কলিজা

এত ডাংগর হওয়ার পরেও সোনালীর এই এক অভ্যাস। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কিসস্যা শোনা তার চাই-ই চাই।কপট রাগ দেখালেও রাতের বেলা ঘুমাতে যাবার আগে মা ঠিকই সোনালীকে গল্প শোনায়। কত রকম যে গল্প! রাজা রানী, বনের পশু-পাখি থেকে শুরু করে নবী-রাসুলদের গল্প। তবে সোনালীর সবচেয়ে অদ্ভুত লাগে ঐ গল্পটা। তাই বারবার মায়ের কাছে আবদার ধরে, মা, আবার হেই কিসস্যা কও না!
–কুনডা?

–হুই যে, মাইয়াডা কইলো , তুমি যদি সত্যি আমারে ভালাবাসো তাইলে তুমার মায়ের কলিজাডা কাইট্যা লইয়া আহো, হেই কিসস্যাডা।

–এক কিসস্যা আর কত শুনবি তুই?

-কও না, মা!

— আইজকা আর পারুম না।ঘুমা অহন।

–মা, কী আচানক না কিসস্যা, না? পোলাডা মাইয়াডারে কত ভালাবাসতো, হেই লিগা মায়ের কলিজাডাও কেমুন কাইট্যা লইয়া আইসে।

–তার চেয়েও তুই দ্যাখ, পোলাডারে বেশি ভালাবাসতো তার মায়ে।কেমন নিজের কলিজা কাইট্যা দিয়া দিলো। আবার পোলায় রাস্তায় পইড়া গিয়া দু;ক্কু পাইলেও মায়ে ঠিকই আইয়া জিগাইছে, দু;ক্কু পাইসো? বহুত কিসস্যা অইসে, অহন ঘুমা। আর একটা কথাও না।সোনালী ঘুমিয়ে পড়ে ঠিকই, কিন্তু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে আকাশ পাতাল ভাবে। ক্যামন মাইয়া, কয় মায়ের কলিজা কাইট্যা লইয়া আইতে। আমি যদি কুনোদিন কাউরে ভালাবাসি তাইলে নিজের কলিজা কাইট্যা তারে দিয়া দিমু, এত ভালাবাসমু। ভালবাসার কথা কল্পণা করেই সোনালীর লজ্জা লাগে। লজ্জায় লাল হয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে।

বেশ কয়েক রাত সোনালীকে রাত পার করতে হচ্ছে, মায়ের মুখে কোন কিসস্যা না শুনেই। মা খুব অসুস্থ। হাসপাতালের বেডে কখনো অর্ধচেতন, কখনো অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকে।মা হয়ত আর বাঁচবে না, সোনালী বুঝে গেছে। কিন্তু তবুও হঠাৎ হঠাৎ নিজেকে খুব অসহায় লাগে।মা মরে গেলে সোনালীর আর কেউই থাকবে না। হাসপাতালে যতদিন আছে, বড় চাচা আর চাচীরা অবশ্য অনেক সাহায্য করছে। সকাল- দুপুর-রাত তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে ঐ চাচা-চাচীরা।সব সময় খোঁজখবরও রাখছে। এজন্য সোনালী কৃতজ্ঞ।দুপুরের খাবার চাচার বাসা থেকে আনার সময় হয়ে গিয়েছে। হাসপাতাল থেকে খুব কাছেই বাসা। সোনালী তাই চাচার বাসায় যাবার জন্য দ্রুত পা চালায় লিফটের দিকে।

লিফটের বোতাম চাপতেই খুলে যায়। ভেতরে লিফটম্যান ছাড়া আর কেউ নেই।সোনালীকে দেখে লিফটম্যান গান গেয়ে উঠে, ‘’আমি তোমার মনের ভেতর একবার ঘুরে আসতে চাই, আমায় কতটা ভালবাসো সেই কথাটা জানতে চাই!’’ লিফটম্যান সোনালীর দিকে ইংগিতপূর্ণ চোখে তাকায়। লিফটের ভেতর একা একা সোনালীকে ভয় ভয় একটা চাপা অস্বস্তি ঘিরে ধরে। হঠাৎ সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে লিফট অন্ধকার হয়ে বন্ধ হয়ে যায়।

–কী অইলো?( সোনালীর কণ্ঠে রীতিমত ভয় ঝরে পড়ে।)

–আরে, তেমুন কিছু না। কারেন্ট গেছে গা।

–তাইলে অহন লিফট চলবো কেমনে?

–চলবো না!

–কারেন্ট না আইলে লিফটও চলবো না?

–হা হা হা। না, চলতো না। তুমি মনে অয় ডরাইতাছো। ডরাইও না। হাসপাতালে কার অসুখ?

–আমার মায়ের।

–নাম কী তুমার?

–সোনালী

–খুবই সুন্দর নাম।সোনালী, তুমারে আমার খুবই ভালা লাগছে।

সোনালীর খুব লজ্জা লাগতে শুরু করে।এই কথার উত্তরে কী বলতে হবে সে তা জানে না। তাই চুপ করে থাকে।

লিফটম্যান কথা বলতেই থাকে, কী অইলো সোনালী, কথা কও না ক্যান? তুমি এহন থিকা প্রতিদিন এই লিফট দিয়াই আওয়া যাওয়া করবা। ঠিক আছে?
সোনালী মাথা নাড়ে, ঠিক আছে। লিফটম্যানকে প্রথমে ভয় লাগলেও এখন ভয় কেটে যাচ্ছে। এমন কি ভালোও লাগতে শুরু করেছে।
লিফটম্যান বলে, তুমি দেহি মাইয়া, কথাই কও না। কথা কইতে জানো, না কি জানো না?

–জানি।

–তাইলে কথা কও না ক্যান?

–আপনার নাম কী?

–অহহহ, হাহাহা, এই কথা? আমার নাম শিপন।

হঠাৎ মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে লিফট চলতে থাকে।

কারেন্ট আইয়া পড়ছে!
সোনালী গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে নেমে যায়। চাচার বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে আবার পা বাড়ায় হাসপাতালের লিফটের দিকে। লিফটের বোতাম চাপে, লিফট এখন আছে ১২ তলায়। সোনালী গুনতে থাকে, ১১, ১০… ২,১,০ আর তারপর শিপনসহ লিফটের দরজা খুলে যায়। শিপনের সাথে চোখে চোখে হাসি বিনিময় হয়, লিফটে ওঠে সোনালী।লিফটের দরজা বন্ধ হতেই শিপন সোনালীকে জড়িয়ে ধরে। সোনালী ভীষণ অবাক হয়ে যায়, ‘’আরে, আরে, আপনি এইডা কী করতাছেন? ছাড়েন, ছাড়েন!

–না,না, ছাড়ুম না! আমি তোমার মনের ভেতর একবার ঘুরে আসতে চাই…।শিপন গায় গেয়ে ওঠে। সোনালীকে চুমু খায়। সোনালী নিজেকে শিপনের হাত থেকে ছাড়াতে পারে না। শিপন সোনালীর গায়ের জামা কাপড় খুলতে থাকে।

–এইডা আপনি কী করলেন?

সোনালী কেঁদে ফেলে।আর শিপন হাসতে থাকে।

–আরে মাইয়া, আমি তোমারে ভালাবাসি।আর বাসি দেইখাই তোমারে আমার ছাড়তে ইচ্ছা করে না। মনে চায় আমার কলিজার ভিতরে লুকাইয়া রাখি তোমারে।সোনালী তুমি আমারে ভুল বুইঝ না।

শিপন সোনালীকে জড়িয়ে ধরে রাখে। শিপনের বুকে লুকিয়ে সোনালী ভাবে, নাহ, শিপনকে সে ভুল বুঝবে না। সেও শিপনকে ভালবাসবে, অনেক ভালবাসবে। নিজের কলিজাও সে শিপনের জন্য কেটে দিতে পারবে।কিন্তু এখন তো মায়ের জন্য খাবার নিয়ে যেতে হবে, খালি ভালবাসাবাসি করলেই চলবে না।শিপন সোনালীকে যেতে দিতে চায় না। কিন্তু যেতে দিতে তো হবেই। কিন্তু তার আগে সোনালীর কাছ থেকে কথা আদায় করে নেয়, আগামীকাল এবং প্রতিদিন সে শিপনের লিফটে এসে দেখা করবে। নাহলে শিপন বাঁচবে না!এরপর থেকে শিপনের সাথে প্রতিদিন লিফটে দেখা হয় সোনালীর। শিপনের যেমন সোনালীর জন্য কলিজা পোড়ে, তেমনি সোনালীরও।শিপনের জন্য সোনালীর প্রেম আরো গাঢ় হতে থাকে। কিন্তু সুখ কপালে বেশিদিন সইলো না। সোনালীর মা একদিন চুপচাপ মরে গেল।সোনালী অনেক কেঁদেছিল, তাতে কি! কাঁদলে কি আর মরা মানুষ ফিরে আসে? সোনালীর বড় চাচা-চাচীরা সত্যিই ভাল মানুষ। সোনালীকে আশ্রয় দিলেন তারাই। মায়ের মৃত্যুর পর কয়টা দিন এত ঝামেলার মধ্যে গেল যে শিপনের কথা তার মনেই পড়ে নি। ঝামেলা একটু কমলে, সোনালীর বুকের ভেতরটা কে যেন চেপে ধরলো, ওহ! শিপন, তুমার কথা আমি কেমনে ভুইল্যা গেলাম। আমি একটা পাষানী।সোনালী আর দেরি করে না, শিপনের সাথে দেখা করার জন্য তখনই রওনা দেয় হাসপাতালের দিকে।সেই লিফটে গিয়ে বোতাম চাপে। কিছুক্ষণের ভেতর লিফট আসে, খুলে যায় দরজা। কিন্তু শিপন নেই, আজ অন্য লিফটম্যান।সোনালীর কলিজা ফেটে যায় দু;খে, শিপন কই?
হাসপাতালের সব লিফট, ক্যান্টিন আর ওয়ার্ডগুলো সে উদ্ভ্রান্তের মত ছুটতে থাকে। একসময় সে শিপনের দেখা ঠিকই পায়।শিপন একটা অল্প বয়সী মেয়ের সাথে বাগানে একটা গাছের আড়ালে খুব হেসে হেসে গল্প করছে।সোনালীর মনে হয়, তার কলিজাতে কেউ ছুরি চালাচ্ছে।সে দূর থেকে চুপচাপ সবকিছু দেখতে থাকে। মেয়েটি চলে গেলে সে শিপনের পিছু নেয়। শিপন কিছুই টের পায় না। আরেকটু দূরে গিয়ে শিপন ভাব জমায় আরেক মেয়ের সাথে। সোনালী আস্তে আস্তে শিপন আর ঐ মেয়ের থেকে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়। এখান থেকে দুজনের কথা সোনালী কিছু কিছু শুনতে পাচ্ছে। শিপন ঐ মেয়েটিকে গান শোনাচ্ছে, আমি তোমার মনের ভেতর একবার ঘুরে আসতে চাই… গান শুনে মেয়েটি হিহি করে হাসে। সোনালীর সব কিছু অসহ্য লাগে। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, শিপন তাকে ছাড়াও অন্য কোন মেয়েকে ভালবাসতে পারে! তাকে ছাড়াও অন্য কোন মেয়েকে ঐ গান শোনাতে পারে! সোনালীর জেদ উঠে যায়, সে শিপনের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়।‘’জিজ্ঞেস করে চিনতে পারতাছেন? নাকি এই কয়দিনে ভুইল্যা গেছেন?’’
সোনালীকে হঠাৎ দেখে শিপন একটু চমকে উঠে। কিন্তু সামলে নেয়। আর শিপনের সাথে থাকা মেয়েটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শিপন সোনালীকে বলে, আপনে ক্যাডা? আপনারে চিনি না। কুনো ভুল করতাছেন আপনি!

–আমি ভুল করতাছি? আমি?

শিপনের সাথে থাকা মেয়েটাও এবার মুখ খোলে, কী হইতাসে এইগুলান?
শিপন বলে, আরে, আমি এই মাইয়ারে চিনি না। দুনিয়াডা ভইরা যেন বাটপারিতে। কোন বাটপারি করতে আইসে কে জানে? এই মাইয়া, সর এইহান থিকা। যাইবা তুমি?
সোনালী আর দাঁড়ায় না সেখানে। গটগট করে চলে আসে চাচার বাড়িতে, নিজের ঘরে গিয়ে বালিশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদে। শিপন! শিপনরে, তোর কত বড় কলিজা, যে তুই আমার সাথে এমন করতে পারলি! আমিও তোর কলিজাটা দেখুম, কত বড় কলিজা তোর!

শিপনের সাথে দেখা করাটা সোনালীর জন্য বেশ কঠিনই ছিল। শিপন কিছুতেই সোনালীর সাথে দেখা করবেই না। আর সোনালী শিপনের সাথে দেখা করেই ছাড়বে। অবশেষে শিপন রাজি হয় দেখা করতে, তবে হাসপাতালে তারা দেখা করবে না। একটা পার্কে গিয়ে দেখা করবে।কথা মত পার্কের সবচেয়ে নির্জন জায়গাটাতে দুজনে দেখা করে। শিপন বেশ গম্ভীর।
–কী কইবা কও তাড়াতাড়ি।

–এত তাড়াহুড়া কিয়ের। অনেক কথা আছে তুমার সাথে। তার আগে আসো, দুজনে মিলা এই কোক খাই।

–কোক-মোক খাইতে পারুম না। কী কথা কইতে আইসো কও।

–শিপন, তুমি আমার উপর রাগ কইরো না। আমি তুমার উপর আর কুন দাবি রাখুম না। তাই আজই শেষবারের মত তুমার সাথে দেখা করতে আইলাম। তুমি কোক খাইতে পছন্দ কর, তাই আমি অনেক শখ কইরা এই কোক কিনছি। তুমি খাইবা না? সোনালীর চোখে জল দেখে শিপনও একটু দূর্বল হয়ে পড়ে।

–আইচ্ছা, দাও তোমার কোক।শিপন কোক খায়। সোনালী অপেক্ষা করতে থাকে শিপন কখন ঢলে পড়বে। ঘুমের ওষুধ মেশানো থাকায় অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শিপন তার হুঁশ হারায়।

সোনালী তার ব্যাগের ভেতর থেকে ধারালো ছুরিটা বের করে। শিপনের গলা কেটে দেয় এক পোঁচে। ক্ষত বিক্ষত করে দেয় শিপনের দেহটাকে। তারপর ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে আনে শিপনের হৃদপিণ্ড আর কলিজাটা। শিপনের কলিজাটা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে সোনালী। এইডা আমার কলিজা শিপন, তুমারে দিসিলাম। তুমি রাখতে পারলা না। আমি আইজ এইটা ফেরত নিতে আসছিলাম। আর এইডাও দেখতে চাইছিলাম, তোমার কত কলিজা কত বড় হইলে আমার সাথে এমন করতে পারো!

আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সোনালী তার মৃত্যুদণ্ডের রায়টা চুপচাপ শুনলো। হ্যাঁ, এতদিন শিপনকে ছাড়া সোনালীর ভাল ঘুম হত না। আজ থেকে সোনালীর খুব ভালো ঘুম হবে। তাই তার মুখে হালকা একটু হাসির রেখা ফুটে উঠে। ব্যস্ত আদালতে কেউ তা দেখতে পায় না।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত