বাবার যা ভুলো মন- তাই বলে এমনটা হবে ভাবেনি মিতুল। নতুন ক্লাশের নতুন নোট বই প্রয়োজন, বাবা বলেছেন আনবেন, ও অপেক্ষায় ছিল। বাবা নোট বইয়ের বদলে একমুঠো উইপোকা কিনে আনলেন, যত্ম করে স্কুলের ব্যাগে ভরে দিলেন।
মিতুল মা’র কাছে শুনেছে বহুদিন আগে বাবা একটা সমুদ্র কিনেছিলেন। সমুদ্রে তখন প্রবল জলোচ্ছাস, প্রতি মুহুর্তে ঢেউয়ের উচ্চতা বাড়ছে, আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। তিনি প্রতিদিন গভীর আগ্রহ নিয়ে সর্বস্বের বিনিময়ে শেয়ার বাজার হতে কেনা সমুদ্রের ঢেউ গুনতেন, উচ্চতা মাপতেন আর ভাবতেন- ঢেউ আকাশ স্পর্শ করলেই সমুদ্রটা বিক্রি করে কিছু জমি কিনবেন।
বিপদের দিনে চাখবেন বলে মা টিনের কৌটায় আশা ভরসার সিরকা মেখে ভাংতি পয়সা ও খুচরো টাকা জমাতেন। সব আশাভরসা খরচ করে মা বাবাকে আরও ক’টা ঢেউ কিনে দিলেন আর স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন- খুব তাড়াতাড়ি একটা চৌকো জমি কেনা হবে। জমির পেছন দিকটায় থাকবে পাকা বাড়ি, সামনে খোলা উঠোন, ওই উঠোনে মিতুল খেলবে। উঠোনের একপাশে বাঁশের মাচায় তরতরিয়ে উঠবে পুঁই আর লাউশাক, কখনও কখনও বড় সিম বা কাকরোল। ছাদের টবে ফুটবে গোলাপ, রাতে ঘ্রাণ ছড়াবে হাস্নুহেনা।
এক সকালে হঠাৎ করেই ক’টা তিমি, হাঙর আর ডলফিন সমুদ্রের সব ঢেউ পান করে গাঙচিল হয়ে উড়ে গেল। সমুদ্র বিক্রয় দপ্তরের ঠিকানাটা রইলো, কিন্তু সমুদ্রের কঙ্কালটাও খুঁজে পাওয়া গেল না। এরপর থেকেই বাবা যেন কেমন হয়ে গেছেন, এই তো সেদিন এক সপ্তাহ চলার মত চাল কিনতে গিয়ে দুই মাসের ক্ষুধা কিনে ফিরলেন।
সবাই নতুন বই নিয়ে স্কুল যায়, নতুন ব্যাগ, নতুন জুতো, নতুন ড্রেস। শুধু মিতুলের পুরানো ব্যাগ, পুরানো জুতো, পুরানো ড্রেস। পুরানো ব্যাগ ভর্তি উইপোকা। একদিন ক্লাশে হাকিম স্যার মিতুলের কাছে নোটবই চাইতেই ও ক’টা উইপোকা স্যারের হাতে তুলে দিলো। স্যার পোকাগুলো ফেরত দিয়ে হতাশ সুরে বললেন, তিন মাসের বেতন বাকী আর তোর বাবা উইপোকা কিনে টাকা ওড়ায়!
মিতুল ঘরে ফিরে মা’কে প্রশ্ন করে , ‘উইপোকার কি অনেক দাম, মা!’ মা আলু দিয়ে পানি ভুনা করছিলেন, হাঁড়িতে লবণ দিতে দিতে জানালেন, ‘আমাদের মত মানুষ ছাড়া আর সবকিছুরই অনেক দাম।’ মা’র উত্তর শুনে মিতুল অবাক হয় না, এ কথা ও বহুবার শুনেছে, স্বগতোক্তি করে, ‘বাবা অনেক দাম দিয়ে কেনো যে উইপোকা কিনলেন!’ মা হাঁড়ির ঢাকনা খুলতেই একরাশ ধোঁয়া বেরিয়ে এলো, হাড়িভর্তি ফুটন্ত পানিতে আলুর ক’টা টুকরো লাফাচ্ছে, মা ওই দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘তোর বাবা উইপোকাও চিনে না, তুই ব্যাগে ঘুনপোকা নিয়ে ঘুরছিস, বাবু।’
ম্যালামাইনের হলদে হয়ে আসা পুরানো প্লেটে দু’মুঠো বাসি ভাতের ওপর এক চিমটি লবণ আর এক কাপ পানি ভুনা ঢেলে মা মিতুলকে খেতে দেন। দীর্ঘশ্বাসের শীতলতা ছুড়ে চুলোর আগুন নিভিয়ে বললেন, ‘ওদের দাঁত বড় হয়ে চোয়াল ফুঁড়ে বেরুবে, এর আগেই ওদের ছেড়ে দিস, বাবু।’
‘দাঁত বড় হতে হতে চোয়াল ফুঁড়ে বেরুবে!’ — ভাবতেই মিতুলের গায়ে কাঁটা দেয়। মা বলেছেন ওদের কিছু না কিছু কাটতে হয়, না কাটলে দাঁত বড় হয়, হতেই থাকে- চোয়াল ফুঁড়ে বেরোয়, মগজ ফুরে বেরোয়, তারপর মরে যায়।
উই হোক বা ঘুন, পোকাগুলোকে মুক্তি দিতে হবে। পরদিন ক্লাশে সবাই বই খুলে বসে, মিতুল বসে ব্যাগের জিপার খুলে। জিপার খোলা পেয়ে প্রথমে তিনটা পোকা বেরিয়ে আসে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর একটা একটা করে পোকা নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে, স্বাধীন আশ্রয়ের সন্ধানে পিলপিল পায়ে হেঁটে যায় এদিকে ওদিকে সেদিকে। ক’টা পোকা ফের ব্যাগে ঢুকে যায়- ওদের গন্তব্য পৃথক।
মিতুল জানে না কী ভীষণ কাণ্ড ঘটে গেছে। পোকাগুলো ছড়িয়ে পড়েছে পুরো স্কুলে। মা পোকাদের প্রসবিত ডিম ফুটে বেরিয়েছে শিশুপোকা। দাঁতের যন্ত্রণায় বড় পোকাগুলো সারাটা দিন কুটকুটকুটকুট করে ক্লাশরুমের দরজা, জানালা আর বেঞ্চ কাটে। ছোট পোকাগুলো মনের আনন্দে কাটাকুটিতে মন দেয়, ওদের দাঁতেখড়ি হয় লাইব্রেরির বই কেটে। ওদেরও দাঁত বড় হয়, ধারালো হয়, ওরা স্কুলের দেয়াল কাটে, ছাদ কাটে, অচল নিয়ম ও দোদুল্যমান আদর্শ কাটে। দিনের কোলাহলে পোকার দন্তচর্চার শব্দ পাওয়া যায় না, রাতের নিরবতায় শোনা যায় কুটকুটকুটকুট… কুটকুটকুটকুট… কুটকুটকুটকুট… যেনো মেশিন চলছে।
ক’মাস পরের কথা, পোকার অক্লান্ত দাঁতের চাপে ঝুরো ঝুরো হয়ে ধুলায় মিশেছে পাঠ্যবই, খসে পড়েছে স্কুলের জানালা, গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে ভেঙে গেছে দরজা, ধ্বসে পড়েছে দেয়াল। স্কুলের শূন্য ভিটায় ঘুঘু চড়ার কথা, কি আশ্চর্য- ধ্বংসস্তুপের ফাঁকফোকর ভেদ করে জন্মেছে ঘাস, ফুটেছে নাম না জানা ফুল, উড়ছে এক ঝাঁক অনিন্দ্যসুন্দর প্রজাপতি।