আনন্দমঠ

ছোটগল্প – আনন্দমঠ

অনেক বছর আগের কথা। আমার সহপাঠিনী দীপান্বিতা প্রেম করে বিয়ে করেছিল তাদেরই পাড়ার নীলেশকে। নীলেশদের সোয়ারী ঘাটে পাইকারি মাছের আড়ত ছিল। পড়াশোনা করেছিল সে অস্টম ক্লাস পর্যন্ত। কাড়ি কাড়ি টাকা ছিল ওদের । কিন্তু টাকা থাকলে কি হবে, নীলেশরা ছিল একটু গোয়ারগোবিন্দ টাইপের। একদিন দেখি, দীপান্বিতা ক্লাশে আসেনি। পরের দিনও সে এলো না। তারপরের দিনও না। এবং তারপরে কোনোদিন আর দীপান্বিতা ক্লাসে আসেনি ।

নীলেশ শরীর চিনত দীপান্বিতার। এক রাত্রে ভালোবাসার অস্তিত্ব নাকি আদৌ দীপান্বিতার মাঝে ছিল না। সন্তান আসছে তার নেহাতই জৈবিক নিয়মে। দীপান্বিতার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, ভালোবাসার তোয়াক্কা না করে। কি নিষ্করুণ সৃষ্টির এই রুঢ় নিয়ম। যা চায় না তাই আসে জীবনে।

দীপান্বিতার জন্য মন খারাপ লাগত। ক্লাসে এতগুলো মুখের মাঝে দীপান্বিতার মুখটি আর দেখা যেত না। কিছু ভালোলাগা, কিছু অন্তর মিশ্রিত টান আমাকে বিষণ্ণ করে রাখত। দীপান্বিতা আমার কেউ ছিল না। কিন্ত ওর জন্য আমার প্রাণ কাঁদত।

আমি পুরানো ঢাকার বাকরখানি খুব পছন্দ করতাম। দীপান্বিতা প্রতিদিন আমার জন্য বাকরখানি নিয়ে আসত ওর ব্যাগে করে । এইগুলি খেয়েই প্রায়ই কাটিয়ে দিতাম বিকাল পর্যন্ত। যদি কোনোদিন বেশি খিদে লাগত, তাহলে শহীদুল্লাহ হলের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে গিয়ে চাঁনখারপুল পার হয়ে হাজি’র দোকান থেকে পাতায় মোড়ানো বিরিয়ানি কিনে এনে দু’জন খেতাম।

যেদিন আমার পকেটে টাকা থাকত না সেদিন আগেই আমার মুখ দেখে বুঝতে পারত দীপান্বিতা। দিন শেষে সন্ধ্যায় ও যখন বাড়ি চলে যেত, তখন ভ্যানেইটি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে আমার বুক পকেটে দিয়ে বলত, চাকুরি পেলে পরে এ টাকাগুলো আমায় শোধ করে দিবে। এখন শুধু হিসাবটা ডায়েরিতে লিখে রাখবে।

প্রায়ই দীপান্বিতা মন খারাপ করে ক্লাসে আসত। সবাইকে হাসিখুশি মুখ দেখাবার চেষ্টা করত। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম, ওর অন্তরের গভীর বেদনার কথা। আমি জানতে চাইতাম, কিন্তু কোনো কথা বলত না দীপান্বিতা। কান্না এবং দীর্ঘশ্বাস দুটোই বুকের গভীরে আড়াল করে রাখত সে। মাঝে মাঝে উদাস কোনো রাত্রিবেলা একাকী শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, জগতে এত মেয়ে থাকতে কেন এই অন্তরদুঃখী মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় হলো।

একদিন এক মেঘলা দিনের অসতর্ক মুহূর্তের কথা। কার্জন হলের সামনে সবুজ ঘাসের উপর দুজন বসেছিলাম। চুপচাপ আছি দু’জনই, কারও মুখে কোনো কথা নেই। হঠাৎ দীপান্বিতা আমার হাত টেনে নিয়ে আঙুল ছুঁয়ে বলেছিল — ‘তুমি তোমার এই অঙুলি দিয়ে আমার সিঁথির সিঁদুর সব মুছিয়ে দাও।’ সেদিন কোনো সিঁদুর মোছা হয়নি। ঝমঝম করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল।

যেদিন ওর সাথে আমার শেষ দেখা হলো, সেদিন বুঝতে পারিনি এইটি হবে ওর সাথে আমার শেষ দেখা। আমরা বসেছিলাম, লাইব্রেরি বারান্দায়। আমাকে দীপান্বিতা বলেছিল — ‘কে যেন আমার চলাফেরা গতিবিধি অনুসরণ করে। এক অজানা আশংকা আমার মধ্যে। যদি আর তোমার সাথে আর কোনোদিন দেখা না হয়। ‘

আমার শিক্ষা বর্ষের বাকি সময়গুলোতে আর কোনো বন্ধু করিনি কাউকে। প্রতিদিন ক্লাশে আসতাম। পিছনের বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকতাম। দুপুরে প্রায় দিনই খাওয়া হতো না কিছুই। খেতে ইচ্ছাও করত না। ক্লাস শেষে একাকী শহীদ মিনারের সোপান তলে বসে থাকতাম। বসন্তদিনে ইউক্যালিপটাসের পাতা ঝরে পড়ত। পথের ধূলো উড়ত বাতাসে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চেনা পথ দিয়ে তারপরেও আরো প্রায় দুই বছর চলেছি। কোথাও কোনোদিন আর দীপান্বিতার দেখা পাইনি। কার্জন হলের সামনে সবুজ লনের ঘাস, বাংলা একাডেমির আম্রছায়া, কিংবা খাজা নাজিমউদ্দিনের মাজার প্রাঙ্গণের ইট, বৃক্ষরাজি কেউই বলতে পারেনি, দীপান্বিতা এখানে আর এসেছিল কী না!

প্রার্থনার দিনগুলোতে প্রায় সন্ধ্যায় চলে যেতাম ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। শঙ্খধ্বনি বাজত সেখানে । আরতি হতো পূজার। কোনোদিন কোনো পূজার স্থলে দীপান্বিতার দেখা পাইনি। ধূপের গন্ধ বিষাদের ধূয়া হয়ে মন্দিরে মিলিয়ে গেছে। সকল পূজা শেষ হয়ে গেছে। আরতি থেমে গেছে। কিন্তু দেবীর দেখা আর মেলেনি।

শিক্ষা জীবন শেষ করে আমি তখন একটি বেসরকারি কলেজের নবীন শিক্ষক হয়েছি মাত্র। দরকার হলো বঙ্কিমের ‘আনন্দ মঠ’ বইটি নতুন করে পড়বার। কিন্তু ‘আনন্দ মঠ ‘ কোথাও খুঁজে না পেয়ে নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকানে বইটি কিনতে যাই। বইটি পেলামও সেখানে।

বইটি কার ছিল জানিনা। বাসায় এসে আনন্দ মঠের পাতা উল্টায়ে দেখছিলাম। প্রথম সাদা পাতাটি ছিল আংশিক ছেঁড়া। কোনো কিছু লেখা ছিল না তাতে। বইয়ের শেষ সাদা পাতার প্রথম পৃষ্ঠায় আবছা নীল কালিতে লেখা ছিল —

‘ বুড়িগঙ্গার ধারে নির্জন শ্মশান ঘাট থেকে
লাশ পোড়ানোর গন্ধ আসছে,
কার হৃদয় পুড়ছে ওখানে দাউ দাউ করে
বাতাস ভারী হয় কার ক্রন্দনে —
কে চলে গেল কাকে শূন্য করে দূরের পরপারে। ‘

আনন্দ মঠের শেষ সাদা পাতার অপর পৃষ্ঠায় লেখা ছিল —

‘সময়ের ব্যবধানে হার মেনেছি সময়ের সাথে
আজো বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে নিঝুম রাতে
মন খারাপের তো কয়েক হাজার কারণ থাকে
সত্যিই কেন যে দেখা হয়েছিল তোমার সাথে। ‘
———- দীপান্বিতা সেন।

প্রথম চরণগুলো উৎসর্গ করা ছিল স্বর্গীয় শ্রী নীলেশ সেনকে, আর দ্বিতীয় চরণগুলো উৎসর্গ করা ছিল আমাকে।

~ কোয়েল তালুকদার

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত