চুপ, এত জোরে চিল্লাইস ক্যান! জোরে না করলে তো কাম হবার নায়। গায়ের জ্বালা মিটাবার জইন্নে নাঙের কাছে যাবার সময় এ কথা মনে আছিলো না? মোর কাম মোক কইরবার দে।
ভাদ্র মাসের তালপাকা গরমে ভিজে গোসল করার মত অবস্থায় রাগ করে রুবিকে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল রেবা ডাক্তার। ডাক্তার না ছাই! হাতুড়ে মহিলা ডাক্তার। পূর্বপুরুষের ক্ষমতাবলে মমিনপুর কমিউনিটি হাসপাতালে অল্প-স্বল্প জ্ঞান নিয়ে চাকরিটা বাগিয়ে নিয়েছে। রুবি, ওর ছোট নাতনির স্কুল সহপাঠী। তাই অমন করে বলার সাহস পেয়েছে। খুব একটা ভালো কাজ যে করেছে, সেটাও নয়। বকুল চেয়ারম্যানের মেয়েকে গালিগালাজ! এত্ত বড় সাহস! ক্ষেপে গেল আয়না পাগলা।
মিয়ার বেটি, তোমরা কইলাম কামটা ঠিক করতোচেন না। তোমরা ছাওয়ালটাক গাইল্যাবার পান না! চেয়ারম্যান শোনলে তোমার খবর করবে।
আয়না পাগলা গলা ঝেড়ে বলে দিল কথাগুলো। মেয়েটা কাঁদছে, গোঙাচ্ছে!
ও… বড়লোকের বেটি দেকি অকামটা সুকাম, তাই না রে আয়না! গরীবের বেটি হইলে এতক্ষণ ছি-ছা- তে পাড়া মাথাত তোলনেন হয়! গরীব করলে শালা অকাম, তাই না রে!
রেবা ডাক্তারের কণ্ঠে যেন বিস্ময় ঝরে।
আয়না পাগলা রুবিদের বাড়ির লোক। কাজের লোক। বয়স ত্রিশ অথবা একত্রিশ। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা কালোরঙা মানুষটার মনটা সাদা। একেবারে দুধ-সাদা। শাকেও হ্যাঁ, ভাতেও হ্যাঁ। কলুর বলদের মত খাটে চেয়ারম্যান বাড়িতে। ঠিক কলুর বলদের মত নয়, বিনিময়ে অনেক কিছু পেয়েছে আয়না, পাচ্ছে, ভবিষ্যতেও পাবে- এ কথা জোর দিয়ে বলাই যায়। চেয়ারম্যানের আজকের এত্ত এত্ত সম্পত্তি! মাছে পুকুর ভরা। রুই মাছ, সিলভার কার্প মাছ, তেলাপিয়া মাছের খলখল শব্দেও মন ভরে যে কারো। দেখলে তো চোখও সুখ পায়। কত্ত বড় বড় মাছ!
আর পটল, করলা, টমেটো, মিষ্টি কুমড়ো আরো যত সব মৌসুমি সব্জি-শাকে মমিনপুর বাজার গমগম করে, তার নব্বই ভাগ তো বকুল চেয়ারম্যানের ক্ষেত হতে আসে। যার নেপথ্যে থাকে আয়না পাগলা। ওর হাত, চোখ ছাড়া অমন সব্জি-শাক চেয়ারম্যানের পক্ষে ফলানো আকাশ কুসুম কল্পনা! সে হিসেবে এসবের মালিকানার সেও কিছু পাবার আশা করতেই পারে, তবে আয়না তা করে না। পরের জিনিসের উপর লোভ করা ঠিক না। তাদের খেয়ে বেঁচে আছে, এটাই তো মস্ত পাওয়া।
বকুল চেয়ারম্যান সব সময় রাজনীতির সায়রে থাকেন। কখনো ভেসে থাকেন, কখনো ডুবে থাকেন। এই ভাসা আর ডোবাতেই জিন্দেগি পার হবে মনে হয়। জন্ম দেয়ার উপকরণ জোগাড় দেয়াই যেন তাঁর কাজ ছিল। কোনো খেয়াল রাখেন না মেয়ের। আয়না পাগলার কোলে করেই প্রথম স্কুল যাওয়া। এখন পর্যন্ত সেই রুটিন মেনে চলে আয়না। সকালে ঘুম থেকে তুলে হাত-মুখে ধুইয়ে দেয়া, নাস্তা খাইয়ে দেয়া, স্কুলে নিয়ে যাওয়া। রোজকার কাজ, রুটিন। শুধু সেদিন অসুস্থ থাকায় নিয়ে যেতে পারেনি স্কুলে।
স্কুল শেষে পাশের গাঁয়ে নানাবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। সেদিকেই গিয়েছিল সে। এপারে মমিনপুর আর ওপারে সুজাপুর। তার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে নদী। মরানদী। ভরা শ্রাবণেও হাঁটুজল।
নদীর পাড়ে আখক্ষেত আছে। এখানে বখাটে ছেলেদের চলাচল বেশি। অঘটনটা ঘটেছিল সেদিন। এমনটাই মনে হয় আয়নার। এ কথা সত্য: রুবি দিনকে দিন সুন্দর হয়ে উঠছে। নজর পড়তে পারে বখাটেদের, রুবিকে তাই আগলে রাখে আয়না। কিন্তু, রক্ষা করতে পারলো কই? নরপশুগুলির হাত থেকে!
রুবিকে আয়না চেনে। বলতে গেলে ওর নিঃশ্বাসের খবরও জানে। মন বোঝে। সপ্তমে পড়া একটা মেয়ে প্রেমের কিছুটা বুঝতেই পারে। কারণ, যুগটা এমনই। তথ্যে ভরপুর পোয়াতিযুগ। যেখানে ইচ্ছে করলেই দশমাস দশদিনের আগেও পেট কেটে তথ্য নামের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানো যায় যখন তখন। বিজ্ঞানের যতসব আজব কান্ড!
সেক্স বিষয়ে জানাটাও জটিল কিছু না। গুগলে একটা সার্চের ব্যাপার মাত্র। গড়গড় করে সব বেরিয়ে আসে। টিভি চ্যানেল তো আছেই! রুবি প্রেম বিষয়টা সিনেমা দেখে বুঝতেই পারে। কিন্তু, সেক্সের বিষয়টি আদতে কি বোঝে? নাকি বোঝে বলেই আয়নাকে এতদিন বলেনি, কাউকে বলেনি। লজ্জা ভুলে নিজ মুখে বললো সব, এতদিনে।
আমি ওদের কাউকে চিনতে পারিনি। শুধু বুঝতে পাচ্ছিলাম আমার সাথে খারাপ কিছু হচ্ছে। বাবার ভয়ে কাউকে কিছু বলিনি। জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম। জ্ঞান ফিরে শুনি ছোটমামা নানাবাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। বাবার ভয়ে ঐ বাড়ির কেউ মুখ খোলেনি। এই জন্যই কিছুদিন থেকেছিলাম নানাবাড়ি।
পুরনো লুঙ্গীটা দিয়ে মুখটা মুছে নেয় আয়না পাগলা। ভয়ে মুখ-চোখ লাল হয়ে গেছে। রাগে, ত্রাসে। ভাদ্রের গরম এমন পরিস্থিতিতে খানিকটা বাড়তি ‘তা’ দিচ্ছে। তেলা মাথায় তেল দেয়ার মতন কারবার।
ব্যাপারটা বড়সাহেবকে জানাতে হবে– একবার ভাবে। নাহ! বড়সাহেব জানার আগে একটা ফয়সালা টানতে হবে– এটাই করবে বলে ঠিক করে আয়না।
অনুঘটককে না খুঁজে ভালোই করেছে সে। এতক্ষণে গর্ভপাতের কাজটা শেষ। মেয়েটার গণ্ডদেশ ভিজে গেছে চোখের পানিতে, ঘামে। ওষুধ লিখে দিল রেবা। সকাল, রাতে প্যারাসিটামল। আরো কিছু ওষুধ। ব্যথানাশক ওষুধ।
রেবার এই একটা কাজে আয়নার হাসি পায়। গণহারে প্যারাসিটামল দেয় সবাইকে। প্রেমে ছ্যাকা? পেটব্যথা? পাতলা পায়খানা? –সব রোগের জাতীয় ওষুধ প্যারাসিটামল।
রেবার হাতে পাঁচশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিল আয়না। রেবা খুশি। সামনে নির্বাচন। রুবির বাবা পুনরায় চেয়ারম্যান হলে পদোন্নতিটা রেবার আর ঝুলে থাকবে না। হয়ে যাবে। তাই রেবা এ ব্যাপারে মুখ খুলবে না জেনেও চুপ থাকতে বলে বের হলো আয়না।
মেয়েটা গোঙাতে গোঙাতে হাঁটছে। ওকে কোলে নেয়ার মত করে বাহিরে নিয়ে এলো। রুবি
নিষেধ করলো। তবুও শুনলো না আয়না।
বেলাটা পড়ে এসেছে। সন্ধ্যা নামবে। রফিক অটোরিকশাওয়ালাকে দেখা যায়। হাক দেয় আয়না।
ঐ রফিক… হামাক নিয়া যা।
থামেন মিয়া ভাই। যাইতোচো।
অটোরিকশাতে ওঠে ওরা। মেয়েটা মাথা নিচু করে আছে। লজ্জায়। আয়নার মুখের দিক দেখছে না।
বেটির কি হইচে আয়না ভাই? বেটিক অনতি করি অটোত তোললেন ক্যানবা?
