জৈষ্ঠ্যের এক আগুন গরম রাতে ধারাল রামদা হাতে জয়নু হঠাৎ বুঝতে পারে এই গল্পের কোন শেষ নেই। এবং শুরুর অংশ থেকে সে স্রেফ ভাগ্যের ফেরে বঞ্চিত। এই চির মধ্যবর্তী গল্প – এর শেষহীন শুরু এবং শুরুহীন শেষের মাঝে সে ত্রিশ বছর নিরুপায় আটকা পড়ে আছে। এই রাত পূর্নিমার, এক মারাত্মক গোলাকৃতি চাঁদ পুরো আকাশের দায়িত্ব নিয়েছে আর মহামারির মত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে বেমানান স্নিগ্ধতা নিয়ে। যেন ব্যাপক ব্রক্ষ্মান্ডের এই শেষতম চাঁদ, আর উঠবেনা- অস্তিত্বের বাকি যাত্রাটুকু অমাবস্যায় ভর দিয়ে যেতে হবে মানুষের, না-মানুষের।
জয়নুর মনে পড়ে এমনই এক কালান্তক জোছনা, ত্রিশ বৎসর আগে, তার বেবাক কিছু হরণ করেছিল। জোছনার প্লাবন দেখে তার মেয়ে বিন্তি, দুই শুক্ল পক্ষ পরে যার পাঁচ বছর হওয়ার কথা আর বিন্তির মা মালা; যে সময়ে উঠোনে থাকার কথা নয়, সেই নিয়তি নির্ধারিত মারাত্মক অসময়ে, বিন্তির জেদের জোরেই একরকম বাধ্য হয়ে নেমে এসেছিলেন। জয়নুর মা, আকলিমা বুড়ি, নিজের কোন দাঁত নেই, প্রায়ই খেলাচ্ছলে বিন্তির ফোঁকলা, আধ হলদে অবিন্যস্ত দাঁত নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতেন, বলতেন, বিন্তিরে চান্দের আলো কাঁচা চিবাইয়ে খাইলে তোরও দুধের লান সাদা সাদা দাঁত অইবো। বিন্তি বলতো, দাদী তাইলে তুই খাস না ক্যা? তোর তো কুনো দাঁত নাই। আকলিমা বুড়ি হেসে কুটি কুটি হতেন।
ত্রিশ বছর আগের ওই রাত্রে, সেই দুধসম দাঁতের লোভে দুরন্ত বিন্তি কাঁচা জোছনা চিবিয়ে খাবে বলে পুরো উঠোনের একোন ওকোন জুড়ে অধরা চাঁদের দিকে মুখ হা করে দৌড়ে বেরাচ্ছিল, পেছনে মালাও। নিশুত রাতে মা মেয়ের এই আহলাদি দাপাদাপি এক সার্থক স্বপ্নদৃশ্যের অংশ হতে পারত যা আচমকাই দুঃস্বপ্নে মোড় নেয় যখন বিন্তি বেখেয়ালে এক অপেক্ষারত কেউটের লেজে পা দেয়। ঠিক ওই মুহূর্ত থেকে এই শেষহীন গল্পের শুরু, মেয়ের পিছু ছুটতে ছুটতে মালা যখন বিপদ টের পেলেন তখন ঢের দেরী হয়ে গেছে, কেউটে বিন্তিকে ছেড়ে মালার উদোম পায়ের তালুতে ততক্ষণে ঢেলে দিয়েছে মরণবিষ। বিন্তি, কোন শুক্ল পক্ষেই যার বয়স আর পাঁচ হবেনা, একরত্তি দাঁতের শিশুসুলভ বায়নায় আরেক জোড়া বিষদাঁতের সাথে এইভাবে তার জীবন বিনিময় করেছিল….
জয়নু পাশের গ্রামের যাত্রাপালা শেষে কেরামত মাঝির সাথে দু দশ গল্প, তামাকের নেশা করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে যার দেরি হয় (গুরুত্বের বিবেচনায় এই ক্ষনিকের দেরি জয়নুকে পরবর্তী ত্রিশ বছর প্রতি পূর্ণিমায় এক সময়নিষ্ঠ নিশাচররুপে গড়ে দেয়), ফিরে দেখে সব শ্যাষ। সেই ফকফকা রাত্তিরে কাল কেউটের মরণ কামড়ে তার বিন্তি আর মালা যখন মুখ দিয়ে ফেনা উঠে শেষটা জানান দিল, বিশেষত্বহীন এবং দংশনে আপাত নীলাভ তাদের মুখ বেয়ে অনর্গল ফেনার ফোয়ারা যখন উঠোন ভিজিয়ে দেয় – জয়নু সংশয়ে ভুগে, তার মনে হয় ফেনা নয় বরং জোছনার কোন তরলরুপ নিয়তির মত মুখ বেয়ে গড়িয়ে এই অভিশপ্ত রাত্রির ষোলকলা পূরণ করছে।
পরদিন ভোরে পুরো গ্রাম ভেঙে পড়ে জয়নুর ফেনা ভরা উঠোনে। প্রলাপগ্রস্ত আকলিমার মাতমের মাঝেও গ্রামের লোকেরা জয়নুর মাঝে এমন কোন বাড়াবাড়ি শোকের প্রকাশ দেখে নাই, কেবল দু পা ছাড়িয়ে বিন্তি আর মালার নিস্প্রাণ মাথা দুই উরুর উপর রেখে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে খুনি চাঁদের শাপান্ত করছিল অনুচ্চস্বরে। এমনকি কবরে নামানোর সময়ও লোকেরা হাহুতাশ কান্নার বদলে এক নিস্পৃহ জয়নুকেই দেখেছিল, সে বিড় বিড় করে বলেছিল, ভালা থাকিস মা, অরে দেইখা রাখিস বউ – আমিও শিগগির আইতাছি, এইবার দেরি অইবোনা।
তবুও জয়নুর দেরি হয়ে যায়, ত্রিশ বছর…
আর বৃদ্ধা আকলিমা ওই কালরাত্রির পরে যে বাকি দু বছর বেঁচে ছিলেন, নিতান্তই বেঁচে থাকতে হয় বলে, এক লাগাতার মোহগ্রস্ততার মেঠোপথ বেয়ে লাঠি হাতে সারা গ্রাম ফোকলা মুখে আউড়ে বেড়াতেন, বিন্তিরে, তর কয়ডা দাঁত লাগবো, আমার মুখের তুন সব তুইলা নিয়া যা। মালারে, তুই ক্যান মায়াডারে থামাইলি না, নিশি চান্দের মরণের ডাক তুইও বুঝোস নাই? হারামীর পুত জয়নুল্লা, তামুকের নেশায় তুই বেবাকডিরে ভুইলা গেলি বাপ? শোনা যায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিদিন আকলিমা বুড়ি তার অদৃশ্য সব দাঁত খুলে মৃত নাতনীকে এইভাবে দান করে যেতেন।
পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে ক্রমে বোঝা যায়, সেই দিন কিংবা স্পষ্ট করে বললে সেই রাত থেকেই পূর্নিমা, এক ফণা উঠা কেউটের জান্তব জিঘাংসা সমেত জয়নুকে ঘিরে রাখে। সে ভীতু নয়। সাতপুরুষের পেশায় ক্ষেতমজুর, পোড় খাওয়া, দারিদ্র্য আর মাটির ক্রমশঃ কর্ষণ তার ভেতরে এক ক্ষ্যাপাটে বলিষ্ঠতার বীজ কবেই পোক্ত করে দিয়েছে। হারানোর শোক, প্রতিশোধস্পৃহা কিংবা নিতান্তই নিয়তির দায় মেটানোর তাগিদে ধারাল রাম দা সমেত সে বের হবে প্রতি পূর্ণিমার রাতে, নিষ্ঠার সাথে পরবর্তী ত্রিশ বছর ধরে।
