৪
বৃষ্টিভেজা সকাল। রাতের ঝাড়ুদার বৃষ্টি শহরের আবর্জনা ধূয়েমুছে ঝকঝকে পরিষ্কার করেছে। সতেজ সকাল। ফুটন্ত গোলাপের মতো দিনের আলো প্রকৃতিকে রঙিন করেছে। আমি ফুলটবে লাগানো গাছগুলোর চোখনাককান ছুঁয়ে পরিষ্কার করে দিলাম। কচি সবুজ পাতা, বেশ নরম। আলো পড়াতে চকচক করছে গাছগুলো। আশপাশের বাহিরটাও বেশ রোদেলা। ডানা মেলে থাকা আলোর পাখনা মোলায়েম সকালে বাক-বাকুম করে আমার মনে সুরের তাল জাগিয়ে দিল। আমি মোবাইলে জয়তী চক্রবর্তীর কণ্ঠে গাওয়া রাবিন্দ্র ছেড়ে দিলাম,
তুমি কোন্ কাননের ফুল, কোন্ গগনের তারা।
তোমায় কোথায় দেখেছি যেন কোন্ স্বপনের পারা ॥
ফিরোজা বেগম গোসল সেরে এসে মাথায় তোয়ালা বেঁধে রেখেছিল। এখন সে জানালার আলোয় এসে চুলের পানি ছড়াচ্ছে। দু’হাতে তোয়ালায় ঝাটা দিচ্ছে। তার কাঁচা শরীরের দিকে তাকিয়ে আমার গুণগুণ সুর জেগে উঠল। ইঙ্গিতে ইশারায় বেশ একটা অবগাহনের খেলা কুহক তুলছে। প্রকৃতি, শরীর এবং চেতনার বিশেষ সম্পর্কে আমি গান শুনতে শুনতে উদাস হয়ে যাচ্ছি। শরীরকে স্থির করে চোখ কান খাড়া রেখে চেতনাকে সজাগ রাখলাম। এরপর শরীরকে ছেড়ে দিয়ে মনকে বিচরণ করতে দিলাম। প্রকৃতির দিকে তাকালাম। দিনদিন যত বেশি ছুটছি আমি, ততবেশি ফিরোজা বেগম যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। দূরে থাকছে। আনমনা হয়ে সে ভিন্ন জগতে ঢুবে থাকছে। তার মনের সাথে আমার সমান তাল থাকছে না। নানান কথা ভাবছি আর বারান্দার নিচে তাকিয়ে মানুষ দেখছি। রিক্সার চলাফেরা শুরু হয়েছে। এই রাস্তা অতীত দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। যখন এই রাস্তা ধরে আমরা হাঁটতাম, পুটপুট করে কত কথা বলত এই ফিরোজা বেগম! অথচ তার গল্পবলামন এখন মরে গেছে এখন। গল্পবলা বউ এখন হৃদয় থেকে মনমাতালো কথা কয়না। কারণ আছে। আমি এখন তার গল্পশোনা মানুষ নই। তার গল্প কেমন যেন প্যানপ্যান লাগে। একঘেয়েমি বরং সে কিছু বলা শুরু করলেই বুঝে ফেলি কি বলতে চায়! কখন কোন কারণে কোন গল্প বলতে চায় সেসব আগাম বুঝতে আমার অসুবিধা হয় না। তাকে আমার পাঠ করা শেষ হয়ে গেছে। তার কথায় আগ্রহ খুঁজে পাই না। বিরক্ত লাগে। তার চাওয়া পাওয়া প্যান-প্যান লাগে। তার গল্পগুলো শেষ পর্যন্ত সেই একটা শব্দেই ঠিকরে পড়ে, নাই। এটা নাই সেটা নাই-এই সব। এর থেকে আমার দরকার “অনুগল্পের মা”। একটা আকাশ, মুক্ত খোলা আকাশ আমার দরকার।
গতরাতে বন্ধু দিদার ফোন করেছিল। আবারো বলেছিল “অনুগল্পের মা” এর সাথে যোগাযোগ করতে আর মজেতেলির গল্পটা শুরু করতে। যেহেতু আমি এখন অফিস ক্যারিয়ার নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকছি এবং ফিরোজা বেগম দিদারকেও পছন্দ করে না, সেহেতু বলেই দিলাম এ অবস্থায় আমার পক্ষে এগল্প লেখা সম্ভব না। সে রাগ করে ফোন কেটে দিল। তবে ব্যাপারটা কাকতালীয় হবে হয়তো, মোবাইলে গান থামিয়ে ফোন বেজে উঠল। অচেনা নম্বর থেকে একটা মেসেস এলো।
– হ্যালো ভাইয়া, কেমন আছেন? অনুগল্পের মা বলছি।
আমি চমকে উঠলাম, সাধারণত অফিসিয়াল কাজে আমি হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করি। আর এই নম্বর ব্যক্তিগত কাউকে দেই না। অথচ সেখানেই এসেছে অনুগল্পের মা। নিশ্চয়ই দিদারের কাজ। আমি ভদ্রতাবশত উত্তর দিলাম, জি ভালো। আপনি?
– ধন্যবাদ। আমিও ভালো আছি। সে জানাল।
আলোচনার ফাঁকে জবাব দিচ্ছি। চুপচাপ কাজ করছি, ঘণ্টাখানেক।
হাতের কাজ শেষ করে দেখলাম, এখনো সে অনলাইনে। আবার লিখলাম, কোথা থেকে?
নিরুত্তর। কিছুক্ষণ পর মিস নাসিফার বার্তা এলো,
– আপনি কি আমাকে চেনেন?
– না মনে হয়। আমি জানালাম।
– ভালো। আমিও চিনি না। তবে শুনুন, আমি রৌশার কাজিন।
– ও-রে বাবা, আপনার বোন তো সেই!
– সেই মানে?
– না মানে বেশ স্মার্ট।
– হুম। তবে আমার কথা কিন্তু জানাবেন না ওকে। প্লিজ প্লিজ।
– না মানে একটু ইয়ে আছে পরে জানাবো। প্লিজ ওকে জানাবেন না।
– আচ্ছা।
আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নাসিফাকে বার্তা পাঠালাম,
– অন্য সময় না-হয় কথা বলি। ব্যস্ত একটু।
– ও আচ্ছা সরি বিরক্ত করলাম। বাই।
রৌশাদের পরিবারের লোকজন দিদারকে খুব পছন্দ করে। এমনকি তারা উপরে ওঠার জন্য দিদারকেই বেছে নিয়েছে। কেনো বেছে নিয়েছে সেটা এককথায় বললে আমার মনে হয়, দিদার যে দিনকে দিন উন্নতির শীর্ষে উঠছে সেখানেই তারা হয়তো পথ খুঁজে পেয়েছে। তবে এ ব্যাপারে তাদের কোনোদিনও জিজ্ঞাসা করি নাই। হয়তো তার এভাবে উন্নতির ব্যাপারটাতে আমি জেলাস ফিল করি। অথচ এই দিদারই আমাকে ফিরোজা বেগমের সন্ধান দিয়েছিল। আমার বিয়ের কথা উঠলে সে-ই তার কোন দূরসম্পর্কের খালার মাধ্যমে জানা এই ফিরোজা বেগমের সন্ধান দিয়েছিল। এর পর থেকেই আমি ফিরোজা বেগমকে নিয়ে এসে ঢাকায় বসবাস করতে থাকি।
সোমবার। অফিসে গেলাম সকাল সকাল। ল্যাপটপ অন করে প্রেজেন্টেশন ওভারভিউ করছিলাম। বিদেশি ডেলিগেটরা আসবেন, যাঁরা আমাদের ইনহাউজ সফটওয়্যার ডিনাই করে ওরাকলের ইআরপি নিতে বলছেন। দিন দিন মূল্যবান হয়ে উঠছে এই সল্যুশন। এটা বিশ্বকে দখলে নিতে এক্সট্রা কিছু সুবিধাও দিচ্ছে। বেশ দামি আর গুরুত্বপূর্ণ, যেটা নিলে বিদেশি লোনগুলো সহজে মিলবে, কোম্পানি মালিককে তাঁরা সেটাই বুঝিয়েছেন। এত লোক লাগবে না, সকালে উঠেই এক ক্লিকে কোনো পণ্যের নাড়ি-নক্ষত্র জানতে পারবেন। আইএস-বিএস ক্যাশ-ফ্লো কিংবা সেলস এন্ড ওভারহেড রেশিও চোখের সামনে প্রতিনিয়ত গ্রাফ-সূচক দেখতে পাবেন। তারই আজ ফাইনাল প্রেজেন্টেশন। চুক্তিতে কোনো কিছু বাদ পড়ল কি না আমরা, আমাদের বিশেষ টিম মিলে সেসব আলোচনা করছিলাম প্রতিটি প্রেজেন্টেশন স্লাইড ধরে ধরে।
দেখলাম ফেসবুকের একটা লিংক এটা। ক্লিক করলাম না। ইচ্ছে হচ্ছে না। আমার কলিগগুলো রৌশার খিলখিল হাসি দেখে উজ্জ্বল হচ্ছে আর চুপসে যাওয়া আমাকে দেখছে তাচ্ছিল্যভরে। তারা বরাবর অন্যের দুঃখ দেখলে খুশি হয়। বিশেষ করে আমার দুঃখে মজা পায় আর তাদের অতৃপ্ত প্রতিহিংশা জিবে ঠোঁটে চেটে রসালো গল্পে রটিয়ে দিতে মজা পায়। আমি ওদের মনের ভাষা, সুপ্ত প্রতিশোধপ্রবণতা বুঝতে পারি। কিন্তু আমি জানি না কেন তারা এমন করে। নিজের না পাওয়ার অপারগতা যেন তাদের আরো বেশি হিংসুক করে রাখে। কিন্তু এটা তো কাউকে ভাগ করে খাওয়ার বিষয় না। কেন জানি না, কলিগরা, যাদের সাথে দীর্ঘ সময় কাটে, তারা অন্যের ভালো চায় না। এটা একপ্রকার মানসিক রোগ। রোগের দ্বারা আমি আক্রান্ত হই। একারণে রৌশার সাথে আমি যেন ওদের দেখায়েই যোগাযোগ করতে থাকি।
সেসিন আর মিস নাসিফার সাথে কথা হলো না। তার লিংকও দেখা হয়নি। সেভাবেই আনরিড থাকছে।
আজকে সকাল থেকেই মনটা পরিবেশমুখর। লেখার টেবিলে গিয়ে কাগজ টেনে লিখতে বসলাম। ভাবলাম, “অনুগল্পের মা” দিয়েই একটা গল্প লিখি। গল্পের চরিত্র হচ্ছে রৌশার হাসি। না ফিরোজা বেগমের গোমরামুখ। মজেতেলির পিঠে ফুটে ওঠা সোনালী দানার ঘাম রোদেলা দুপুরে চকচক করছে। কল্পনার ভেতরে আমি প্রবেশ করতে থাকি। মনে হতে থাকে, প্রতিটি অনুভূতি প্রতিমুহুর্ত হাজারো অনুগল্প পয়দা করে চলেছে। প্রতিটি জীবন যেন অনুগল্পের মা। আমি রৌশার আপ্লুত হাসি নিয়েই শুরু করলাম। নারীচিত্রের পেন্সিল স্কেচ এঁকে রৌশা নামটা কেবল লিখেছি মাত্র। দেখি ফিরোজা বেগম পেছন থেকে এসে মুখের সামনে দাঁড়িয়ে। সে খপ করে কাজগটা খাঁমচে নিল। পড়ামাত্র ছিড়ে টুকরো টুকরো করল।
– ছিঃ! সে রাগ করে সোফায় বসে থাকল। নিস্তব্ধ, নিরব, গোমরামুখ।
আমি বোকার মতো চেয়ে থাকলাম। আমার কল্পনাকে অনুশাসন করা অভিমানি বউ ভুল বুঝেছে। আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। আমার হাত তার শরীরে স্পর্শ লাগামাত্র সে ঝটকা মেরে সেখান থেকে উঠে গিয়ে অন্যদিকে বসল। আমিও উঠে আবার তার পাশে গেলাম। সে কটমট চোখে তাকিয়ে আবার উঠে গেল।
– আরে বোকা, এসব তো গল্পের জন্য কল্পনা মাত্র। আমি বললাম।
– কল্পনা না। চরিত্রহীন পুরুষের কামনা বাসনা। তোমাকে চিনি না আমি?
– চেনো বলেই তো প্রকাশ্যে নামটা লিখলাম। গোপন কিছু থাকলে কি লিখতাম?
– খবরদার আর একটা কথা বলবে না লুচ্ছা কোথাকার!
এই হচ্ছে ব্যাপার, আমার চিন্তার লুচ্ছামি দূর করে পুত-পবিত্র করার দায়িত্ব বউ নিয়ে অনুশাসন চালাতে যদি চায়, তাহলেও আমাকে চিন্তাদাসে পরিণত হতে হবে। এমন চিন্তাদাসে আমি পরিণত হতে চাই না। তাই নানান ভণিতায় সেদিনও তার মান ভাঙালাম। মান ভাঙলেও তার বদ্ধমূল ধারণা হতে থাকে, নানান বাহানা করে বাইরে যাওয়ার এ-ছুটি আমিই বাতিল করেছি। যার প্রতিক্রিয়া হিসাবে সে সামান্য বিষয় নিয়ে তর্ক শুরু করল।
একদিন, কাজে ব্যস্ত আছি, সে ফোন করে বলল তাড়াতাড়ি বাসায় আসো আমরা বাইরে যাব।
বাসায় এলাম। বলল, চলো বাইরে যাব।
– তোমরা যাও। আমি ক্লান্ত। যেতে পারব না এখন।
– তুমি কেনো যাবে? তুমি শুধু চেন টাকা। আমি চিনিনা তোমাকে!
– শোন ফেরো, উন্নতির শীর্ষে যাওয়ার উত্তম সময় এখন আমার। এসময় আমি অন্যকিছু শুনতে চাই না। টাকা আর ক্ষমতা কি সেটা আমি ভালোভাবেই জানি। সুখের জন্য এর থেকে উত্তম কি রাস্তা আছে দাও তো। অযথা মেন্টাল টর্চার করছ।
– কি, আমি মেন্টাল টর্চার করছি? কি কইতে চাও তুমি?
– তাছাড়া কি?
সে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতর কাঁদতে লাগল। কিছুক্ষণ পর দরজায় গিয়ে টোকা দিলাম। দরজা খুলল না সে। সে ঘুড়ে বেড়াতে চায়। আর আমি উন্নতির জন্য ব্যাকুল। কাজপাগল হয়ে ছুটছি। ঘোরাঘুরির সময় কই আমার।
যাক, এভাবেই দিন যাচ্ছিল। বেশ সহযোগিতাও করল মাঝে মাঝে। কখনো বউয়ের সন্দেহে খোঁচা দেই। রাগ-হিংসা উৎপাদনের জন্য রৌশার কথা তুলি। এতে ফিরোজা বেগমের হাতছাড়া হওয়ার গোপন আকুতি হাতছানি দিতে থাকে। আমাকে আঁকড়ে ধরার প্রাণপণ চেষ্টা করে সে। রাত-বিরাতেই জড়িয়ে ধরে আদর করে মন দিয়ে। অফিস ড্রেস ঠিকঠাকমতো পরিষ্কার করে সাজিয়ে রাখে। আমার পরিধান, মাথার চিরুনি, জুতার কালার, খাবারের টেবিল, বসার সোফা, আহার, বিনোদন- সব দিকে খেয়াল রাখে ভরপুর ভালোবাসায়। বুঝতে পারি, কৌশলটা ফলদায়ক! সুবিধামতো কাজে লাগাই। সুকৌশলে, যাতে বিরক্তিকর পর্যায়ে না যায় খেয়াল রাখি। যাতে সন্দেহের বিষও কেটে যায়।
দিন যায়। আমিও ফিরোজা বেগমের ভালোবাসায় গলে যাই। তার মতো হই আমি। ফলে আরেক বিপদ আসে। আমার ওপরে খবরদারি শুরু করে সে। অনুধাবন করি, দিন দিন তার ভালোবাসা গায়েব হতে শুরু করেছে। সে তার করায়ত্বে আমাকে দাস বানিয়ে রাখতে চায়। বউভাড়ুয়া বানাতে চায়। আমি তেমন পুরুষ নই। সে শুধু খবরদারি নয়, হুকুমদারি করে আমার ওপর।
তার কথামতো না চললে ক্রমশ উগ্র হয়। সে বুঝতে চায় না, মানুষ নত হয়ে সব সময় থাকে না। হোক না হয় ভালোবাসায় নত, আর আমি তো পুরুষ! ভালোবাসার দাসে পরিণত হব সে ভাবে কেন? তাকে বোঝাতে পারি না। মোহ কেটে যায়। আমিও অফিস ল্যাপটপ নিয়ে থাকি। অফিসের কাজে মোবাইল কথা বলে সময় কেটে যায়। রাত-বিরাত কাজ আর ঘরে বিছানায় ছড়ানো কাগজপত্র দেখে ফিরোজা বেগম বিরক্ত হয়। সে তার মতো করে আমাকে পায় না। বলে, এটা কি জীবন নাকি? কিছু বলি না।
একদিন অফিস থেকে এসে দেখি, লাটের বউ হয়ে সেজেগুজে সোফায় বসে আছে ফিরোজা বেগম। পাশেই লাগেজ গুছানো। পায়ের ওপর পা রেখে পা দোলাচ্ছে।
– কি ব্যাপার? নতুন নাটক দেখছি। মনে মনে বললাম।
ইচ্ছে হলো না বেশি ঘাটাঘাটি করতে। তোয়া দৌড়ে এলো। বাবা বাবা, আমি নানু বাড়ি যাবো। নানু বাড়ি যাব।
– এই অসময়ে?
– গাড়ি তো রাত দশ বারো- সব সময়ই পাওয়া যায়। এখন নটা বাজে মাত্র।
– আগে থেকে বলবে না?
– কেনো গত কালকেই তো কথা হলো। রেডি হয়ে থাকবে, নিয়ে যাব।
– বলেছিলাম না কি?
– আজব তো! সবকিছুই কি ভুলে যাচ্ছ আমাদের বেলায়? গতরাতে শোয়ার আগে ল্যাপটপে কাজ করছিলে তখন বললাম না?
– ও হ্যা মনে পড়েছে। একদম ভুলে গেছিলাম মাইরি। দাড়াও।
সে বলল, তুমি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়ে আমাকে টিকিট কেটে দাও, আমি বাপের বাড়ি যাব।’
কি আর করা। বললাম, আচ্ছা।
– আচ্ছা আবার কী? টিকিট কেটে দিবা না।
– দিব রে বাবা। এত অস্থির হচ্ছ কেন?
– অস্থির হব না, আমাদের দিকে তাকানোর সময় আছে তোমার? তুমি থাকো তোমার অফিস নিয়ে।
– অফিস নিয়েই তো থাকব। নাহলে টাকা কোথা থেকে আসবে শুনি? আর টাকা না আসলে এভাবে সেজেগুজে সুন্দরী নাটের বুড়ী হয়ে থাকবে কিভাবে?
– কিসের নাটের বুড়ী হ্যা? ও-ওহ, একটা শাড়ি পরেছি, এতেই নাটের বুড়ী হলাম না? সব খুলে ফেলব? সব। বলেই সে কাপড় খুলতে লাগল।
– তুমি কিন্তু অতিরিক্ত নাটক করছ ইদানিং। বেশি ঝামেলা করবা না বলে দিলাম।
– জানি তো, কি আর বলবে তুমি। অত কথা শুনতে চাই না, টিকেট কেটে দাও, আমি চলে যাব। থাকো তুমি তোমার টাকা পয়সা অফিস নিয়ে।
– হ্যাঁ, সেটাই থাকব। মনে মনে বললাম অশান্তির নাটের বুড়ী থেকে অন্তত রেহাই পাবো।
– থাকবে তো, থাকবে না? তোমার তো হাসার মানুষ আছে, আর আমরা, নিঃসঙ্গতায় একা একা মরে যাচ্ছি। দেখছো কখনো? বলেই সে কাঁদতে লাগল। প্যান প্যান করে বলল,
– হাসিমুখে কোনো দিন আমাদের সাথে কথা বলেছ? বাচ্চাটাকে সময় দাও না। অফিস আর ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরা। বাসায় ঢুকেও কাজ। বাচ্চাটা কাছে গেলেও বিরক্ত হও। সব সময় মেজাজ আর দেমাগ। কখনো হাসিমুখে বাসায় ঢুকেছ?
– এ জন্য তুমি দায়ী।
– আমি দায়ী! আমি দায়ী? হায় আল্লাহ, কী বলো এসব?
– হ্যাঁ, প্রতিদিন তুমি প্রস্তুত থাকো বাসায় আসা মাত্র নিত্যনতুন নাটক শুরু করবে। আর সংসারটা দোজখ বানিয়ে রাখবে।
আমি জানি, সে বাপের বাড়িও যাবে না, আবার চুপও থাকবে না। তার উদ্দেশ্য অশান্তি। মেজাজটা গরম হয়ে উঠল। বিকৃতি এটা। নোংরামি। যখন আমি ঝামেলায় থাকি, তখন তার অত্যাচার বাড়ে। কিছুই বুঝতে পারো না। বললাম, কী চাচ্ছ তুমি বলো তো, আসা মাত্র শুরু করলে ঝগড়া?
চোখ বড় বড় হয়ে গেছে আমার। আমি তেড়ে এসেছি তার মুখের সামনা সামনি। সে বড় বড় চোখ করে কিছুক্ষণ আমার চোখে তাকিয়ে থাকল। তারপর বশ মানা সাপের মতো আস্তে করে মাথা নত করে নিল। আমার ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে সে বুঝতে পেরেছে, খারাপ কিছু করতে যাচ্ছি আমি। কিন্তু কিছুই করলাম না। বউ পেটানো স্বামী নই আমি। আমার অফিসব্যাগটি নেওয়ার জন্য সে হাত বাড়ায়ে দিয়ে নরম সুরে বলল, ‘আচ্ছা সরি। যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।’
আমি হাত ঝটকা দিয়ে বিছানার ওপরে অফিসের ব্যাগটা ফেলে দিলাম।
– ফ্রেশ হব? মেজাজটা বিগড়ে দিয়ে বলছ ফ্রেশ হও! আশ্চর্য!
গলার কাছে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আপন মনে বললাম, ফ্রেশ হয়ে একটা দোজখের মধ্যে বসে থাকো!
– দোজখ মানে? ফিরোজা বেগম কথাটা ধরে বসল।
– দোজখ নয়তো কী? বাসায় তো এখন ঢুকতেই ইচ্ছে করা না। ঢুকলেই দোজখ দোজখ লাগে।
– লাগবেই তো, লাগবে না! রৌশা পরির বেহেশতখানায় যে এতক্ষণ ছিলে, সেখানের বাইরে তো দোজখ লাগবেই তোমার।
– বাজে বকবে না একদম। চোখ রাঙিয়ে বললাম। একদম খারাপ পরিণতি হবে বলে দিলাম।
সে আমার শার্টটা নিতে নিতে বলল, বাজে বলছি? যা সত্য তাই বলছি।
– এই, কী সত্য? কী? আমি চেতিয়ে বললাম।
সে চট করে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ‘সত্য হলো, রৌশা মাগির আছর পড়েছে তোমার ওপর। এই কারণে তুমি কোথাও নড়তে চাচ্ছ না। আর নিজের লোকদেরও পছন্দ করছ না।’
– ছিঃ! ছি ছি ছিঃ! এসব কিভাবে বলো তুমি? ফেরোজা বেগম, ছিঃ!
ফিরোজা বেগম চলে গেল। শাড়ির আঁচলে মুখটা মুছে নিয়ে টেবিল গোছাতে থাকে। বুঝলাম, জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। সন্দেহপ্রবণ মন তৈরি হয়েছে তার, এই সন্দেহ সহজে যাবে না।
ধুর এসব ভাবতে পারব না। সে কি করে করুক। আমিও যা ইচ্ছা তা-ই করব। আরে বাবা, বাসায় ঢোকা মাত্র এমন করলে হয়? “সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে।” কাপড়ে বুণন করা বাক্যগুলোর, ঘরে ঢোকামাত্র হাসিমুখে কথা বলা বা সালাম দেয়ার মধ্যে একটা মজেজা আছে। এগুলো দূরত্ব ভেঙে দেয়। অথচ ফিরোজা বেগম সন্দেহে ফুলে ভোম হয়ে থাকে। যতটুকু না রৌশা, এর থেকেও বড় ফ্যাক্ট হচ্ছে সন্দেহপ্রবণ তার জেদি দেমাগ।
রাতের খাওয়া শেষ করে আমি আলাদা বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বুঝতে পেরেছি, এ সংসার বেশিদূর এগুবে না। পুরুষ মানুষ দিন শেষে শান্তির আশায় যদি ঘরে ফিরতে না পারে, সংসার যদি আশ্রয় না হয়ে দোজখের আগুন হয়ে ওঠে, সেআগুনে ঘর করা মুষ্কিল। অথচ কত পার্থক্য রৌশা আর ফিরোজা বেগমের মধ্যে! রৌশা- সে চৌকুষ। যে কোনো ঝামেলায় কিভাবে হাসি মুখে ম্যানেজ করে রৌশা। তখন কত প্রাণবন্ত আর আপন হয়ে থাকে। তার থিউরি, প্রথমে ম্যানেজ করো, অতপর প্রসঙ্গ তোলো। কিন্তু ফিরোজা বেগম ম্যানেজ করা তো দূরে থাক, কৌশল করে। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যেও তার কৌশল। জঘন্য নোংরামি।
দিন দিনে এমন হয়, কোনো প্রসঙ্গ এলেই রৌশা যেন তুলনা হয়ে ওঠে। তার সাথে ঘরের বউয়ের তুলনা। এবং এই তুলনা যে তাদের দুজনকেই হেয় করা- এই বোধ তখন পর্যন্ত আমার হয়ে ওঠেনি। ভাগ্যিস মিন নাসিফা নামের একজন আমার জীবনে এসেছিল। সে প্রসঙ্গ অনেক পরে।
কিন্তু এসময়ে ফিরোজা বেগমকে আমার পক্ষে পাঠ করা খুবই সহজ হয়ে যায়। বুঝতে পারি, কখন সে অশান্তি শুরু করবে আর কখনই বা মিলন হবে। এমনকি দিনক্ষণ পর্যন্ত আগাম বুঝতে পারি আমি। আর এ কারণে পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই আমার মনমেজাজ বিগড়ে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে, আজকে রাতে বা কাল সকালের মধ্যেই সে একটা ঝামেলা শুরু করবে। সম্ভবত সেও বুঝে যায়। ফলে কোনোমতে আটকে থাকা পোস্টারের মতোই সংসার নামের দেয়ালে আমরা ঝুলে থাকি। প্রেমহীন দুটো হৃদয় শুষ্ক হাহাকারে দুই মুখে ফারাক হয়ে থাকে। এইভাবে ঝুলে থাকার জন্যই কি মানুষ সংসার করে? অন্যদের সংসারও কি এমন? আহা পাশের বাসার ভাবিরা- কী সুখে থাকে! আমার কলিগেরা! আর আমার সংসার! সংসারের সুখ প্রশান্তি সব অন্য বাসায় চলে গেছে। আনঘরে আমার হৃদয় চেয়ে থাকে। সুখ কোথায় আমার মধ্যে! দুর্ভাগ্য আমার, সবই পরের মধ্যে। সবই হয়েছে পরকিয়া। আমার জীবন, আমার সুখ প্রশান্তি, আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা, সবই পরকিয়ায় অস্তিত্বমাণ হয়ে যায়। অতৃপ্তির এমন বুণন আমার অস্তিত্বে এমনতরো প্রকট হয় যে আমি আমার মধ্যে কোনো কিছুতেই আর সুখ পাই না। বউয়ের খিলখিল কাটখোট্টা হাসির থেকে রৌশার কথাই সুমধুর। বউয়ের সাথে শারিরিক তৃপ্তির চেয়ে রৌশার আঙুল চোবানো চায়ের চুমুক অধিকতরো মজাদার। শুধুমাত্র কর্তব্য পালনের জন্য বউয়ের সাথে এই বিবস সংসার যাত্রার কোনো অর্থ নেই ।
বিরক্ত লাগছিল। কাজে আর যৌনতায় বন্দি থাকা জীবন হাঁসফাঁস করছিল। মনের বিনোদন মরে গেছে। সেই মন তুমি কাজে দাও, আর সেক্স করো, এটাই জীবন। হঠাৎ মাথার মগজে আলোড়িত হলো কথাটা।
আফসোস হতে লাগল। ঘুম আসছিল না, রাত গভীর হতে হতে আকাঙক্ষা প্রকট হয়ে উঠল, ফিরোজা বেগমের পরিবর্তে চোখের সামনে ভেসে এলো আবারো রৌশা। তার পালিশ করা ঠোঁট, বাঁক খাওয়া শাড়িরে ভাঁজে শারিরিক দোল, মৃদু হাসির ভ্রু কাঁপানো ইঙ্গিত, চাহনির সতর্ক ইশারা কিংবা তার আড্ডাপ্রিয় সঙ্গ আমাকে আকর্ষণ করে, বিমোহিত করে, আমার কামনা-বাসনায় নাচন তুলে আমার আত্মাকে চটুল ঠোঁটে থেকে থেকে কামড়ে কামড়ে নাড়া দেয়; দিল-কলিজা কাঁপিয়ে দিয়ে আমাকে, আমার জীবনকে জাগিয়ে তোলে রৌশা।
অথচ সংসারের দায়িত্বে এসে ফিরোজা বেগম বদলে গেছে। আমাকে মেরে ফেলছে প্রতিদিন। মানসিকভাবে হত্যা করছে। খুন করে আমার বোধবুদ্ধির যাবতীয় সত্তাকে, আমার ভালোবাসাকে নাই করে দিচ্ছে। আমি যেন বস্তুসদৃশ এক মূর্তি বনে যাই। বলতে গেলে, বিয়ের পর ক’বছরের মাথায়ই আমি প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছি। এখন তো তার হাসিটাও কেমন ক্ষেত ক্ষেত লাগে। অবাক হই, আমার মতো একজন যোগ্যতর মানুষ এই ফিরোজা বেগমের মতো ক্ষেতকে প্রেম করে বিয়ে করেছে! সে তো ভালোমতো হাসতেও জানে না। হাসির একটা স্মার্টভাব আছে না, যেমন রৌশার সেই দৃষ্টিকাড়া প্রাণবন্ত হাসি। চমক দিয়ে রৌশা একটা হাসি দিলে না মাইরি, চিত্তে লেগে থাকে সারাদিন। কিন্তু ফিরোজা বেগমের সেটা নেই।
মানুষ যে যা-ই বলুক, নারীবাদীরা বিষোদ্গার করুক আমার বিরুদ্ধে, সরল মানুষ হিসেবে আমার সোজা কথা, এই কর্পোরেট দুনিয়ায় ক্ষণিক সময়ে চেতনকে বিনোদনে রাখার কৌশলটা কিন্তু ফিরোজা বেগম বোঝে না। বোঝে রৌশা, আমার জুনিয়র কলিগ। বলা যায়, রৌশার যে ম্যানেজিং পাওয়ার তার নিপুণ দক্ষতা তৈরি করেছে, তার চাহনিতে, কথার সাথে তার নড়াচড়ায় যে রিদম তোলে, ফিরোজা বেগমের সেটা নেই। সে নির্জীব, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়, রসময় আর চটকদার কথাও জানে না। ম্যানেজ করার ধ্যানধারণা বা মন-মানসিকতা কোনোটাই তার নেই। তার সাথে ঘরসংসারে আমিও যেন নির্জীব হয়ে যাই। মনমরা, বিষহ্ণ হয়ে পড়ি।
আচ্ছা, বাণিজ্যিকি এই বিশ্বে, আমার মতো অতি সাধারণ চাকুরের কি দৌড় ছাড়া চলে? প্রতিযোগিতার এ দুনিয়ায় আমার চাই জীবন, হরদম টগবগিয়ে ঘোড়ায় চড়ে দাবড়ে বেড়ানোর মতো রিদম। সেই তুলনায় কলিগ রৌশাই কিন্তু জীবন্ত। তাকে পাশে নিয়ে দৌড়ানো যায়। মনপ্রাণ ঢেলে বিনিয়োগ করা যায়। তবেই না মুনাফা! তার দ্রুত সঞ্চালনক্ষম আঙুল যখন কি-বোর্ডে ঝড় তোলে, এটা না মাইরি, একটা সুরসংগীত তার আত্মা থেকে বেরিয়ে জীবনসায়রে ঝড় তোলে। তাজ্জ্বব হয়ে আমি গলা বাড়িয়ে দেখি, কাজে ধ্যানমগ্ন সে। মুচকি হাসিতে সামান্য টোল পড়েছে, নিবিষ্ট মনে কীবোর্ড টিপছে সে। আন্তরিক। তার মুখে চোখে অবয়বে আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। লম্বা নাকে, মসৃণ গালে, নিষ্পাপ ঠোঁটে অপূর্বতা, অদ্ভুত! অদ্ভুত পরিপাটি, পরিশীলিত মুদ্রিত এমন ভাঁজবিন্যাসে সৃষ্টি-যেন বেহেস্তি সুখ। এটা তো ঈশ্বরের খোদাই। আমি অবাক হয়ে হালকা কাঁপুনি ধরা ওর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকি, হুম্! কর্পোরেট, এই কর্পোরেট তাকে নিপুণ করেছে, দক্ষ করেছে। সে জানে কাস্টমারকে কিভাবে আকর্ষণ করতে হয়, কাস্টমারের চাহিদা-মননকে বিবেচনা করতে করতে সে নিজেকেও বদলে ফেলেছে।
তার সোজা কথা, ‘জীবনকে কেন ইনজয়েবল করব না স্যার? হোয়াই নট মেক মাই লাইফ ইনজয়েবল? আমার এমন দুঃখ দুঃখ জীবন ভাল্লাগে না। ওয়ান টাইম লাইফ, এনজয় ইটসেলফ। জীবনকে প্রোপার ইউজ করা শিখতে হয় স্যার। প্রতিমুহূর্তের জন্য। উপভোগ করো আর বাঁচো। ফিল দ্য লাইফ। নগদ যা পাও লুটে নাও। এটাই জীবন। যে মুহূর্ত বেঁচে আছ সেই মুহূর্তই তো জীবন। মরে গেলেই মৃত। হা হা হা। তাহলে কেন সেই মুহূর্ত মৌজ করে বাঁচব না? একটা কথা বলি স্যার, যদি আমি না চাই? কে আমাকে ওপরে তুলবে? কেউ না চাইলে আল্লাহ কি তার ভাগ্য পরিবর্তন করে? সব আমার ভেতরে সামু ভাই, আয়্যাম দ্য পাওয়ার। এই পাওয়ার আর কৌশল ব্যবহার করে কেন আমি ওপরে উঠব না? কেনো আমি সুখে থাকব না? জানেন স্যার, চেলেন্স বা ঝামেলা যাই বলেন, এসব ওভারকাম করে চলাই হচ্ছে জীবন। এর জন্যই তো যৌবন, কৌশল, বিবেক। এগুলো হলো সুবিধামতো মই। উন্নতির সিঁড়িতে পা রেখে উঠতে গেলে এসবও ব্যবহার করা দরকার। এই টসটসে দেহ, শরীর মন রূপ যৌবন, বিদ্যা বুদ্ধি কৌশল গহনা অলংকার অর্থ সম্পদ ক্ষমতা- সেসব কি সব সময় থাকে? শুধু এটাই বলেন না, যৌবন ফুরালে কি কদর থাকে স্যার? আমি মনে করি, এগুলো প্রোপার ইউজ করাই বিচক্ষণতা। সময়ের তালে এটাই সারভাইভ। এটাই নীতি। এর বাইরে কোনো নিয়ম নীতি নাই স্যার। শুধু বোকারাই এই সারভাইভাল জানে না। তারা আদর্শ ধরে থাকে। আদর্শ হচ্ছে এমন একটি সভ্য খাপ, যার ভেতরে সহজে কাউকে ঢুকিয়ে রেখে শোষণ করা যায়। ঠিক বলেছি না স্যার? যারা শোষক, তারা এসব ভালোভাবেই জানে। তাই তারা এসব মানে না। তাই তারা বুদ্ধিমান। তারাই টিকে থাকে। যারা জানে না, নীতি আদর্শ নিয়ে পড়ে থাকে, যেমন ফারজানা ম্যাম, তারা ওনার মতোই চুপসে গিয়ে জগৎ থেকে হারিয়ে যায়।’
বলেই সে মুচকি হাসি দিয়ে চলে গিয়েছিল। এখনো মনে পড়ে, একবার ফিরে তাকিয়ে সে ভ্রু কাঁপানো নাচন দিয়েছিল।
যদিও আমি তার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত নই, ফারজানা ম্যামের ব্যাপারে সে যা-বলে তা মানি না, তবুও ভালো লাগে। ভালো লাগে ফড়ফড় করে কই মাছের মতো তার দাপাদাপি। এ কারণেই হয়তো সিনিয়র কলিগ বা ফারজানা ম্যামের বিরুদ্ধ সে কথা তুললে আমি আপত্তি করি না। নিরব থাকি।
ফারজানা ম্যামকে রৌশা পছন্দ করে না। ফারজানা ম্যাম আমাদের অফিসের সিনিয়র কলিগ। সে সাধারণভাবে বাঁচতে চায়। তার কথা, ‘সারভাইভ কি সামু সাব? পৃথিবীতে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে, বনের সুউচ্চ বৃক্ষ যার ছায়াতলে বিলুপ্ত হয়েছে অনেক গাছ। অথচ সামান্য শষ্যদানা গম, মশা বা অতি ক্ষুদ্র জীবাণু, যেমন ভাইরাস মানুষকে শাসন করেছে। যেমন এখন মানুষকে শাসন করছে ডাটা-ইনফরমেশন। সেই ডাটার দাসে পরিণত হয়েছে বিশ্ব। এরপর শাসন করবে যন্ত্র। তাহলে কি হলো? শুধু নিজে গোগ্রাসে গিলে ওপরে ওঠার নাম কি সারভাইভ? সারভাইভ সেটা না, যেটাকে রৌশা মিন করে। সারভাইভ হলো সম্মিলিত ভাবে টিকে থাকা। আর তার জন্য যে ফিটেস্ট বলা হয়, সেই ফিটেস্ট বা ক্ষমতার সাথে জড়িয়ে আছে পরিবেশ ও চাহিদা। টিকে থাকার যোগ্যতা কি জিনিস এটা রৌশার সরল চিন্তা না সামু সাব। বুঝলেন?’
আমি কিছু বলি না। ফ্যালফ্যাল হাসি। তর্কে ঘি ঢালি। মজা নেই। উষকে দিয়ে উপভোগ করি। কখনো-বা গো ধরে যুক্তি তুলি- সবই ভাওতাবাজি। তবে এটা ঠিক, মেয়েদের স্মার্ট হতে হয়। শিক্ষা আর কৌশল জানতে হয়। তাই হয়তো আমার চেতনে, মননে, ধ্যানধারণায় রৌশার দৃষ্টি প্রভাব ফেলে। মা টাইপ ফারজানা চরিত্রও আমি আঁকড়ে ধরি। এটা আমার চিন্তা-চেতনায় হঠাৎ করে আসেনি। দাদার দাদা, তারও দাদা, এমনকি হাজার হাজার বছর ধরে আমার সংস্কারে, বিশ্বাসে ক্রমশ এটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে ভোগের নারী আর গৃহিণী নারী এক নয়। কত কত পুরুষের জীবন বাইজিখানায় হারিয়ে গেছে, কত রাজা মহারাজা নারীর হেরেমে শ্বাস ফেলেছে। অথচ কত নারী স্বামীর রাজ্য পরিচালনা করেছে অন্তরালে থেকে। সহায়ক হয়ে। আমি ফিরোজা বেগমের ভেতর সবগুলোকে খুঁজি। মায়ের মতো শাসন, বাইজিদের মতো বিনোদন, স্ত্রীর মতো কর্তব্য, কৌশরের আত্মভোলা আবেগী জীবনসঙ্গীনি। কর্পোরেটের চৌকুশতা। যেন উহু কষ্টে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে। নিজের দক্ষতায় পারিবারিক ঝামেলা দূর করবে। থাকবে স্মার্ট। অথচ আমার ফিরোজা বেগম, আমার হাড় চিবিয়ে খাওয়া বিবি, বোঝেই না যে স্মার্টনেস কী! এখনকার পুঁজিবিশ্বে স্মার্টলি ডিল করতে হয় প্রতিটি বিষয়। বুঝে শুনে তো বিনিয়োগও করতে হয়। সেটা যে বিষয়ই হোক, হতে পারে শরীর বা মন বা প্রেম বা মাধুর্য শব্দমালা। যেমন রৌশা করে। না হলে কি মুনাফার আশা করা যায়? মুনাফাই তো সারকথা- তাই না! সে বোঝে না। তার কাজে এমন আত্মিক ভালোবাসাও নেই। উপভোগপ্রবণতাও নেই। আরে প্রাণ তো থাকা উচিত। থাকা উচিৎ হৃদয় অর্জন করার একাগ্র উন্মাদনা। অথচ তার নাই কোনো জয়োল্লাস কামনা। নাই বুদ্ধি কৌশল। জাস্ট একটা যন্ত্রের মতো সে শুধু দায়িত্ব পালন করে। জাস্ট একটা গৃহস্থালি বউ সে আমার। জাস্ট হাউসওয়াইফ।
এভাবে আমি দিনকে দিন নিজের ভেতরে প্রবেশ করি। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠি। নিজের প্রাপ্তির বাইরে অন্য কিছু ভাবতে পারি না। এর পর থেকেই রৌশার সাথে গোপন প্রেমে জড়িয়ে পড়ি। দিনও ভালো যায়। কিন্তু ফিরোজা বেগম শুকনো পাতার মতো শুকাতে থাকে। আমি ভ্রুক্ষেপ করি না। তাচ্ছিল্যের এই উপেক্ষায় আমাদের আবেগ অনুভূতির দেয়াল তৈরি হতে থাকে। আমাদের ভালোবাসা বিভাজন দেয়ালা দ্বারা আলাদা হয়ে নিজের ঘরে গুমোট জমে থাকে। নিজের মধ্যে একা, নিঃসঙ্গ, গুমোটবদ্ধ থেকে একসাথে পরিবারের মানুষ হয়ে ঘরসংসার করি। ফলে ফিরোজা বেগমের কোনো কিছুতেই প্রাণজাগানিয়া জীবনী থাকে না। সে শুকোয়। আমার সন্তানও শুকায়। আমি যেন দিনকে দিন পরিবারছাড়া হতে থাকি। গ্রামের বাড়ি থেকে তেমন কেউ আর ফোনও দেয় না। পরিবার বলতে যা বোঝায়, সেটা বউয়ের পরিবার হয়। সেই পরিবারে আমি শুধু মেহমান। শুধুই মেহমান।