১.
এক বছর আগে বাবা মাথা ঘুরে পরলেন। ঘরের সবচেয়ে বড় মাথাটা পরলে গোটা পরিবার দিশা হারায়। বাবার ঘুরে পরা অনেক কিছুই ঘুরিয়ে দিয়েছে। চেনাজানা পৃথিবীটাকে অনেক বদলে দিয়েছে। ক্ষণিকের মনে হওয়া পথটা আজ যেন সাত জনমে শেষ হবেনা।
অপরিচিত এক অন্ধকার সময় পথ আটকে দাঁড়ালো। ঘোর অন্ধকারে অনেক পরিচিত মুখও অপরিচিত হয়ে গেলো। এই বিভীষিকাময় সময়ের নির্মম বাঁকে বাঁকে আমি আর আমি থাকিনি। অনেক কিছু শিখেছি।
এখন আমি আর বোকা নই। বাতের রোগীকে সিটিস্ক্যান মেশিনে ঢুকালে হা করে চেয়ে থাকিনা। আমি জেনে গেছি মানুষের চোখের পানি একটা অসীম লাভজনক ব্যবসার অমূল্য পুঁজি। আজকের আমি চালাক। যে দেখতে পায়। আবেগী হয়ে আর বলে না- প্লিজ, একটা কিছু করেন, টাকা সমস্যা না। রোগীকে আইসিইউ তে রেখে দাতে দাত চেপে দর কষার সাহস রাখি।
গার্মেন্টসে অডিট করতে গিয়ে জেনেছি। একেক গার্মেন্টসের একেক মেশিন পছন্দ। এক হাসপাতালের টেস্ট রিপোর্ট অন্য হাসপাতাল নিতে চায় না। ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারি। এক হাসপাতালের টেস্টের মেশিন অন্যখানে পছন্দ হয় না।
তবে একই রকম নোট সবার পছন্দ। দেশে নোট বানানোর মেশিন বোধহয় একটাই। সাধারণ মানুষ ঐ মেশিনের খবর জানে না। তাদের নোটের জোগাড় হয় ভিন্ন প্রক্রিয়ায়। কারো ভিটেমাটি ছাড়লে নোট আসে। প্রিয় গয়নার মায়া ছাড়ে কেও। কেও সারাজীবনের সঞ্চয় হাতছাড়া করে। সেই সঞ্চয়ের সাথে ছেলের পড়ার খরচ, মেয়ের বিয়ের খরচ ও হাত ছেড়ে পালায়। মানুষের একেকটা সম্বল হাসপাতালের একেকটা নোট মেশিন।
যার কিছু নেই। তার আছে সুবর্ণ সুযোগ। রাস্তার কুকুরের মতো শেষ জীবনে কাটানোর সুযোগ। এদেশে জন্মালে এমন সুন্দর সুযোগ পাওয়া যায়। তিলেতিলে ধুঁকে ধুঁকে মরা যায়।
২.
একদিন অফিস থেকে ফিরলাম। ছোট বোনের কাছে শুনলাম মা পাগল হয়ে গেছে। ছুটে গিয়ে দেখি মা শিশুর মতো কাঁদছে। রাতে আরও কিছু অদ্ভুত কাণ্ড করলো।
যার বাবার লিভার সিরোসিস। বড়ভাই বিদেশে। তার শেষ আশ্রয় মা। সেই মা পাগল হয়ে গেলেও তার ‘কিছু হয়নি’ রিয়েকশান দিতে হয়। বাবার জটিল অসুখের রিপোর্ট পড়ে পড়ে ‘কিছু হয়নি’ রিয়েকশান দেয়া আয়ত্ত করেছি। অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে।
সামনে পরীক্ষা। অফিসে প্রচুর কাজ। পড়া নাই। ঘুম নাই। খাওয়া নাই। ফিলিং স্যাড বলার জন্য ফেইসবুক নাই। ঢাকার রাস্তার জ্যাম ঠিকই আছে। অফিসের লেইট এড়াতে ঘড়ির সাথে পাল্লা দিতাম। বাংলা মোটর থেকে কাওরানবাজার সোজা হাটা।
পাশাপাশি একসাথে অনেক মানুষ হাঁটছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির এই নগরে আমি একা। বড্ড একা।
অফিসটা খুব অন্ধকার মনে হচ্ছিল। ওয়াশরুমে গিয়ে দেখি চোখের কোনে মুক্তার মতো স্বচ্ছ পানি। কাজ ফেলে ওয়াশরুমে গিয়ে দুই দিন অঝোরে কাঁদলাম। অফিসের সবচেয়ে অপ্রিয় জায়গাটা আপন হয়ে গেলো।
মাকে নেয়া হলো বাবার পরিচিত এক বয়স্ক ডাক্তারের কাছে। কদিন আগের প্রেস্ক্রিকপশান দেখে চোখ কপালে তুললেন তিনি। জানালেন ভুল ঔষধের প্রভাবে এমনটা হয়েছে। একজন সার্টিফাইড ডাক্তার কিসের প্রভাবে এমন ভুল করেছেন। সেটা জানালেন না। কিছু ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে আম্মু সুস্থ হলেন।
মানুষ ভুল করে। ডাক্তাররাও কি মানুষ? এদেশে তো তাদের দেবদেবীর মতো পূজা করা হয়। এক হিসেবে তারা দেবতাই। একজন দেবী মায়ের প্রেস্কিপশানে ছোট্ট একটা শব্দ লিখে দিলেন। আমার গোটা পৃথিবী উল্টে গেলো। এমন সাধ্য তো শুধু দেবতার হয়।
এক বছরের নির্মম অভিজ্ঞতায় ডাক্তার আর দেবতার একটা পার্থক্য খুঁজে পেয়েছি।
দেবতারা জানেন যার ক্ষমতা অনেক, তার দায়িত্বও অনেক। দেশের বেশীরভাগ চিকিৎসক সেটা জানেন না।
৩.
পায়ের তালুতে ইয়া বড় এক ফোস্কা। নিছক অবহেলায় ওর ভিতরে ফাঙ্গাসের নগরী গড়ে উঠেছে। অপারেশান করতে হবে ডাক্তারের আদেশ। এজন্য হাসপাতালে ভর্তি হলেন কাকা।
একমাত্র চাচা সপরিবারে হংকং এ থাকেন। ঈদ কাটালেন হাসপাতালে শুয়ে। উন্নত দেশের উন্নত নিয়ম। জান থাকলে ঈদ হবে। বাঙালির নিয়ম ভিন্ন। আবেগি নিয়ম। ভাই হাসপাতালে। আবেগী নিয়ম মেনে, ঈদের নামাজ পড়ে এসে আব্বু শিশুর মতো কাঁদলেন। টেলিফোনে চাচী আম্মা ও কেঁদেছেন।
চাচাতো ভাইয়েরা ঈদের আসল অর্থ বুঝেনা। ওদের ভিডিও গেমস আর ফুটবলের পৃথিবী। ঈদ এখনো ঐ পৃথিবীতে গুরুত্ব লাভ করেনি। বাবা ঘুরে পরার আগে আমার পৃথিবীও এমন ছিলো। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের গুরুত্ব বুঝিনি।
পাখির বাচ্চার মতো করে মা বাবারা আমাদের আগলে রাখেন। কঠিন বিষয়গুলো বুঝতে দেন না। আমাদের জন্য যুদ্ধ করতে করতে নিজের সবকিছু ভোলেন। অবহেলায় পায়ের ফোস্কার বিষ গায়ে টেনে আনেন। হঠাৎ ঘুরে পরে সব ঘুরিয়ে দেন। এভাবে সাতার না শিখিয়ে হঠাৎ একদিন মাঝ নদীতে ফেলে দেন। নির্জীব অক্ষম হয়ে অকুল দরিয়ায় হাবুডুবু খায় কলিজার টুকরারা। অলৌকিক কিছুর অপেক্ষা করে।
বিদেশি চিকিৎসায় কাকার পদ-জনিত সমস্যার এখনো পূর্ণ সমাধান হয়নি। ১৬ কোটি মানুষের দেশে ডাক্তার অনেক কম। একটা পায়ের পেছনে এতো সময় দেয়ার উপায় নেই। এদেশে চিকিৎসা করালে কাকা দ্রুত সমাধান পেতেন।
হঠাৎ সজ্ঞান হয়ে দেখতেন। গম্ভীর চেহারায় কেও মায়াজড়িত কণ্ঠে বলছেন।
– দুঃখিত মতিন সাহবে, অনেক চেষ্টা করেও আমরা আপনার পা টা রক্ষা করতে পারলাম না। আপনাকে বাঁচাতে বাধ্য হয়েই…। এই যে নেন, বলে পা টা হাতে ধরিয়ে দিতো।
নিজের হাতে রাখা পায়ের দিকে তাকিয়ে আমাদের মতো নিরুপায় হয়ে কাকা ভাবতেন।
আলহামদুলিল্লাহ। প্রাণে বেঁচে গেলাম।
৪.
মেয়েদের সাথে তর্কে জিতা সহজ কাজ। একটু খেপিয়ে দিলে হয়। ওরা যুক্তির লাগাম হারায়। বুদ্ধিহীন পালোয়ানের মতো শক্তি অপচয় করে হেরে যায়।
মেধাবী মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টা। কঠিনের চেয়ে বেশী কিছু। একজন মহা মেধাবিনির সাথে অনলাইনে প্রায় খুনসুটি হতো। সে যাই বলুক আমি উত্তর দেই। অনলাইন যুদ্ধে রিপ্লাই না দেয়ার অর্থ হেরে যাওয়া।
এই দ্বিপক্ষীয় তর্কে বন্ধু ও ছোট ভাইরা নিজ নিজ আইডি থেকে দর্শকের ভূমিকায়। সুতরাং রিপ্লাই না দিয়ে ওর কাছে হেরে যাওয়ায় আনন্দের কিছু নেই।
একদিন সত্যি ওর কাছে হেরে গেলাম।
আমি নিষ্কর্মা, অলস মানুষ। দুই ঘণ্টা গাড়িতে কাটালে চার ঘণ্টা বিশ্রাম নিতে হয়। কিছুদিন আগে রাস্তায় তিনঘণ্টার জ্যামের কবলে পরলাম। শাহাবাগ থেকে বাসাবো মনে হলো আরব্য রজনীর সাত সাগর তের নদীর থেকে দূরে। বাসায় এসে ব্যাঙের মতো হাতপা ছড়িয়ে বেহুশ।
ছোট্ট একটা মেয়ে। পড়াশুনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপার্টমেন্টে প্রথম। হলের খেলাধুলায় চ্যাম্পিয়ান। খুব ভালো রাঁধুনি। অগণিত গুন। এই গুণবতীর কথা ভাবলেই আমার চোখর সামনে একটা মস্ত পাহাড় ভেসে উঠে।
কিছুদিন আগে হঠাৎ জানলাম, ওর মা আর নেই। বন্ধুদের সবার খুব মন খারাপ হলো। ওর খুব কাছের মানুষের থেকে আমরা যথাসম্ভব খোঁজ নিলাম। কিছুদিন পর মনে হলো, এবার ওর সাথে একটু আলাপ করা যায়। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।
দুর্যোগে মানুষকে শক্তি দিতে হয়। শক্তি দেয়ার একটি বুদ্ধিদীপ্ত পদ্ধতি হলো। নিজেকে দুর্যোগাক্রান্তের থেকে শক্তিহীন বুঝানো। পদ্ধতিটা বন্ধু রঞ্জুর কাছ থেকে শিখেছি।
আমার বাবার জটিল অসুখের কথা ওকে জানালাম। রঞ্জুর পদ্ধতি শতভাগ সফল। নিজের কষ্ট ভুলে মেয়েটি আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো।
– ভাইয়া আঙ্কেলকে ইন্ডিয়া নিয়ে যান, এখানকার ডাক্তাররা কসাই।
ডাক্তারদের উপর ওর ক্ষোভ দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
-অ্যান্টি কি চিকিৎসা জনিত অবহেলার শিকার?
ধারণা ঠিক। জানলাম, চিকিৎসকদের চরম গাফিলতির কারনে ও আজ মাতৃহারা। যেই সমস্যার কারনে ওর মাকে হাসপাতালে নেয়া হয় সেটার কোন চিকিৎসা দেয়া হয়নি। এমনকি সমস্যা চিহ্নিত করার নুন্নতম চেষ্টা করা হয়নি!
যে মায়ের প্রতিটি সন্তান তুখোড় মেধাবী। প্রবল সাহসী। এই রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থা সেই মাকে এমন নির্মম মৃত্যু উপহার দেয়। এদেশের মেধাবী, সাহসীরা নিজের সবচেয়ে বড় সম্পদ হারিয়েও টু শব্দ করতে পারে না। একদম কুঁচকে যায়। এখানে ‘ন্যায় বিচার’ শুধু একটি শব্দ মাত্র। এই প্রতারক সিস্টেমের কিছুই হয়না। হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে।
প্রবল কম্পন অনুভব করলাম। শক্তিহীনকে শক্তি দেয়ার পদ্ধতি জানি। মাতৃহীনকে কিভাবে সান্ত্বনা দিতে হয় সেই পদ্ধতি রঞ্জু আমাকে শিখায়নি। ভুল হয়েছে। পদ্ধতিটা জেনে আলোচনায় আসা উচিৎ ছিলো। খুব বিব্রতবোধ করছিলাম। টেনেটুনে কোনভাবে আলোচনা করে যাচ্ছিলাম।
ওর শেষ ম্যাসেজটা ছিলো,
‘ভাইয়া। আমার আম্মার জন্য দোয়া করবেন। পৃথিবীটা খালি হয়ে গেছে আমার।’
কি বলবো? উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। অনেক চেষ্টা করেও আর রিপ্লাই দিতে পারলাম না।
আমি একটা পাহাড়কে চিনতাম । এই ভঙ্গুর মেয়েটাকে তো চিনি না। একদম অপরিচিতা। চোখের সামনে পাহাড় ধসে পরলে মানুষকে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি হেরে গেলাম।
৫.
কয়েক বছর আগে এক বন্ধুর সাথে হঠাৎ কুমিলা মেডিকেলে যেতে হলো। উদ্দেশ্য একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানো। রোগী, সেই বন্ধুর প্রতিবেশী। দ্রুত অপারেশান করতে হবে। আর অপারেশনের জন্য চাই রক্ত। আমরা ঝড়ের বেগে হাসপাতালে পৌছালাম। সাথে তিনজন প্রিয় অনুজকে নিলাম। ওরা সবাই রক্ত দিবে। পৌঁছে রোগীর সাথে দেখা করলাম। ভদ্রমহিলা কথা বলছেন তখনো।
রক্তদাতারা যেহেতু হাসপাতালে পৌঁছেছে। এখন একটাই কাজ। যত দ্রুত সম্ভব রক্ত গ্রহণ করে অপারেশান করা। যেই রুমে রক্ত সংগ্রহ করে আমরা সেখানে গেলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছি। রক্ত নেয়ার খবর নাই। একটু পর একজন এসে বললো এখন লাঞ্চ টাইম। লাঞ্চের পর আসেন। দুই ঘণ্টারও বেশী সময় পর লাঞ্চ শেষ করার দয়া হলো তাদের। আধ ঘণ্টার কাজ শেষ হতে লাগলো পাঁচ ঘণ্টারও বেশী। ৩০ মিনিটের কাজ ৩০০ মিনিটের বেশী!
রক্ত নেয়ার আরও অনেক পরে রোগীকে অপারেশান করতে নেয়া হলো। বাড়ি ফিরে খবর পেলাম, রোগীকে বাঁচানো যায় নি। বিস্তারিত শুনে চমকে গেলাম। অপারেশানে দেরি হওয়াতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে রোগীর মৃত্যু হয়!
একটা পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড হয়েছে। অসহায় পরিবারটা সব জানে। কোন প্রতিবাদ করেনি। কাওকে কিচ্ছু বলেনি। ঝামেলা করে দাফন বিলম্বিত করার মানে হয়না। গরম গরম দাফনে সমস্যা হলে মৃতের আত্মা কষ্ট পায়। এমনটা তারা চায় না।
সরকারি হাসপাতাল বিষয়ে জানাশুনা আছে এমন একজনের থেকে জানলাম। শুধুমাত্র মেডিকেলের বারান্দায় হাঁটা চলা করে এমন অনেকেই এখন কুমিল্লা শহরে বাড়ির মালিক। মহামান্য রক্ত সংগ্রহকারীরা তো শুধু মেডিকেলে হাঁটেন না বরং হাসপাতালের অতি গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসেন। তাদের সুইস ব্যাংকের সাথে লেনদেন থাকা উচিৎ। উনাদের লাঞ্চটাইম অবশ্যই একজন গরীবের ক্রিটিকাল লাইফ টাইমের চেয়ে দামী।
দেশে উনাদের মতো বড় সাহেবদের বড্ড অভাব। স্বাস্থ্য বিভাগ চাইলেই তো যাকে তাকে সেখানে নিয়োগ দিতে পারে না। তাই শুধু লাঞ্চ কেন, বড় সাহেবেরা হজে গেলেও ঐ চেয়ারের জন্য পর্যাপ্ত জনবল জোগাড় করা সম্ভব না। জনবহুল দেশে দু-চারটা ফকির মরে লাশ হলে কি ই বা এমন হবে?
প্রতি ঈদে আমাদের সংগঠন ‘জাগ্রত তরুণ’ বাচ্চাদের নতুন জামা দেয়ার চেষ্টা করে। মহিলাটি তিন সন্তানের জননী ছিলেন। বন্ধু একরামসহ সদ্য মা হারা বাচ্চাদের ঈদের জামা দিতে গেলাম। বাড়ির সামনে খেলছে ওরা। বড় ছেলেটা ফোর বা ফাইভে পড়ে। ছোটরা তখনো স্কুলে যায় না। একরাম ওদের বাবাকে ডেকে জামাগুলো দিলো। উনি আমাদের সামনে সেগুলো নিজের সন্তানদের বুঝিয়ে দিলেন। বাচ্চারা খুব খুশী হলো।
প্রিয় পাঠক, নতুন জামা কি ওদের মা না থাকার কষ্ট ভুলিয়ে দিবে? জানি না। যেই ভূখণ্ডে মানুষের জীবনের মূল্য নাই। হিসাব মতে সেখানে একটা নতুন জামা একজন মানুষের অভাব পূরণ করার কথা। শিশুদের নিষ্পাপ মন এই জটিল হিসাব বুঝেনা। নিষ্পাপ মনের কষ্ট বুঝতে কিছু মানুষের প্রয়োজন। যে মানুষেরা জীবনের মূল্য বুঝে। মায়ের অমূল্য ভালোবাসা অনুভব করতে পারে। বিলাসিতায় সময় নষ্ট করে হাজার শিশুকে এতিম বানায় না।
আমরা সব দেখি। সব বুঝি। অথচ কেও কিচ্ছু বলি না। আমরা সবাই খুনির সহযোগী। সবাই গরম গরম লাশ লুকানোর ধান্দায় ব্যস্ত। আমাদের পক্ষে আর মানুষ হয়ে ওঠা সম্ভব না। এতিমের কষ্ট বুঝা সম্ভব না। এই এতিমরা যত দ্রুত আমাদের প্রতারক দুনিয়ার জটিল হিসাব বুঝবে। নিষ্পাপ থেকে মস্ত পাপী হয়ে আমাদের একজন হয়ে উঠবে। ওদের ততই মঙ্গল।
হে জাগ্রত তরুণ! ওদের ভালো চাইলে, ওদেরকে আর ভালোবাসা শিখাতে যেও না। ওরা হিংস্র হোক। প্রতিশোধপরায়ণ হোক। দুর্ধর্ষ চেঙ্গিস হয়ে এই পাপী, হত্যাকারী রাষ্ট্রের মানচিত্র চিবিয়ে খাঁক।
৬.
এইতো সেদিন যেন। হোস্টেল থেকে একটু ফাঁক পেলেই চলে যেতাম। কুমিল্লা ইপিজেড, হাউজিং, তারপর বারপাড়া। বড় ফুফুর বাড়ি। অন্দরে বা আঙ্গিনায় বসে আছেন ফুফু। হাতে চিরসঙ্গী পানের বাটা। মানুষকে বলতেন, দেখো আমার আব্বা আসছে। পান আর মানুষ ফুফুর পাশে সবসময় থাকতো। শৈশবে বাবা ডাকার ফুরসৎ পাওয়ার আগেই বাবাকে হারিয়েছিলেন। এজন্য বোধহয় আমাদেরকে সবসময় আব্বা ডাকতেন।
বামুনের দেশে সাগর হৃদয়ের কেও থাকলে বামুনরা তাকে আঁকড়ে থাকে। সবাই নিজের দুঃখ কষ্ট ঐ সাগরের বুকে নিশ্চিন্তে জমা রাখে। ফুফু বড় মনের মানুষ ছিলেন। সেজন্য বোধহয় অসহায় পাড়া পড়শিরা সবসময় তাকে আঁকড়ে ধরে থাকতো। এমন একজন মানুষ প্রতিদানে কি পেলেন!
সামান্য অসুস্থকে দায়িত্বহীন অপচিকিৎসা দিয়ে নৃশংসভাবে মারার বড় উদহারন আমার বড় ফুফু।
কয়েক মাস আগে একজন মৃত বোন কিভাবে ভাইয়ের উপকার করেছিলো। সেই ঘটনাটা বলি,
আমার আব্বুর ক্রনিক লিভার সিরোসিস। পায়ে পানি জমে থাকে। অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না তাই নতুন এক ডাক্তারের কাছে নিলাম।
সব রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে কি পাঁচ হাজার টাকা দামের কোন ইঞ্জেকশান দেয়া হয়েছে? আব্বু বললেন।, না। দেয়া হয়নি। ডাক্তার প্রেস্কিপশান লিখে বললেন, যত দ্রুত সম্ভব এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটা ইঞ্জেকশান দিতে হবে।
এতো স্বল্প সময়ে এতো পাওয়ারফুল ইঞ্জেকশান! আমার খুব অদ্ভুত মনে হলো। আমি ইঞ্জেকশান দিতে বাধা দিলাম। নিশ্চিত হতে অন্য ডাক্তার দেখালাম। প্রেস্কিপশান দেখে নতুন ডাক্তার সাহেবের মাথায় হাত। তিনি বললেন এই ইঞ্জেকশান তো আমরা একদম লাস্ট স্টেজের রোগীকে দেই। সাধারনত লিভার ক্যান্সারের ক্ষেত্রে। এমন উদ্ভট প্রেস্ক্রিপশান ঐ ডাক্তার কিভাবে দিলেন?
আপনারাই বলুন, এদেশের কয়জন রোগী একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের আদেশ অন্যত্র যাচাই করে? যাদের ভাববার কেও থাকে না। যাচাই করার কেও থাকে না। তাদেরকে এমন ভুল ইঞ্জেকশান শরীরে নিয়ে মরতে হয়।
ফুফুর কেও ছিলো না। ভুল পরামর্শ। ভুল ঔষধ। এমনকি শরীরে ভুল রক্ত দেয়া হয়েছিলো। একটা জলজ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। ফুফুর অপচিকিৎসায় মৃত্যু আমাকে খুব ভাবায়। শুধুমাত্র একারনে সেদিন আব্বুর প্রেস্কিপশানটা যাচাই করিয়েছিলাম। এভাবেই আব্বুকে সেদিন মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলো তার মৃত বোন।
ফুফুকে শেষবার দেখতে গিয়ে চিনতে পারছিলাম না। দ্বিধায় পরে গেলাম। এমন গুরুতর রোগীর স্বজনরা দ্বিধায় পরে। প্রিয়জনকে আর কয়টা দিন নিজেদের কাছে আটকে রাখার দোয়া করবে নাকি অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মানুষটার মুক্তি তথা মৃত্যুর জন্য দোয়া করবে। তিলেতিলে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে কিছুদিন পর সবাইকে কাঁদিয়ে অকালে চলে গেলেন ফুফু। আজন্ম ভর্তি থাকা পানের বাটাটা শুন্য হয়ে ঘরের এক কোনে পরে রইল।
আচ্ছা, ইরাকে যার নেতৃত্বে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চলেছে সেই মানুষটা কি এতো কঠিন করে মৃত্যু কে দেখবে? যার কুচক্রে গোটা ভিয়েতনামে রক্তনদী বয়ে গেছে সে কি এমন ধুঁকে ধুঁকে মরেছে? মনে হয় না।
এদেশে অপচিকিৎসায় দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করে এমন মানুষকে নিঃশেষ হতে হয় যার দ্বারা কখনো কারো অনিষ্ট হয়নি। যে শর্তহীনভাবে ভালোবেসেছে সবাইকে।
প্রকৃতি নাকি শুন্যস্থান একদম পছন্দ করে না। এজন্য আমরা সহজে মৃত ব্যক্তির অনুপুস্থিতি ভুলে যাই। প্রকৃতিতে ব্যাতিক্রম নিয়মও আছে। প্রকৃতিতে কিছু মানুষ মরুর বুকে থাকা গাছের মতো জমিনে আবির্ভূত হন। গাছটা হঠাৎ হারিয়ে গেলে। মরুবাসীরা ঐ শুন্যস্থান ভুলতে পারে না। ঐ দগদগে ক্ষত আজীবন থেকে যায়।
শুনেছি বারপাড়ার মানুষ গাছটাকে ভুলতে পারে না। তীব্র ক্ষরায় ক্লান্ত দীকভ্রান্ত হয়ে যখন ছায়া খুঁজে পায় না। যাওয়ার কোন জায়গা পায় না। তখন গাছটাকে খুব মনে পরে। সবার ফুফুকে খুব মনে পরে।
৭.
বড়ভাই হাসপাতালে। খবর পেয়ে সবাই দিশেহারা হয়ে ছুটলো। যারা হাসপাতালে গেলো। সবার জন্য বড়ভাইয়ের বিশেষ উপহার। উপহারের নাম ধমক।
বংশের বড় ভাইরা রাগি হন। খেলার বয়স থেকে সংসার নামক জাহাজটা টানেন। সবার মুখে হাসি ফোঁটাতে গিয়ে হাসি আনন্দের সাথে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করেন। বন্ধুত্ব করেন গাম্ভীর্য আর রাগের সাথে।
উল্লেখিত বড় ভাইটি দেশ কাঁপানো জাদরেল ফুড ইন্সপেক্টর শফিকুর রহমান। তিনি আমার বড়ভাই না। আমার বাবা চাচাদের সবার বড়ভাই। আমার বড় দাদার বড় ছেলে। আমাদের সবার বড় জ্যাঠা। আমরা ডাকি বড় জেয়া।
আব্বুসহ আমরা ল্যাব এইডে ছুটে গিয়ে দেখি নির্ভার হয়ে শুয়ে আছেন জেয়া। জেয়ার মতে তিনি একদম সুস্থ। একজন সুস্থ মানুষকে দেখতে এসেছি সবাই। গাধার মতো কাজ করেছি আমরা। নিয়ম অনুযায়ী গাধাদের উপহার ধমক। এমন উপহারে মানুষ কষ্ট পায়। এক্ষেত্রে ঘটনা উল্টা। সবাই খুব খুশী।
হাসপাতালের যাওয়ার পথে এই ধমক নামক উপহারের সূচনা। প্রথম উপহার বিজয়ী হলেন আমাদের বাবু ভাইয়া। জেয়ার ছোট ছেলে। বাবু ভাইয়ার কৃতিত্ব তিনি রাস্তা পার হতে গিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ বাবার হাত ধরেছেন। হাত ছুড়ে ফেলে দিয়ে বাবু ভাইয়াকে নগদ ধমক দিয়ে বললেন, আমাকে এভাবে ধরছস কেন? আমি কি রোগী! বাবু ভাইয়ার পর একে একে ধমক খাওয়ার তালিকায় জেয়াকে দেখতে যাওয়া সবাই নাম লেখালো।
মৃত্যু পথযাত্রীদের অস্বাভাবিকত্ব থাকে। চলে যাওয়ার ইঙ্গিত থাকে। সবাইকে দেখার জন্য ছটফটানি থাকে। ধমক উপহার পেয়ে সবাই বুঝলো জেয়া একদম স্বাভাবিক। কোন উল্টাপাল্টা ইঙ্গিত নাই। কাওকে দেখার জন্য ছটফটানি নেই। এমন দেখা আরও অহরহ হবে। খুশীমনে সবাই বুকভরা ধমক খাওয়ার আনন্দ নিয়ে ঘরে ফিরলো।
কম কথা বলা মানুষদের অভিব্যাক্তি অনেক কিছু বলে। বড় জেয়া সেই রকম মানুষ। তাঁর প্রতি সবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তিনি বুঝতে পারতেন। মুখে না বললেও ধমকের আড়ালের অভিব্যাক্তি দেখে বুঝেছি সবাইকে কাছে পেয়ে তিনি অনেক খুশী হয়েছিলেন।
স্রষ্টা মানুষকে ধমক পরিমাপ করার ক্ষমতা দেননি। পরিমাপ করা গেলে দেখা যেত। এই চিকিৎসাকালিন ধমকগুলো অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে জোরালো ছিল। এখানে রাগের সাথে আরেকটা জোর যোগ হয়েছে। বিশ্বাসের জোর। সবাইকে সেই বিশ্বাসভরা ধমক দিয়ে জেয়া বলেছেন,
-তোরা এসব কি শুরু করলি? ছোট্ট একটা অপারেশানের জন্য আসছি। কষ্ট করে কেন আসছচ? আমি কি রোগী?
অনেকদিন আমেরিকা থাকার সুবাদে সেখানে চিকিৎসা করার সব ধরনের সুযোগ ছিলো। সবার আবদারও ছিল সেরকম। তিনি এ দেশের চিকিৎসায় বিশ্বাস রাখলেন। বিশ্বাস করলেন এই অপেশাদার, দায়িত্বহীন চিকিৎসা ব্যবস্থাকে।
তিনি ভেবেছিলেন ওটি তে ঢুকবেন। চোখ বন্ধ করবেন আর খুলবেন। চোখ খুলতেই ডাক্তার এসে বলবেন অপারেশান সাকেস্ফুল।
জেয়া আর চোখ খুললেন না। আমাদের সবার চোখকে অথৈ জলে ভাসালেন।
এদেশে এভাবেই অর্থলোভ আর অবহেলায় একজন সতেজ, সবল মানুষের চোখ চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়। হোক সেই রোগী একটা গোটা বংশের বটবৃক্ষ। তাতে কারো কিছুই আসে যায় না।
চিকিৎসায় ঝুঁকি থাকবেই। সেই ঝুঁকির দোহাই দিয়ে জীবন নিয়ে আর কতো ছেলেখেলা হবে? নিজেদের অদক্ষতা, অপেশাদারিত্বকে কিভাবে জাস্টিফাই করবেন কিছু ডাক্তার?
অথচ আয়ের বেলায় একদম কোন ঝুঁকি নাই। রোগীর রক্ত প্রবাহ থেমে গেলেও নোটের প্রবাহ থামে না। গুনে গুনে চকচকে নোট দিয়ে প্রিয় মানুষের দেহটাকে হাসপাতাল নামক ঐ খাঁচা থেকে ছাড়িয়ে আনতে হয়। একটা জঘন্য, ঠুনকো সিস্টেম সবার হাত পা বেধে রেখেছে। এতকিছুর পরও নিরুপায়দের যাওয়ার কোন জায়গা থাকে না। ঘুরেফিরে সেই মৃত্যুকূপে যেতে হয়। যেখানে গুরুতর অন্যায় হলেও বিচার নেই।
মজলুমদের যাওয়ার জায়গা একটাই যেখানে সবার চোখ খোলা থাকবে।
সেদিন নিশ্চয়ই জেয়া চোখ খুলবেন।
আচ্ছা। ঐসব ডাক্তাররা কীভাবে জেয়ার চোখের দিকে তাকাবেন সেদিন? একজন মানুষের বিশ্বাসের অমর্যাদা করে । একটা গোটা বংশকে বটগাছের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত করে। কি অর্জন করলেন তারা? অর্থের লোভ আর দায়িত্বহীনতার বাইরে আর কি কি কারণ দেখাবেন? সেদিন কি এদেশের ঠুনকো সিস্টেমের জোরে ল্যাব এইডের সে সব ডাক্তাররা পার পেয়ে যাবেন?
আমাদের মতো নিরুপায়, ক্ষমতাহীনদের শেষ ভরসা সবজান্তা হাকিমের সেই সর্বোচ্চ আদালত। সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম।
——————————————
পরিশিষ্ট;
একটা আর্টিকেলে পড়েছিলাম। মাদার তেরেসা একবার বলছিলেন, ‘‘সেদিন স্বপ্নে দেখলাম। আমি স্বর্গের দরজায় দাড়িয়ে। স্বর্গের প্রহরী আমায় বললো, তুমি পৃথিবীতেই ফিরে যাও, ভিতরে তো কোন বস্তি নেই”।
আর্টিকেলটা পড়ে সত্যিই আমার চোখ বেয়ে পানি পরলো। সেদিন অডিটের কাজ শেষে রুমা থেকে বান্দরবনে ফিরলাম। আমার ছায়ার মতো সঙ্গি জয় বম্ব কে বিদায় দিতে হলো। জয়দা রুমায় ফিরে যাওয়ার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন দাদা আবার আসবেন। রুমা থাকাকালিন জয়দার অদ্ভুত ইংরেজি শুনে খুব হেসেছি। বান্দরবনে আমাকে বিদায় দেয়ার সময় ইচ্ছা করে আবারো ভুলভাল ইংরেজি বললেন। আমাকে হাসানোর চেষ্টায় এ যাত্রায় ফেইল করলেন জয়দা। আমি হাসতে পারিনি।
সেদিন সন্ধ্যায় বান্দরবনের রাস্তায় একা একা হেঁটেছিলাম কিছুক্ষন। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গায়ও একা ভালো থাকা যায় না। হোটেল এসে কিছু না ভেবে পড়তে বসে গেলাম। মাদার তেরেসাকে নিয়ে লেখা এক দীর্ঘ ইংরেজি আর্টিকেল। একজন সাধারণ নারীর অসাধারণ মহীয়সী হওয়ার গল্প। আর্টিকেলটির বিভিন্ন বাঁকে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য গল্প আমাকে নাড়া দিলো। সঞ্চিত আবেগগুলো একসাথে চোখের পানি হয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো, মাদার তেরেসার স্বর্গ নিয়ে দেখা স্বপ্নের উক্তিটা পড়ে। আসলেই তো! বস্তির অসহায় দুস্থ মানুষের সেবা করা যার কাছে সবচেয়ে সুখের। সেই মাদার তেরেসা সুস্থ, সুখী মানুষের স্বর্গে ভালো থাকবেন কি করে?
নিয়ত যেকোনো মহৎ বা অসৎ কাজের পরিণতি ঠিক করে। আমাদের অভিভাবক ও শিক্ষকেরা খুব আগ্রহ নিয়ে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেন। সে আলোচনার মূলে থাকে বিশ্রী অর্থলোভ। ছেলেমেয়ে ডাক্তার হওয়া মানে বাড়িতে টাকার গাছ লাগানো। তাই যেকোনো মূল্য সবাই সন্তানকে বা ছাত্রকে ডাক্তার বানাতে চান। অধিকাংশ মানুষের মনে ভুলেও সেবার চিন্তা আসে না। তাদের মাথায় থাকে কড়কড়ে নোট। কই কখনো কাওকে তো ভাবতে দেখিনি, আমাদের সন্তান মাদার তেরেসার মতো মানুষের সেবা করবে। নগ্ন সত্য হলো, তাদের মাথায় মাদার তেরেসাদের মতো মানুষের জায়গা হয় না।
জায়গা হবে টা কিভাবে! কোন ডাক্তারের সাথে দেখা করতে তিন মাস আগে সিরিয়াল দিতে হয়। কোন ডাক্তারের শহরে কয়টা বাড়ি সেসব তথ্যে তাদের মাথাটা যে ভর্তি।
আরেকটা সহজ প্রশ্ন। স্কুল কলেজের বারান্দা পেরিয়ে বান্দরবনের হোটেলে আমার সত্যিকারের মাদার তেরেসার সাথে পরিচয় হবে কেন? এ পরিচয় তো হওয়ার কথা ছিলো স্কুলের শ্রেণীকক্ষে। শিক্ষক, অভিভাবকদের অর্থলোভ আর দুনিয়াবি উন্নতি কেন্দ্রিক বদ নিয়তের মাধ্যমে যারা চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। তাদের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পুরন হলে তা অনেক মানুষের দুঃস্বপ্নের কারন হয়। দুর্বল চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরির কারিগর শিক্ষক, অভিভাবক, সমাজপতিরা একসময় অপচিকিৎসার শিকার হন। তখন উনারা যত্রতত্র অপমানসূচক ভাষায় জল্লাদ, কসাই, প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বিশেষায়িত করেন।
আমার প্রশ্নের এখানেই শেষ না, হঠাৎ কি এমন হলো! ঘটা করে সুস্থ মানুষগুলো একে একে কবরে নেমে যাচ্ছেন? কেন সেদিন ব্যাংকে চাকরি পেয়ে মিষ্টি খাওয়ানো ভাইটা জানায়, আমার আশা শেষ, আর কোন চিকিৎসা নেই। হ্যাঁ। মানতে দ্বিধা নেই। ভুল খাদ্যাভ্যাসের কারনে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাজা প্রাণ ঝরছে। অল্প বয়সে শরীরে মরন রোগ বাসা বাঁধছে। কিন্তু পেশাদার স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সচেতনতা বৃদ্ধির কোন প্রচেষ্টা তো দেখি না। উল্টো মনে হয় এ যেন সচেতন হত্যাকাণ্ড। যদিও সভা-সেমিনারে গড় আয়ু বৃদ্ধির ফাঁকা বুলি শুনে আমাদের কান পঁচার দশা।
একটা আশার ব্যাপার হচ্ছে, এখনো অনেক সৎ ও নিষ্ঠাবান সুচিকিৎসক আছেন এদেশে। তাদের মহানুভবতার অনেক উদাহরন আমাদের পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু বেশীরভাগ চিকিৎসকই ডায়গনোস্টিক সেন্টার আর ওষুধ কোম্পানির সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। এসব অপশক্তির বিরুদ্ধে চিকিৎসক সমাজের দৃঢ় অবস্থানের অভাব মহান পেশাটিকে কালিমার কুৎসিত প্রলেপে ঢেকে দিচ্ছে।
————-
বাবা চাচাদের দেখেছি জীবনে কঠোর পরিশ্রম করে অনেক কিছু অর্জন করেছেন। কিন্তু কথা শুনলে মনে হয় যেন উনাদের কর্মগুনে কিছুই হয়নি। উনারা সবসময় বলেন, আমাদের চেষ্টা ছিলো কিন্তু সব মায়ের দোয়ার ফল।
প্রতি সপ্তাহে আব্বু ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতেন। রাত জেগে দাদু ছেলের ঘরে ফেরার প্রতীক্ষা করতেন। আব্বু এসে ডাকলে বলতেন, ঘুমাইছিলাম। তুমি ডাকছো যে উঠে গেছি। আমরা সবাই জানি দাদু ঘুমান নি। এই সময়টা জেগে থাকা দাদুর চাকরির মতো। সপ্তাহ শেষে ছেলের চাকরি শেষ হয়। মায়ের হয় শুরু। সন্তানের চাকরিতে অবসরের সীমা থাকে। মায়েদের থাকে না। ছেলেদের চুল দাঁড়ি পাঁকে, ছেলের ছেলেদের মুখভর্তি দাঁড়ি গজায়। তবুও মায়ের অপেক্ষা শেষ হয় না। আব্বু সবসময় বলেন, আমার মায়ের দোয়ার কারনে আল্লাহর রহমতে চলার পথে কখনো কোন বিপদ হয়নি।
দুই শতাব্দি, দুই মিলিনিয়াম প্রত্যক্ষ করা প্রজন্ম আমরা। চিঠি দেখেছি। ফোর জি ও দেখছি। প্রায় সবকিছুই চরম বেইমানের মতো বদলে গেছে। মেনে নিয়েছি। খাপ খাইয়েছি। মা বাবা নামক কোমল সম্প্রদায়টি একটুও বদলায়নি। এক চুলও না। আজ আমার বেশীরভাগ বন্ধু অতি অল্প বয়সে বাবার লাশ নিয়ে কবরে নামার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। আমাদের প্রিয়মানুষেরা নানান কঠিন অসুখে জর্জরিত। খুব করে চাই প্রতিটি প্রিয়জন, প্রতিটি বাবা-মা সুস্থ সবল ভাবে দীর্ঘদিন এ সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকুন। ভুল চিকিৎসায়, অসচেতন অভ্যাসে, অকালে প্রিয় মুখটা হারিয়ে না যাক।
মৃত্যুকে আটকানো যায়না। আটকাতে পারেনি কেও কখনো। তবে সুন্দর জীবন চর্চা ও সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে সুস্থভাবে দীর্ঘ জীবন যাপন যে খুবই সম্ভব। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান তার প্রমাণ রেখেছে অগণিতবার।
আমাদের চিকিৎসকদের মাদার তেরসা হতে হবে এমনটা দাবি করছি না। ন্যূনতম মানবিক দৃষ্টি দিয়ে আমাদের দেখার চেষ্টা করুন। ফাঁকা বুলির পরিসংখ্যান নয় বরং সত্যিকারের সুস্থ, সবল দীর্ঘায়ু সম্পন্ন একটি প্রজন্ম গড়ে উঠুক। যার নেতৃত্বে থাকুক আমাদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত চিকিৎসক সমাজের প্রবল পেশাদারিত্ব ও অসীম মানবতাবোধ।
আগের প্রজন্মের মতো আমরাও তো চাই পাঁকা চুল দাঁড়ি নিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে, অপেক্ষায় জেগে থাকা কারো ন্যাকা ঘুম ভাঙ্গাতে। সারা পৃথিবী জয় করে এসে আমরাও বলতে চাই, আমাদের কোন কৃতিত্ব নাই। সব কৃতিত্ব ঐ জাদুকরীর দোয়ার। যে দোয়া করেছেন ঐ মাজারের মতো গৃহে বসে থাকা পীর, মুর্শিদ। আমাদের মা, বাবা।
(ঢাকা, আগস্ট- অক্টোবর ২০১৭)