গীতালি

 

অণুগল্প – গীতালি

‘আজু সখি, মুহু মুহু
গাহে পিক কুহু কুহু,
কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু
দোঁহার পানে চায়।…’

বৈশাখের এই ধূলিধূসর অপরাহ্ণে কে এই গান গায়? দূর থেকে ক্রমশঃ সেই সুর নিকটে চলে আসছে। মনটা অকারণে উদাস হয়ে উঠল।

অনেক বছর আগে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উপরে উঠছিলাম, হাঁটতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছিলাম খুব , কিন্তু উদ্যোম হারাইনি। উঠতেই হবে পাহাড় চূড়ায়। দূরপানে চেয়ে দেখেছি সমুদ্র, শুনছিলাম সাগরতরঙ্গের ঝিলমিলি শব্দ। নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম পাহাড়ি নানাবৃক্ষের পত্রপল্লবের গন্ধে। তারপর একসময় ধীরে ধীরে মন্দিরে পৌঁছে যাই।

প্রাঙ্গণে খুঁজছিলাম কোনো পারিজাত বৃক্ষ। যা দেখেছিলাম আদিনাথে, কিন্তু এখানে কোথাও এই ফুলের গাছটি নেই। দেখলাম অন্য একটি বৃক্ষ। তার নামও জানিনা। গাছটির আড়ালে আলুথালু বেশে একজন পাগলিনীকে দেখতে পাই। মেয়েটির বয়স ত্রিশ হবে। শুকিয়ে যাওয়া দ্রাক্ষালতার মতো লাবণ্যহীন রূপ , হাতে শঙ্খবালা পরা। মলিন শাড়ি পরিহিত। ঘোমটা নেই মাথায়। আলুলায়িত কুন্তল। সিঁথিতে যে সিঁদুর পরত এটা বোঝা গেল। এখনও সিঁদুরের অস্পষ্ট দাগ লেগে আছে। সে স্তব্ধবাক চাহনিতে নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে। কথা বলতে চাইলাম ওর সাথে, কিন্তু কোনো কথা বলল না।

খুব স্বল্প সময় অবস্থান করেছিলাম সেখানে। মন্দিরের একজন সেবক বলছিল ওর কথা। মেয়েটির স্বামী ঘরছাড়া হয়ে চলে গেছে নিরুদ্দেশের দেশে। সে নাকি ছিল উন্মুল ভবগুরে এক গায়েন। সেই থেকে এই মেয়েটি ঘরছাড়া। স্বামীকে নাকি খুব ভালেবাসে। পৃথিবীর পথে পথে তাকে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই মন্দিরে অল্প কিছুদিন ধরে এসেছে। থাকবে না বেশিদিন। হঠাৎই কোনো এক প্রত্যুষে ওকে আর এখানে দেখা যাবে না। চলে যাবে অন্য কোথাও অন্য কোনো মঠে কিংবা মন্দিরে।

সেবকের কাছে থেকে আরও জেনেছিলাম – মেয়েটির নাম গীতালি। হঠাৎ কখনও নাকি একাকী গুনগুন করে গান গায় সে। খুবই সুমধুর সেই গান ও সুর, কিন্তু শুনতে চাইলে গাইত না। ওর যখন মন চায় তখন গায়। আমিও শুনতে চেয়েছিলাম ওর গান। বলেছিলাম – গীতি, তুমি একটা গান গেয়ে শোনাও না আমাকে। কিন্তু গীতালি গান গেয়ে শোনায়নি। মনে মনে কেবল শুভাশিস জানিয়েছি – ওগো মেয়ে তুমি যেন তোমার স্বামীর দেখা পাও।

ফেরার পথে যখন পাহাড়ের সোপান ভেঙে নীচে নেমে আসছিলাম তখন দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম এই গান এই সুর। হয়ত গীতালি গাচ্ছিল এই গান –

‘আজু সখি, মুহু মুহু
গাহে পিক কুহু কুহু,
কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু
দোঁহার পানে চায়।…’

জানিনা আর কতকাল এই গান অন্তরে অনুরণিত হবে। আর কত আলস্য মুহূর্তে প্রাণে বাজবে এমন স্বপ্নবিধুর মধুর সুর ! স্বপ্নে দেখা কোনো মধুময় স্মৃতির জন্য মানুষ কেন যে বিলাপ করে জানিনা। পাহাড়ি সোপানের পথ-ঘাট তখন অস্ত সূর্যের আলোয় তামাটে বর্ণের হয়ে আসছিল।

– কোয়েল তালুকদার

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত