আশ্বিনের এক দুপুরবেলা রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের দিকে তাকিয়ে তনিমা অবাক হয়ে যায়। দেখতে পায় রোদের ক্যানভাসে শীতের কয়েকটা ছোপ যেন এখনই টের পাওয়া যাচ্ছে। এই সময়টা তার খুব ভাল লাগে। মনে হয়, এই যে নির্ভার রোদের মধ্যে আগমনী শীতের খেলা, এটা এই পৃথিবীতে শুধু তার চোখেই পড়ে। শীতের তো রশ্মি হয় না, আবার এত আগে কুয়াশাও পড়ার কথা নয়। তবু বাতাসে একটা ঘ্রাণ সে পায়। হাওয়া উত্তর দিক থেকে বইতে শুরু করেনি। কিন্তু প্রকৃতিতে কোথাও যেন শীতের জন্ম হয়েছে। অনেক দূরে বৃষ্টি হলে যেমন ঘ্রাণ পাওয়া যায়, বাতাসে ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ আসে তেমনই কিছু একটা। তনিমা মাঝে মাঝে ভাবে এর কী নাম দেওয়া যায়? বিকল্প না পেয়ে সে এর নাম দিয়েছে ‘আবেশ’। দুপুরে রোদের মধ্যে শীতের আবেশ খেলতে দেখে তনিমায় শরীর চনমন করে ওঠে। বুঝতে পারে আজকের দিনটা বিশেষ। অবশ্য সকালেই মনে হয়েছিল তার, আজকের দিনটা ভাল কাটবে। বাসা থেকে নিয়মিত টিফিনবক্সে দুপুরের খাবার নিয়ে অফিসে আসে। আজ মনে হলো, খাবার নেবে না। রান্না-বান্না করেছে। তমালকে খাবার দিয়েছে। বাচ্চাদের জন্য খাবার টেবিলে সব সাজিয়ে টিফিন বক্স ছাড়া বেরিয়েছে। তমাল আগেই বেরিয়ে যায় অফিসের মাইক্রোবাস ধরার জন্য। তনিমা ধীরেসুস্থে বেরিয়ে সিএনজি নিয়ে অফিসে এসেছে।
তমাল খেয়াল করলে বলতো, আজ কি বাইরে দাওয়াত আছে নাকি? তনিমা তখন তাকাতো নিজের হ্যান্ডব্যাগের দিকে। বলতো, ওহ খাবার নেইনি তাই?
ছোটখাট ব্যাপারে তমালের বেশ মনোযোগ।
তারপরই বলতো, আজকে একটু বাইরে খাবো।
তমাল জানে তনিমা নিজের মর্জিমতো চলে। সাজানো-গোছানো কমপ্লিট নারী বলতে যা বোঝায় তমালের কাছে তনিমা তা-ই।
সে হয়তো বলতো, আজও কি সেই তোমার প্রিয় পিৎজা? নাকি নতুন কোনো রেস্টুরেন্ট ওপেন হয়েছে গুলশানে? তোমাদের কত মজা না? নতুন নতুন রেস্টুরেন্ট হয় আর দল বেঁধে খেতে যাও।
আজ অবশ্য দল বেঁধে খেতে যাবার ইচ্ছা নেই তনিমার। একা একা হেঁটে গিয়ে কোথাও বসবে। নিজের নয়, আজ অন্যের রান্না খাবে। কোথায় খাবে জানে না। অফিস থেকে বেরিয়ে কাছে কোথাও যাবে। হাঁটা দূরত্বে। ফিরবেও হেঁটে। সল্টজ ফাইন সি ফুড থেকে ফিরতে গিয়ে রোদের মধ্যে শীতের আবেশ খেয়াল করে তনিমা একটু থমকে দাঁড়ালো। রোদের দিকে তাকিয়ে নিজে নিজে বললো, বাপরে।
কেমন একটা সুখ তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। শীত তাহলে আসছে- নিজেকে খবরটা দিল তনিমা। শীত আসার আগে কত কাজ পড়ে যায় তার।
শীতকাল এলে আরাম লাগে তানিমার। মাঝে মাঝে আবেশে মরে যেতেও ইচ্ছা করে। সবচেয়ে ভাল লাগে এই সময়টা। কেমন একটা প্রেম প্রেম ভাব। শীতের পূর্বরাগ চলতে থাকে প্রকৃতিতে। হঠাৎ একটা বাতাস কোথা থেকে এসে যেন দোলা দিয়ে যায়। ভাবলো, শাড়িগুলো নামিয়ে কালই রোদে দেবে। কাল ছুটির দিন। কিন্তু অন্য ছুটির দিনের মতো আলস্য যেন ভর না করে, এটাই এখন তার চাওয়া। তার কালেকশনে শাড়ি অনেক। একটা একটা করে জমিয়েছে। তমালও জানে, শাড়িই পছন্দ ওর। সুযোগ পেলে শাড়ি গিফট করে। তার আম্মা একদিন ডেকে বলেছিলেন, শাড়ি তো আমি পরি না। তুমি সব নিয়ে যাও। সব কী আর নিয়ে আসা যায়? আম্মা যেগুলো অনেক বছর পরে না সেগুলো সে নিয়ে এসেছে। নিজে তো কেনেই দেখেশুনে। বাছবিচার করে। ফেব্রিকস না দেখে, বুনন না দেখে শুধু ডিজাইন দেখে অনলাইনে শাড়ির অর্ডার সে দেয় না। শুধু শাড়ি নয়, কাপড় কিনতে হলে ধরে তাকে দেখতেই হবে। টেকশ্চার অনুভব করতে হবে। শাড়িগুলো হ্যাঙ্গারে ভাঁজ করে সাজিয়ে রাখে ওয়ার্ডরোবে। কোথাও যেন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঁজ না পড়ে। নিয়মিত ওয়ার্ডরোব খুলে দেখে। ন্যাপথলিন দেয়। ন্যাপথলিনের গন্ধটা বেশ পছন্দ তার। তন্দ্রা আর তূর্য যখন ছোট ছিল তখন ওরাও ওয়ার্ডরোব থেকে শাড়িগুলো বের করার সময় আশপাশে বসে থাকতো। ন্যাপথলিনের গন্ধ খুব পছন্দ ছিল তাদের। এখন দুজনের কেউই আর কাছে ঘেঁষে না। নিজেদের বন্ধু-বান্ধব তৈরি হয়েছে। আর স্মার্টফোনের ভেতর এমনই ডুব দিয়েছে যে বাসায় থাকলেও ওদের দেখা পাওয়া ভার। তনিমা শুরু থেকেই খুব সতর্ক ছিল, পড়াশোনায় খুব ভাল না হলেও বখে যায়নি ছেলেমেয়েরা। স্মার্টফোন ব্যবহার করলেও একেবারে এডিক্ট হয়ে যায়নি।
ছুটির দিন তমালের রুটিন এলোমেলো হয়ে যায়। সারাদিন ঘুমাতে চায়। আজ আর বাজার হবে না। বাজারে তনিমাই যায়। মনে মনে হিসাব করে দেখলো, ফ্রিজে যা আছে তাতে বাজারে না গেলেও চলবে। সপ্তাহটা টেনেটুনে চলে যাবে। দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে তমাল উঠে সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমা দেখতে বসার আগে ওকে সবজির বাজারে পাঠাতে পারলে আর চিন্তা থাকবে না। সকালে নিজে খেয়ে, বাচ্চাদের নাস্তা দিয়ে ওয়ার্ডরোবটা খুললো তনিমা। তমাল বললো, আজ কি আবার সেই শাড়ি ডে? তমাল জানে, তিনমাস পরপর ছুটির দিনে তনিমার রুটিন কাজ এটা। বললো, আমি তাহলে গেস্ট বেডে চলে যাই। তমাল উঠে গেলে তনিমা শাড়িগুলোতে আলতো করে হাত বোলালো, যেন আদর করছে। ধরে দেখে, গন্ধ নিয়ে একটা সুখের আমেজ ভর করলো তার ওপর। বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকালো, রোদের গায়ে খেলা করা শীতের ছোপগুলো দেখে মনে মনে বললো, বাহ।
হ্যাঙ্গারের শাড়িগুলো পরে ধরবে, আগের দিনই ভেবে রেখেছে তনিমা। আজ বরং ডাঁই করে রাখা শাড়িগুলো আগে ধরবে। মাঝের তাকে রাখা শাড়িগুলো একটু অবহেলিত। দামিগুলো স্বভাবিকভাবে খাতির পায়। এদের জায়গা হ্যাঙ্গার। তনিমা খেয়াল রাখে যেন এগুলো ঠিক থাকে। বাকীগুলোও বের করে কিন্তু তিনমাস পর পর বের করে রোদে শুকানোর সুযোগ পায় না। ওরা হয়তো বছরে একবার রোদের মুখ দেখে। দুটো বারান্দায় আর কত শাড়ি ধরে। এবার ভেবেছে, অবহেলিতগুলোই আগে বের করবে। মাঝের তাকের সব শাড়ি বের করে বিছানায় ছড়িয়ে ওপরের তাকে নজর দিল সে। এক পাশে একটা লাল পেড়ে শাদা শাড়ি দেখে অবাক হলো। ওটা আলাদা হয়ে আছে। অনেকদিন খেয়ালই করেনি তনিমা। বুড়ো আঙ্গুলে ভর দিয়ে ওপরের তাক থেকে আলাদা করে শাড়িটা নামিয়ে ভাঁজ খুলতেই কেঁপে উঠলো সে। ন্যাপথলিনের গন্ধ ছাপিয়ে একটা অন্যরকম গন্ধে সে কয়েক সেকেন্ডের জন্য অবশ হয়ে গেল।
অদ্ভূত না? নিজে থেকেই বললো সে।
মুখটা লাল হয়ে উঠলো তার। ঘরের দরজা বন্ধ করে আবার শাড়িটা হাতে নিলো। একটু ইতস্তত করছিল। তবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শাড়ির কাছে নাক নিয়ে গেল। আস্তে আস্তে গন্ধটা নিতে থাকলো।
আবারও বললো, অদ্ভূত! কীভাবে সম্ভব?
শাড়িটা জড়িয়ে ধরলো সে। লক্ষ্য করলো তার হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে। মেঝেতে বসে পড়লো তনিমা। তার শরীর ও মন কেমন আর্দ্র হয়ে উঠছে। রসায়নটা সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু ঘটনাগুলো একে একে মনে পড়তে থাকলো তার।
১৪২৫ সালের পয়লা বৈশাখ কী যে এক অ্যাডভেঞ্চার ভর করেছিল তনিমার ওপর। ঘটনাটা ইচ্ছা করে ভুলে যেতে চেয়েছিল সে। তার ভাষায় এটা আনলাইক মি। ওর সাজানো গোছানো পরিপাটি জীবনের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।
রবীন্দ্রসঙ্গীত সে ছোটবেলা থেকেই শোনে। রান্নার সময়ও কানের ইয়ারফোনে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতে থাকে। মনের কথাগুলো যেন নতুন করে ভাষা পায় এই গানগুলোতে। সেবার পয়লা বৈশাখে তার ইচ্ছা হলো, খুব ভোরে রমনা বটমূলে যাবে। সেখানে রবীন্দ্রনাথের গান শুনবে। ইচ্ছাটা যে তারই সেটা অবশ্য নাও হতে পারে। কেননা কয়েক মাস ধরে লোকটা তাকে প্রোভোক করছিল। নামটা মাঝে ভুলে গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু আজ স্পষ্ট মনে পড়লো, আলমগীর। মুখে উচ্চারণ করলো সে, আলমগীর!
ইনবক্সে কয়েক মাস ধরে কথা বলছিল। নম্র, ভদ্র একটা মানুষ। রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ করে। টুকটাক গান, আবৃত্তিও করতো বোধহয়। গুছিয়ে কথা বলে। একটু উদাস টাইপ। আলমগীর একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, কখনো সূর্য ওঠার আগে রমনায় গিয়েছেন?
তনিমা যায়নি শুনে সে ভোরের রমনার বর্ণনা দিতে শুরু করেছিল নিয়মিতভাবে।
জানেন, ভোরের রমনা একেবারে অপার্থিব। উদ্যানের গাছগুলোর মাঝ দিয়ে যখন ভোরের প্রথম আলোটা আসে, মনে হয়, এ পৃথিবী এত সুন্দর! যেন স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। আলোর রশ্মি এসে মাটিতে পড়লে ওই মাটিতে খালি পা ছোঁয়াতে এত ভাল লাগে। আর যদি আপনি গাছ চেনেন তাহলে তো কথাই নেই। জানেন, দ্বিজেনদা যখন বেঁচে ছিলেন তখন তার সঙ্গে মাঝে মাঝে রমনায় যেতাম। দ্বিজেনদা গাছ চেনাতেন। একেক গাছের পাতা বেয়ে নেমে আসা রোদ একেক রকম। তার গন্ধও একেক রকম। দ্বিজেনদাকে চেনেন তো?
তনিমা লেখালেখির জগতের লোক না হলেও পড়ে। দ্বিজেন শর্মাকে বেশ চেনে। জানে অনেক কিছু তার সম্পর্কে। লেখক-কবিদের অনেককেই চেনে। আলমগীরের কথা রিলেট করতে পারে সহজে। লেখকদের আলমগীর ভাই বলে ডাকলে তারও আপন মনে হয়।
তনিমা বলে, অতো ভোরে রমনায় যাইনি কখনো। কিন্তু পয়লা বৈশাখের সকালে গিয়েছি অনেকবার। বটমূলে ছায়ানটের গান শুনেছি। সুন্দর তো।
ভোরে না গেলে বুঝবেন না। রমনার আসল স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ অনুধাবন করতে পারবেন না, আলমগীর বলে। সত্যি কথা বলতে, পয়লা বৈশাখের ভিড়, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এসব এড়িয়ে ভোরের নির্জন রমনা আলাদা বস্তু। কিন্তু আপনার তো তেমন উপলক্ষ তৈরি হবে না সহসা। একটা কাজ করবেন? সামনের পয়লা বৈশাখে ভোরে রমনায় আসবেন? একসঙ্গে সূর্যোদয় দেখবো।
তনিমা বলেছিল, সূর্যোদয় কখন হয়?
বৈশাখে পৌনে ছয়টায় হবে।
তার মানে রওয়ানা দিতে হবে সেই চারটায়।
তা কেন? পাঁচটায় বেরুলেও চলবে। আপনাকে বাসার সামনে থেকে তুলে নেবো।
অতো ভোরে নাকি ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য। আমার তো এখনই ভয় করছে অতো ভোরে বের হতে হবে ভেবে।
পয়লা বৈশাখে কিছু মানুষ পথে থাকবেই। আমি একটা সিএনজি নিয়ে মিরপুর ১৪ নাম্বার থেকে আপনাকে পিক করবো। এক সিএনজি করেই চলে যাবো রমনা। আশা করি সমস্যা হবে না।
তনিমা সহসা হ্যাঁ করে না। বুঝতে চায় লোকটাকে। কয়েক মাসের আলাপে এতটা নির্ভর করা যায় কি না ভাবে। অতো ভোরে সিএনজিতে কোনো সুযোগ নিতে পারে। চারদিকে অন্ধকার থাকবে তো। অনেক ভাবে সে। পয়লা বৈশাখে একা বেরুবে- এটাই বা কীভাবে হয়। তন্দ্রা, তূর্য, তমাল, তনিমা তো একসঙ্গেই বৈশাখের প্রথমদিন বাইরে যায় সাধারণত। সকালে পান্তা-ইলিশ খেয়ে রমনা, শাহবাগ ঘুরে ক্লান্ত হয়ে দুপুর গড়িয়ে বাসায় ফেরে। তমালকে কী বলবে ভেবে পায় না। প্রায় অচেনা একটা লোক তাকে একা পিক করে ভোরে রমনায় নিয়ে যাবে? কেমন হবে? আনলাইক তনিমা। ভাবে কোনো এক বান্ধবীর কথাই বলবে। যেমন, শোনো ইয়াসমিনরা বলছিল, ভোরে সূর্য ওঠার আগে রমনা নাকি দারুণ লাগে। কয়েকজন মিলে যাবার প্লান করছি। শুধু মেয়েরা। ইয়াসমিন গাড়িতে পিক করবে মোড় থেকে।
তনিমা নিজেকে বলে, এগুলো কেন ভাবছে সে? তমালের কাছ থেকে কিছু কি লুকাচ্ছে? মনে হচ্ছে যেন তমালকে মিথ্যা বলে যেন অভিসারে যাবার পরিকল্পনা আঁটছে।
এদিকে আলমগীর রমনার আইডিয়াটা মাথা থেকে সরাচ্ছে না। লোভ দেখিয়েই যাচ্ছে। রমনায় এখন কী কী ফুল ফুটেছে জানেন?
কৃষ্ণচূড়া? লালে লাল হয়ে যায় না? বলে, তনিমা।
শুধু কৃষ্ণচূড়া? রাধাচূড়া, কনকচূড়া, সোনালু, জারুল, কুরচি, গুস্তাভিয়া, কাঠগোলাপ, ডুলিচাপা, উদয়পদ্ম, পাদাউক, মধুমঞ্জুরি, কমব্রেটাম, পালাম, নাগেশ্বর, হিজল, ঝুমকো লতা, জ্যাকারান্ডা, অশোক।
এত? আপনি সব গাছ চিনে রেখেছেন নাকি?
দ্বিজেনদার সঙ্গে কিছুদিন ঘুরলে আপনিও চিনে যেতেন।
আলমগীরের কাছে এত এত ফুলের নাম শুনে তনিমার লোভ হয়। যাবার তো ইচ্ছা হয়, কিন্তু বাসায় কী বলবো। অতো সকালে যাবার কথা কেমন শোনাবে?
তনিমা মুখে আর বলে না- আলমগীর তার কাছে অচেনা একটা লোকই। ফেসবুকে পরিচয়। প্রোফাইল ঘুরে যা বুঝেছে তাতে লোকটাকে ক্ষতিকর মনে হয়নি। কিন্তু নিশ্চয়তাই বা কী? কত ঘটনা ঘটছে চারদিকে। ফেসবুকে পরিচয়, দেখা করতে গিয়ে ধর্ষিত তরুণী। এসব একদম নিতে পারে না তনিমা। এমন খবর সামনে এলে চোখ ফিরিয়ে নেয়। বোঝার জন্য কয়েকদিন ঘনিষ্ঠভাবে ফলো করে আলমগীরকে। লোকটা হয়তো খারাপ নয়, ভাবে সে। সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, যাবে?
মন বলে, যাবে। ভোরের রমনায় বৈশাখের প্রথম দিন।
একদিন আলমগীরকে হ্যাঁ করে দেয়।
আলমগীর উচ্ছ্বাস দেখায় না মুখে।
শুধু বলে, আপনার স্মৃতিতে অনেকদিন থাকবে ভোরের ছবিটা। রমনার ভোরের কয়েকটা ছবিও পাঠায় আলমগীর। আক্কাস মাহমুদের তোলা। ছবিগুলো দেখে তনিমার আগ্রহ বেড়ে যায়। বলে, এত সুন্দর! যাবো।
পয়লা বৈশাখের আগের রাতে ভাত রেঁধে পান্তা বসায় তনিমা। ডিপ থেকে ইলিশ বের করে ম্যারিনেট করে ফ্রিজে রেখে দেয়। ভোর চারটায় উঠে ভেজে ফেলে। গিমা শাক ভাজি করে। করলার একটা পদ করে। আড়ং থেকে কেনা মাটির পাত্রে সব সাজিয়ে রেখে দেয় টেবিলে। বলে, ঠিক আছে না? এরপর স্নান করে ভাবতে থাকে কী পরবে। শাড়ি তো অবশ্যই। লাল পেড়ে শাদা একটা শাড়ি অনেক বেছে প্রবর্তনা থেকে কিনেছিল। সুতির সফট টেকশ্চারের কাপড়। সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ। কপালে বড় একটা লাল টিপ পরলো। নিজেকে জিজ্ঞেস করলো, আমি কি অভিসারে যাচ্ছি?
উত্তর এলো, অবশ্যই না।
প্রস্তুত হয়ে তমালকে ডাকলো।
টেবিলে সব গোছানো আছে। তোমরা কি যাবে রমনায়?
তমাল বললো, তোমাকে ফলো করার ইচ্ছা আমার নেই। আমরা বেরুলে ১২ নাম্বারের দিকে যাবো। শুনলাম, ওদিকে একেটা মেলা হচ্ছে।
অতো ভোরে বাসা থেকে বের হতেই গা টা ছমছম করে উঠলো তনিমার। মোড় থেকে বাসা পর্যন্ত গলি খুব দূর নয়। কেউই নেই গলিতে। দেখলো, নির্জন মোড়ে সিএনজি দাঁড়ানো। তাকে দেখে সিএনজি থেকে নামলো আলমগীর। কল্পনার সঙ্গে মেলালো লোকটাকে। মেলে তো।
আলমগীর সিএনজিতে দূরত্ব রেখে বসলো। এতে বেশ স্বস্তি পেল তনিমা। প্রথম দেখায় লোকটাকে ভদ্র মনে হলো তার। প্রায় অন্ধকার রাস্তায় যানবাহন কিছুই নামেনি। দ্রুত রমনায় পৌঁছে গেল তারা। রূপসী বাংলার গেটে নামলো। পথে তেমন একটা কথা বললো না আলমগীর। ইনবক্সে গুছিয়ে কথা বলতে পারলেও সামনাসামনি তাকে বেশ লাজুকই মনে হলো তনিমার।
সে-ও কিছু বললো না। আড়ষ্ঠতাটা কাটার অপেক্ষায় দুজনই। ওরা পৌঁছানোর পরপর রমনায় ভোরের আলো ফুটলো।
আমরা সফল হলাম। কী বলেন তনিমা?
তাই তো দেখছি।
ঘুরে ঘুরে গাছ আর ফুল দেখাতে শুরু করলো আলমগীর। বললো, প্রথম গানটা যখন বেজে উঠবে, দেখবেন গাছগুলো খলখল করে উঠছে। জানেন তো, গান শুনলে গাছরা কত খুশি হয়?
তনিমা বললো, আপনাকে চুপচাপ থাকতে দেখে আমি তো ভেবেছিলাম সামনাসামনি একদম বলতেই পারেন না। অবশেষে কথা ফুটলো তাহলে।
আলমগীর হাসে।
দুজনে মিলে উদ্যান ঘুরে বটমূলে যায়। ওরা পৌঁছাতেই গান বেজে ওঠে।
ঘণ্টা দুয়েক বটমূলে বসার পর আলমগীর বলে, খেয়ে নিশ্চয়ই বের হননি?
তনিমা মাথা নাড়ে।
আমিও খাইনি। পান্তা ইলিশ খাবেন নাকি?
তনিমাও ভাবছিল, রমনায় পান্তা ইলিশ খাবে কি না। আলমগীর বললো, আরেকটু অ্যাডভেঞ্চার করবেন? পুরান ঢাকায় যাবেন?
নিরবে? তনিমা বলে। নিরবের খাবার তার পছন্দের।
অনেক হাঁটতে হবে কিন্তু। দোয়েল চত্বর না পেরুলে রিকশা মিলবে না।
দুজনে কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকলো। আলমগীর বললো, শাদা শাড়িতে এত সুন্দর লাগে আপনাকে!
সবাইকেই লাগে।
আপনি আলাদা রকম সুন্দর। একটা মাদকতা আছে। আপনার দৃষ্টি যেন এখানে নেই, কোনো এক সুদূরের পানে চেয়ে আছে।
পটানোর চেষ্টা করবেন না কিন্তু। আমি জানি আপনি ভাল মানুষ।
আলমগীর একটু থমকে যায়।
তনিমা ভাবে, রিকশায় উঠলে শরীরে শরীরের স্পর্শ এড়ানো যাবে না। একবার মনে হলো নিজে একটা রিকশায় উঠে আরেকটা রিকশায় আলমগীরকে উঠতে বলবে। কিন্তু যার সঙ্গে এত ভোরে বাসা থেকে বেরিয়েছে তাকে তো এমন করে বলা যায় না। দুজন তাই এক রিকশায় নিরবের দিকে রওয়ানা দিলো। রিকশায় উঠেই বুঝলো, আলমগীর যথেষ্ট সতর্ক। একপাশে আড়ষ্ঠভাবে নিজের ছিপছিপে শরীর নিয়ে বসে থাকলো। অনেকটা পথ হেঁটে বেশ ঘেমে গেছে আলমগীর। একটু দূরত্বও রেখেছে ওইটুকু জায়গায় নিজেকে ম্যানেজ করে। তনিমার মায়া হলো। মনে হলো, ঘেমে যাওয়ার কারণেই লোকটা এমন আড়ষ্ঠ হয়ে বসেছে। ঘাম তো একটা স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া, মানুষ ঘামবেই। বললো, স্বাভাবিকভাবে বসুন না।
আলমগীরের ডানপাশটা এবার তনিমার শাড়ির সংস্পর্শে এলো। আলমগীর ভাবছিল, ডান হাতের বেড়টা তনিমার পিঠের দিকে দেবে কি না। ধরবে না তাকে। তবে হাতটা ওইদিকে দিলে তার সুবিধা হতো। কিন্তু অনেক ভেবেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। একুশে হলের সামনে স্পিডব্রেকারে রিকশা ব্রেক করলে আলমগীরের হাত আপনাআপনি কোমরের দিক থেকে তনিমাকে ধরে ফেলে। তনিমা বুঝে গেল, কী ঘটে গেছে। সাবধানী হতে গিয়ে একটা ভুল করলো সে। আলমগীরের দিকে সরে এলো। আলমগীরও ভুল বার্তা পেয়ে তনিমার কোমরটা আরও ভাল করে জড়িয়ে ধরলো। তনিমা ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলো, একটা লজ্জাও ঘিরে ধরলো তাকে। ডান হাতে আলমগীরের হাতটা খুলে সরিয়ে দিলো।
আপনি অনেক সুন্দর।
আলমগীরের শরীরের গন্ধটা টের পেতে শুরু করলো সে। আলমগীরও হয়তো তার শরীরের গন্ধ পাচ্ছে, চুল থেকে ঘ্রাণ নিচ্ছে। তনিমা ভাবলো, আলমগীর কি চন্দনের গন্ধ পাচ্ছে? ঘাম, পারফিউম আর রোদের গন্ধ মিলিয়ে আলমগীরের গন্ধ তাকে একটু অস্বস্তিতে ফেললো। অন্য এক পুরুষের গন্ধ। তমালের কথা মনে পড়লো তার। এসব কেন ভাবছে সে?
আলমগীর তার কানে কানে বললো, রিকশায় চুমো খেতে খুব মজা কিন্তু।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, হুড উঠিয়ে দেবো?
তনিমা কিছুই বললো না। মাথায় তার হাজারটা চিন্তা ঘুরছে। আসলে কোনো চিন্তাই ঘুরছে না। মাথাটা যেন শূন্য হয়ে গেছে।
আলমগীর হুডটা উঠিয়ে দিলো। আবারও ডান হাতে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরলো।
বললো, একবার।
একবারই। আর কখনো নয়। ঠিক আছে?
আলমগীর বললো, ঠিক আছে।
তনিমাকে রিকশাতেই জড়িয়ে ধরলো সে।
নিরবে বসে খেতে খেতে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলো না দুজনে।
আলমগীর বললো, আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যাবে?
না যাবো না। তুমি করেও বলা যাবে না।
নিবর থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো তনিমা। তমাল বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে গেছে।
প্রথমেই ফেসবুকে, ফোনে আলমগীরকে ব্লক করলো। অবসন্ন তনিমা শাড়ি খুলে রেখে একটা ঘুম দিলো।
বললো, এ নিয়ে আর ভাবতে চাই না। নেভার।
সে বছর শাড়িটা ওভাবেই রেখেছিল ওয়ার্ডরোবের ওপরের তাকে, একদিকে।
এত বছর পর শাড়িটা ধরতেই গন্ধটা অবশ করে দিলো তাকে। একবার তার মনে হলো, হয়তো মস্তিষ্কে কোনো একটা হরমোন সিক্রেশনের কারণে তার মনে হচ্ছে গন্ধটা সে পাচ্ছে। আসলে এমন কোনো গন্ধ নেই।
কিন্তু নিশ্চিত হতে শাড়িটা নাকে ধরতেই আবার স্পষ্ট ঘ্রাণ পেতে শুরু করলো।
তনিমা আপন মনেই বললো, বিস্ময়কর!
মনে হচ্ছে আলমগীর তার পাশে বসে আছে। তার ঘামের গন্ধ, পারফিউম আর রোদের গন্ধ মিলিয়ে অবিকল সেদিনের সেই ঘ্রাণ পাচ্ছে।
আবেশটা তাকে কেন কাঁপিয়ে দিচ্ছে সে বুঝতেও পারছে না।