আমার উড়তে থাকা ঘুড়ি

আমরা ছোটবেলায় গ্রামের বাড়ি যাইতাম বছরে বেশ কয়বার। আমাদের বলতে আমারই ছোটবেলা। ওইসময় তো সব কিছুই ছিল ছোট ছোট। আর কৌতুহল।

তো যেইবার গিয়া সপ্তার বেশি থাকা হইত, সেইবারগুলাতে ফিরা আসার পর দুপুর হইলেই কেমন কেমন লাগতে থাকত আমার। কী একটা শহর; নদী নাই কিচ্ছু নাই। বাড়িতে থাকলে দুপুরের খাবারটা একটু আগে আগে সাইড়া দৌড় দিয়া নদীতে চইলা যাওয়া যাইত। দুই একটা বন্ধুও জুটত হাতের নাগালে। এইখানে, এই শহরটাতে, আছে শুধু বারান্দার রেলিং। আমি দুই রেলিংয়ের ফাঁকটাতে মাথা ঠেকায়ে আর কি করব। বইসা বইসা ঘুড়ি উড়াই।

আমাদের বাসা তখন চারতলায়। আর মুখোমুখি যেই বিল্ডিংটা, সেইটা নিয়া হিসাব মিলাইতে গিয়া অনেকবারই ভাবছি যে আমাদের চারতলার সমান্তরালে ওদের তিনতলার উপরের একটু অর্ধেক আর চারতলার নিচের অনেকটা অর্ধেক ক্যামনে থাকে। দুইটা বাসার মাঝে একটা গলি আছে ক্রিকেট খেলার জন্য। আমি ওইখানে দাঁড়ায়া দুইটা বিল্ডিংয়েরই নিচতলা চোখ দিয়া মাইপা দেখছিলাম যে সমান সমান। উঠতে উঠতেই মেবি গড়মিল হইল। আমাদের বা ওদের।

অথবা সামগ্রিক বড় অর্থে ভাবলে আমার বা ওর।

তিনতলার আমার সামনের বারান্দাটায় ও থাকে। নাম জানি না। ওর একটা চশমা পরা ছোট ভাই আছে ভেতরে। আর বাবা মা তো থাকেই। বিকাল হইলে যেমন আশপাশের সব বিল্ডিংয়ের ছেলেরা হই হই কইরা খেলতে আসে, ওর ভাইটা কোনোদিনই আসে নাই। তাই আমি ওর নাম জানি না। ওর ভাইয়ের নামও না। ওরা পুরাটাই আমার কাছে দৃশ্য ও শব্দের বাস্তবতা। সিনেমায় না চরিত্রদের নাম দিতে হয়।

বারান্দায় ঘুড়ি উড়াইতে উড়াইতে কোনো একদিন যে ওর নামটা জাইনা নিব সেইটাও হইতেছে না আমার। অনেকদিন ভাবছি যে আজকে জিগেশ করবই করব। কিন্তু অতপর, ও এমনভাবে দোলনায় দুলতে দুলতে আমার উড়তে থাকা ঘুড়ি দেখতে থাকে। তারপর হঠাৎ ঘুড়িটা কোথাও ঠেইকা গেলে, অস্থির হইয়া দোলনা থেকা উইঠা, গ্রিলে দুইহাত শক্তভাবে ধইরা, একবার আমার দিকে একবার ঘুড়ির দিকে আবার আমার দিকে সহমর্মী হইয়া তাকাইতে থাকে। তখনও কেন আমি ওকে জিগেশ করতে পারি না—কি গো তোমার নাম?

এমন না পারতে পারতে আমাদের আরও কতোগুলা না পারা তৈরি হয়ে গেল এরই মধ্যে। আমি এখন আর কোনো দুপুরেই ঘুড়ি না উড়ায়ে থাকতে পারি না। আবার ও-ও পারে না দোল না খেয়ে থাকতে। আগে তো ঘুড়ি উড়াইতে ভালো না লাগলে আম্মুর সাথে গল্প কইরা বিকালের দিক গড়াইতাম। আম্মু কিঞ্চিৎ কৌতুহলবশত লক্ষ্য করছিলেন ব্যাপারটা যে কই যায়। শান্ত ছেলেটার জীবনে হঠাৎই কতো তাড়াহুড়া। কিছুই না করা-না লাগা দুপুরে তার সাথে চারগুটি খেলার দিনগুলা কোন খেলায় গিয়া শেষ হইল তিনি হয়ত তাও ভাবছিলেন। বলেন নাই কিছুই। আমি তার মিস করা বুঝি। অথচ কোনো এক উদ্দাম আকর্ষণ আমাকে টাইনা নিয়া যায় কেবলই বারান্দায়।

