কাক+আলাপ=কাকালাপ

কাঠপোড়া রোদ হঠাৎ থেমে যেমন করে উপকূলে হানা দেয় ঘূর্ণিঝড় বা কিছুক্ষণ আগেও প্রেয়সীর সাথে কথা বলা বন্ধুটি যখন হঠাৎ শোনে, তার প্রেয়সী ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে রোড এক্সিডেন্ট করেছে এবং স্পটডেথ, তখন শরীর যেমন হিম হয়ে আসে, তীব্র গরমের এই শহরে কুয়াশা জড়ানো শীত হঠাৎ করেই হানা দিয়ে গা হিম করে দিচ্ছে। আমরা গুটি কয়েক মিলে পুকুরের পাশে আগুন ধরিয়েছি, যদি শীত একটু নিবারণ করা যায় আরকি। আর্টস ফ্যাকাল্টির ছাত্র যদিও সবাই, আড্ডায় আমাদের প্রসঙ্গ থাকে বরাবরই বিজ্ঞানকেন্দ্রিক বা দর্শনকেন্দ্রিক। আজকে আড্ডা শুরু হলো, আগুনের কেন ছায়া থাকে না এই নিয়ে যুক্তি তর্ক। হঠাৎ চোখে পড়লো, একটু দূরে, শীতে কাবু হয়ে যাওয়া একটা মৃতপ্রায় কাক জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আমাদের মাঝে সবচেয়ে পশু-পাখিপ্রেমী রহমান ভাই, কাকটিকে নিয়ে আগুনের পাশে রাখলো, আগুনের তাপে বেঁচে উঠতে পারে ভেবে।
আগুনের তাপে শীত কিছুটা হলেও নিবারণের জন্যই কাকের নড়াচড়ায় তার অবস্থা কিছুটা উন্নতির ইঙ্গিতই পেলাম সবাই। আগুনের উপকরণ বাড়ন্ত দেখে সকলে খড়কুটোর সন্ধান করছিলাম। হঠাৎ ডানা ঝাপটানোর শব্দে পিছনে ফিরে থ বনে গেলাম সবাই; কাকটি আগুনে ঝাঁপ দিয়ে বসলো। দৌঁড়ে এসে বাঁচানোর চেষ্টা করলাম যদিও, করেও কোন লাভ হলো না। ব্যাপারটা দেখে সকলেরই মন খারাপ হয়ে গেলো, বিশেষ করে রহমান ভাইয়ের।
যেহেতু আমার গল্পটি কাককেন্দ্রিক, কাক নিয়ে কিছু কথা বলে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। কাককেন্দ্রিক যত উদাহরণ আমরা দেখি সবই কেন জানি কাক জাতিকে নিচু করার জন্যই তৈরি, বাংলা কিংবা গ্রিক মিথোলজিতে; কাকের কালো হওয়ার কারণ, সুন্দর কণ্ঠ থেকে কর্কশ কণ্ঠের কারণ হিসেবে রচিত হয়েছে যত কুৎসা এবং ছোট ছোট অপরাধকে কেন্দ্র করে দেয়া হয়েছে বড় শাস্তি। কাক বেচারা এসব কিছু গায়ে না মেখে পৃথিবীর যত আবর্জনা পরিষ্কারের মহান দায়িত্বে নিয়োজিত। শুধু পারছে না মানুষ আবর্জনাকে সাফ করতে, আকারে অনেক বড় বলেই বোধহয়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, সংসারের চাপ নেই, টাকা পয়সা সংক্রান্ত ঝামেলা নেই, বৃদ্ধ বাবারা যেমন পেনশনের টাকার আশাতেই স্বর্গীয় হলো তেমনভাবে পেনশনের কোনো আশা নেই, ঘুষ দিতে হয় না কোথাও, রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে জেলে যাবার ভয় নেই, স্বর্গের লোভ কিংবা নরকের ভয়ও নেই। আমিই কী ভেবে যেন বলে উঠলাম, কাকের কী এমন কষ্ট ছিলো যে এভাবে মারা যেতে হবে, ও তো আর মানুষ না, সংসারের ঝামেলাও নেই।
মনির ভাই আমার কথার উত্তর দিতে একটা চেষ্টা করলো এভাবে, ও মানুষ নয় এবং ওর মস্তিষ্কও উন্নত নয় এবং এজন্যই সে বুঝতে পারেনি হয়তো, আগুনে ঝাঁপ দিলে সে মারা যাবে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে যখন দেখলো, আগুনের উত্তাপে ঠান্ডা কাটছে, আরো গরম হওয়ার জন্য হয়তো আগুনেই ঝাঁপ দিয়ে দিয়েছে।
ইফতি এতো পরিমানে ভুতের ভয় পায় যে, বাসা থেকে একা কখনো কোথাও যেতে চায় না। শুধু তাই নয়, ব্যাপারটা এমন যে কোন রকমের অস্বাভাবিক ঘটনা দেখলেই ওর সন্দেহ হয়, এখানে নিশ্চয়ই খারাপ ভুতের একটা কাজ থাকতে পারে। ওর চেহারায় একটা ভয়ার্ত ভাব খেয়াল করলাম। ওর মতে, এটা কোন অশরীরী আত্মা হতে পারে যার অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে এবং কাকের শরীরে ঢুকে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে।
রবিন যখন একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত, ওর অতি প্রিয় খালামনি, যে কিনা সারা জীবন বিভিন্ন রোগের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত, হঠাৎ রোগকে বিদায় জানিয়ে ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে দেহ ত্যাগ করে। রবিন বলে উঠলো, কাককে দেখে কিন্তু মোটেও সুস্থ স্বাভাবিক কাক মনে হচ্ছিলো না। কাকটি বোধহয় বড় কোন রোগে আক্রান্ত, যে আর জীবনের ভার সহ্য করতে না পেরে আগুনে ঝাঁপ দেয়ার মতো দুঃসাহস করেছে।
এরকম ভাবে সবারই কোন না কোন মতামত ছিলো। এসব আড্ডা যেহেতু একটা নির্দিষ্ট বিষয়কেন্দ্রিক হয় না, একটা পর্যায়ে আমাদের আড্ডার বিষয়ও কাক থেকে সরে যায় এবং আমিও কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচি। ছোটবেলায় শোনা, কাক একটা অশুভ পাখি, সুতরাং রাত দুপুরে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে আমারো কিঞ্চিৎ ভয় লাগছিলো। হঠাৎ কল আসলো, কিছুক্ষণ আগে নাফিজ সুইসাইড এটেমপ্ট করেছে, ঢাকা মেডিকেলের এমার্জেন্সিতে ভর্তি; দৌঁড়ে গেলাম হাসপাতালে। কিছুক্ষণ আগেই নাকি ওর প্রেমিকা এক্সিডেন্ট করেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে। দুর্ঘটনার খবর শোনার পরই নাকি নিজেকে ছুরি দিয়ে স্টেপ করে। এখন মোটামুটি শঙ্কামুক্ত হলেও যেহেতু প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে, ভয়ানক কিছু হওয়ার সম্ভাবনাই ছিলো।
এই ঘটনায় হঠাৎ কাকের কথা মনে পড়লো। হাসপাতালে যাওয়ার সময় পুকুরপাড়ে লাইটের আলোয় স্পষ্ট চোখে পড়েছিলো, একটা বেজি একটা কাকের শবদেহ ছিঁড়ে খাচ্ছে এবং এটা আগুনে পুড়ে যাওয়া কাক নয়, ভিন্ন একটা। কেন জানি কোন এক নিউজ পোর্টালে পড়া একটা নিউজ মনে পড়লো, ‘কাক একটি মনোগ্যামাস পাখি’।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত