ফগড়হাট ড্রেনের ব্রিজে একটা মানুষ বসে আছে – এই শুনে সকলে দিল ছুট । উপরে তখন আশ্বিনের রোদ । এমনই তেজ , কামারশালায় রেগে লাল হওয়া লোহা প্রাণভরে যাকে আশীর্বাদ করে – এই যে বাবা তুমি যোগ্য উত্তরসুরি হলে !
মানুষটার গলায় মাফলার , সাপের মতো একোবেঁকো ডিজাইন, হাতে সস্তা ব্রেসলেট , বিড়ি ফুকাচ্ছে । কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে গুজব রটিয়ে দিল , মানুষটা বোধহয় লাফ দেবে ব্রিজ থেকে । কে একজন কাছে গিয়ে – নিজে মরা ভালো কাজ নয় জাতীয় কি একটা বলতে গেল কি গেল না , লোকটা বিরক্তমুখে বলল , ‘ রোদ তাপাচ্ছি , মরে যদি যাইও , মরার পরে এ রোদ তো পাবো কিনা এ ব্যাপারে গ্যারান্টি নাই । তাতে কিনা তোমরা ছায়া করে আছো ! ভাগো !…’
সকলে গুজগুজ করে নানান কথা ছড়িয়ে শেষে ক্লাবঘরের এক ষন্ডাকে পাঠালো । এক এক দু মণ বাইসেপস ওর, লোকটাকে কোলে তুলে রেলিং থেকে নামাবে । ষন্ডা কাছে ভিড়তে গিয়ে ছিটকে দৌড়ে এলো – তওবা তওবা , ও শালার হাতে পিস্তল – সকলের পিলে চমকায় , দু একজন আস্তে ধীরে চম্পট দিলো । হুঁ হুঁ কি আর করা – বলে মুরুব্বিরা হাঁটা দেয়, পিস্তলের ঘা খেয়ে চিৎপটাং হবার চেয়ে বাড়ি গিয়ে মাছের ঝোল পেটে চালান দিয়ে শুয়ে থাকা যাক ।
কৌতুহলী লোকের অভাব জগতে কোনোকালে ছিল না । তেমনি দু একজন জান হাতে করে এগিয়ে গিয়ে বলল, এই যে বাপ, খুব তো কেরাদানি দেখাচ্ছো , মতলব টা খোলাসা করো তো দেখি –
লোকটা মাফলার খুলে আনমনে ভাঁজ করে । তখন বোঝা যায়, লোকটার মুখ নিখুঁত জ্যামিতিক – গ্রীক ভাস্কররা এমনই সব দেবতা খোদাই করে গেছে । তাছাড়া , লোকটার চোখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল । ধিকিধিকি জ্বলে যে কাঠ , তার মতো , শান্ত অথচ ভীষণ । তখন একটু সম্ভ্রম জাগে সবার । কেউ কেউ ফিসফাস করে – হুম হুম – না ও মনে হচ্ছে পাগলটাগল নয় – না না দেখো না ঘরছাড়া সাধুদরবেশও তো হতে পারে । কেউ কেউ বলে – আরে রাখো সাধুদরবেশ ! গিরিঙ্গি এ শালা , ধরতে হবে – না না চুপ চুপ , দেখো ও মনে হয় কিছু বলতে চায় – গুন্জন জোরালো হয় ।
কৌতুহলী লোকেরা আরেকটু আগায় । বলে, এইযে সোনাচাঁদ , ঝেড়ে কাশো । লাফ যে তুমি দিবে না সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি – সার্কাসটা করছ কেন পরিষ্কার করে বলো দেখি –
লোকটা মলিন হাসি হাসে । কৌতুহলী লোকদের কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয় । হাসছো কেন বাপ ?
লোকটা ধীরে ধীরে বলল, ‘ আমি তোমাদের তিনটা গল্প শোনাবো । ‘ গাঁয়ের লোকেরা নড়েচড়ে ওঠে । গল্প কে না শুনতে চায় ! লোকটা আয়েশ করে রেলিংয়ের গায়ে হেলান দিয়ে বসে । তারপর বলে,
‘ সে এক দূর অতীতের কথা, এক বনে এক হোগলার ঝোপের উপর একটা সুলুবিন পাখি থাকত । পাখিটা প্রতিদিন শেষ বিকেলে একটা গমের দানা এনে পুঁতে দিত হোগলার ঝাড়ের নরম মাটিতে । দিন যায় – বছর যায় – যুগ যুগান্তর উড়ে গেল – গম আর গজায় না । পাখিটা সব ছাড়ে । একা একা অপেক্ষা করে । তার মন বলে, মাটিতে কোনো সমস্যা ছিল হয়ত । এবার শীত শেষে নতুন পলি এলে গমের সন্তানরা গজাবে । গজায় না । আবার ভাবে , দুবছর খরা ছিল । তাই বুঝি পানি পায় নি । এবার বর্ষায় কচিকাঁচা পাতা এসে ভরাবে মাঠ । ভরায় না । কখনো হঠাৎ মনে হয় , ও সময়টা ছিল নিয়তির ক্রোধে রোগার্ত, আর দুটো সময় পার হোক – তারপরই আসবে দিন – আসে না । বছরগুলো কুয়াশার মতো মিলিয়ে যায় । শেষে আকাশে তাকিয়ে সুলুবিন বলল, দয়াময়, আমার যুগ-যুগ ধরে একটাই গোপন সাধ ছিল – ঘরের নিচে সোনালি গমের ক্ষেত – বাতাস বইত শনশন – সিরসির আওয়াজ উঠত গমের শিষে – আহ্ দয়াময় – তাও বুঝি হলো না !
সুলুবিন পাখি দিনে দিনে দুর্বল হয়ে এলো । বার্ধক্য সমাগত । একদিন তার এক জ্ঞাতিভাই এলো দেখতে । সুলুবিন মনের দুঃখ খুলে বলে । জ্ঞাতিভাই বলল, তুমি কি উরাদুন নদীর তীর থেকে গম কুড়িয়ে আনতে ? সুলুবিন মাথা নাড়ে – জানো কি করে?
জ্ঞাতিভাই বলল, হায় সুলুবিন, ওগুলো ছিল নষ্ট গম ! যুগযুগ ধরে তুমি যা রোপণ করে গেলে, সেগুলো ছিল উরাদুনের নোনা জলে ধোয়া । মৃত আর নিস্পন্দ । ‘
‘ এখন আমি দ্বিতীয় গল্পটা বলি । ‘ গাঁয়ের লোকেরা চুপ করে ছিল । লোকটা বলে চলে ,
‘ এক যাযাবর পথ চলতে চলতে এক বাড়িতে এসে হাজির হলো । বাড়িটা ছোটোখাটো সরাইখানা । রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে সকলে বড়ঘরে আরাম করে বসে । চারপাশ খোলা, বাতাসের চলাচল গা জুড়ায় । যাযাবর দেখলো, সেই রাতের অতিথি মোটে চারজন । বাড়ির মালিক পানের বাটা দিতে দিতে বিনীতভাবে জানতে চাইলেন , কাল সকালে কার গন্তব্য কোথায় । আর কে কতদিনের জন্য সওয়ারী করছে । বাতচিত শুনে যাযাবর বুঝলো , তারা চারজন চার দিকে যাবে । কতদিনের জন্য – এর জবাবে একজন বললো একদিন, একজন এক মাস , আরেকজন এক বছরের জন্য বের হয়েছে । যাযাবরের পালা এলে সে চুপ করে রইলো । মালিক বলল, জনাব, বলতে অসুবিধা আছে ?
যাযাবর সামান্য হাসে । তারপর বলল, না ।
মালিক বলল, তাহলে বলুন না ! কতদিনের জন্য বের হয়েছেন ?
যাযাবর এক মুহূর্ত ভাবে । তারপর বলল, বোধহয় এক জীবনের জন্য ।
মালিক কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । তারপর সবার উদ্দেশ্যে বলে , যেখানেই যাক যতদিনের জন্যই যাক, তারা যেন যাত্রা শেষে একবার এখানে ওঠে । আর একটা অনুরোধ জানালো মালিক । এই যাত্রায় তাদের কাছে সবচেয়ে যা মূল্যবান মনে হবে – তা যেন এসে বলে । মালিক চারজনকে চারটা গুনছাপ কয়েন দেয় – তাদের চিহ্ন ।
পরদিন সকালে যাযাবর চলে গেল । তারপর দিন মাস বছর যুগ – কত বছরের পর বছর যে কোথায় হারিয়ে গেল – যাযাবর সে হিসাব গুলিয়ে ফেলেছে । অবশেষে একদিন যাযাবর হাজির হলো সেই সরাইয়ে । বাড়ির মালিক থুথ্থুরে বুড়ো হয়ে পড়েছে । যাযাবর পকেট থেকে গুনছাপ কয়েন বের করে । মালিকের চোখ স্থির হয়ে যায় । যাযাবর জানতে চায়, সেই তিনজন এসেছিল কি না । মালিক জানায় , এসেছিল । যাযাবরই পৌঁছেছে সবচেয়ে দেরিতে । যাযাবর মাথা নাড়ে । মালিক বলে, তাহলে কী তোমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান লেগেছে ?
যাযাবর বললো, সেই তিনজন কী বলেছে আগে শুনি –
মালিক বাক্সের ভেতর থেকে একটা স্বচ্ছ বয়াম বের করে । বিরাট সাইজ । প্রকান্ড জায়গা প্রায় ফাঁকা পড়ে আছে । মালিক মুকারি খোলে, দুর্বল হাতে ভেতর থেকে বের করে তিনটা কাগজ । বয়ামের ভেতর আর কিছু নাই । যাযাবর হাতে নিয়ে দেখে, তিনটা কাগজে তিন জুটি শব্দ লেখা –
এক দিন – অবসর
এক মাস – গৃহঘর
এক বছর – সময়
মালিক বলে, এই তিনজন – যারা কেউ একদিন ,কেউ এক মাস , কেউ এক বছরের জন্য বেরিয়েছিল , তাদের কাছে মূল্যবান মনে হয়েছে এই তিনটে জিনিস । এবার বলো, তোমার কাছে কী মূল্যবান মনে হয়েছে ?
যাযাবর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিছু না । কিছু না । শূন্য ।
মালিকের চোখে গাঢ় আনন্দের ছায়া পড়ে । বলে,আমি জানতাম । আমি ঠিক ঠিক জানতাম ।
যাযাবর তাকিয়ে থাকে । মালিক বলে, তিনটে কাগজ আমি কীসে রেখেছি খেয়াল করেছো ? যাযাবর বয়ামের দিকে তাকায় একবার । মালিক বলে চলে, এই বয়ামে রেখেছি , কারণ আমি তোমার উত্তর জানতাম যাযাবর । তাই কাগজ তিনটাকে রেখেছি এই শূন্য বয়ামে । মূল্যবান সবকিছুকে ঘিরে আছে শুন্যতা । শুন্যতাতেই ওদের বাস । ‘
লোকটা বলে,’এবার আমি তৃতীয় গল্পটা বলব ।’
লোকেরা বিহ্বল হয়ে বসে ছিল । লোকটা বলে, ‘ গল্পটা সহজ । ‘ লোকেরা উৎসুক মুখে তাকিয়ে রইলো । লোকটা বলল, ‘ তাহলে শোনো, গল্পটা এই যে – ‘
লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে । কি যেন শোনে বাতাসে । তারপর হঠাৎ হাঁটা দেয় । গাঁয়ের লোকেরা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, কোথায় চললে ?
লোকটা যেতে যেতে মৃদুস্বরে জবাব দেয়, ‘ সুলুবিন পাখি আর যাযাবর যেখানে গেছে । ‘
আর তৃতীয় গল্পটা ?
‘ সেটা এইযে শেষ হল ।’