ওদিকে ওর সাথের ঘটনায়, অন্য কোনো স্তরের বিন্যাস আস্তে আস্তে আমার চোখে ধরা দিতে শুরু করল। ব্যাপারটা নতুন আসলো নাকি আগের থেকেই বিদ্যমান তা আমার জানা নাই। আমরা যেমন ফোকাস হওয়ার পরের মুহূর্তগুলাই জানি তাই নতুন এই অনুভূতির সাথে মাত্রই পরিচয় ঘটল আমার। আমি দেখলাম যে আটকে পড়া ঘুড়ি আর আমার বিহ্বল চেহারার দিকে তাকানোর মুহূর্তটায় ও অন্য কোনো আকুলতা নিয়া তাকায়ে আছে। আমি বুঝতে পারতেছি ওর চাওয়া। কিন্তু কিছু একটা আশঙ্কা কাজ করত আমার ভেতরে। সুন্দরের অমন কান্না তো আমি তখনও নিতেই শিখি নাই। তাই একটু দূর দূর অবস্থান।

এইসব দুপুর শেষে রাতে, যখন ওর আব্বা সারাদিন অফিস কইরা বাসায় ফিরে, তখন আমি আমার রুমের দরজা বন্ধ কইরা রাখি। প্রায়দিনই ওর বাপ বাসায় ফিরলে হাউকাউ হয়। এমনই হাউকাউ, প্লেটবাটি ছুঁইড়া মারা, গালিগালাজ আরও যে কতরকম কিছু। সে তার মেয়েরে নিয়া কারও সামনে যাইতে পারে না। এত সুন্দর মেয়ে। তারে বোবা হইতে কে বলছিল?

ওর মা কার না কার সাথে শোয়াতে ও হইছে এমন চিল্লাচিল্লিও শুনি মাঝেমধ্যে। সেই ব্যাটার বোবা মেয়ে হওয়াই তো অসম্ভব। ঘুষ খায় না কিছু না। নামাজও পড়ে পাঁচবেলা। এইখানে বউয়ের পাপ ছাড়া আর কি কোনো চান্স আছে নাকি। তার বউরে সে একদিন বলল, তোমার কি মনে হয় আল্লা ফাইজলামি করার লোক হ্যা? আমার মেয়ে হইব বোবা!

এইগুলা ঘটার সময় ও নিরবে কান্না করে মনে হয় বারান্দায়। তখন আমি কষ্ট পাওয়ার ভয়ে যাই না। কিন্তু এইবার ও মেবি দেখাইতেই চায় আমাকে। ওর বোবা কান্না দেইখা আমি তারপর অনেকগুলা দুপুর আর ঘুড়ি উড়াইলাম না। ও গ্রিল ধইরা কানলে আমি বারান্দার ফ্লোরে বইসা রেলিং ধইরা থাকতাম। যেন ওরেই ধইরা আছি। এবার আর কান্না কিসের।

তারপর আসলো এক শুক্রবার। আমি মাঠে খেলতে যাব আজকে। গলিতে যাদের সাথে খেলি ওরা নিচে থেকে চিল্লায়ে ডাকতে থাকে নয়টা বাজলেই। আজকে কোনো সাড়াশব্দ এখনও পাই নাই। তবে আমি রেডি হয়েই আছি। ওসাকা ‘কস্টেপ’ কিনছি নতুন। বল একদম চকচক করতেছে দেখছি স্বপ্নে। আর সে কী স্পিন! খাওয়াদাওয়া সাইড়া একবার বারান্দায় গেলাম। ও যদি থাকে একবার দেখা কইরা যাই। গিয়া ওর থমথমে বরফের মতো রক্তশুন্য মুখ দেইখা আমার গলা একদম শুকায়ে গেল।

ও নিচের গলির দিকে চোখ নামাইল । আমি প্রথমবার অজানা কোনো এক শঙ্কায় তাকাই নাই। নিচে হয়ত এমন কোনো দৃশ্য যেইটাতে আমি কষ্ট পাব। তারপর ও আবারও আমার দিকে তাকাইল। বুঝাইতে চাইল যে তাকাও। এইটাই সত্য। এইটাই ঘটছে। তাকাও। আস্তে আস্তে ও আমাকে নিয়া বিল্ডিংয়ের নিচে তাকাইল। অনেক মানুষ। আমি দেখলাম অনেক মানুষ। ওর বাবা মারা গেছে।

আমি যেন হঠাৎ দ্বিধায় পইড়া গেলাম। বোকা বোকা চেহারায় কষ্ট পাইতেছি। আমার মনে হইতেছে ওর তো তাহলে কষ্ট ফুরাইল এতোদিনের! কতো মারধর, কতো কান্নাকাটি, কতো অপমান। আর কোনো কিছুই বাকি নাই ওইসবের। ছোটমানুষের কৌতুহলী মন। আর ওই বারান্দায় সে কেন কষ্ট পায়।

আমার আর খেলতে যাওয়া হইল না। ওরা নাকি কালই বাড়িতে চইলা যাবে। আমাকে নানাভাবে ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করল। আমাকে বলল ঘুড়ি নিয়া আসতে। আমি ঘুড়ি আইনা উড়াইতে লাগলাম। দেখলাম, আমার উড়তে থাকা ঘুড়ির আজকে আর কোথাও আটকায়ে যাওয়ার দরকার পড়তেছে না। এতোদিন এইরকম আকার ইঙ্গিতে কথা বললেই তো আমাদের কতো কথা হইত। হায়হায়।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত