ক)
আপনি বড় হবেন আর আপনার মা-বাবা বয়স্ক হতে থাকবেন। দেশের উৎপাদন ব্যাবস্থা উন্মূল হওয়ার কারণে ও আপনার মনোজগৎ শহুরে হয়ে যাওয়ার কারণে কিংবা ছেলেমেয়ে মানুষ করার যৌক্তিক কারণবশত আপনি হয়ে যাবেন এলাকা ছাড়া। এভাবে দিন চলে যেতে যেতে আপনি ফোন পাবেন সকালে যদিও ঘটনাটি ঘটবে রাত্রে, আপনার ঘুমের ব্যাঘাত না করানোর জন্য তাছাড়া এতো রাত্রিতে আপনি যেতেও পারবেননা। আপনাকে ফোন করবে আপনার উকিল ভাই অথবা এলাকার কোন দুষ্টু ছেলেটি। যে মানুষ হতে না পেরে গ্রামেই থেকে গেছে।
আপনি যাকে নিয়ে কখনো ভাবেননি সেই ক্ষেপা ফরহাদ রাতভর হাসপাতালে আপনার বাবাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবে। এরপর নির্ভরযোগ্য কোন শিক্ষিত বুঝদার মানুষের কাছ থেকে আপনি খবরটি নিতে চাইবেন। মা এর কান্নাকাটিতে অবস্থা সম্পর্কে আপনি কিছুই বুঝতে পারবেননা। তখন আরমান দুলাভাই ফোনে বলবে -“তোর আসা উচিৎ বলেই মনে হয়।”
আপনি সময়মত পৌঁছাত পারেন অথবা নাও পারেন। যদি পারেন তবে আপনার বাবার মৃত্যু দেখার সৌভাগ্য হবে ভালোভাবে বললে বলা যায় যে – আপনি আপনার বাবার শেষ সময়ে পাশে থাকলেন।
যেহেতু আপনার বাবার ডায়াবেটিস ও হাইপ্রেশার ছিলো আর কোন এক্সিডেন্ট ঘটেনি তাই আপনার বাবার বিভিন্ন অর্গানগুলো ক্রমশ ক্ষয় হতে হতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবেন।
আপনাকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। আপনি চাইলে “জানাজার নামাজ” শিখে রাখতে পারেন। যেহেতু ঢাকায় মৃত্যুুর অনুষ্ঠানে যাওয়ার তেমন সুযোগ হয়না। আর হলেও চক্ষুলজ্জার খাতিরে যেতে হয় তাই জানাজার নামাজটা আপনি বারবার ভুলে যাবেন। এক্ষেত্রে আমার একটা গলদ বিশ্বাস জন্মেছিলো যে আমি যেদিন জানাজার নামাজ আয়ত্ব করবো সেদিন আমার বাবা মারা যাবেন। তাই ছোটবেলায় গৃহশিক্ষক হাফেজ মামুন হুজুর জানাজা শেখালেও আমি যথারীতি ভুলে আছি। আর শেখার চেষ্টাও করিনা।
আসল প্রসঙ্গে আসি, তো আপনার অপেক্ষায় পুরো পরিবার আপনার পথ চেয়ে থাকবে। আপনি বড় ছেলে আপনার সিদ্ধান্তের জন্য। যদি বাবা মারা গিয়ে থাকেন তাহলে তো কথাই নেই। আর মারা না গিয়ে থাকলে আপনার বাবা হয়তো বারবার আপনার কথা জিজ্ঞেস করতে থাকবেন।
রায়হান কতদূর? ফোন দিছিলা?