রফিকের চোখে প্রশ্ন। ভয় পেল রুবি। এমন পরিস্থিতিতে ‘মানুষ’ নামের সাহসী জীব ভিতু হয়ে যায়। অসহায়ত্ব ভর করে তাদের উপর। রুবির ঠিক তেমনটা হচ্ছে।আয়না আবার সত্যটা না বলে দেয়! তাহলে তার বাবার আকাশছোঁয়া সম্মান মুহূর্তে মাটিতে মিশে যাবে যে! বাতাসে বাতাসে রটে যাবে এ কথা। ‘ক’-তে কলিকাতা বোঝা আমজনতা রুবির ব্যাপারটাকেও ধরাকে সরা জ্ঞান করবে।
আর কইস না ভাই! বেটি আমগাচোত চইড়বার ধরি পড়ি গেইচে। পাওখান বাঁচি গেইচে। ডাক্তার কইল।
ও… তাকে কন। মুই ভাবনু, কি নাতে কি হইচিল।
হ, তোমরা তো একনা বেশি বোজেন!
রেগে গিয়ে, তড়িঘড়ি করে বললো কথাটা। রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে রফিকের দিকে।
রুবির দু’চোখে পানি পড়ছে। টপ টপ।
বাবা, সারাটা জীবন এমন করে তোমার মেয়েকে পাশে রাখবে তো!
মুখে না, মনে মনে কথাটা বলল আয়নাকে। মুখে বললে বিপদ হত। আয়না কেঁদে দিত। আনন্দে। কারণ, বিয়ে করেছে ঠিক। আয়নার বউ কখনো মা হয়ে ওঠতে পারেনি, বাবা হয়ে ওঠাও তাই হয়নি আয়নার। সে কথা, সে ব্যথা রুবি বোঝে। বলে না। বললে যদি আয়না কষ্ট পায়! এমনিতেই এলাকার মানুষ সব সময় কথা শোনায় আয়নাকে। চোখের অাড়ালে, সম্মুখে।
চোখ মুছে নেয় রুবি। আয়না দেখার আগেই। মিনিট ত্রিশ সময় নিয়ে রিকশাটা চেয়ারম্যান বাড়ি পৌঁছে যাবে।
আয়নার মাথায় খেলছে চিন্তা। হরেক রকমের চিন্তা। না জানি বখাটেগুলো মেয়েটার সাথে যা করেছে, সেসব ভিডিও করেনি তো! করলে– ইন্টারনেটে না ছেড়ে দেয়! তাহলে তো ষোল চাষ! বড়সাহেবের নির্বাচনে জেতা তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার জন্য নূন্যতম সম্মানটুকু থাকবে তো?
সাহেব যদি জেনে যায় ব্যাপারটা তাহলে আয়নারও তো এ বাড়ির ভাত বন্ধ হয়ে যাবে। কেমনে ভুলবে এ বাড়ির মায়া, মেয়েটাকে। রুজিনা আপাকে, যে কিনা নদীরপাড়ে পটলবাগানে পটল তুলতে গিয়ে বেহুশ অবস্থায় পেয়েছিলেন তাকে। নিজের ভাইয়ের মতন স্নেহ, ভালোবাসায় বড় করে তোলেন। স্কুলে পড়ান। কিন্তু, আয়না পড়া ছেড়ে দেয়। সংসারের টুকটাক কাজগুলোকেই তার ভালো লাগে। রুজিনা আপা তাই ‘আয়না পাগলা’ বলে ডাকতো ওকে। নিজের বাপ, মার কথা মনে নাই তার। মনে নাই বললে ভুল হবে। মনে করতে চায় না আয়না। বানের সময় নদী ভাঙনে একরাতে জমি গেল, ঘরসহ বাপ-মা গেল। বিয়েটাও দিয়েছিলেন রুজিনা আপা। ধুমধাম করে। পুরো পাড়ার মানুষ খেয়েছিল পেট পুরে।
মেয়েটা পৃথিবীতে আনতে বিধাতা প্রতিদান চেয়ে বসলেন। আপার প্রাণবায়ুর বিনিময়ে মেয়েটা পৃথিবীতে এলো। তখন সাহেব কি যেন একটা কাজে ঢাকায় ছিলেন। নিজের স্ত্রীকে মাটি দিতে পারলেন না, কোলে নিতে পেলেন না মেয়েটাকে; প্রথমবারের মত। নিল আয়নাই। রুবির জন্য আয়নার তাই এত্ত মায়া!
এসব ভাবতে ভাবতে রিকশাটা চেয়ারম্যান বাড়ি পৌঁছে গেছে। এল-আকৃতির হলুদরঙা বাড়ি। বড়সাহেব বাড়ি নেই। নির্বাচনের কাজে ঢাকায় গেছেন। দিন সাতেকের জন্য। বাড়িতে আয়নার বন্ধ্যা বউ আতসী বানু। রুবিকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল। রফিককে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বিদায় করলো।
সাহেব বাড়িতে না থাকলে পয়সা-কড়ি ওর হাতেই থাকে। বর্তমানে হাজার দশেক নগদ টাকার মালিক সে। টাকাগুলো আছে সাহেবের ঘরে আলমারিতে। আজকাল রাত-বিরাতে ডাকাত পড়ে বাড়িতে বাড়িতে। নৈশপ্রহরী আছে। কাজের না, অকাজের। রাতেও ঘুম, দিনেও ঘুম তার। কত বার ছাঁটাই করতে চেয়েছিলেন চেয়ারম্যান, আয়নার জন্য পারেন নি। বয়স্ক মানুষ, অভিজ্ঞ প্রহরী। এ বয়সে যদি কাজটা যায় তবে বউ, বাচ্চা নিয়ে বিপাকে পড়বে। তাই অনিচ্ছা শর্তেও রাখা।
গরুগুলোকে ভুসি, ভাত দিয়ে একটু পানি খাইয়ে নিল আয়না। তারপর খড় দিল।
ডাল, সব্জি সাথে ভাত। খাওয়া শেষে রুবি আর আতসী এক ঘরে শু’লো। মেয়েটার মুখের দিক তাকানো যাচ্ছে না। ব্যথা হচ্ছে বোধ হয়।
শুন, ছইলটার ভিতি খেয়াল থুইস। কোনো সমস্যা হইলে মোক ডাকাবু। ফিসফিসিয়ে আতসীর কানের কাছে মুখ এনে বললো আয়না।
আয়না শু’লো সাহেবের ঘরে। ঝিঁঝিঁডাকা রাত বাড়ছে। চিন্তা বাড়ছে আয়নার। নগদ টাকা, রুবি, সাহেবের নির্বাচন। সব নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। চিন্তা হচ্ছে না শুধু আতসীকে নিয়ে। ওকে নিয়ে ভাবার কি আছে! ও তো দিব্যি আছে মা হতে না পারার কষ্টটা বুকে চেপে। কত রাত যে ও নারী হয়ে ওঠে, দেহ-জমিন উজাড় করে দেয়। আয়নাও রীতি মতন বীজ বুনে যায়। তবুও ফসল ফলে না, বাবা হয়ে জন্ম নেয়া হয় না আয়নার।
জোছনানামা রাতে কামরাঙা গাছটায় পেঁচা ডাকছে। ঝিঁঝিঁরাও আধিপত্য বিস্তার করছে। জোনাই জ্বলছে, হাস্নাহেনা স্বীয় যৌবনের রূপ ছড়াচ্ছে। কী মাদকতা সে রূপে, কী ঘ্রাণ! এমন ঘ্রাণের রাতে আতসীর শরীরেও ঘ্রাণ ছড়ায়। তবে সেই ঘ্রাণ আর আজকাল নেশা জাগায় না আয়নার ভেতরে। উলুবনে মুক্তো ছড়িয়ে লাভ কি?
আতসী বলে দোষ নাকি আয়নারই। মাঝে মাঝে আয়নাকে ছেড়ে যেতে চায় আতসী। তার জন্যই নাকি সে ‘মা’ ডাকটা থেকে বঞ্চিত। আজকাল নিজের শরীরটার বেশ খাতির-যত্ন করে, সময় নেয় গোসলে। কাজ না থাকলে মাথায় নারিকেল তেলের পুরো শিশিটাই বোধ হয় কাত করে, মোহনীয় ঘ্রাণ! ঠোঁটে লিপিস্টিক, হাতে চুড়ি পড়ে পাড়া বেড়াতে বের হয়। রফিকের সাথে নাকি হেসে হেসে কথা বলে। দেখেছে রুবি। আয়নাকে বলেও দিয়েছে। তবে প্রথম প্রথম বিশ্বাসে বাঁধতো আয়নার। আজকাল আতসীর ব্যাপারে অমন কথা আয়নাকে ভাবায়। সংশয়জালের আবির্ভাব হয় মনে। আতসীকে মুখেও বলে না। বললে যদি সত্যি চৌকাঠ পেরিয়ে যায়! মা মরা মেয়ে, এ প্রকান্ড বাড়ি সামলাবে কে? এ বাড়ির সম্মান থাকবে? এসব ভেবে আর বলেনি কিছু।
তন্দ্রা চলে আসে। ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছে রুবিকে ডাকছে ও-
রুবি, মা আমার। আয় বুকে আয় মা…
মরে গেলাম রে… আমারে ছেড়ে দাও… বাবা গো… মনে হচ্ছে রুবি চিৎকার করে উঠলো। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আয়নার। স্বপ্ন দেখছে, বুঝতে পাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটায় রাত চারটা। তাড়াহুড়ো করে উঠলো আয়না।
চাঁদটা মেঘে ঢেকে গেছে খানিকটা। আয়না ছুটে গেল আতসীর ঘরে। আতসী ঘরে নেই, রুবি তো দিব্যি ঘুমোচ্ছে। গেল কই আতসী? সন্তর্পণে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ঝিঁঝিঁর ডাকের আধিপত্য টের পাওয়া যাচ্ছে এখনো। মেহমানখানার ঘরটার দিক থেকে গোঙানির আওয়াজ আসছে। আয়নার পায়ের গতিতে ব্যর্থতার আভাস। ধীর গতিতে যত এগিয়ে যাচ্ছে, গোঙানিটা তত স্পষ্ট হচ্ছে। রফিকের সাথে লীলায় মেতে উঠেছে আতসী। শালি বেশ্যা!
পৃথিবীটা উল্টে যাচ্ছে যেন! মাথা ঘুরছে আয়নার। ধপ করে খড়ের স্তুপে বসে পড়ে আয়না। রফিকদের লীলাভূমির থেকে হাত পাঁচেক দূরে। আয়নার ডাকাডাকিতে জেগে যায় রুবি। তবে না শোনার ভান করেছিল তখন। আয়নার পিছুপিছু আসে রুবি, লুকিয়ে সে এই জঘন্য লীলা দেখে। রুবির মনে হচ্ছে সেদিনের সেই জানোয়ারটা তার শরীরটাকে ক্ষত-বিক্ষত করছে, বুকের উপরে হাত চালাচ্ছে। চোখ বন্ধ করলো রুবি। বন্ধ করে থাকলো অনেকক্ষণ। তারপর দৌড়ে ঘরে চলে গেল। এতক্ষণে টের পেয়ে গেছে রফিকরা। ‘থ’ হয়ে বসে আছে আয়না। রফিক পালিয়ে গেছে। আতসী খানকিটা কাপড় ঠিক করছে। মুখ চেপে দৌড়ে ঘরে গেল সে। আয়না বসেই আছে। তার পৃথিবীটা যেন তখনো ঘুরছে, বিশ্রীভাবে। অদূরে কুকুরের ‘ঘেউ ঘেউ’ শব্দ। রফিককে তাড়া করছে বোধ হয়।
সুবহে সাদিক। ফজরের আযানের সময় হয়ে আসছে। নামাজে যেতে ইচ্ছে হলো আয়নার। না, গেল না। চারদিক ফরসা হতে শুরু করেছে। আয়না উঠে দাঁড়ালো। ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে, গেল না। গোয়ালঘরে গেল। গরুগুলোকে খড় দিল, কবুতরগুলেকে সরিষা ছিটিয়ে দিল। ‘বাক-বাকুম’ করতে করতে খাচ্ছে কবুতরগুলো।
খানকিটা কি ঘরে আছে, না ভেগেছে!
ঘরে পা দেয় আয়না। রুবি ঘুমোচ্ছে আর আয়নার মহতী বউটা মুখে কাপড় চেপে বসে আছে চেয়ারে। ওদিকে একবার তাকালো। ঘেন্না হচ্ছে আয়নার। তালাক দিতে ইচ্ছে করছে।
ফোন বেজে উঠলো। বড়সাহেবের ফোন।
আয়না, আমি আজ সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছি রে। বাড়ির জন্য কিছু লাগবে?
না, সোগ আছে। তোমরা ভালোও ভালোও আইসো। গম্ভীরতা এড়িয়ে উত্তর দেয়ার চেষ্টা আয়নার।
কি রে, তোর গলা অমন শোনায় কেন? কিছু হয়েছে?
না, বাজারোত আসি ফোন দেন মোক। তোমাক আইনবার যাইম। এলা মাছগুলার খাবার দিম। রাখো ফোন।
আচ্ছা, রাখলাম তাহলে।
ফোন কাটলেন চেয়ারম্যান সাহেব। গামছা ঘাড়ে নিল, নিম ডালে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুরের দিক যাচ্ছে আয়না। একটা আচমকা বাতাস ছুঁয়ে গেল যেন! কিছুটা প্রশান্তি লাগছে বুকে।
সাহেব আসছেন। নির্বাচনী কাজে নেমে পড়বে সবাই, আয়নাও। সাহেবকে এবারো জেতা চাই। জেতাই চাই। জিতবেও, এটাও জানে আয়না। কারণ, সাহেব তো আর কম করে না সবার! তবুও সংশয়। কেন্দ্র দখল করতে পারে সাবেক চেয়ারম্যান জহিরুল্লার চ্যালারা। তাই সজাগ থাকতে হবে। গতবার তো আয়না পিটিয়ে আধমরা করে ছিল ক’টাকে। ব্যালটবাক্স চুরি করে পালাচ্ছিল।
পুকুরপাড়ে এসে পড়ে আয়না। মাছগুলো পাড়ে ঘেষে আসছে, খাবারের আশায়। এই যা! খাদ্য তো নিয়ে আসেনি আয়না। মাথাটা গেল নাকি! যাবারই কথা। যা ঘটে গেল!
রুবি এদিকেই আসছে। এখনো কেমন কেমন করে হাঁটছে মেয়েটা। ঠিক সেরে ওঠে নি। ওর হাতে মাছের খাদ্যের ডালা। হাত বাড়িয়ে সেটা নেয় আয়না। দুজনে মিলে খাদ্য দিচ্ছে মাছদের। কী সুন্দর খাচ্ছে মাছগুলো! এই পৃথিবীর মানুষগুলো আয়নার সাথে বেঈমানী করে, অবুঝ এ প্রাণীগুলো কিন্ত বেঈমানী করে না! বানের জলেও ভেসে যায় না অন্যপুকুরে। কিন্তু, তাদের ভেসে যাবার সুযোগ থাকেই।
দুপুর গড়িয়ে আসছে। শিরিষের ডালপালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ছে দাওয়ায়, উঠোনে। সকাল থেকে অভুক্ত আয়না, রুবিও হয়তো। আর আতসী? ও কি খেয়েছে? রেঁধেছে কিছু? নাকি নাঙের কাছে গেছে আবার!
না, যায় নি। রান্নাঘরে আওয়াজ পাওয়া যায়। রুবি গল্প করছে রেবা ডাক্তারের নাতনির সাথে। স্কুল নিয়ে। মেলাদিন ক্লাস কামাই দিচ্ছে রুবি। সে নিয়ে নানা প্রশ্ন রেবার নাতনির। সেদিকে ব্যস্ত রুবি।
হুট করে পায়ে পড়ে কে জানি। চোখ নামিয়ে দেখে- আতসী।
মাপ করি দেও, এমন কাম আর হবার নায়। কিরা করি কইতোচো। মোক মাপ করো।
পাও ছাড় বলচি, পাও ছাড়! ভাগ চোকের সামন থাকি। যা তোর নাগরের কাচোত!
না, আগে কন মাপ করচেন। কন, কন তোমরা!
চোখ বন্ধ করে আয়না। কিছুক্ষণ। তারপর খোলে। চোখটা ভিজে আসছে আতসীর, আয়নারও।
আচ্চা যা। মাপ করনু। আর কোনোদিন যদি এ কাম করিস… তাইলে কিন্তুক… বলেই হনহন করে বেরিয়ে যায় আয়না। মরতে ইচ্ছে করছে।
বাড়ি থেকে একটু দূরে হিজলগাছের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। রুজিনা আপার কবরটার পাশে। খুব কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে আপার সাথে। বলতে ইচ্ছে হচ্ছে শেষরাতের কথাগুলো। মরে গেলে মানুষের দৃষ্টিশক্তি বাড়ে। আপা কি এসব দেখেন নি?
কষ্টের রাতে অথবা দিনে আপার কবরের পাশে এভাবে চোখ ভেজায় আয়না। একটা সময় মনে হয় আপা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে: আয়না, ভাই আমার। এমন করিস না। ধৈর্য ধর। জীবন কখনো কখনো এমন রে। ঠিক হবে সব। যা, বাড়ি যা।
বেলা পড়ে এসেছে।
আতসী বাড়ি নেই। পাশের গাঁয়ে বাপের বাড়ির দিকে গেছে। রুবি এমনটাই বললো আয়নাকে।
আসলে যে পুকুরপাড়ের তালগাছের নিচে বসে রফিকের সাথে কথা বলছে, সেটা ঠিকই দেখেছে রুবি। আয়নাকে সেটা বলল না। কি দরকার মানুষটাকে কষ্ট দেবার! কিন্তু, আতসী ঠিকই ঠকাচ্ছে আয়নাকে। আসলে কুত্তীর লেজে ঘি মেখে লাভ নাই, লেজটা বাঁকাই থাকে।
রুবি, কিচু খাইচেন তোমরা? আন্দে নাই কিচু?
হুম। কিন্তু, আমি সেটা খাই নি। রেবা ডাক্তারের বাড়ি থেকে ভাত এনে খাইছি, তুমি কিন্তু খাওনি। আমি তোমার খাবার রেখেছি। ঐ যে টেবিলের উপর, খেয়ে নাও। পানিও আনা আছে।
এতটুকুন মেয়ের আতসীর প্রতি ঘৃণাবোধ অবাক করে আয়নাকে।
আতসীকে তোমরা ঘেন্না করেন নাকি! অয় আন্দিচে তোমরা খান নাই কেন?
এমনি, ইচ্ছা করে নাই। খাই নাই আজ।
তোমার আব্বা আসতোচে আইজ।
ও… ভালো।
কোনো আগ্রহই নাই বাপের প্রতি। বাপেরই বা কতটুকু! সাতদিনের একদিনও তো খোঁজ নেন নি মেয়ের।
সন্ধ্যা হবে হবে ভাব। বড়সাহেব ফোন করেছেন।
আয়না, আমি আজ রুবির নানাবাড়ি থাকবো। তুই আসিস না। কাল দেখা হবে রে। ভালো থাক।
আচ্চা, সাহেব। সাবধানে থাকেন তোমরা।
মুখটা গোমড়া করে বাড়ি ফিরলো আতসী। কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও চুপ থাকলো আয়না।
গরুগুলোকে খাইয়ে নিল। খড়, ভুসি সাথে চাউলধোয়া পানি। ভাত রান্না হলো। সাথে পুঁইশাক, আলুর ভাজি। রুবির প্রিয় খাবার। আয়নারও। খেয়ে নিল সবাই একসাথে। দাওয়ায় বসে। রুবি খেতে চাচ্ছিল না। খাওয়ালো আয়না। জোর করে।
মা, শরীরডা ভালা আপনের? দুধ খাইমেন একনা? আতসীর দরদি কণ্ঠস্বর।
হুম, অল্প দিও। অন্যদিকে মুখ করে উত্তর দিল।
আচ্চা, দিতিছি।
আমার ঘরে দিয়ে যাও। আমি ঘরে গেলাম। মাথাটা ব্যথা করছে। – বলে উঠে যায় রুবি। আতসী গেল রান্নাঘরে।
চাঁদটা ঘোলাটে। বড় হচ্ছে রাত। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আয়না। চাঁদটা কী যেন বলতে চায় তাকে! আসলে বিশাল আকাশের বুকে থাকলেও যে মাঝে মাঝে চাঁদটার বুকে অভিমান জমে। মলিন হয় চাঁদের যৌবন-জৌলুসে ভরপুর মুখখানা। এটা কতজন খেয়াল করে? চাঁদটাও যে কথা বলতে চায়, আয়নার তেমনটাই মনে হচ্ছে। উদাসী’বনে গেল যেন, আয়না।
এই যে! কি দেখেন আকাশের ভিতি, কথা শোনেন মোর।
আতসীর কণ্ঠে মায়া! যে কণ্ঠ মাতালবনে নিয়ে যায় আয়নাকে, রফিককেও। দীর্ঘ একটা শ্বাস নেয় আয়না, চোখ স্থির করে আতসীর দিকে।
ক, কি কবু। হাতোত কি? আয়নার চোখে প্রশ্ন।
দুধ, এই ভরতি গেলাসেরগুলা তোমার, অর্ধেক ফাঁকা গেলাসেরটা রুবির। মুই একনা ছমিনা বুবুর বাড়িত গেনু। পান শেষ, দেকো একনা পাওয়া যায় নাকি। ধরো গেলাসগুলা।
হাত বাড়িয়ে গ্লাস দুইটা নিল আয়না। ছমিনার বাড়ি গেল আতসী। মেয়েটা পড়ছিল, আগামী পরশু পরীক্ষা। ঘরে ঢুকলো আয়না।
তুমি কষ্ট করে দুধ আনলে কেন? সে কই? প্রশ্ন মুখে চেয়ে আছে রুবি।
একটু পান খাইতে গেছে ছমিনার বাড়ি। নেন তো রুবি বুড়ি, দুধ কোনা খায়া নেন। বলে ভর্তি গ্লাসটা রুবির মুখের কাছে ধরে আয়না।
আরে এটা না, ঐটা দাও। অর্ধেক ফাঁকা গ্লাসটার দিকে ইঙ্গিত করে রুবি।
শইল দুর্বলা তোমার, সামনোত ফির পরীক্কা, বল করা নাগবে তো শইল্লোত! বেশি করি খাওয়া নাগবে।
বলে ভর্তি গ্লাসটা রুবির মুখের কাছে নেয় আয়না। ক’টা দিন নিজ হাতে খাওয়াতে পারে নাই আয়না। আজ খাওয়াচ্ছে।
দুই ঢোক খেলো রুবি। মুখ সরিয়ে নিল। মুখছবিতে বিরক্তির ভাব! বুক চেপে ধরলো রুবি।
উয়াক! উয়াক! বাবা..আমারে তুমি কি খাওয়াইলা, বাবা। মরে গেলাম গো!
পৃথিবীটা যেন ঘুরতে লাগলো। আয়না কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ছটফটাতে লাগলে রুবি। মা, মাগো…-বলে চিৎকার করার চেষ্টা তার। মুখ দিয়ে সাদা সাদা ফেনা বের হচ্ছে, চোখ উল্টোতে লাগলো।আতঙ্কে নীল হয়ে যাচ্ছে আয়না। ইতিউতি অস্থির হয়ে তাকাচ্ছে আয়না। রেবা ডাক্তার… হ্যাঁ, ওর কাছেই নিতে হবে।
রুবিকে কাঁধে নিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে আয়না। কিন্তু, পা যেন চলছেই না!
চাঁদটা পুরোপুরি ঘোলাটে হয়ে আসছে যেন! ক্ষীণ আলোতেই ছুটছে আয়না। বাতাসে থমথমে ভাব।
হাত-পা কেমন নিস্তেজ হয়ে আসছে রুবির।
হিজল গাছটার কাছে এসে পড়ে আয়না। রুবির সাড়া-শব্দ থেমে আসছে যেন। তড়িঘড়ি করে কাঁধ থেকে নামালো, কোলে নিল। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে চাঁদমুখটার। হাত, পায়ে কোনো সাড়া নেই। আয়না রুবির বুকে কান পেতে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বোঝার চেষ্টা করছে। একবার বোধ হয় চোখ মেললো।
বা….বা…। সাথে সাথে চোখ বন্ধ হলো। সাদা সাদা ফেনা গাল বেয়ে আয়নার হাতে পড়ছে।
বুকফাটা একটা চিৎকার দিল আয়না। বিকট চিৎকার!
দু’একটা কুকুর ডেকে উঠলো। বুড়ো নৈশপ্রহরী ছুটে এসেছে। হঠাৎ চুপ মেরে গেল আয়না। মেয়েটা ততক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে, মায়ের কবরের খানিক দূরে; চিরতরে। জোছনালোকে মায়াবীমুখটার ঘুমন্ত চেহারা! যেন পরী নেমে এসেছে ধরায়।
হা… হা… হা… কে দুধ খাবু আয়! আয় গেলাসে গেলাসে খিলাইম, আয়! হা… হা… অদ্ভুত রকম হাসছে আয়না।
আবারো জোরে জোরে কয়েকটা চিৎকার। আশপাশের সব ঘুমন্ত মানুষ জেগে গেছে। এদিকে ছুটছে। হাতে টর্চ, কুপি। বাড়ির কুকুরটাও এসেছে। এলো না শুধু ভাদ্রমাসী কুত্তা-কুত্তীরা, আতসী আর রফিক।
আয়না আর রুবিকে ঘিরে জটলা পাকাচ্ছে সবাই। নিজের মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো টানছে আয়না। বুড়ো নৈশপ্রহরীটা হুহু করে কাঁদছে। আফসোস করছে কেউ কেউ। উপস্থিত সকলের চোখ ভিজে আসছে।
হঠাৎ লাফাতে শুরু করে আয়না।
হা… হা… হা… কে দুধ খাবু আয়! আয় গেলাসে গেলাসে খিলাইম, আয়! হা… হা…
(রচনাকালঃ ২০১৮/ প্রথম প্রকাশিত- দর্পণ- ওয়েবম্যাগে-২০১৯)