ছোট মেয়ে সুমায়লাকে নিয়ে আমি দারুণ সমস্যায় আছি। সে মানুষের মুখে-চোখে ‘থু’-করে থুতু ছুড়ে। নিষেধ করলে বলে, আমি থুতু না, থু-থু দিচ্ছি।
– কেনো?
সে তখন শব্দ করে আমারও মুখে-চোখে-গায়ে থুথু ফেলে। বাচ্চা মেয়ে, রাগও করতে পারি না। দু’হাতে তুলে ওকে আছাড় মারার জন্য মেজাজ খমদম করে, পারি না। আদরের মেয়ে সে আমার। বহু চেষ্টার পরে প্রায় বারো বছরের চেষ্টার ফলে একমাত্র স্পেশাল চাইল্ড রুহানের পর জন্ম হয় সুমায়লার। তাকে সুস্থ্য-সবল পেয়েই আমাদের পরিবার আনন্দে মেতে ওঠে। ফিরে আসে প্রশান্তি। বলা যায়, এরপর থেকে একপ্রকার তাকে মাথায় তুলে রাখি।
অথচ সেই সুমায়লা যেখানে সেখানে থুথু/থুতু ফেলা শুরু করলে সবার মুখের চেহারা গোমড়ামুখো হয়ে যায়। থুথু আর থুতুর মধ্যে কি সে পার্থক্য বোঝে জানি না, কিন্তু তার ব্যবহারে ক্রমশ অবস্থা বদলাতে থাকে। জন্ম দিয়েছি বলে পিতামাতা সহ্য করলেও, এই বদভ্যাস আমাদের আত্মিয়-স্বজন পাড়া-পড়শিরা সহ্য করে না। ক্রমাগত অভিযোগ করে, ত্যক্তবিরক্ত হয়, ধমক দেয়। আমাদের আড়ালে মেয়েকে চিমটিও কাটে। তাকে একারণে একলাও রাখি না। অন্য কোথাও গেলে সাথে নিয়ে যেতে চাই না। এমনকি ডাক্তারের কাছে নিয়েও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। সুমায়লা ডাক্তারের মুখেও থুথু ছোড়ে।
বলা যায় খুব কষ্ট পেয়েই বলছি, কথাটা লিখতে খুব খারাপ লাগছে আমার, আজকে নিজেকে খুব অসহায় আর ভাগ্যহত মনে হল। ডাক্তার যখন রাগত স্বরে বলল, আবার কেনো এনেছেন? বলেছি না, কোনো রোগ নাই সুমায়লার!
কিন্তু সবাই জানে এবং তার থুতু ফেলা নিয়ে কটুক্তিও করে, বলে, এটা রোগ, “বাজে রোগ” একেবারে হলফ করে বলে, থুথু ছিটা রোগ হয়েছে সুমায়লার। আমি ডাক্তারকে এ-কথাই বলি। বারে বারেই বলি। ডাক্তার প্রায় রাগ হয়ে আমাকে অপমান করে বলে, আপনারই বরং রোগ হয়েছে। মানসিক রোগ। অযথা নিজের সন্তানকে রোগী বানাচ্ছেন। হয়তো অন্য কোনো দুরোভিসন্ধি আছে আপনার। আর না থাকলে নিজেকে ডাক্তার দেখান যান! তবু আমার কাছে আর আনবেন না।
একজন ডাক্তার এভাবে বলতে পারে কিনা জানিনা বা এভাবে রোগীর অভিভাবককে বলা উচিত কিনা সেটা নিয়েও তর্ক করতে চাই না। বরং আমার যে মানসিক রোগ হয়েছে- এই কথাটা নিয়ে আমি চিন্তায় পড়ি। যদি তাই হয়, যদি সুমায়লার থুথু ছিটা রোগ হয়েছে বললে মানসিক রোগী হয়ে যাই, তাহলে সন্তানের পিতা হয়ে আমি তো আর আমার আত্মিয়-স্বজন পাড়াপড়শিদের মানসিক রোগী বলতে পারি না।
ধরেন তার জেঠি বলল, এটার থুথু ছিটা রোগ হয়েছে।
অমনি আমি বললাম, আপনার মানসিক রোগ হয়েছে।
শান্তিটা থাকে কোথায়? জাদরেল আর বড়লোকের বেটি খুব জেদি মহিলা তার জেঠি। আপনারা তো জানেন। তাই অপরাধবোধে পড়েছি। তাছাড়া নিজের চোখে যা দেখেছি, সেটা অস্বীকার করতে পারি না। একারণে ভাবলাম, আমার অপারোগতার ব্যথাটা সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েই দেই। যে কথা সরাসরি মুখে বলা যায় না, সেটা নাহয় বিকল্পভাবে প্রকাশ করি। এতে আমিই বরং মানসিক রোগী হয়ে থাকি। দোয়া চাইছি। ক্ষমা চাইছি। আপনারা দয়া করে আমাকে আর মানসিক রোগী বানাবেন না। আর আমার মেয়েটাকে খারাপ চোখে দেখবেন না।
দ্বিতীয় যে কথাটা না বললেই নয়, যদিও ব্যাপারটা আমার মেয়ের ভুতভবিষ্যতের জন্যও ক্ষতিকর, তবুও বলছি, আমার মেয়ে সুমায়লা এই রোগটা হঠাৎ করে পায় নাই। শুধু সুমায়লা থেকেই শুরু হয়নি রোগটা। বরং এর শুরু হয়েছে আমাদের আরো কয়েক পুরুষ আগে থেকে। আমার দাদীমার লেখা ডাইরিতেও এ বংসের থুতু ফেলা রোগের কথা পাইছি আমি।
বিষয়টা আমি আবিষ্কার করি ঘনকালো এক অমাবস্যার রাতে। তারও কিছুদিন আগে যখন আমি অনেক সময় ধরে সুমায়লাকে পাখির মতো বোঝাচ্ছিলাম, মা, মানুষের গায়ে থুথু ফেলতে হয় না। সুমায়লা! লক্ষ্মি মেয়ে আমার। আমার কথা শোনো মা, আমার কষ্টটা বোঝ! চোখ গড়িয়ে অশ্রু ফেলি। মেয়ে তখন আমার কষ্ট দেখে দুর্বল হয়ে পড়ে। বাবার কষ্ট বোঝে সে। কিছুদিন থুতু দেয় না। এসময় একটা কাজ করে সুমায়লা। বোতলে করে থুতুগুলো ভরে লুকিয়ে রাখে। তার মা এই বুদ্ধিটা শিখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি না থাকলে সেই থুতুর বোতল মানুষের গায়ে ছুড়ে মারে। ঘৃণাভরা থুথুর এই নিক্ষেপ যদিও আমার সামনে করে না, তবুও এটা মেনে নেয়ার মতো না। কিন্তু অফিস ছেড়ে তো মেয়ের কাছে সবসময় বসে থাকা যায় না। যদিও তার মা দেদার ঘুমায়, যদিও বলে, বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার মন মানে না। বরং তার বদভ্যাসটা আরো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আমার চিন্তা থামে না। সবাই ঘুমিয়ে গেলে আমি একাকি ধ্যানমগ্ন থাকি। আল্লাহর কাছে নাজাত চাই আর কাঁদি। জায়নামাজে প্রায় আধোঘুম হয়েছি এমন সময় ঝটকা খেয়ে বইয়ের সেলফে উল্টে পড়ি। তখন সেলফের তাক থেকে দাদীর লেখা ডাইরিটা জায়নামাজের মুখে পড়ে।
ডাইরিটা মুছে এপাতা ওপাতা ওল্টাই। হঠাৎ দেখি, বহু আগে, বহু বহু আগে, সুমায়লার থুথু ছিটা রোগটার কথা আছে। সতর্ক করে দিয়েছেন দাদীমা, “এ পরিবারে একজন থুথু ছিটা রোগীর জন্ম হবে।”
তাজ্জব ব্যাপার! আমি আরো পাতা ওল্টাই। দাদীমাকে বোঝার চেষ্টা করি। কেনো তিনি একথা বলেছিলেন! তাঁর চিন্তা চেতনা ধরার চেষ্টা করি। তাঁর প্রজন্মের আগাম রোগের কথা জানতেন তিনি- ভাবতে থাকি। সত্যি বলতে কি, আমি যেন সুমায়লার থুতু ফেলা রোগের আসল উৎসটাই তখন ধরে ফেলি, মনে হতে থাকে, এইবার আমি রোগের হদিসটা পেয়ে যাব।
তখন বর্ষা, বৃষ্টিময় রিমঝিম সকাল, পুঁটিমাছ উজানে এসে চলকে চলকে উঠান বারান্দার দেয়ালে পিঠ চুলকাচ্ছে, দাদুরা ক’ভাই আর পড়শিরা সেই বারান্দায় বসে পাটের রশি পাকাচ্ছে আর গল্প করছে। দাদিমা পান বানাতে বানাতে দেখেন, তারা পানিতে থুথু ফেলে পুঁটিমাছকে থুতু খাওয়াচ্ছে। বাপ দাদারা মশগুল গল্প করছে, ইতিহাস ধরে, রবীন্দ্রনাথ তো হিন্দু! হো হো করে হাসে তারা আর থুথু ছেটায়। আরেকজন বলছে, ওনার লেখা থেকে হিন্দু হিন্দু গণ্ধ আসে। হো হো করে হেসে তারা জলে থুথু ফেলে। আরেকজন বলে, আর ওটা? নজরুল, সে বাউলটা তো একটা নাস্তিক!
আবার থুথু ফেলে। দাদিমা দেখেন, পুঁটিমাছগুলো শুধু তাদের থুথু খাচ্ছেই না, লুটোপুটি করে মাতোয়ারা টেনে ছড়ছড় করে ছুটছে। আর মাছের পেটগুলো ফুলে হুটুম মোটা হয়ে গেছে। আর খেতে পারছে না। দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে ঝিমাচ্ছে। আর বারান্দার মানুষদের ফেলা থুতুগুলো ফেনার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে।
তারা এবং তাদের সন্তানেরা যখন পূর্বপুরুষদের অস্তিত্ব নাই করে দিয়ে সোরওয়ার্দি কিংবা মওলানা ভাসানি পর্যন্ত এসেছে, যখন সবকিছু অস্বীকারের মধ্য দিয়ে নতুন পলক জেগেছে, তখন দেখে, থুতুর স্তুপ একটা মিনারের মতো দাঁড়িয়ে গেছে। এমনকি স্বাধীনতা থেকে মুজিব, মেজর জিয়া কিংবা আরো পরের ব্যক্তি পর্যন্ত আসতে আসতে দেখে যে সেই স্তুপ ভেসে ভেসে বাড়িগুলো পাক দিচ্ছে। এমনকি সাধারণ মানুষদেরকেও তলিয়ে ফেলেছে। চোখ বুঁজলে বুঝতে পারেন, এই সব থুতুর স্তুপ মানুষের অস্তিত্বে প্রবেশ করে পাহাড়ের মতো আকার নিচ্ছে। দাদি তখন অনুধাবন করেন, হৃদপিণ্ডে প্রবেশ করেছে থুতুগুলো। থুথুর এই যে ফেনিল উচ্ছ্বাস, পূর্বপুরুষদের নাই করে দিতে দিতে নিজের অস্তিত্বও নাই করে ফেলা, এই উন্মাদনার ঘোরে টলতে টলতে দাদিমা ঘরে ঢোকেন, লেখেন, এই বংসে থুথু ছিটা রোগীর জন্ম হবে!
দাদিমার লেখা সারাংসটা থেকেই আমি স্পষ্ট অনুমান করি, থুতুর স্তুপ আমাদের ভেতরে জড়ো হতে হতে সুমায়লার মুখ দিয়ে এখন হরহর করে বের হচ্ছে। আমার কষ্ট হয়, ঘৃণা, অস্বীকার আর অস্তিত্ব হারানো এক প্রজন্ম মিনারে উঠে সুমায়লা আজ মুখে মুখে থুতু ফেলছে। আর আমি তাকে শোধরাবার চেষ্টা করছি।
ফজরের আজান এবং নামাজ সেই কবে শেষ হয়েছে। আমি ঝিম মেরে বসে আছি জায়নামাজে। মেয়ে তখনো ঘুমায়ে। জানালার ফাঁক দিয়ে নয়া সকালের ফুরফুরে আলো বিছানায় পড়েছে। সকালে উঠে সবাইকে আমি দাদির কথাটা বলি, “এই পরিবারের একজন থুথু ফেলা রোগী জন্মাবে,” তখন সবাই হাসাহাসি করে। যেন তারা আমার বাব-দাদাদের মতো হাসে। এখনো তারা একই রকম ভাবে ঠাট্টা করে। তারা যাই করুক, সুমায়লার অদ্ভুত লক্ষণগুলো আমি আমাদের অস্তিত্বের মধ্যে লক্ষ্য করি। চিন্তায় পড়ি, যে থুতুর স্তর মেরুদণ্ডের শেকড়ে সারা অস্তিত্বে প্রকট হয়ে আছে, সেটা কি সুমায়লাকে বোঝালেই রোগটা নাই হয়ে যাবে?
জানিনা। তবুও পিতা হয়ে আশা ছাড়ি না। জায়নামাজ থেকে উঠে দাঁড়াই। সুমায়লার মাথার কাছে খাড়া হয়। দেখি, তার মুখভর্তি থুতু। দীর্ঘ রাত ধরে সে মুখে জমা করেছে। যেন মুখ ফেটে বের হয়ে যাবে। তবুও সে উঠে বেসিনে যাচ্ছে না। বললাম,
– মা, এভাবে থুতু ধরে রেখো না।
সে তখন পুত করে তার মুখের জমানো সমস্ত থুতু আমার মুখে ছুড়ে দিল। যাও এখান থেকে। সে আমাকে ঘৃণা করল। আমার সারা শরীরে, সারা মনে-দেহে তার বোঝাই থুতুর পাহাড় আমাকে প্লাবিত করল। সেই থুতুপ্লাবনে গা ভাসিয়ে আমি ঝিম মেরে মেয়ের দিকে অবাক তাকিয়ে থাকি আর থুতুর স্রোতে ভেসে চলি।