বাড়িতে লোকজন ভরে যাবে। দূরদূরান্ত হতে শুভাকাঙ্ক্ষী, আত্মীয়-স্বজন আসবে নানারকম ফলমূল আর মাছ-মাংশ রান্না করে। আপনার বাবার জন্য। আপনার বাবা এসব খাওয়ার উপযোগী নন তখন।
বাড়িতে পৌঁছালে আপনার বাবা খুশিতে টলোমলো হয়ে উঠবেন। তখন এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হবে। আপনার মন চাইবে আপনি আপনার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদেন। কিন্তু উপস্থিত লোকজনের কারণে তা আর হয়ে উঠবেনা। কেননা আপনি বড় হয়ে গেছেন ততদিনে। আপনি আর বাবার কোলে উঠার মতো নন। সকলে কান্নাকাটি করলেও আপনাকে শক্ত থাকতে হবে। কেননা আপনি বড়! বেশ বড়।
খ)
আব্বা মুখে খেতে পারছেননা। সদর হাসপাতাল থেকে বুলু মামার বন্ধু পাইপ লাগিয়ে দিয়ে গেলেন। ব্লেন্ড করে খাওয়ানো হচ্ছে। অভিমান ছুড়ে বড় আব্বাতো মাহবুব ভাইয়ের বউ ভাবী এলেন এবং রাত জাগলেন। আমরা অল্টারনেট করে রাত জাগছি। বউ রান্নাবান্নার কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। মা আত্মীয়-স্বজন সামলাচ্ছেন। আমি, আপা আর সদ্য বিবাহিত ছোট ভাইয়ের বউ মৌরিন মিলে আব্বার সেবাযত্ন করছি।
স্থানীয় ডাক্তার দিয়ে কাজ না হওয়ায় ফোনকলে বিভিন্ন ডাক্তারবৃন্দের পরামর্শ নিচ্ছি।
বাড়িতে লোকসমাগম বাড়তেই আছে। কোবিড নিয়ে কারও কোন উদ্বিগ্নতা নেই। কেউ কেউ দেখি আব্বার কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছে। বিষয়টি মেনে নেওয়ার মতো না। যেন আব্বা মারা যাচ্ছেন। মনে চায় এই লোকদের ধমক মারি। এতে করে তো আব্বা আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে না কী? কিন্তু অতিথি হওয়ায় তাঁদের কিছু বলা যাচ্ছেনা। রোগীর বাড়িতে এ এক সমস্যা অতিথিদের আপ্যায়ন, রাতে থাকার জায়গা, তাঁদের রান্নাবান্না অপরদিকে রোগীর সেবা, টাকার ব্যাবস্থা কোনটাই বাদ দেওয়া যায়না। ঝাঁকে ঝাঁকে লোক আসতেই আছে। তবে এর মাঝেও খেয়াল হয় কেউ কেউ আসছে না। এমন সময় অপ্রত্যাশিত সহযোগিতা যেমন পাওয়া যায়, তেমন অসহযোগিতাও।
এভাবে কয়েকদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর হঠাৎ একদিন শ্বাসকষ্ট! বাসেদ আর রুনু মামা মিলে ট্যাক্স অফিসার রুবেল হাসান সাহেবের বাসা হতে অক্সিজেন নেবুলাইজার আনা হলো। রুবেল হাসান দয়ালু মানুষ। বলতেই না করেননি।
সদর হাসপাতালে চিকিৎসা বলতে কিছু নেই। আইসিইউ তো দূর কী বাত!
ভর্তি করানো হলো প্রথমে মেডিসিন বিভাগে। ডাঃ সায়েম পরিচিত সজ্জন মানুষ। তিনি সবকিছু দেখভাল করছেন। তাঁর বাসা থেকেই খাবার আসছে নিয়মিত।
আব্বার পাশের বেডে এক প্রতিবন্ধী কিশোর ভর্তি হলো। রাতে তীব্রতর হলো শ্বাসকষ্ট। বেচারার খুব কষ্ট হচ্ছে। জোড়ে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তাঁর বাবা রংপুর মেডিকেলে নিবেন সকালে এমন সিদ্ধান্ত হলো। হাসপাতালে এলে রোগী আর রোগীর এটেনডেন্সরা কেমন আত্মীয় হয়ে উঠেন। কোথাও গেলে বলে যান। মূল্যবান জিনিসপত্র দেখবার দায়িত্বও দিয়ে যান নির্দ্বিধায় অথচ কেউ কারও পূর্বপরিচিত নন। পারস্পরিক অসহায়ত্ব মানুষকে কতই না পরস্পরকে কাছাকাছি আনে!
আব্বা বেডে শুয়ে আছেন। কয়েকদিন ধরে পাইপ দিয়েই খাওয়ানো হচ্ছে। মেডিকেলে টেস্টগুলোর দশটার মধ্যে কখনো দুটি তিনটি হয়। তাই ভেজাল বাদ দিয়ে পপুলারেই করাতে হচ্ছে। রোগীকে বহন করার জন্য তাদের এম্বুলেন্স হাসপাতাল গেটে লাগানোই থাকে। একদিন বুকের এক্সরে দিলো, লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দিবো কিন্তু কাউন্টার থেকে বলে দিলো এক্সরে এখানে হয়না। ফিল্ম নাই। আমি গিয়ে বললাম যদি ফিল্ম আনে দেই! তারও সোজাসাপ্টা উত্তর তাও পরিচালকের পার্মিশন লাগবে!
সরকারি সেবাগুলো বন্ধ রেখে পার্শ্ববর্তী বেসরকারি সেবাগুলোতে এভাবেই চড়ামূল্য দিতে হচ্ছে জনগণকে।
আব্বা নিজে উঠাবসা করতে পারছেননা। এই মানুষটাকে নিয়ে পপুলারে টানাহেঁচড়া সে আরেক যন্ত্রণাদায়ক।
আমরা আইসিইউ এর জন্য অপেক্ষা করছি। বেড খালি নাই। আইসিইউ তে একজন মানুষ মারা গেলে আরেকজন মানুষের ভাগ্য খোলে। একজন মারা গেলে আব্বাকে আইসিইউতে ভর্তি করানো যাবে। আমরা একজনের মৃত্যুর অপেক্ষা করছি।আব্বা মুখে খেতে পারছেননা। সদর হাসপাতাল থেকে বুলু মামার বন্ধু পাইপ লাগিয়ে দিয়ে গেলেন। ব্লেন্ড করে খাওয়ানো হচ্ছে। অভিমান ছুড়ে বড় আব্বাতো মাহবুব ভাইয়ের বউ ভাবী এলেন এবং রাত জাগলেন। আমরা অল্টারনেট করে রাত জাগছি। বউ রান্নাবান্নার কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। মা আত্মীয়-স্বজন সামলাচ্ছেন। আমি, আপা আর সদ্য বিবাহিত ছোট ভাইয়ের বউ মৌরিন মিলে আব্বার সেবাযত্ন করছি।
স্থানীয় ডাক্তার দিয়ে কাজ না হওয়ায় ফোনকলে বিভিন্ন ডাক্তারবৃন্দের পরামর্শ নিচ্ছি।
বাড়িতে লোকসমাগম বাড়তেই আছে। কোবিড নিয়ে কারও কোন উদ্বিগ্নতা নেই। কেউ কেউ দেখি আব্বার কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছে। বিষয়টি মেনে নেওয়ার মতো না। যেন আব্বা মারা যাচ্ছেন। মনে চায় এই লোকদের ধমক মারি। এতে করে তো আব্বা আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে না কী? কিন্তু অতিথি হওয়ায় তাঁদের কিছু বলা যাচ্ছেনা। রোগীর বাড়িতে এ এক সমস্যা অতিথিদের আপ্যায়ন, রাতে থাকার জায়গা, তাঁদের রান্নাবান্না অপরদিকে রোগীর সেবা, টাকার ব্যাবস্থা কোনটাই বাদ দেওয়া যায়না। ঝাঁকে ঝাঁকে লোক আসতেই আছে। তবে এর মাঝেও খেয়াল হয় কেউ কেউ আসছে না। এমন সময় অপ্রত্যাশিত সহযোগিতা যেমন পাওয়া যায়, তেমন অসহযোগিতাও।
এভাবে কয়েকদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর হঠাৎ একদিন শ্বাসকষ্ট! বাসেদ আর রুনু মামা মিলে ট্যাক্স অফিসার রুবেল হাসান সাহেবের বাসা হতে অক্সিজেন নেবুলাইজার আনা হলো। রুবেল হাসান দয়ালু মানুষ। বলতেই না করেননি।
সদর হাসপাতালে চিকিৎসা বলতে কিছু নেই। আইসিইউ তো দূর কী বাত!
ভর্তি করানো হলো প্রথমে মেডিসিন বিভাগে। ডাঃ সায়েম পরিচিত সজ্জন মানুষ। তিনি সবকিছু দেখভাল করছেন। তাঁর বাসা থেকেই খাবার আসছে নিয়মিত।
আব্বার পাশের বেডে এক প্রতিবন্ধী কিশোর ভর্তি হলো। রাতে তীব্রতর হলো শ্বাসকষ্ট। বেচারার খুব কষ্ট হচ্ছে। জোড়ে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তাঁর বাবা রংপুর মেডিকেলে নিবেন সকালে এমন সিদ্ধান্ত হলো। হাসপাতালে এলে রোগী আর রোগীর এটেনডেন্সরা কেমন আত্মীয় হয়ে উঠেন। কোথাও গেলে বলে যান। মূল্যবান জিনিসপত্র দেখবার দায়িত্বও দিয়ে যান নির্দ্বিধায় অথচ কেউ কারও পূর্বপরিচিত নন। পারস্পরিক অসহায়ত্ব মানুষকে কতই না পরস্পরকে কাছাকাছি আনে!
আব্বা বেডে শুয়ে আছেন। কয়েকদিন ধরে পাইপ দিয়েই খাওয়ানো হচ্ছে। মেডিকেলে দশটার মধ্যে কখনো দুটি তিনটি হয়। তাই ভেজাল বাদ দিয়ে পপুলারেই করাতে হচ্ছে। রোগীকে বহন করার জন্য তাদের এম্বুলেন্স হাসপাতাল গেটে লাগানোই থাকে। একদিন বুকের এক্সরে দিলো, লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দিবো কিন্তু কাউন্টার থেকে বলে দিলো এক্সরে এখানে হয়না। ফিল্ম নাই। আমি গিয়ে বললাম যদি ফিল্ম আনে দেই! তারও সোজাসাপ্টা উত্তর তাও পরিচালকের পার্মিশন লাগবে!
সরকারি সেবাগুলো বন্ধ রেখে পার্শ্ববর্তী বেসরকারি সেবাগুলোতে এভাবেই চড়ামূল্য দিতে হচ্ছে জনগণকে।
আব্বা নিজে উঠাবসা করতে পারছেননা। এই মানুষটাকে নিয়ে পপুলারে টানাহেঁচড়া সে আরেক যন্ত্রণাদায়ক।
আমরা আইসিইউ এর জন্য অপেক্ষা করছি। বেড খালি নাই। আইসিইউ তে একজন মানুষ মারা গেলে আরেকজন মানুষের ভাগ্য খোলে। একজন মারা গেলে আব্বাকে আইসিইউতে ভর্তি করানো যাবে। আমরা একজনের মৃত্যুর অপেক্ষা করছি।
গ)
আইসিইউ এ আব্বাকে নেওয়া হয়েছে। চারপাশে টুঁউ টুঁউ টুঁ করে এক বিরক্তিকর শব্দ। মাঝে মাঝে শব্দটা ঘড়ঘড় করে উঠলে নার্সরা তাকিয়ে দেখছে। চারপাশে রোগীদের নীরব মৌনতা। অধিকাংশ অচেতন। নাকে মুখে পাইপ। বেডেই সবকিছু। আব্বার দিকে তাকিয়ে আছি। আব্বা কখনো কখনো তাকিয়ে দেখছেন। ভেতরে অবস্থান করতে দেয়না বেশিক্ষণ। ডাক্তারের পরিচিত হওয়ায় নার্সরা কিছু বলছে না। তারপরও বেশিক্ষণ আব্বার কষ্ট দেখে অসহায় হয়ে থাকতে না পেরে বেরিয়ে এসে আইসিইউ এর পোশাকটি খুলে রাখলাম। প্রকান্ড হাসপাতালটি কত রোগীকেই না ধরে আছে। রাত বাড়ছে। হাসপাতালে পায়চারি করছি। বউকে ফোন দিয়ে সন্তানদের খোঁজখবর নিলাম। বউ শান্তনা দিলো।
হঠাৎ নীচতলায় লাশঘরের দিকে চোখ গেলো। পরিবার পরিজনহীন ঘরটিতে একটি লাশ রাখা দেখলাম। আশেপাশে কেউ নেই।
ডাক্তারসাহেব তাঁর চেম্বারটি ছেড়ে দিয়েছেন, আমি সেখানেই ঘুমাচ্ছি। ঘুম আসে না। কখন কী খবর হয়!
হাসপাতালের বাইরে এলাম। এখানে সেখানে মানুষের বিচরণ। সারারাতজুড়ে ঔষধ আনাআনি। দোকানগুলোও খোলা। কোভিড বেড়ে যাওয়ায় দোকান বন্ধে পুলিশের নজরদারি। লকডাউন চলছে। বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আকাশজুড়ে মেঘমালা। আবছা চাঁদের আলো। কখনো কখনো মেঘের ভেতরে চাঁদ প্রবেশ করলে ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাসপাতালের পাশে কোভিডের জন্য আলাদা সেন্টার করা হয়েছে। সারাদিন সেখানে লাইন। মানুষজন ভীত সন্ত্রস্ত পরাস্ত!
আব্বারও কোভিড টেস্ট করাতে বলল। এচআরসিটির রেজাল্ট ভালো। ডাক্তার আব্বাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন – কেমন আছেন?
আব্বা ঘুমিয়েই ছিলো মনে হয়। ব্যাথায় ককিয়ে উঠলেও স্পষ্ট বলে উঠল
-আলহামদুলিল্লাহ!
ছোটভাই ছুটি পেয়ে এসেছে। আমাকে বলল তুই দুদিন রেস্ট নিয়ে আয়। কারো মুখে কোন কথা নাই। হাসপাতালে পরিচয় হওয়া বালিয়াডাঙ্গির এক হিন্দু ভাইয়ের সাথে দেখা এম্বুলেন্স থামিয়ে বলল -ভাই বাবাক লে যাছু! জমি গটেলায় বেঁচে দিলো হামরা খামো কি? ভেতরে তাকিয়ে দেখছি ওঁর বাবা বমি করছে। আর ও মুছে দিচ্ছে।
তাঁরা বিদায় নিলো।
আর কখনো দেখা হবেনা জানি। তবুও বেদনাটু রেখে গেলো!
ঘ)
মা তাঁর আলমারির ভেতর হতে, যেখানে সিন্দুক থাকে অথবা পাঁজরের গহ্বর হতে বের করে আনলেন
আব্বার দেওয়া আংটি;
যে আংটিতে সংযুক্ত ছিলো আজীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি আর বিশ্বাস।
নানীর দেওয়া চুড়ি, যাতে মায়ের স্নেহটুকু
নিজের জমানো শখের পুরনো মুদ্রা,
যে মূ্দ্রাতে তিনি বপন করে দেখতে চান কালের বিন্যাস!
নানাজানের দেওয়া নূপুর;
যে নূপুরের ঝনঝন কলরবে মেতে থাকতো বিষণ্ণ গ্রাম, মেঠোপথ, শস্য ছড়ানো উঠান!
দাদীর দেওয়া গলার হার আর বেনারসি ;
যে হারে জড়িয়ে ছিলো সংসারে শান্তির দক্ষিণা বাতাস! শাড়িতে রঙ্গিন আবহ!
হরিণের চামড়ার বাঁধানো কোরআনমজিদ;
যাতে আছে আদি ও অনাদি কালের নিশ্চয়তা আর বিশ্বাসীদের জন্য সরল পথের পাথেয়!
নানীর হাতের তৈরিকৃত উলের জায়নামাজে দুনিয়া আখেরাতের অসহনীয় বালা-মুসিবত হতে মুক্তির প্রার্থনা!
আরও নানা কিছিমের মূল্যবান জিনিসপত্র সহ সবই তিনি এরপর শোফার টেবিলের উপর রাখলেন। সবার চোখ চকচক করছে। সকলে ভদ্রতাবশত উদার। কেউ চেয়ে নিবে না সামনাসামনি। ওজনে কম হলেও জমিদার নাতনি আমার মা পেয়েছিলেন একটি রৌপ্যের কৌটা অসাধারণ কারুকার্যখচিত। গহনাগুলোর পাশাপাশি
সকলের আগ্রহ সেদিকেও। বড় মেয়ে, কয়েকজন জামাই, নতুন পুত্রবধূ, দরিদ্র বড় ছেলে ছাড়াও নাতিনাতনিদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এই রুপার পানদানি।
একেক গহনা নিয়ে মায়ের রয়েছে একেক গল্প। যেন আলিফ লায়লার হাজার কাহিনী। কিন্তু গল্পগুলো ব্যক্তিগতভাবে খুব গুরুতপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা এই মধ্যবিত্ত জীবনে। এসব ক্রয়ে ও সংগ্রহের ইতিহাসে বিজড়িত হয়ে আছে নানামাত্রিক ত্যাগ আর কাটছাঁটের যন্ত্রণা।
আজ কারও পাবার আর কারও হারাবার দিন আমাদের পরিবারে। মায়ের চারপাশে আমরা বসে আছি মায়ের আহ্বানে। মা তাঁর জীবন দিয়েই তো সন্তানদের বড় করে এরপর নিজস্ব জমানো সম্পদগুলিও দান করে যেতে হবে তাঁকে। অথচ এই মা! সেও তো কিশোরী ছিলো, সেও তো নাক ফুটানোর পর প্রথম নাকফুল পেয়ে আহ্লাদিত হয়ে উঠতো, সেও হয়তো অন্যান্য চাচাতো, মামাতো এমনকি নিজের বোনদের সাথে এই গহনাজনিত ঈর্ষাকান্ডে জড়িত হত।
আজ জীবনজুড়ে জমানো সমস্ত শখের সম্পদ তিনি বিলিবন্টন করে দিবেন তাঁর সন্তান আর নাতিনাতনিদের মাঝে। শুধু বন্টনই করবেননা উপরন্তু এক কঠিন পরীক্ষা দিবেন তিনি। মাতৃত্বের সুকঠিন পরীক্ষা। সবচেয়ে দামি গহনাটি তিনি কাকে দিবেন! কে পায়! কাকে তিনি সবচেয়ে অধিক ভালোবাসেন! আজ সেই পরীক্ষা! সন্তানদের নিকট মা হিসেবে মাতৃত্বের পরীক্ষা। সকল উত্তরাধিকারীগণ মায়ের পরীক্ষার পর্যবেক্ষক। নাতিনাতনিরাও দেখছে কার তাঁর প্রিয় সন্তান কে? আমার মা নাকি প্রিয়তার মা? নাকি বখতিয়ারের ডেডি!
মা একে একে তাঁর গহনাগাঁটি বন্টন করে দিচ্ছেন নাকি সংসারখানি?
আব্বার মৃত্যুর আব্বার পড়নের সবকিছু দানখয়রাত করে দেওয়া হয়েছে। আব্বার শালটি অবশ্য বড় ছেলে হিসেবে পেয়েছি। এটা পড়লে মনে হয় আব্বা আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন! যাক সে কথা।
মা কয়েকদিন কাঁদার পর আজ কাঁদছেননা। ছেলেমেয়েদের ছুটি শেষ হয়ে এসেছে। তাই আর দেরি করা যাচ্ছেনা। মা একে একে সবকিছু ছেড়ে দিলেন। দিয়ে দিলেন অশ্রুহীনভাবে, যা কিছু তাঁর নিজস্ব। যেগুলো ছিলো মায়ের সাহস, শক্তি আর গর্বের ধন। সব অর্জন করে সব বিসর্জন করে দিলেন তিনি অতি শান্তচিত্তে! কী সহসা!
মা এখন মুক্ত!