“রোল নং ১৭, দোলা মিত্র”
১৯৭২ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের কোনো একটি দিন। আজ এতদিন পর সঠিক দিন তারিখ মনে নেই। দেশ মাত্র স্বাধীন হয়েছে। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল।’
মুক্তিযুদ্ধের পরে আমাদের স্কুল প্রথম খোলার দিন ছিল সেদিন। দীর্ঘ দশমাস পর স্কুল খুলবে। দীর্ঘ দশ মাস পর সবার সাথে দেখা হবে। কেমন একটি উৎসব উৎসব মুহূর্ত ছিল সেদিন , কেমন একটি উত্তেজনা উত্তেজনা ভাব ছিল।
ক্লাস নাইনে পড়ি। প্রথম ক্লাসটি ছিল ওয়াহিদ স্যারের অংকের ক্লাস। আমাদের ক্লাসে প্রায় পঞ্চাশ জনের মতো ছাত্র ছাত্রী ছিল। এর মধ্যে ছাত্রী ছিল মাত্র সাতজন। তখন মেয়েরা স্যারদের পিছে পিছে ক্লাসে আসত। এবং ক্লাস শেষ হলে স্যারদের পিছেপিছে বেরিয়ে যেত।
দীর্ঘ দশ মাস পর স্যার প্রথম রোল কল করছে। ক্লাসে সেদিন অনেকেই আসেনি, ষারা আসেনি তারা কেন আসেনি, সহপাঠীরা যারা জানত তারা কেউ কেউ বলে দিচ্ছিল।
স্যার একসময় কল করে — ‘রোল নং ১৭, দোলা মিত্র।’ কোনো রেসপন্স নেই। কেউ বলছে না — ‘ইয়েস স্যার’। মেয়েদের বেঞ্চে ছয়জন ছাত্রী বসা ছিল। তাদের ভিতর দোলা মিত্র নেই।
ক্লাস কক্ষ নীরব নিস্তব্ধ। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। দোলাদের বাড়ি ছিল ধলডোব গ্রামে। ঐ গ্রামেরই একটি ছেলে ছিল, নাম বিমল। বিমল আমাদের সাথে পড়ত। স্যার ওকে জিজ্ঞাসা করে– ‘তুমি কী দোলার কোনো খবর বলতে পারো?’ বিমল বলছিল — ‘ স্যার, দোলা’ রা ভারতে চলে গিয়েছে। এখনও ফিরে আসেনি।’
দোলা’ রা ভারত থেকে আর কোনো দিন ফিরে আসেনি। কেন আসেনি। সে অনেক দুঃখের কথা। অনেক দাম দেওয়া কাহিনি।
কেমন ছিল দোলা নামের মেয়েটা? ক্লাসে চুপিচুপি ছেলেরা ওকে ডাকত কাননবালা বলে। উজ্জ্বল গৌরবর্ণের এই মেয়েটির চোখ দুটো ছিল বিনোদিনীর মতো টানাটানা, কেশবতী ছিল সে। হাতে কঙ্কণ পরত। কিন্তু কিনিকিনি শব্দ হতো না হাতে। স্কুলের বারান্দা দিয়ে স্যারদের পিছনে পিছনে হেঁটে যখন সে ক্লাসে যেত, তখন সিনিয়র ছেলেরা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত ওকে। ‘বধূ তুমি চলে যাও গো বকুল বিছানো পথে পথে।’
দোলা ভালো গান গাইতে পারত। স্কুলে বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ও গানে প্রথম হতো। সেই বার আমাদের ক্লাসে দুজন ছাত্র ছাত্রী পুরস্কার পেয়েছিল। একটি পেয়েছিল গানে দোলা মিত্র। আর একটি পেয়েছিলাম আমি — স্বরচিত কবিতা পাঠে। শহর থেকে ক্যামেরাম্যান এনে বিজয়ীদের স্টীল ছবিও তুলেছিল।
দোলা আমার সহপাঠী হলেও ওর সাথে আমার কিংবা অন্য ছেলেদের সাথে ওর তেমন কোনো কথা হতো না। কারণ কথা বলার সুযোগ ছিল না তখন। ছুটির পরে একদিন বাড়ি যেতে যেতে দোলা আমাকে বলেছিল — ‘তুমি তোমার কবিতাটি কপি করে আমাকে দিও। খুব ভালো লিখেছ, একেবারে গানের মতো।’
আমি লাইনটানা একটি সাদা কাগজে আমার সেই কবিতাটি লিখে দোলাকে দিয়েছিলাম। তাও গোপনে, কেউ দেখতে পায়নি। সেদিনও ছুটির পর বাড়ি যেতে যেতে কথা হয়েছিল দোলার সাথে। কবিতাটি দেওয়ার সময় আমি ওকে বলেছিলাম — ‘তুমি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যে গানটি অনুষ্ঠানে গেয়েছিলে, ঐ গানটি আবার একদিন আমায় গেয়ে শোনাবে?’
দোলা বলেছিল — ‘গেয়ে শোনাব তোমাকে একদিন ‘।
তারপর তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। একদিন ভোরবেলা শহর থেকে ধলডোব গ্রামে মিলিটারি গেল। ম্যাসাখার করল বাগবাটি, হরিনাগোপাল ও ধলডোবসহ হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলো। জ্বালিয়ে দেওয়া হলো তাদের ঘরবাড়ি ও মন্দির। ঘর থেকে মানুষ ধরে নিয়ে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। ধর্ষণ করে মেয়েদের। পাক সৈন্যদের কালো হাতের থাবা থেকে সেদিন দোলাও রক্ষা পায়নি। সেও ধর্ষিত হয়েছিল।
লজ্জ্বায় আর গ্লানিতে দোলাদের পরিবার শরণার্থী হয়ে সেই যে ভারতে চলে গিয়েছিল, তারপর আর তারা ফিরে আসে নাই এই দেশে।
তারপর জীবন থেকে কত পৃষ্ঠা উল্টে গেছে। কতদিন কত বছর চলে গেছে কালের অতল তলে। আমিও চলে এসেছি গ্রাম থেকে শহরে। সেই কবে অজ পাড়াগাঁয়ের এক স্কুলের, ক্ষণকালের এক সহপাঠিনী ছিল দোলা মিত্র! তাকে জীবনভর মনে রাখার দায় কী ছিল আমার? যে আবার চলে গেছে অন্য দেশে।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কত গান শুনেছি কত জনের কাছ থেকে। কত সুরে সুরে ভেসে গেছে কত আনন্দের ক্ষণ ! সেই কবে পল্লীর এক স্কুলের অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে দোলা মিত্র নামে অখ্যাত কেউ একজন — কী এমন গান গেয়েছিল যে, তার সেই কণ্ঠ, তার সেই সুর এত দিন ধরে মনে রাখতে হবে ! কিংবা তা কী এখনও হৃদয় বীণায় অনুরণিত হবে চিরকাল !
অনেক বছর পর পিপুলবাড়িয়া বাজারে সহপাঠী বিমলের সাথে আমার একবার দেখা হয়। ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দোলা এখন কোথায় থাকে? বিমল বলেছিল — ‘শুনেছি, দোলা শিলিগুড়িতে থাকে। ইসকন মন্দির রোডে ওদের বাসা। দোলা ওখানকার একটি স্কুলের গানের মাস্টার। ওর স্বামীর নাম — সুনীল চক্রবর্তী।
২০০৪ সালে আমি ও আমার স্ত্রী দার্জিলিং গিয়েছিলাম বেড়াতে। ফেরার পথে শিলিগুড়িতে দুইদিন ছিলাম। খুব ইচ্ছা হলো, দোলার সাথে দেখা করার। একদিন বিকালে আমার স্ত্রীকে নিয়ে ইসকন মন্দির রোডে দোলাদের বাড়ি খুঁজতে বের হই। পেয়েও যাই ওর বাড়ি।
আধাপাকা টিনসেড ছোট্ট ছিমছাম একটি বাড়ি। বাড়ির গেটে নক করতেই গেটটি খুলে দেয় মধ্যবয়সী একটি লোক। বুঝতে পারছিলাম, ইনি দোলার স্বামী হবে। উনি বলছিলেন — কোথা থেকে আপনেরা এসেছেন?
— আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
— কার কাছে এসেছেন?
— এখানে দোলা মিত্র নামে কেউ থাকে?
— থাকে। তবে দোলা মিত্র নয়, সে এখন দোলা চক্রবর্তী। উনি আমার স্ত্রী।
— ওহ! আচ্ছা! আমরা দোলার সাথে একটু দেখা করব।
— আসুন, ভিতরে বসুন।
ছোট্ট সাজানো গোছানো একটি ড্রয়িং রুমে আমাদের বসতে দেয়। একটু পর একজন মহিলা প্রবেশ করে। দেখলাম তাকে! এ যে দোলা মিত্র !
সেই অপূর্ব সুন্দর মুখচ্ছবি! আজও তেমনই আছে লাবণ্যময় রূপ মাধুর্য! মার্জিত বাচনভঙ্গী, আনত নয়ন! কী যে দেবী দেবী লাগছিল ওকে!
আমি ওকে বললাম — চিনতে পারছ আমাকে?
— পারছি! তুমি রঞ্জন!
— হ্যাঁ, আমি রঞ্জন। তেত্রিশ বছর পর আমাদের দেখা হলো।
আমার স্ত্রীকে দেখিয়ে দোলা বলছিল, তোমার বউ নিশ্চয়ই!
— হুম! ওর নাম — মায়াবতী!
দোলা ওর স্বামীর সাথেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।
দোলাকে দেখছিলাম আর বিষাদে মনটা ভারী হয়ে উঠছিল। ওর মায়াময় মুখখানি দেখে কান্না পাচ্ছিল খুব। বলতে ইচ্ছে করছিল, দোলা — ‘তুমিও তো আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছ। তোমার এই আত্মত্যাগ আমরা ভুলি কী করে?’
সেদিন রাত অবধি দোলার বাসায় ছিলাম। অনেক কথা হয়েছিল দোলা ও দোলার স্বামীর সাথে। দোলা না খেয়ে আসতে দেয়নি।
দোলার ড্রইংরুমে একটি জিনিস দেখে অবাক হয়েছিলাম — ওয়ালে কাঁচের ফ্রেমে একটি ছবি যত্ন সহকারে সে টানিয়ে রেখেছে। ছবিটি আমাদের স্কুলের একটি পুরস্কার বিতরণীর। ছবিতে আমি ও দোলা পুরস্কার গ্রহণ করছি হেড স্যারের কাছে থেকে। সবুজ ছায়া সুনিবিড় স্কুল আঙিনা। আম সুপারির ঝাড়, খোলা মাঠ, খোলা আকাশ সবই ছবিতে দেখা যাচ্ছে। এ যেন বাংলাদেশের একটি চিরায়ত রূপ !
ওর বাড়ি থেকে যখন চলে আসব, তখন দোলা বলছিল — রঞ্জন, তুমি আমার গান শুনবে না?
— শুনব, গাও।
দোলা হারমোনিয়াম বাজিয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই গানটি গেয়ে শোনায়। যে গানটি স্কুলের অনুষ্ঠানে সে গেয়েছিল, যে গানটি আমাকে গেয়ে শোনাবে বলে একদিন সে কথা দিয়েছিল —
‘তুমি না হয় রহিতে কাছে-
কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে,
আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে।
এই মধুক্ষণ মধুময় হয়ে নাহয় উঠিত ভরে-
আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে,
কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে……। ‘
তারপর আরও কত বছর চলে গেছে।
“রোল নং ১৭, দোলা মিত্র” ক্লাস কক্ষের ভিতর রোল কলের সেই আওয়াজটি দিনে দিনে কেমন যেন অস্পষ্ট ও ক্ষীণ হয়ে আসছে !
- ~ কোয়েল তালুকদার