাতা হিসেবে আর্বিভূত হলেন। তারই কথামতো তিনি ডাইনে বামে লাট্টুর মতো ঘুরে বেড়ান। সেই নেতার অস্থায়ী স্যাটেলাইট হিসেবে মুকুট সাহেবের নিয়োগ হলো, অলিখিত।
এখন দেখি মুকুট সাহেবের গায়ে নিত্য নতুন পাঞ্জাবি আর কাঁধে একখানা শান্তিনিকেতনি ব্যাগ। পকেটে ঝকঝকে ফোর কালারের ভিজিটিং কার্ড। সরকারি আমলারা যখন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে মিটিংয়ে ডাকেন তখন মুকুট সাহেব সেই নেতার ইস্তেহার সাংস্কৃতিককর্মীদের চাওয়া পাওয়ার সাথে এমনভাবে চালিয়ে দেন যেন মনে হয় এগুলো সব সত্যি। চাটুকারিতাকে এমন এক শৈল্পিক উচ্চতায় মুকুট সাহেব নিয়ে গেছেন, যা দেখে স্থানীয় লিটল ম্যাগের খুচরো কবি’র দল মুখ লুকায়। আর রাজনীতি কাম সাংস্কৃতিক কর্মীরা হিংসেয় জ্বলেপুড়ে মরে। জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে মুকুট সাহেবের সদস্যপদ হয়ে যায়। মানে এখন তিনি ট্রেড লাইসেন্সধারী পুরোদস্তর পেশাজীবী শিল্পী। তিনি এখন শিল্পী সাপ্লায়ার। সরকারি যেকোনো অনুষ্ঠানে তা মন্ত্রী- মিনিস্টার বলেন, কি রাস্ট্রপতির আগমণ সবখানেই মুকুট সাহেবের সাপ্লাইকৃত শিল্পীরা নেচে গেয়ে মাত করে দিচ্ছে। তবে মুকুট সাহেবের নীতি আছে আর তা হলো শিল্পীদের সেলামী তিনি পুরোটুকু মেরে দেন না!
আশ্চর্য্যরে বিষয় হলো মুকুট সাহেবের আমাশয় চেপ্টে যাওয়া শরীরে মাংস জমতে শুরু করেছে। তার চেহারায় একটা আলগা জেল্লা হ্যালির ধুমকেতুর মতো উঁকি ঝুকি মারছে। চেহারাটা হোদল কুতকুতের দিকে ক্রমশ: এগিয়ে চলছে। এখন মাঝে মধ্যে তিনিও প্রধান অতিথি হয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে আসন গ্রহণ করছেন। যখন অনুষ্ঠানগুলোতে প্রধান অতিথি হয়ে যান তখন রেন্ট এ কার থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করেন। বলাবাহুল্য বেশিরভাগ অনুষ্ঠানের পূর্বে মুকুট সাহেবকে কিছু টাকাও তাদেরকে দিতে হয়, বক্তব্য দেবার সময় হাততালি দেবার জন্যে! থুথু ছেটানো সহযোগে লালাময়ী বক্তব্য রাখেন মুকুট সাহেব আর তার বক্তব্যের সময় আয়োজনকারী সংগঠনের কর্তা ব্যক্তিরা বাদাম চিবোনো বা ফেসবুক চালাতে অধিক মনোযোগী হতে গিয়ে সময় মতো হাততালি দিতেই ভুলে যান। তবে এইসব সময়ে মুকুট সাহেবের মনের কষ্ট মনেই চেপে রাখতে হয়। হাতে তালির জন্য মাইকে তো আর তাড়া দিতে পারেন না!
ঠিক এই যখন অবস্থা হঠাৎ একদিন অন্য একটি উপশহর থেকে মুকুট সাহেবকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হবার আমন্ত্রণ আসে। এই আমন্ত্রণ আসা মাত্রই তিনি খুশীতে নয়খান হবার যোগাড়! সাথে সাথে ফেসবুকে একটা স্টাটাস দেন। দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেলে আড়ংয়ে গিয়ে বউয়ের পছন্দ করা একটা রংচঙে পাঞ্জাবি কিনে ফেললেন উনত্রিশ’শ টাকায়। যেদিন যাবেন তার আগের রাত্রে তার ঘুম আসে না। বিছানার এপাশ ওপাশ করেন। এমনকী তিনি অবাক হন যে আয়োজনকারী সংগঠন তার কাছে কোনো টাকাও চাই নি।
পরদিন রেন্ট এ কার থেকে চৌদ্দ সিটের একটা এসি মাইক্রোবাস এসে হাজির হয় মুকুট সাহেবের বাড়ির সামনে। তাতে তিনি ফুরফুরে মেজাজে উঠে বসেন। ছেলে মেয়ের পরীক্ষা থাকাতে বউটাও সাথে যেতে পারলো না। এমনকী শ্যালকটাও গ্রামের বাড়ি। অগত্যা মুকুট সাহেব একা একা রওনা হলেন। যেতে যেতে ফেসবুক লাইভে গিয়ে সবাইকে জানাচ্ছেন তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন? লাইক গুনচ্ছেন। এমনকী ড্রাইভারটাকে এক্ট্রা দেঢ়’শ টাকায় রফা করেন কারণ সে পুরো অনুষ্ঠানটা মোবাইলে ভিডিও করবে তাই! ভাবচ্ছেন জীবনটা সত্যিই কতই না সুন্দর! কত কষ্ট তিনি করেছেন এই জায়গায় আসার জন্য। পরিশ্রমের ফল মিঠা হয়। আজ এই মিষ্টি ফল তাড়িয়ে তাড়িয়ে তিনি উপভোগ করবেন।
উপশহরে পৌঁছে দেখেন স্কুল মাঠে বুড়ো-জোয়ান-আবালে কানায় কানায় ভরে গেছে। ব্যানারে ব্যানারে তার নাম জ্বলজ্বল করছে। মাইক্রোটা থামতেই আয়োজনকারীরার দল সব ফুলের মালা দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করে মঞ্চে নিয়ে গেলেন। হাসি হাসি মুখের মুকুট সাহেব তৃপ্তিতে দর্শকের দিকে চোখ বুলালেন।
মাইকে ভেসে আসছে মুকুট সাহেবের জীবনী। তিনি খানিকটা অবাক হলেন কারণ তাকে রবীন্দ্রনাথের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে দিচ্ছে এরা। এমনকী বিপ্লবী-কবি-দুয়ালু-দাতা- সাংস্কৃতির সেবক- নাট্যজন- কবিতা প্রেমিক আরো কতো কী বিশেষণে বিভুষিত করছেন! এবার তিনি খানিকটা লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করছেন। ভাবছেন শালাদের মতলব কী? এতো তেলতো আমিও কোনোদিন মারি নাই। এতো শুধু তেল নয় বাটারওয়েল, ঘি, মাখন সব একাকার– খিচুড়ি!
হঠাৎ মুকুট সাহেবের মাথায় বজ্রপাত মানে সাদা বাংলায় ঠাঠা পড়লো। এ্যাঁ কয় কী? কী কচ্ছে সমুন্ধির পুত? ভালো করে কান খাড়া করে যা শুনলেন, তা তিনি নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারলেন না। মাঠভর্তি মানুষ হাতেতালি দেয়া শুরু করলো। এবার মুকুট সাহেব ঘামতে শুরু করলেন। দরদর করে ঘামচ্ছেন। একবার মাথা ঘুরিয়ে ব্যানারে আয়োজকদের নামটা দেখতে চেষ্টা করলেন, সেখানে লেখা আমরা কয়েকজন। মাইকে অনাবর্ত ভেসে আসেছে তার নাম আর দর্শকের সারি থেকে জয়োধ্বনি। হঠাৎ আবিস্কার করলেন তার হাঁটু ও হাত দু’টোই সমান্তরালভাবে কাঁপছে। মাথাটাও বোধহয় খানিকটা ঘুরছে। হৃদকম্পের আওয়াজ তিনি নিজেই শুনতে পারছেন। কী করবেন? সাহায্যের জন্য ইতিউঁতি তাকালেন কেউ নেই। কালো কালো মাথাগুলো যেন সব দাঁত বের করা হায়েনা। মাইকে ভেসে আসছে উত্তেজিত কন্ঠধ্বনি- মুকুট সাহেব অত্র অঞ্চলের সংস্কৃতি চর্চায় কর্মীরা যেন সারাদেশ দাপিয়ে কাজ করতে পারেন তারজন্য একটা মাইক্রোবাস উপহার দিচ্ছেন। তার মতো মহান মানুষের জন্য আমরা আজ গৌরাবান্বিত। মুকুট সাহেবের মতো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে আমরা কাছে পেয়েছি একী আমাদের কম পাওয়া। তিনি কথা দিয়েছেন সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য মাসে মাসে দশ হাজার করে টাকা আমাদের দেবেন! সুধী দর্শক সবাই হাততালি দেন!! জোরে জোরে হাততালি দিয়ে আকাশ বাতাস ফাটায় দেন!!!