– তুই ক’ তো ভায়া, আল্লাহ মোক নিয়া যায় না কেনে?
রাত তিমিরেই ছিল। বাঁচার আকুতি ছিল নিঃশেষ প্রায়। সেসব পেরিয়ে আজ সকালের রোদ উঠানে পড়েছে। তবুও জরিনার মনে পুরানা খেদ। চাচাতো ভাই মোজাম সকালে আসা মাত্র তার কাছে জানতে চায় জরিনা, কী কারণে আল্লাহ মোক এখনো নেয় না, ক’ তো তুই?
মোজাম উত্তর দেয় না। মাথা নিচু করে ভাষা খোঁজে। সেও জানে এসব অযুক্তিক কথা। আসল কথা হচ্ছে জরিনা মুক্তি চায়। জরিনার ধারণা, আল্লাহর বিচারে তার মুক্তিটা যেন পরসংসারের জালে আটকে গেছে। বাবার সংসারকে সে পরসংসার মনে করে। তাই সে মনে মনে মোজামের চোখে শ্বাস ফেলে বাঁচতে চায়।
কিন্তু মোজামের এক কথা, কাউকে আকড়ে ধরি বাঁচি থাকবার চিন্তা বাদ দে জরিনা। মুক্তি নিজেকেই চাইতে হবে।
– মুই কি নিজে চাও না? চেষ্টা তো করোছো, কিন্তুক পারোছো কই? মুই বহুত চিন্তা করি দেখুছু, মুক্তি পাবার জন্য কারো না কারো সাহায্য লাগে মোজাম।
উঠানে বসে আছে মোজাম। সে ঠাঁর চোখে জরিনার দেহের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেও জানে, যৌবন খলবল করা জরিনা বন্দিজীবন চায় না। তাই সে সুযোগ নিতে চায়।
ঘর-দুয়ার ঝাড়ু দিতে দিতে জরিনা মাথা ঘুড়িয়ে বলে, মোরও তো জীবন আছে নাকি! মোর কথা কাহো বোঝে না কেনে মোজাম! এগিলা জ্বালা মুই কতো সও!
এগিলা জ্বালা বলতে সে তার বৃদ্ধ পিতা-মাতা আর বিকলাঙ্গ ভাতিজার দায়-দায়িত্বটাকে বোঝায়। সে যেন আর সহ্য করতে চায় না। বুকে ওড়না পেঁচিয়ে কোমোরে বেঁধে টান দিয়ে বালতি ভরা পানি আনে। মোজাম চোরা চোখে তাকায়। জরিনা তোয়াক্কা করে না। বারান্দায় অসুস্থ ভাতিজা রুহান মাদুরের ওপর হেগে-মুতে শুয়ে আছে। তার শরীর থেকে বিকট গন্ধ আসছে। হাল্কা কুসুম পানি এনে মুছে দিতে দিতে সে বলে, দেখিছিস কি করেছে এটা। কত সহ্য করো মুই। এটাক কার কাছে মুই রাখি যাও ক’?
যার কাছে জরিনা উত্তর চায়, জানে সে, মোজাম একটা কঠিন মাল। তাই সজাক থাকে। একেবারে তাড়িয়েও দেয় না। বেশি প্রশ্রয়ও দেয় না। জানে, অসুস্থ মা বাবারা তার ওপরে নির্ভরশীল তাই তাকে তারা বিয়ে দিবে না। পারলে নিজেকেই পছন্দের মানুষ বেছে নিতে হবে। কিন্তু সেখানেই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরসংসারের জ্বালা। তাই ক্ষোভ। ক্ষোভ যেন তার পোড়া কপালের। বলে,
– কখনো মনে হয়, সবকিছু থুয়া মুই পালাই যাও। কিন্তুক, এই নুলা ছাওয়াটাক ফেলে কোন্ঠে যাইম মুজাম? মুই তো অতোটা বিবেকহীন হবার পারিম না।
জন্ম থেকেই অসুস্থ রুহান। অটিষ্টিক বেবি, স্পেশাল বেবি অনেকে বলে। এসব জানে না জরিনা। সে বলে নুলা ছাওয়া। তাকেও তার দেখাশোনা করা লাগে। সেসব কিছুরই যেন সমাধান খোঁজে সে মোজামের চোখে।
অথচ সেই চোখ অনিশ্চিত, দ্ধিধাময়, কামনার। তবুও সে মোজামের লালসাভরা চোখকে ভালোবাসার হৃদয়ে বাঁধতে চায়। সে কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, কাহো মোক চিনবার পারল না, কাহো আপন করে দেখে না রে মোজাম, এটাই দুঃখ।
মোজাম কাছে আসতে চায়। আরো শুনতে চায়। কিন্তু হালুবালু করে না। জরিনা বলে,
একদিন দেখিবু, আল্লাহর দুনিয়ায় দু’চোখ যেদিকে চায় পালাইম মুই। যেমনটা মোর ভাই পালাইছে।
কথাটা মূলত মোজামকে উদ্দেশ্য করেই বলে জরিনা যে কেউ তাকে চিনতে পারে নাই, বিশেষ করে মোজামও না। তবুও মোজাম বিষয়টা পাত্তা দেয় না। বরং বলে, তোর ভাই তোকে ঠিকই চিনছে। তাই তোর মাথাত সব ছাড়ি দিয়া পালাইছে!
হা হা করে হাসে মোজাম। জরিনাও হাসে। বলে, ঠিকই কছিস।
– তা তোর ভাইয়ের কি খোঁজ পালুনা আর?
– না রে ভাই! মনে হয় ঐটা মরি গেইছে।
ভাই মরে গেছে- এ কথাটা বলতে বুক কাঁপে না জরিনার। বরং অবজ্ঞার থুতু ফেলে বলে, ও-কথা তুলিস না! ওর কথা তুই মোক কবু না রে মুজাম। ওইটা কোঠে মরে মরুক! অয় থাকিলে জঞ্জাল আরো বাড়ে, জানিস!
– মুই কতবার বারণ করিছু। এগুলা ছাড়ি দে। শোনে কারো কথা। তোর ভাই তখন নয়া বাপ পাইছে, কামুল নেতা যা কয় হের কথায় উঠে বসে। নিজের বাপের জন্যও এমন করে নাই। আরো একটা মারাত্মক কথা জানিস, কানের কাছে হেলে সে আস্তে আস্তে বলে, নেতাকে নাকি মাইয়া সাপ্লাই দিত তোর ভাই।
– ফাউল কথা বকিস না। তুই ফির কম কিসে? তোক চিনো না মুই?
– মুই এইলা করো নাই।
– আহাহাহা! সাধু মাল!
এসময় গলা খাকারি দেয় প্রতিবেশী চাচি। পাশের গলি দিয়ে আসে চাচি। চাচিকে দেখে জরিনা কল তলায় বাসন মাজতে যায়।
– কখন আলু রে মোজাম।
– এই তো এলায় আসুনু। কেমন আছেন চাচি?
– আছো। হামার ভালো থাকা। কি খবর এতোদিন পর আসুলু।
– ঢাকা গেছুনু। বহুদিন পর তোমাক এনা দেখিবার আনু। মাকুক আনা দেখি যাও। আসি শোনোছো, মাকু নাকি পালাই গেছে।
– কি জানি, পালাইছে না মরছে। বহুদিন তো দেখো নাই।
এরপর কাছে এসে কয়, মনে হয় মারি ফেলাইছে চেংড়াটাক। মেলা দিন নাই। হাসিনার সময় কেমন করি তাগড়া ঘোড়ার মতো লাফি বেড়াইত দেখিন নাই? গদি সরতেই কায় যে কোনঠে গেল!
– তা এক ফির মারিবে কেনে?
– আরে পাগলা, ওক মারিবেনা মানুষ! কী কথা কইস তুই, ওটা কম শয়তান আছিল? টিকটক না কি কয়, অগিলা মুই জানোও না, আইজ এ মাইয়া আসে তো কাইল আরেকটা। ও-বাবা! শোনোছো, শয়তানটা মেয়ে মানুষ নিয়া কি কি করেছে, একটা মেয়েকে নাকি মারি ফেলাইছে। পেপারোত উঠিছিল তো পাগলা, দেখিস নাই? সারা দুনিয়া তোলপার হইল, মানুষগুলাক কয়দিন এক্কেলে মশগুল করি থুইল। তুই ফির দেখিস না ওগিলা। তা মুই দেখিছু বেটা, এই চেংড়াটা ভালো আছিল না।
– ওরে শয়তান বানাইছে কামুল। কত নিষেধ কিরিছি, মাকু শোনে নাই। এখন বুঝুক! আল্লাহর তো একটা বিচার আছে নাকি?
– এই কারণে তো বোকা নুলা একটা ছাওয়া হইছে। ঐ যে ঐটা ওর ছাওয়া।
– কিন্তু বউটা গেল কই?
– পালাইছে। পালাইবে না? বিয়া করছে কিনা তারও তো ঠিক নাই। তার ওপর নুলা একটা ছাওয়া হইছে। আল্লাহ মালুম কি পাপ করিছে।
কথাটা কানে আসে জরিনার। সে খ্যামটা দিয়ে ওঠে, চাচি, তুই কী বুঝিস পাপের? প্রেম করিলে পাপ হয়? হয় চাচি, কি কথা কন এগিলা? এই কথা তোমরা ক-বার আসিছেন?
– মুই খারাপ কি কনু? যা সত্য তাই কছু। মরিচের জন্য আসিনু, মরিচ আছে, দে তো দুইটা।
– মরিচ নাই।
মরিচ থেকেও দিল না জরিনা। কিন্তু চাচি রান্নাঘরে দেখে যে মরিচ আছে। অবশেষে চাচি মরিচ নিয়ে বকবক করতে করতে চলে গেল।
জরিনা নড়ে না, ঝিম মেরে বসে থাকে। বলে, কেমন শয়তান হইছে পাড়ার মানুষ।
মোজাম কাছে এসে কয়, এইটা তো তুই ঠিকই কছিস জরিনা। প্রেম পাপ না।
জরিনা কথা বাড়ায় না। শুধু বলে, মুড়ি খাবু তুই? খাইলে বইস ঐঠে। সরিষার তেল, মরিচ মাখি দেছো।
কল তলায় পা ধুতেধুতে জরিনার কানের কাছে হেলে কয়, তা মুই যে তোরে প্রেম করি আদর করবার চাই, তুই হাত ধরির দেইস না কেন?
– এই চেংড়া কি কইলি রে, তুই গেলি এইখান থাকি! নাখরি দিয়ে তাড়িয়ে দেয় জরিনা।
জরিনা ক্লান্ত। তার ভাঙা স্বর জাগতিক ক্লেশের সাক্ষী। রুহান তাকে মা বলে ডাকে। তাকে ফেলে যেত মন চায় না। চোখের জল গাল বেয়ে পড়ে জরিনার। কিন্তু জরিনার কাছে সে শুধু অসহায় এক শিশু। রুহানের অসুস্থ শরীরের যত্ন নিতে নিতে নিজের স্বপ্নগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে, সেটাও সে জানে না।
অনেক সময় একলা কাঁদে জরিনা। তার একাকিত্ব, ক্লান্তি, এবং ভাঙা স্বপ্নের ভেতর মোজামের দ্বন্দ্ব দেখে, তার আশায় ভয়, জরিনা রুহানের মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে মোজামকেও ইশারা করে যেন খায় একগাস। মোজাম হা-করে ইশারায়। কাছে এসে গ্রাস নেয় না। বরং কাছে প্রায় গা ঘেঁষে বসে।
– কি রে! সরি বস যা!
– আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু তোর পা দুইখান দে তো? বলেই সে পা ছুঁইতে চায়। জরিনা পা সরিয়ে নিয়ে বলে,
– এমন করিস না মোজাম। তুই মোক সাহায্য করিস ঠিক আছে, কিন্তুক তোর মতলব মুই বোঝ। মোর দেহখান একবার পাইলে তুই মোক ভুলি যাবু।
– আল্লাহর কিড়া ভুলিম না। মুই বিয়া করিম তোক। মোজাম তফাতে সরে।
তবুও জরিনা কিছু বলে না।
মোজাম আরে কাছে আসে। ধীর কণ্ঠে বলে, তুই মোর বউ হইলে, সবকিছু বদলাই ফেলাইম। এই দুনিয়ার কষ্ট তোকে ছুঁইতে পারবে না।
পাশ থেকে রুহান ওহ ওহ করে জরিনাকে হাত দিয়ে গুতো মারে। জরিনা চেয়ে দেখে, রুহান ছলছল তাকিয়ে আছে। রুহানের অসহায় চেহারা দেখে জরিনার ভেতরের অসহায়ত্ব জাগে, ছেলেটা বুঝে ফেলেছে, তাকে ছেড়ে যাবে তার ফুফু। তাই সে হাত আঁকড়ে ধরে।
একদিন দেখে, মোজাম জরিনার জন্য চুপচাপ রাতের খাবার নিয়ে হাজির।
মোজামকে দেখে জরিনার মনের ভেতর আহ্লাদ জেগেছে। মনটা আনন্দে নেচে উঠেছে। কিন্তু যদিও জানে, মোজামের এই আগ্রহ তার লালসা মাত্র। শুধু মানুষের শরীরের ঘ্রাণে ঘুরঘুর করে। তাই কয়, ওমন খারাপ মানুষের মতো নজর দেইস নারে মুজাম। যদি মন থাকি তুই চাইস, তাইলে মরদ মানুষের মতো মোক বিয়া করি ফেল। না হইলে তোর প্রতি বিশ্বাসটা মোর নষ্ট করিস না।
– আল্লাহর কিড়া জরিনা, তোর মনটাক মুই ভালো বাসে। এই যে চাঁদ সাক্ষি রাখি, তোর হাতোত চুমা দিয়া কছো, তোক ছাড়া মুই বাঁচিম না। বিশ্বাস করবু, তুই না থাকিলে কেমন জানি মোর মনটা ফাঁকা হয়া যায়।
– ওসব ঢংয়ের কথা কইস না। এতো দিন তাইলে তুই কোঠে আছিলু, ক’তো দেখি, একবারো কি তোর মনটা মোক দেখির চায় নাই?
– চাইছিলো তো! তুই যে মোক পাত্তাই দেইস না, কেমনে আইসো? তোর জন্যে, বিশ্বাস করবু না, মনটা মোর নাখোশ হইছে রে। মনে কষ্ট নিয়ে ঢাকা গেছু, মনে মনে কছু, কী এমন লাটের বেটি হইছে জরিনা, টাকা কামাই করি দেখাই দেইম।
– তা দেখাও এখন!
মোজাম মোচর দিয়া ঘোরে, কয়, কি আর কইম রে জরিনা, তোক ছাড়া মোর টাকা পয়সাও জমিবে না। দূরে থাকি এইটা মুই বুঝবার পারছু, তোক ছাড়া কোনো উপার্জন মোর দরকার নাই। খা খা করা বুকখান খালি এই কথাটা কইছে, শেষে খালি হাতে ফিরে আসিছু।
– তাইলে ক’, কেনে মুই তোর খালি হাতোত জীবন রাখিম?
– আরে পাগলি, তোক তো মুই মোর জীবনের ওপর রাখিম। হাতোত কেনে থুইম তোক? তোক মুই মোর পরানের ভেতর রাখিম রে জরিনা। ভালোবাসা দিয়া তোক মুই মোর পাঁজর দিয়া বান্ধি রাখিম। খালি একবার তুই মোর হয়। দেখবু তখন, কেমন যুয়ানি ফিরে মোর।
– কিন্তুক এই নুলা ছাওয়াটা মুই কোথায় থোও ক’তো! মোর বুড়া বাপ মা, এমাক বা কায় দেখিবে? তুইতো জানিস, বাড়িত বসি দর্জির কাজ করি এই সংসারটা চালাছো মুই। মুই না থাকিলে কি হইবে?
বাস্তবতা এটাই। এই বাস্তবতা সে উপেক্ষা করতে পারে না। মোজাম ঘুরে এসে বলে,
– কায় দেখে দেখুক, এর জন্য তোর জীবনটা নষ্ট করবু তুই?
– না, নষ্ট তো করির চাও না, কিন্তুক কি করিম সেটাও তো বুঝিবার পাও না। এমাক ছাড়ি মুই কেমন করি পালাই থাকিম, ক তো।
– তুই চলি গেইলে, আপনে দেখবু, ওমরা একটা পথ বাছি নিছে। তোকে পাইলে, দুজন মিলে খুব সুন্দর একটা ঘরসংসার করিম দেখি নেইস।
হয়তো কথাটা ঠিকই বলে মোজাম। কিন্তুক, ভাগ্যে যে এই ঝামেলা দিছে! ভাবে সে। রান্নাঘরে যায়। একলা ভাবে, এত ঝামেলাই যদি আসিবে মোর জীবনোত, তাইলে যৌবন দিছে কেন এই শরীরত। মুই মোজামের কাছোত যাবারো পারো না, আবার এই যৌবন জ্বালা সইতেও পারো না। বলে, হাত ধরিবার দেইম তোক, তুই যদি মোক বিয়া করিস। আর…
– আর কি?
– যদি এমাক আনা দেখিস।
– এমাক কি মুই দেখোছো না?
– দেখিছিস তো!
জরিনা জানে, যতই কউক মোজাম, ওমাক দেখিবে না। অন্যের সংসারের বোঝা কায় টানিবার চায়!
জরিনার ঘরের জানালায় ঝুলে থাকা ভাঙা পর্দা ঠিক করে দেয় যাতে রুহানের গায়ে রোদ না পেড়ে। রুহান ঘুমিয়ে পড়েছে। মুখে রোদ পড়ে নিষ্পাপ মায়া ফুটে উঠেছে। বাচ্চাটার মুখে আল্লাহ এমন মায়া দিছে! কেনো দিছে মনে মনে ভাবে সে। তার বিছানার পাশে রুহানের ছোট্ট খেলনা গাড়ি পড়ে আছে। আবারো ভেঙেছে। বারবার ভেঙে ফেলে। আবার ঠিক করে জরিনা। মোজাম গাড়িটা নিয়ে জোড়া লাগাতে চেষ্টা করে।
পরের বেশ কিছুদিনও মোজাম চুপচাপ জরিনার বাড়িতে এসে রুহানকে নিয়ে খেলা করে। বেশ ভাব হয়েছে দু’জনের। সেই মুহূর্তে জরিনা অনুভব করে, মোজাম হয়তো তার বোঝা ভাগ করতে পারে। কিন্তু কোথায় যেন একটা বাঁধা। জরিনা আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, মোজামকে ভরসা করা যায়। বেশ কর্মঠো সে। যেমন পরিশ্রমী, তেমন মনোযোগীও। দরদও আছে তার প্রতি। কিন্তু মোজামকে মনেপ্রাণে চাইলেও সে শয্যাশায়ী পিতামাতা আর অসুস্থ রুহানকে ফেলে যেতে চায় না। হায় আল্লাহ, কায় দেখিবে ওমাক! এই জজ্ঞাল মুই কার কাছোত থুইম?
– তা তুই মোক এগিলা শুনাইস কেন?
– শুনাছো মনের দুখে রে। মোর ভাই থাকিতে দূরে দূরে দেখছুলু, তখন সুযোগ ছিল, তখন তুই আসিলু না, এখন ঘনঘন বাড়িত আসিছিস। তাই তোকে কছো।
– কছিস ক। এখন তো মুই আসিছু নাকি?
– আসিছিস তো!
তারা বেশ কিছুক্ষণ কথা কয়না। জরিনা পা নাড়ায়। মোজাম পায়ের দিকে তাকিয়ে কয়,
– তোর পাও কি ফর্সা রে জরিন, মুই দেখো একনা, হ্যাঁ অল্পনা একটু দেখি ছুঁইয়া দেইম।
– মোর গা ছুবার পাবু না কিন্তু, কয়া দিলাম!
– আচ্ছা ছুঁইম না যা!
– কিড়া?
– আল্লাহর কিড়া।
যেন অনুমতি পেয়েছে মোজাম, নেমে বসে। জরিনা খাটে বসেছে। চিপে ধরেছে শাড়ির গোছা। পুরুষের নিঃশ্বাসে তার অবিশ্বাস আছে। বিশেষ করে চতুর মোজাম ভোগ করে পালাবে এটা সে হতে দিবে না। একটু ঘুড়িয়ে নিয়ে কট করতে চায় সে। চায় এমন চালাক চতুর পুরুষ। তার ধারণা, জঞ্জালকে উৎড়ে ফেলা বেটা না হইলে সংসার আগায় না। তাই সে মোজামকে প্রোশ্রয় দেয়। দেখে মোজাম কাপড় ধরেছে।
শাড়িটা আলগোছে ধর, যেন পাট না ভাঙ্গে, এরপর উপরে তুলে দেখ মোর পায়ের ফরসা।
– কি সুন্দর তোর পা মাইরি, মুই তোর পা দুইখান ছোঁয়ার জন্যি আইসো রে জরিনা।
পায়ে সুড়সুড়ি পায় জরিনা, পা চটকে তুলে। বলে, এখন বাইর হয়, যা। মোজাম সাহস পায় না, তোর নাকি জরিনা খিলখির হাসে আর তো তরাক তাকায়, মনে মনে বলে, তোর মতলব জানো মুই।
তোর মুচকি হাসিটা খুব সুন্দর জরিনা। ফাইন কিন্তুক। তুই যদি মোর বউ হোস, তোক মুই খুব সুন্দর শাড়ি দিয়া ফাইন করি সাজাইম। দেখবু তখন রাজার বউ বউ লাগছে।
– আহারে চেংড়ার শখ কত! তোর রাজা হবার শখ হইছে না! পায়ের আঙ্গুল দিয়ে মাটির খসটায় জরিনা। দুয়ারের বাঁশ ধরে হালকা মোচড় দেয়। আচলটা বুক থেকে নিচে নামে। পিটপিট করে তার চোখ। প্রেমের আলো জ্বলে। মোজাম চটক দিয়া কয়, দেখলু কেমন রুপ ভাসিছে তোর।
– রুপ না ছাই! এগুলো দেখি তো কুনজর দেয় মানুষ। জানিস মোর জন্য কতোজন পাগলা আছিল? গার্মেন্টস থাকি পালায় আসনু কেনে, জানিস, অই গোদগোদা শুকরটা চোখ দিছিল মোর ওপর। হেয় নাকি মালিক হয়।
– মুই জানো মোর বাপ মোক বিয়া দিবার চায় না, তুই যে মোক এতো ভালোবাসিস, সেইটাও বোঝে। মোর মনটাও চায় তোক নিয়া ঘরসংসার করো। কিন্তু এমাক থুয়া মুই কি করিম ক তো!
– সেই এক কথা আর কত দেখাবু জরিনা, রুহান কি তোর ছাওয়া হয়। তোর পেট থেকে বেরাইছে? ওর জন্য জীবন নষ্ট করবু তুই।
জরিনা অসহায় তাকায়।
মোজাম বলে, এবার ফাইনাল একটা কথা শুনবার চাও মুই, ক’ তো মোর সাথে তুই যাবু কি-না? মোক তুই ভালোবাসিস? বিয়া করিম মুই তোক। বিশ্বাস না হয়, চল কাজি খানাত।
জরিনা হাত সরিয়ে নেয়। শান্ত আর স্পষ্টভাবে বলে, মোর আশা তুই ছাড়ি দে। মুই বুঝবার পারছু, আল্লাহ মোর জীবনটা নুলা করি দিছে মুজাম। এভাবেই জীবনটা শেষ হবে মোর।
জরিনার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অসহায় হয়ে মোজামের দিকে চেয়ে থাকে। করুণ এক অক্ষমতা তাকে গ্রাস করেছে। মোজাম জানে, তার আয় ইনকাম কম। বাড়তি সংসারের বোঝা সামলাবার ক্ষমতা তার নাই। মিথ্যে প্রোলোভন সে দিতে জানে না। মোজাম চলে যেতে উঠে দাঁড়ায়। যেতে চায়। আবার থামে। ফিরে চায়। এবার গেলে আবার কবে আসবে মোজাম জানা নাই। শুধু দু’জন দু’জনের চোখে তাকিয়ে থাকে। দিনগুলো আহত পাখির মতো বেদনা ভরা, স্তব্ধ।