কন্যা জয়তন হও


আজ থেকে বছর দশেক আগে, নভেম্বরে শীত পড়তে শুরু করার দিন গুলোয় যখন শীতের কাপড় পড়ার উপযোগিতা প্রথম অনুভুত হয়, মাগরিবের আজানের আগেই যখন দূর্বা ঘাসে শিশির জমার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় এবং ঘটনা চক্রে এশার নামাজ নাগাদ শীতের কাপড় গায়ে না চাপালে যখন ঠিক জমে ওঠে না- সেই সময় মেঘডুমুরের উত্তর কোনে রমিছা বেগমের বাড়ি থেকে সুর, সঙ্গীত, গীত কিংবা হট্টগোলের শব্দ পাওয়া গেলে মসজিদে এশার নামাজ রত মুসল্লিদের নামাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় এবং তখন মুসল্লিরা নামাজ শেষ করে আর এবং ছোট ছোট বাচ্চারা নামাজ উপেক্ষা করেই রমিছা বেগমের বাড়ির দিকে ছুটে গেলে দেখতে পায় তার উঠানের মাঝ বরাবার পোতা উচু খুঁটিতে গরদিঘী হাট থেকে ভাড়া করে আনা হ্যাচাক বাতি উঠানের পুরো জমিন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে আলোকিত করে চলেছে এবং সেই আলোর খানিক অংশ বাড়ির বাইরে পুকুরের পানিতে পড়লে জলে এবং আলোয় এক ধরনের মধুর, মোহ জাগানিয়া অনুভূতির সৃষ্টি করে কিন্তু সেই সুন্দরের প্রতি কারো দৃষ্টি ফেরানোর কোন সুযোগ থাকে না। কারণ সেই সময় রমিছা বেগমের উঠানে সেই হ্যাচাক বাতির নিচে রমিছা বেগমকে একটা হাতল ওয়ালা কাঠের চেয়ারে বসিয়ে রমিছার ভাগ্নে রহিমুদ্দি তার দল বল সাগরেদ নিয়ে রমিছা বেগমের চারিপাশে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করে, নৃত্যের সাথে সবাই এক সাথে সুর করে গেয়ে ওঠে – “কন্যা জয়তন হও, খবর ন্যাও, ন্যাংরা-বাসুলি ঘিরিঅ্যাঁ নিছে গাও”।

রহিমুদ্দির দলের সবাই যখন রমিছাকে পর্যাবৃত্ত গতিতে প্রদক্ষিন করে চলৎশক্তিহীন রমিছার ম্রিয়মান শরীরে অহেতুক অযথা স্নায়ু উদ্দীপনা সৃষ্টির ব্যর্থ চেষ্টা করে তখন রমিছার আপন ভাগ্নে রহিমুদ্দি রমিছার চেয়ারের গোড়ায় একটা চটের ছালা পেতে বসে কাধ থেকে হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত তীব্র চাপ প্রয়োগ করে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত যখন মালিশ করতে থাকে তখন স্বভাবতই রহিমুদ্দি এবং রমিছার হাতের ঘর্ষণের কারনের হাতের কাঁধ থেকে মোগড়া পর্যন্ত ম্যসেজের কাজ স্মুথলি করার জন্য এক ধরনের উৎকট গন্ধ যুক্ত তেল রহিমুদ্দি হাতে নিয়ে রমিছার হাতে তীব্র চাপ দিয়ে মালিশ করার কাজ টা করতে থাকে এবং এই উৎকট গন্ধ যুক্ত তরলের নাম কি তা একটু পড়েই জানা যায় যখন রহিমুদ্দি চেঁচিয়ে বলে ওঠে এই ‘’পাক ত্যাল কই’’! এবং এই পাক ত্যাল যদিও রহিমুদ্দির হাতের কাছে একটা ছোট পাক ত্যালের স্পেশাল বাটিতে থাকার কথা কিন্তু এই পাক ত্যাল শেষ হয়ে গেলে কিংবা শেষ হওয়ার আগেই বাটিতে পাক ত্যাল সরবরাহ করার দায়িত্বে রহিমুদ্দির দলের লোক তার দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করে বলেই রহিমুদ্দিকে বিশেষ ওই তেলের জন্য ওই ভাবে ত্বরিত তাগাদা দিতে হয়। এবং সেই সাথে এ কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, রমিছা শুধু যে হাত নড়াচড়া করতে পারে না তাই নয়, তার মুখ বাকা হয়ে যাওয়ায় ওপরের চোয়াল থেকে নিচের চোয়াল একটু ডান দিকে বেকে যায় এবং এই সেই বাকানো অংশ যথা স্থানে এনে সোজা করতে রহিমুদ্দি স্বীয় খালার বাঁকানো মুখের ওপর হাতের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে জবরদস্তি চালালেও রমিছা অচেতন কিংবা চেতন যাই থাকুক না কেন কোন আওয়াজ তো করতে পারেই না বরং তার নিস্তেজ মাথা এক বার ডান দিকে আরেকবার বাম দিকে এমন ভাবে ঝুলে পরে যে তখন মনে হয় কোন মৃত শরীরকে দাঁড় করালে সেই মৃতের মাথা যে কায়দায় কাধ বরাবর ঝুলে পড়তে উদ্যত হবে, রমিছার মাথা ঝুলে যাওয়ার দৃশ্য দেখলে সেই মৃতের উপমা মনে পরে।

দিন কয়েক আগে মেঘডুমুর প্রাইমারি স্কুলের সামনে নিচু জমিতে কৃষি কাজ করার সময় রমিছা বেগম মাথা ঘুরে পরে যায় এবং তার পর চলৎশক্তি হারিয়ে ফেললে রমিছা শয্যাগত হয় এবং যেহেতু চিকিতসা বিজ্ঞানের ভাষায় ঠিক কি কারনে রমিছা হুট করেই পরে গিয়ে চলার শক্তি, উঠে দাঁড়ানোর শক্তি এবং বাক শক্তি হারিয়ে ফেলে তা এই অঞ্চলের মানুষ জানে না, তাই এ কথা রাষ্ট্র হয়ে যায় যে ,”দুনিয়ার ধার দুনিয়াতেই শোধ হয়” কিংবা “সারা জীবন স্বামী থেকে দূরে থেকে নষ্টামি করে জীবন পার করলেও আল্লাহ যে সহ্য করবে না তা তো জানা কথা”। এইসব কথা রমিছার আঙ্গিনায় রহিমুদ্দির দলবল নিয়ে সেইসব নৃত্য, মালিশ কিংবা গান উপভোগ করতে করতে রমিছার অনুরুপ পরিনতির জন্য কি বা কে দায়ী তা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলে সেই ভরাট মজলিশে অবধারিত ভাবেই আক্কাস আলীর নাম চলে আসে এবং সেই মজলিসেই ছোট দের মধ্যে অনেকেই যারা রমিছা সংক্রান্ত আলাপে ইতিপূর্বে যুক্ত হতে পারে নাই তারা প্রথম আক্কাস আলীর সাথে ঘোড়াবান্ধা নামটা শুনতে পায় এবং এটা যে একটা জায়গার নাম এটা আমরা প্রথম শুনি আমাদের এলাকার এই রমিছা সংক্রান্ত প্রচলিত গল্পে। সেসব গল্প যে একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্য তা হয়ত হলফ করে বলা যাবে না এবং তা ঠিক এই কারনে যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে যেখানে রাজধানী কিংবা বড় বড় শহরেই বিজ্ঞান কিংবা কর্পোরেট ব্যবস্থার নামে পণ্য বানিয়ে রেখে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে পন্যের ভ্যালু অ্যাড করার কাজে ম্যনিপুলেট করা হয় কিংবা নারীরা নিজেরাই অনেক সময় সেই সুযোগ করে দেয়, সেখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে গ্রামীণ অঞ্চল মেঘডুমুরে যেখানে কৃষিই একমাত্র জীবিকা, যেখানে শিক্ষা বলতে মানুষের উপস্থিত বুদ্ধিগুলোকে কাজে লাগিয়ে চাষের উপযোগী জ্ঞান অর্জন করে নিজের জীবন যাত্রার মান দরিদ্র কিংবা অতি দরিদ্র সীমা বরাবার স্থাপন করে বাকি জীবনটি চালিয়ে নিয়ে এবং বয়োপ্রাপ্ত হলে নিজের যৌন আকাঙ্খা মেটাবার উপকরন হিসেবে বিয়ের প্রচলন আছে কিন্তু সংসারে নারীর যে পারস্পারিক সম্পর্ক কিংবা পারিবারিক কিংবা সামাজিক নানান জটিলতায় উপস্থিত বোধ, বুদ্ধি কিংবা বিবেচনা দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনে অংশীদারিত্ব নাই, এমনকি সন্তান ধারনের মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেও নারীর নুন্যতম স্পেস নাই, সেখানকার মত প্রত্যন্ত অঞ্চল মেঘডুমুরে রমিছা বেগমকে নিয়ে প্রচলিত গল্প গুলো যে নিখুত কিংবা রমিছা এবং আক্কাস আলী উভয় পক্ষের মতামত নিয়ে ক্রস চেকড করে সমাজে ছড়িয়ে পরে আছে এরকম ভাবলে খুব সম্ভবত রমিছা বেগমের প্রতি অবিচার করা হবে এবং সেটা ঠিক এই অর্থে যে, প্রচলিত সকল গল্পই রমিছার বাক্তিগত, সামাজিক এবং চারিত্রিক ইমেজকে মাটিতে নামাতে করতে যথেষ্ট; এই যেমন রমিছা বেগম বিয়ের বছর পাচেকের মধ্যেই দুই সন্তানের জন্ম দিয়ে নানান সাংসারিক জটিলতায় তার স্বামীর বাড়িতে অর্থাৎ আক্কাস আলীর সাথে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে নি এবং যেহেতু গ্রামীণ সমাজে দিন-তারিখ- মাস – বছর কিংবা জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী পালনের বিশেষ রীতি নাই, তাই একথা আমাদের পক্ষে হলফ করে বলা সম্ভব নয় যে পঞ্চ বার্ষিকীর আগে নাকি পরে ঠিক কবে রমিছা বেগম ঘোড়াবান্ধা থেকে এসে মেঘডুমুরে পুত্রহীন মা বাবার ঘরে আশ্রয় নেন। কিন্তু ওইদিন যেদিন ঘোড়াবান্ধা থেকে রমিছা শেষ বারের মত চলে আসেন সেদিন ঘোড়া বান্ধার অনেকেই হয়ত একথা ভেবে বসেছিলেন যে, রমিছা বেগম এই যে চলে যাচ্ছেন মেঘডুমুরের উদ্দেশ্যে তা হয়ত কিছু সাংসারিক ক্রোধের ফল এবং ক্রোধ কিংবা অভিমান কমে গেলে কিংবা আক্কাস আলী তার নানা শ্বশুর অর্থাৎ রমিছা বেগমের নানা নছিম সরকারের কাছে ধর্না দিলেই রমিছা বেগমকে ঘোড়া বান্ধায় ফেরত আনা সম্ভব হবে | কিন্তু না, সেই আশা রমিছা জীবিত থাকাকালীন কখনই পূরন হয় নি এবং আজ এই প্রখর রোদের বিকেল বেলায় আছর নামাজের পর বুচনু আরার বাঁশ ঝারের ভিতরে রমিছার দাফন কার্য সম্পন্ন হওয়ার পর সেই সম্ভবনা একেবারেই বিলুপ্ত হয়।


যেদিন রমিছা বেগম মারা যান এবং বুচনু আড়ার বাঁশ ঝারের মাঝে রমিছা বেগমের পৈতৃক সম্পত্তির মাঝে তার আগের রাতে মারা যাওয়া রমিছার জন্য সেদিন সকাল সকাল গোর খোরকদের খুড়ে রাখা কবরের মাঝে রমিছা শায়িত হলে একটা ইতিহাসের সমাপ্তি হয় এবং তখন আমাদের মনে হয় এই দাফন সংক্রান্ত বৈঠকে এই এলাকার মানুষ একটি এবং রমিছার দুই সন্তান একটি করে দুইটি ভুল করে বসে এবং যার প্রথমটি রমিছা সারাজীবন সহ্যই করে গেছেন কিন্তু দ্বিতীয় ভুলের জন্য রমিছা বেগমের সন্তানেরা কখনও ক্ষমা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না এবং এ কথা রমিছা বেগমের এক মাত্র সন্তান জিল্লু এবং মেরিনাও জানতেন এবং এই জানার পরও এই ভুলের জন্য মায়ের মৃত্যু শোকের সাথে এই অপরাধ মনে উদয় হলে তাদের উভয়ের চোখ জলে ভিজে যায় এবং তারা ডুকরে কেদে উঠতে না উঠতেই জিল্লুর মনে পরে ১৯৮৮ সালের কোন এক দিনে যখন পাশেই মেঘডুমুর সরকারী প্রাইমারি স্কুলে যখন তার বয়সী অনেকেই যায় আবার অনেকেই যায় না, আবার অনেকেই কয়েক দিন যাওয়ার পর খাতা কলম না থাকার কারনে স্কুলে যাওয়া বৃথা ভেবে স্কুল যাওয়া ছেড়ে দেয়, সেসব দিনের এক বিশেষ দিনে জিল্লু স্কুলে মাঠে গিয়ে খাতা কলম না থাকা সংক্রান্ত জটিলতায় কিংবা পড়াশোনার প্রতি বিরক্তি থেকে সঞ্চারিত কারন থেকে স্কুলের মাঠের এক কোনে আমলকীর যে গাছ ছিল সেই গাছে উঠে আমলকী পেড়ে গাছেই খাওয়া শুরু করে এবং তখন হয়ত স্কুলে আসা অন্য অনেকেই আমলকী গাছের নিচে ভীর করে এবং জিল্লু হয়ত সখ্যতার খাতিরে দুই একজনের উদ্দেশে আমলকী ফেলে দেয় এবং তখন একজনের উদ্দেশে ফেলা আমলকী নিয়ে যখন অনেকের মধ্যে হুরোহুরি লেগে গেলে জিল্লুর মনের মধ্যে গাছে চড়তে পারার অহমিকা জেগে ওঠে। কিন্তু সেই অহমিকা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, যখন নিচেই বসে থাকা একদল লোক জিল্লুকে শাসায় এবং বলে এই মাগির ছেলে! কথাটা গ্রামে যেহেতু সচরাচর গালি তাই এটা খুব একটা জিল্লুর গায়ে লাগার কথা ছিল না কিন্তু গাছ থেকে নামতে নামতে নামতেই জিল্লু সেদিন প্রথমবারের মত জানতে পারে তার মা একটা নষ্টা, যে স্বামী বেঁচে থাকতে স্বামীর ঘড় ছেড়ে বাপের বাড়িতে এসে থাকে। জিল্লু যে বাপকে ছাড়া মাকে নিয়েই থাকে এবং তার বোন মেরিনা যে তখন সংসারের টানাটানির জন্য তার ফুপুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ফুপুর ধানের চাতালে কাজ করার বিনিময়ে একটা পারিবারিক পরিবেশে থাকছে একথা জিল্লুর অজানা নয়, কিন্তু তবুও ওইদিনের ওই কথা, ‘রমিছা বেগম নষ্টা’ এই কথা জিল্লুর মনে তীব্র আন্দোলন সৃষ্টি করে কিন্তু জিল্লু এর কোন দিশা খুজে না পেয়ে, মায়ের সাংসারিক কিংবা পারিবারিক কিংবা বৈবাহিক অবস্থা নিয়ে জিজ্ঞাসা করার মত অবস্থা না থাকায় কিংবা আধুনিক নাটক সিনেমা, গল্পে পারিবারিক কমপ্লেক্সিটি বিহীন যে পারস্পারিক সম্পর্কের জাল বোনা হয় তা যে জিল্লুর পক্ষে বাস্তবিক অর্থেই সম্ভব নয় তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় এবং জিল্লু হয়ত পাড়ার মোরে জটলার মধ্যে আলাপে রত লোকের মুখে রমিছা বেগমের প্রসঙ্গ শুনতে পায় এবং কৌতূহল বসত সে স্থান ত্যাগ না করে কান পেতে শুনতে পায় যে এলাকার লোক আলোচনা করে রমিছা কেন আক্কাস আলীর সাথে থাকল না! এবং রমিছার চরিত্র নিয়ে জাবর কাটার পাশাপাশি এও আলোচনা করে যে, আক্কাস আলীর মত ছেলের সাথে যার সংসার হয় না, সে বেশ্যা না হয়ে পারে না এবং সেই জটলায় নানান জন নানান কথা বলে এবং জিল্লুর মন বিষিয়ে ওঠে এবং সে স্থান ত্যাগ করে গোলামের বাড়ির আড়ার পিছনে গিয়ে এলাকার বাড়ন্ত ছেলে পেলের সাথে গিয়ে জমে এবং তখন যেহেতু এলাকায় বিড়ি বাঁধাইয়ের কাজ চলত এবং বিড়ি চুরি করে গোলামের আড়ার এই সেফ প্লেসে এসে বিড়ির টানার মধ্যে একটা আনন্দ ছিল সেই আনন্দে জিল্লু সেদিন সামিল হলেও জিল্লুর বিড়ি টানার ব্যাপারে তার এলাকার চ্যালামো বন্ধুদের সাথে তার একটা বিশাল পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় এবং যা বাহ্যিক ভাবে প্রকাশমান না হলেও এ কথা সত্যি যে জিল্লুর সাথের ছেলেরা যেখানে উঠতি বয়সের জন্য বাপের বাধাই করা বিড়ি থেকে দুই একটা বিড়ি সরায়ে রেখে পরে এখানে এসে টান দেয় সেখানে জিল্লু তার মায়ের হিস্ট্রি নিয়ে চিন্তিত হয়, তার মনঃজগতে আঘাত করে তার মায়ের জীবন নিয়ে পাড়ার মোড়ে শোনা তার চটুল ইতিহাস যার কোন সমাধান তার হাঁতে নাই। এমনকি, আসলেই তার মা বেশ্যা কি না কিংবা কি কারনে তার রমিছার সংসার হল না তা তার মনে ক্রমাগত উদয় হতে থাকে এবং প্রিয় মা সংক্রান্ত কটু কথা শুনে তার নিউরনে যে ক্রমাগত চাপ পড়তে থাকে তা থেকে মুক্তি লাভের আশায় জিল্লু বিড়িতে টান দেয়। কিন্তু বিড়ি টেনে গলায় কাশির উদ্রেগ হলে সে বুঝতে পারেনা তার এই বিড়ি টানা জনিত কাশির উদ্রেগের কারণ কি আসলে তার বিড়ি সংক্রান্ত অনভিজ্ঞতা নাকি তার মা রমিছা বেগমকে নিয়ে শোনার ফলে জীবন কিংবা সমস্ত দুনিয়াদারি নিয়ে তার অন্যমনস্কতা! মনের অভ্যন্তর ভাগ থেকে উৎসারিত এসব প্রশ্নের কোন সমাধান না পেয়ে জিল্লু বাড়ি ফেরে এবং বাড়ির সীমানায় আসতে আসতে মায়ের ওপর তার এক ধরনের বিতৃষ্ণা জেগে ওঠে এবং মাকে নিয়ে শোনা নানা খারাপ কথা তার মনে অনেক প্রশ্ন ক্ষোভের জন্ম দিলে জিল্লু ভাবে মায়ের জন্য তাঁকে লোকের কাছে কথা শুনতে হয় কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় তার মাকে নিয়ে কটু কথা বলা হয় যেহেতু, সেহেতু সে ক্ষোভ লালন করতে করতে বাড়িতে আসে এবং ক্ষোভের সাথে মাকে ডাক দেয় এবং খাবার দিতে বলে কিন্তু ডাকের কোন জবাব আসে না তখন সে মাকে কর্কশ ভাষায় মনে মনে গালি দেয় এবং সেই গালি হয়ত এলাকার পুরুষদের মুখের গালির মতই বিদঘুটে এবং খুব সম্ভবত বাড়িতে এসেই মাকে পেলে যতই ক্ষোভ থাক না কেন জিল্লু এমন গালি মনে আনতে পারত না কিন্তু যেহেতু এলাকার আলোচনায় মাকে নিয়ে শোনা কথা এবং যার জন্য হয়ত তার মধ্যে ইমেজ সংকট কিংবা আত্ম গ্লানি তৈরি হয় এবং বাড়ি এসেই মাকে না পেয়ে তার মনে এই গালি উদয় হয় এবং ক্ষুধা পেয়ে বসলে তীব্র ক্ষোভ এবং কিছু দমিত গালি নিয়ে জিল্লু ভাত বেড়ে নেয় এবং খেতে বসে এবং জিল্লুর এই ভাত খেতে খেতেই মায়ের কথা মনে হয়, মা যে বাড়িতে নাই এই কথা মনে হয় এবং সকাল বেলা রান্না করে গরুর বাথানে পল দিয়ে রমিছা বেগম যে বিলের জমিতে নিড়ানি দিতে যায় এবং নিড়ানি দিতে গেলে যেহেতু হাতে কাচা ধানের গাছের ধারের জন্য হাত কেটে যায় কিংবা কেটে গিয়ে ঝালায় এবং এজন্য এলাকার পুরুষরা সাধারনত শার্ট গায়ে দেয় যার ফলে বারন্ত ধানের গাছ থেকে কাধ থেকে মগড়া পর্যন্ত রক্ষা পায় এবং এই উপায় খুব কাজের দেখে রমিছা বেগমও যেদিন ছেলে জিল্লুর একটা শার্ট গায়ে দিয়ে জমিতে যায় সেদিন এলাকার লোকেরা এ নিয়েও কথা বলতে ছাড়ে নি যে রমিছা ব্যাটা ছাওয়ালদের মত শার্ট পড়া শুরু করছে এবং এই বিষয় নিয়েও সমালোচনা হয় সেটা জিল্লুর মনে উদয় হয়, উদয় হয় এই সংসারে ছেলেকে নিয়ে চালাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে দুই বেলা অন্নের সংস্থান করতে গিয়েই তো রমিছা তার পৈতৃক সুত্রে পাওয়া জমিতে ধানের আবাদ শুরু করে এবং যেহেতু সংসারে কোন কর্তা নাই এবং ছেলে জিল্লুও ছোট তাই রমিছা নিজেই জমিতে চাষাবাদ শুরু করে, জমিতে ধান রোপণ করা, নিড়ানি দেওয়া, কাটা, ধানের আটি বাঁধানো থেকে শুরু করে সবই রমিছা বেগম একাই করে কেবল মাত্র জমি লাঙল দিয়ে চাষ করা ব্যতীত ধান উদপাদন জনিত সকল কাজ রমিছা প্রায় একাই করে এবং এই করেই যে জিল্লুকে নিয়ে এখনও দুইবেলা খেতে পাচ্ছে , এই নিয়েই রমিছার তৃপ্তি, সে কথা জিল্লুর মনে পরে, মনে পরে জমি থেকে ফেরার পর মায়ের ক্লান্তি মাখা মুখ এবং এই ক্লান্তি শুধুই তীব্র রোদের ভিতর জমিতে চাষাবাদ জনিত ক্লান্তি নাকি জীবনের এই বয়সেই রমিছা যে বুড়িয়ে যাচ্ছে সেই ক্লান্তি সেটা জিল্লু ঠিক ধরতে পারে না। কিন্তু এ কথাও সত্যি, মেঘডুমুরের এই গ্রামীণ সমাজে কৃষি কাজ করতে গিয়ে তীব্র পরিশ্রম এবং সেই সাথে অভাব অনটনের সংসারে তিন বেলা ঠিক মত খেতে না পাওয়া প্রায় সকল সংসারে পুরুষ মানুষেরাই যখন বুড়িয়ে যায় তখন মেয়ে রমিছার বুড়িয়ে যাওয়া নিয়ে বললে হয়ত বাড়িয়ে বলা হয় কিন্তু এটাও তো সত্য যে এলাকার পুরুষদের মত রমিছার যুদ্ধ তো শুধু কৃষি জনিত জটিলতার সাথে নয়, রমিছাকে যুদ্ধ করতে হয় তখনও যখন এলাকার মানুষ বলে মেয়ে মানুষ জমিতে নামলে ধানের ফলন কমে যায় কিংবা রমিছা ছেলে মানুষের মত চলে তখন তীব্র শারীরিক পরিশ্রমের সাথে তার মানসিক যুদ্ধও শুরু হয়। রমিছা একটা মেয়ে এবং মোজাফফরের সাথে সংসার ত্যাগের পর যে খুব আরামে অন্য কোথাও বিয়ে বসতে পারত এবং এবং মেয়ে হিসেবে দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে গিয়ে পুরুষতন্ত্রের পারপাস সারভ করতে পারত, সন্তান উতপাদনের ইলিমেন্ট হতে পারত এবং সেই সাথে খাওয়া পড়া নিয়ে সকল দুশ্চিন্তা দূরে সরিয়ে দিন যাপন করতে পারত কিন্তু সেসবের কোনটাই না করে কেন রমিছা এই পথ বেঁছে নিল এই প্রশ্নের উদয় হলে জিল্লুর মন মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরপুর হয়, সে ভাবে মা রমিছা চাইলেই নতুন বিয়ে করে জিল্লুকে ত্যাগ করে নতুন সংসারে যেতে পারত এবং তখন জিল্লুর নিজের কি পরিনতি হত সে কথা ভাবলে তার মন কেদে ওঠে এবং সেই সাথে কিছুক্ষণ আগেও এলাকায় রটানো কুতসা জনিত কারণ থেকে উৎসারিত ক্ষোভ থেকে জিল্লু যে নিজের মাকে গালি দেয় এই জন্য জিল্লু দেখে সে নিজেও একটা পুরুষ হয়ে উঠছে যেই পুরুষ জন্মগত ভাবে প্রিভিলেজড এবং নারীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তার মা রমিছা নিয়ে বাজে কথা বলে এবং জিল্লু নিজেও যে তার মাকে গালি দেয় এই কারনে সে তার মায়ের সামনে দাঁড়ালে তার মনে খারাপ লাগা কাজ করে এবং সেই থেকে আজ পর্যন্ত, রমিছার এই দাফন পর্যন্ত , জিল্লু হয়ত কোনদিন কখনও তার মায়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে নি এবং তার মনে উদয়ও হয় নি কেন তার মায়ের সংসার হয় নি কিংবা জিল্লু হয়ত আর কখনও এলাকার পুরুষের মত ভাবার সাহস পায় নি যে তার মা একটা নষ্টা।


রমিছার কেন সংসার হল না তা আমরা বলতে পারব না , কারন আমাদের জন্মের বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ব্যাপার নিয়ে আমাদের সত্যি জানা প্রায় অসম্ভব এবং সেহেতু মেঘডুমুরে ঘটে যাওয়া রমিছার জীবনের প্রতিই কেবল আমরা দৃষ্টি পাত করতে পারি এবং আমরা জানি রাজধানী শহর ঢাকায় বসে বিভিন্ন প্রগতিশীল দলের পক্ষে যেসব সভা সমাবেশ করা হয়, নারীদের বিপ্লবী মূর্তিকে প্যাট্রোনাইজ করা হয় কিংবা নারী অধিকার নিয়ে কথা বলা হয় তারা হয়ত জানে না তাদের দেশে একজন রমিছা আছেন যিনি সমাজের সকল প্রতিকূলতা ভেদ করে নিজের মত চলতে দ্বিধা করেন নি এবং আমরা দেখতে পাই এর মধ্যেই জিল্লু বড় হয়ে ওঠে এবং মায়ের সাথে জমিতে কাজ করতে পারে এবং তখন রমিছার কিছুটা শারীরিক কষ্ট লাঘব হলেও একটা প্রতিষ্ঠিত সমাজের সকল মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কৃষি কাজ করা শুধু তো একটা পেশা না কিংবা নিজের জীবিকা না, একটা প্রতিষ্ঠিত সমাজের মত, পথ আদর্শের বিপরীতে গিয়ে স্বাভাবিক একটা কাজ করলে যে সমাজের ওপর কোন আঘাতই পরে না কিন্তু তারপরও সমাজে সামাজিক ক্ষমতা কাঠামোতে পুরুষদের অবস্থান উপরে হওয়ার কারনে এবং কৃষিই যেহেতু এখানে ক্ষমতা চর্চার জায়গা সেই ক্ষমতার চর্চায় রমিছা নিজের জীবন বাঁচার তাগিদে কৃষি চর্চায় নামলে তা সমাজের প্রতিষ্ঠিত বয়ানের বিরুদ্ধে হওয়ার কারনে রমিছা যে সামাজিক, মৌখিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বাধার সম্মুখীন হন সেইটা রমিছাই ভাল উপলব্ধি করতে পারবেন এবং তার কিছুটা হয়ত তার ছেলে জিল্লুও উপলব্ধি করতে পারবে নিশ্চয়ই, কারণ সে নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করেছিল সামাজিক ক্ষমতার পুরুষতান্ত্রিক বয়ানের কারনে তার মাকে যে চারত্রিক উপাধি পেয়েছেন সেই পুরুষ তিনি হয়ে উঠবেন না কারণ জিল্লুর একদিন বোধোদয় হয় তার মা নতুন বিয়ে করতে পারত, অন্নের বাড়িতে কাজ করতে পারত কিংবা নিদেন পক্ষে পতিতালয়ে দেহ ব্যবসা করতে পারত কিন্তু তার কোনটাই করেন নাই বরং সেসব করলে জীবন যাই হোক ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই এবং সেই লড়াই থেকে উৎসারিত মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ থেকে রমিছা খুব সহজেই মুক্তি পেতে পারতেন কিন্তু এত বাধা অতিক্রম করে রমিছা এই কঠিন পথ ধরার কারণ আর যাই হোক অন্য সব বিকল্পে পথে গেলে সামাজিক নারী হিসেবে অন্য নারীদের যেখানে ক্ষমতা চর্চার টুল হিসেবে ব্যাবহার করা হয় সেরকম হতেন হয়ত এবং তার প্রতিদান স্বরূপ চারিত্রিক প্রশংসা পত্র মিলত সমাজের কাছে কিন্তু সেই বিকল্প পথে গেলে জিল্লুর জীবন কি হতে এটা ভাবলে জিল্লুর চোখে পানি এসে যায় এবং এই যে এলাকার সকল লোকের উপস্থিতিতে জানাজা সম্পন্ন করে রমিছার মৃত দেহ কবরে নামানোর জন্য অন্তত দুইজনের মানুষের প্রয়োজন হয় এবং সেই জমাট মজলিসে জিল্লুর সাথে জিল্লুর খালাত ভাই রহিমুদ্দি কবরে নামতে উ্দ্যত হলে একটা সোরগোল পরে যায় এবং সবাই তখন বলে মেয়ে মানুষের শেষ কার্যে বেগানা পুরুষের নামার কি দরকার এমন কানাঘুষা চলে এবং তখন সবাই আক্কাস আলীর দিকে দৃষ্টি ফেরায় এবং বলে আক্কাস আলীর সাথে রমিছার আজ অবধি তালাকের কোন খবর পাওয়া জায় নি তাই আক্কাস আলীই যে রমিছার কবরে নামার অধিকার রাখে এই সিদ্ধান্ত নিতে কারোরই মুহূর্তের বেশি সময় লাগে না এবং এই সিদ্ধান্ত নিতে জিল্লুর সম্মতির দরকার পরে নি সেই ভরাট মজলিসে। কিন্তু এইটা শোনার পর জিল্লুর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে এবং সে তখন কি করবে ভেবে পায় না এবং সে দেখে তার মা মৃত, খাটিয়ায় শায়িত, যিনি সারা জীবন ক্ষমতার বিরুদ্ধে, প্রচলিত বয়ানের বিরুদ্ধে লড়াই করে শেষ জীবন খুব কষ্টে পার করে আজ চির শান্তির জগতে চলে যাওয়ার মুহূর্তের সময়ও আবারও রমিছা বেগমের উপর সমাজের প্রচলিত বয়ান তার ওপর বহু বছর আগের স্বামী নামের এক বোঝা আক্কাস আলীকে চাপিয়ে দেয়, চাপিয়ে দেয় এই অর্থে যে গত চল্লিশ বছর আক্কাসের সাথে কোন মুখের দেখা, কোন শারীরিক কিংবা সামাজিক সম্পর্ক না থাকার পরেও এবং এই চল্লিশ বছর নিজের বৈধ স্ত্রী হিসেবে বিন্দুমাত্র দায়িত্ব পালন না করেও রমিছা বেগমের শেষ কৃত্যে আক্কাস আলী যে কারনে শুধু মাত্র পুরুষ হওয়ার জন্যই রমিছার কবরে নামার অধিকার পান সেই ক্ষমতা কাঠামোর প্রতি জিল্লুর প্রচণ্ড বিদ্বেষ জাগে এবং সেই সমস্ত বিদ্বেষ, রাগ, ক্ষোভ, অভিমান কিংবা রমিছার সকল কষ্ট জিল্লুর গাল বেয়ে অশ্রু হয়ে ঝড়ে পরে এবং পিতা আক্কাস আলীর সাথে কবরে নেমে রমিছার মৃত দেহ নামিয়ে শেষ দেখা দেখে সাদা কাফনে মুড়ানো শরীর মাটিতে নামিয়ে রেখে উপরে উঠা মাত্র বাঁশের তৈরি খাটিয়া দিয়ে রমিছার কবরের বক্সার নিমেষের মধ্যে ঢেকে ফেলা হয় এবং জিল্লুর কানে বাজে মসজিদের ইমাম সাহেবের মুখ নিঃসৃত ধবনি- মিনহা খালাকনাকুম, ও ফিহা নুইদুকুম, ওয়া মিনহা নুখ্রি জুকুম, তারাতান উখড়া। এই ধনি কানে আসলে জিল্লুর সম্বিত ফিরে আশে এবং জিল্লুও তখন কবরে তিন বার তিন মুঠো মাটি দিয়ে মায়ের প্রতি তার শেষ দায়িত্ব টুকুও সমাপ্ত করে কিন্তু সেই মুহূর্তের জিল্লুর ইচ্ছা হয় আরও কয়েক মুঠো কিংবা অনেক মুঠো মাটি সে যদি মায়ের কবরে দিতে পারত তাহলে বোধ হয় তার এই ভেবে মানসিক শান্তি অর্জিত হত যে তার আরও কয়েক মুঠো স্পর্শ তার মায়ের কবরে রচিত হত এবং ছেলে এবং মায়ের পরম স্পর্শ লেগে থাকত এই বুচনু আড়ার মাঝে রমিছা বেগমের কবরস্থানে। কিন্তু না তা হয়ে ওঠে না এবং জিল্লু মাত্র তিন বার, গুনে গুনে কেবল মাত্র তিনবারই কবরে মাটি দিতে দিতে উচ্চারন করে মিনহা খালাক নাকুম, ও ফিহা নুইদুকুম, ও মিনহা নুখ্রিজুকুম তারাতান উখড়া এবং শেষ মুঠো মাটি দিতে গিয়ে জিল্লু মিয়া একটা বিকট আর্তনাদ করে ওঠে এবং কান্নায় ভেঙ্গে পরে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত