অচিন পাখি
আমি তখন আমাদের বাগবাটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন স্কুলে তিন পিরিয়ড করার পর বাকি ক্লাসগুলো করতে আর ইচ্ছা করছিল না। আমার খিদেও লেগেছিল খুব। ভাবলাম বাড়ি চলে যাই। তাই ক্লাসের পিছন দরজা দিয়ে বইগুলো অনেকটা লুকিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হই।
আমাদের স্কুল ছিল বাড়ি থেকে আড়াই মাইল দূরে। কাঁচা রাস্তা আর মেঠো পথে হেঁটে স্কুলে যেতে হতো। সেদিন ছিল চৈত্রের দুপুর। আমি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কাঁচা রাস্তা দিয়ে না এসে মাঠ আর ক্ষেতের পাশ দিয়ে মেঠো পথে বাড়ি ফিরছিলাম।
পথে নেমে দেখি, চৌচির করছে মাঠ। কোথাও সবুজ নেই। কোনও ক্ষেতে ফসল নেই। শুধু চাষের মাঠ। ক্ষেতগুলোতে পড়ে আছে মাটির শুখনো ছোট বড় ঢিল। রোদ্রে তপ্ত হয়ে যেন আগুন ছড়াচ্ছে। চারপাশে কোনো বাড়ি ঘর নেই। বিরাণ এই প্রান্তর পারি দিতে হবে আমাকে একা। সাথে কোনও সাথী নেই। দূরে তাকিয়ে দেখি মিছে পানির ঢেউ বইছে। আসলে সবই ছিল দুপুরের করুণ ধারা। সবই ছিল মরীচিকা।
হাঁটতে হাঁটতে ঘামতে ঘামতে ক্লান্তি নেমে এসেছিল শরীরে। ধুলির পথে পায়ে পায়ে উড়ছিল ধূলো। পথের শেষ যেন শেষ হতে চাইছিল না। পা দুটোও কেমন থেমে আসছিল। কোথাও কোনও ছায়াতলে একটু জিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছিল। নির্জন সেই চরাচরে পথের ধারে একটি উন্মুক্ত ঈদগাহ দেখতে পাই। সেখানে একটি আমগাছ আছে। আমি সেই আম গাছের ছায়াতলে যেয়ে দাঁড়াই। দেখি, সেখানে আমাদের গ্রামের ‘অন্ধ’ হাফেজ মিয়া বৃক্ষমূলে একাকী বসে আছে।
হাফেজ ভাল মতো চোখে দেখতে পেত না। আবছা আবছা দেখতে পেত। মাটির দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে একাই লাঠি হাতরিয়ে পথ চলত। সে ছিল কোরআনে হাফেজ। সেই জন্য সবাই তাকে হাফেজ নামে ডাকত। সে ভালো গানও গাইতে পারত। হাফেজ ছিল অত্যন্ত গরীব ও দীনহীন। পথে ঘাটে, স্টেশনে, লঞ্চ স্টীমারে, ক্বেরাত ও গান গেয়ে মানুষের কাছ থেকে দান ও সাহায্য গ্রহণ করে জীবন নির্বাহ করত।
আমি হাফেজের সাথে গল্প করি। কথা বলতে বলতে আমি তাকে বলি — ‘ হাফেজ ভাই, তুমি আমাকে একটা গান শোনাও না।’ হাফেজ ভাই বলল, ‘এখানে আর কেউ তো নেই। তুমি একাই শুনবে গান?’ বললাম, ‘আমি একাই শুনব। তুমি বিকেলে আমাদের বাড়ি এসে মার কাছ থেকে চাল নিয়ে যেও।’
সেদিন সেই খাঁখাঁ ক্লান্ত দুপুরে হাফেজ আমাকে এই গানটি গেয়ে শোনায়েছিল —
- ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি
দিতাম পাখির পায়।….’
আমি হাফেজের সাথে মাথা দোলায়ে আর দুহাত নেড়ে গানটি মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। এই গানটি প্রথম তারই কাছ থেকে শোনা ছিল। এটি যে একটি লালন গীতি তাও তখন জানতাম না। গান শেষে হাফেজ ভাইকে আমি বলেছিলাম—
‘এই গানটির অর্থ বলে দাও না।’ হাফেজ ভাই বলেছিল, তুমি এই গানের অর্থ এখন বুঝবে না। বড়ো হও, তখন বুঝতে পারবে।’
তারপর অনেক বছর চলে গেছে। ততদিনে আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। স্কুল শেষ করে কলেজে পড়েছি। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছি। এখানে আমাদের লালন সাহিত্য পাঠ্য ছিল। ক্লাসে স্যার লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গীতি
টি পড়িয়েছে। বুঝেয়েছেও আমাদের। কিন্তু খাঁচার ভিতরে সেই অচিন পাখিকে সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারিনি। চিনতেও পারিনি। আর কেমনই বা ছিল সেই পাখি দেখতে?
তারও অনেক পরে একবার বাড়িতে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, হাফেজ ভাইয়ের কাছ থেকে সেই অচিন পাখির গান আর একবার শুনে বুঝিয়ে নেব। কিন্তু জানতে পারলাম হাফেজ ভাই মারা গেছে। মনের ভিতরে কী এক আকুতি হলো — সেই অচিন পাখিকে আর বোঝা হলো না। পাখি অচিনই রয়ে গেল।
আমি এখনো তন্ময় হয়ে ভাবি — সেই কত বছর আগে এক অন্ধ গায়েন ধূঁ-ধূঁ খোলা প্রান্তরে বৃক্ষ তলে বসে গেয়েছিল গান। এক অর্বাচীন বালক সেই গান শুনে বিমুগ্ধ হয়েছিল। তার সেই গানের অপার্থিব সুর এখনও যে সেই বালকের অন্তরে বাজে —
‘মন তুই রইলি খাঁচার আসে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশের
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।’
~ কোয়েল তালুকদার