জয়নুর মাথায় আসেনা কোন কেউটেরই ত্রিশ বছর বাঁচার কথা নয়, তার জানা নেই অথবা না জানার এই জ্ঞানশূন্যতাই কালে কালে জয়নুদের এমন বাঁকে দাঁড় করায় যেখানে, ভালোবাসা আর প্রতিশোধ; একে অন্যের পরিপূরক চিহ্নের মত জীবনের বাকি পথটুকুর দিকনির্দেশ করে দেয়।
কিংবা সে কিছুটা বুঝেও; তবুও মানুষের যে চিরন্তন ছেলেমানুষী তাকে অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক করে রাখে, তারই হাস্যকর কিন্তু গ্রাম্য একরোখা জের ধরে জয়নুর স্থির বিশ্বাস, এই কেউটে কেবল তার হাতে মরবে বলেই বিন্তি মালাকে মেরেছিল আর এই কালান্তক নাগ এ জমিনের কোন সৃষ্টি নয়, হারামজাদা পূর্ণ স্ফিত চাঁদের সাথে এই সরিসৃপের কোন ব্যাখ্যাতীত যোগ আছে; সময়, পদার্থ এবং স্থানসূত্রের কোন ফোঁকর গলে চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে সে প্রতি পূর্ণিমায় পৃথিবীর বুকে নেমে আসে, আর কোন জয়নুর বুক খালি করবে বলে। তাই রামদা হাতে জয়নুর ত্রিশ বছরের প্রস্তুতি, এই রাইত ঘুমানোর নয়।
জৈষ্ঠ্যের এই আগুন গরম পূর্নিমা রাতে, জড় ও জীবিতের মধ্যকার সব পৃষ্ঠতল কেমন সাদাটে, সংশয়ী দেখায় আর জয়নুর উঠোন হয়ে উঠে এক প্রবল প্রেক্ষাগৃহ; ত্রিশ বছর ধরে শুরুহীন শেষটার মঞ্চায়ন করছে। উঠোনের মাঝ বরাবর যেখানটায় জয়নু আজো দিখন্ডিত ফেনার দাগ দেখতে পায়, আর ডাইনেরডা বিন্তি, বামেরডা বিন্তির মা বলে শনাক্ত করতে পারে, সেইখানটায় বসে উদাস মুখে
শুকনো তামাক চাবায় আর আকাশের দিকে তাকিয়ে খেদোক্তি আউড়ায়, “মর মর, এত কুড়ি বয়স হইলো, তোর মরণ নাই চান্দের বুড়ি? তুই মরস না মরস, বিন্তির কসম, যাইবার আগে তর পোষা কেউটেরে আমি সাথ নিয়া মরুম।”
ঠিক তখনি জয়নু দেখতে পায়, উঠোনের পুব কোণে এক গর্ত আপনাআপনি বড় হচ্ছে, ভেতর থেকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে সেই অবশ্যম্ভাবী ফণা যার অপেক্ষায় এতোকাল। আকাশের দিকে তাকিয়ে আরো দেখতে পায় কেউটের লেজের একাংশ তখনো চাঁদের বুকে, এই চুড়ান্ত পূর্ণিমা তাকে ধীরলয়ে পৃথিবীর দিকে টেনে আনছে।
আমি আইতাছি বিন্তির মা, বলে জয়নু প্রস্তুত হয়। এই অপার্থিব চদ্রালোকে ধারাল রামদা খানি এক অব্যর্থ ব্রহ্মাস্ত্র বলে ভ্রম হয় আর জয়নুকে পৌরাণিক অসুর – অনন্ত নাগ বধ করে তবেই ক্ষান্ত হবে।