শ্রাবণের আকাশে বৃষ্টি নেই, রানার বিল এসময় বর্ষার জলে থৈ-থৈ করে, সেখানেও প্রত্যাশা মাফিক জলের দেখা নেই; ৎ -এর মতন আকারের বিলের জলে ফুটে আছে শাপলা। রাক্ষুসে সূর্যটা পুরোপুরি ভর করার চেষ্টা করছে বিলের জলে, ফুটন্ত শাপলার টগবগে শরীরে; মৃদু বাতাসে অদূরে ফুটে থাকা বাহারি ফুলের গন্ধে যেন মন মাতোয়ারা হয়ে আসে চিলাইয়ের।
এক জোড়া লালসর উড়ে গেল। সেদিকে নির্লিপ্ত নয়নে চেয়ে থাকতে থাকতে চিলাই যেন উড়ালপাখি হয়ে গেল! যেন ভুলে গেল সে একটা ষোল বছরের তরুণ। তার কাছে মনে হতে লাগলো- সে একটা যৌবনপুষ্ট লালসর। ছুটে চলছে একটা যুবতী লালসরের খোঁজে। সেই যুবতীকে কি কখনো পাবে ও? যুবতী লালসর কি তার সাথে এমনি করে উড়ে চলবে বিশাল আকাশের বুকে; উড়তে উড়তে ক্লান্ত হলে কি কোনো মহুয়ার মগডালে বসে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেবে?
আসলেই কি সে কাম্য যুবতী লালসরেকে কখনো পাবে? নাকি পেয়েছিল! সে লালসর কি নিজেই ধরা দিয়েছিল, বছর তিনেক আগে। যখন চিলাইয়ের মুখে গোঁফদাড়ির চিহ্নমাত্র ছিল না।
সেটা ছিল পূর্ণ-জোছনা রাত। চাঁদটা সবেমাত্র মহুয়াবনের দিকে মুখ তুলে চেয়েছে। পূর্ণিমার মিষ্টি আভার একটুখানি পড়েছে সুনন্দাদের বাড়ির দিক। চিলাইদের বাড়ির দুই বাড়ি পর বাড়িটা।
খুব ঘুম পেয়েছিল চিলাইয়ের, তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু, ভ্যাপসা গরম পড়েছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তাই। মা, বাবা ঘুমোচ্ছেন। সন্তর্পণে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে চিলাই, টঙের দিকে যাবে।
টঙের উপরে কে যেন শুয়ে আছে। কিছুটা ত্রাস, কিন্তু জানার আগ্রহে এগিয়ে গিয়ে দেখে: তন্দ্রায় আচ্ছন্ন পাশের বাড়ির উনিশে পা দেয়া সুনন্দা দিদি। গায়ের উপরিভাগে তার শুধু হালকা একটা ওড়না, নিচের দিক পাজামা।
এ অবস্থায় তাকে দেখে চলে আসতে চায় চিলাই। না, ততক্ষণে জেগে গেছে সুনন্দা দিদি। না, এখন ‘দিদি’ শব্দটা নিতে ইচ্ছা করছে না। কারণ, সে রাতসহ অন্তত সাত-আটটি রাত নিজেকে খুবলে খাইয়েছে সুনন্দা, চিলাইকে। কতবার নিজে থেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল চিলাই, কিন্তু বোঝে নি সে। চিলাইকে নারী শরীর ভোগের নেশাটা শিখিয়েছে সুনন্দা-ই।
আজ এই শ্রাবণের বৃষ্টিহীন দিনে, নিজেকে এ গ্রামের বৃষ্টিহীনতার একমাত্র কারণ মনে করে চিলাই। তার মনে হচ্ছে- আমার মতন এমন পাপী এখানে আছে জন্য বিধাতা বিমুখ হয়েছেন।
বহুবার নিজেকে শেষ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারে নি। শরীর খুবলে খাওয়ার নেশা কেড়ে নিয়েছে ওর প্রাণোচ্ছ্বল কৈশোর। আজও তাই শরীর খুবলে খেতে ইচ্ছে করছে চিলাইয়ের। সুনন্দাকে কোথায় পাবে, কোথায় পাবে অমন মাদকতা ভরা তনু! সুনন্দাকে তো ঠিক দু’বছর ধরে ভোগ করছে ওর স্বামী।
এসব ভাবতে ভাবতে আজ আবার নিজেকে ঘৃণা করতে ইচ্ছা করছে চিলাইয়ের, মরে যেতে ইচ্ছা করছে। আসলে ও তো সে রাতেই মরে গেছে!
সূর্যটা এতক্ষণে হেলে পড়েছে, বিলের জলে সেটার ছাপ; আনমনা চিলাইয়ের চৈতন্য ফিরে আসে যেন!
একঝাঁক পানকৌড়ি উড়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে; চিলাইয়ের মনে হতে লাগলো- এক ঝাঁক লালসর উড়ে গেল, যাদের সর্দারিণী সেই সুনন্দা; যারা রাতের অন্ধকারে শরীর ছিড়ে খাওয়ায় আর দিনের আলোয় শরীরের সৌন্দর্য ছড়িয়ে বেড়ায়; আকাশ থেকে আকাশ, বন থেকে বন, মন থেকে মন।
(রচনাকাল: ২০১৯। বাংলা ট্রিবিউনে করোনাকালীন বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত)