ডিটেক্টিভ কে কে (কেরামত আলীর কেরামতি)—১২

১২
‘বাড়ি নাম্বার ষোল। মালিকের নাম—রাকিবুল হাসান রাকিব। শুক্রাবাদ।’
‘আপনি কোত্থেকে আসছেন?’
‘আমি কাঁঠালবাগান থেকে এসেছি।’
‘কাঠালবাগান কোন এলাকায় থাকেন?’
‘২৪২/এ রোকেয়া ভিলা, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট।’
‘কাঁঠালবাগান ঢালের কাছে মনে হচ্ছে?’
‘জি ঠিক ধরেছেন।’
‘কাঁঠালবাগান কাঁচা বাজারের পেছনে আমার বন্ধুর বাসা। নাম মোজাম্মেল। মসজিদের গলিতে একটা লন্ড্রির দোকান আছে না—বিসমিল্লাহ লন্ড্রি?’
‘জি।’
‘ওটাই আমার বন্ধুর লন্ড্রি।’
‘ও আচ্ছা।’
‘আমার নাম বলে জামা-কাপড় ইস্ত্রি করলে পয়সা কম রাখবে।’
‘ঠিক আছে। ধন্যবাদ।’
‘তা এদিকে কী মনে করে?’
‘একটু দরকার ছিল।’
‘আরে এতক্ষণ ধরে কথা বলছি। আপনার নামটাই তো জানা হল না।’
‘আমার নাম কেরামত আলী, এ্যাসিসটেন্ট ক্লার্ক, মৎস্য বিপণন বিভাগ, কাওরান বাজার, ঢাকা।’
‘কাওরান বাজারে এই ধরনের অফিস কোথায় ভাই?’
‘আছে। এটিএন বাংলা টেলিভিশনের সামনে। ট্রান্সটেক ইলেট্রনিক্স শো-রুম বিল্ডিঙ।’
‘তা কী বললেন যেন—মৎস্য বিপণন, মানে কি মাছ বেচা অফিস?’
‘জি একদম ঠিক ধরেছেন।’
‘ভাই, আমি তো প্রায়ই যাই কাওরান বাজারে। আপনার ফোন নাম্বারটা দেন। একদিন গিয়ে আপনার দোকান থেকে মাছ কিনে আনব।’
‘জিরো-ওয়ান-সেভেন-ওয়ান-টু-সিক্স-সেভেন-ফোর-ফোর-ফোর-জিরো।’
‘দাঁড়ান, আমি একবার বলি, দেখেন মেলে কি-না।’
‘বলেন।’
‘জিরো-ওয়ান-সেভেন-ওয়ান-টু-সিক্স-সেভেন-ফোর-ফোর-ফোর-জিরো।’
‘একদম ঠিক আছে।’
‘আমি আপনাকে একটা মিস কল দেই।’
‘দেন।’
‘কল এসেছে ভাই। শেষের টু ডিজিট ডাবল এইট।’
‘হ্যাঁ ভাই। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালোলাগল। তা কত নাম্বার বাড়ি যেন খুঁজছিলেন?’
‘বাড়ি নাম্বার ষোল। মালিকের নাম—রাকিবুল হাসান রাকিব।’
‘আপনি কষ্ট করে সামনের ওই মোড়ের দোকানে গিয়ে জিগান।’
‘তারমানে আপনি চেনেন না?’
‘না ভাই।’
লোকটা চলে গেল। অথচ সে এতক্ষণ যেভাবে কথা বলছিল তাতে কেরামত আলীর মনে হয়েছিল নিশ্চয় সে রাকিবুল হাসান রাকিবকে চেনে। নাহ, তার এত প্রশ্নের জবাব দেওয়া একদমই ঠিক হয় নি। মনে মনে এসব কথা ভাবতে ভাবতে কেরামত আলী মহল্লার মোড়ের মুদি দোকানে গেল।
চিকন গ্রিলের বেড়া ঘেরা দোকান। মাঝ বরাবর চৌকোণ পকেট; সদাই বা টাকা আদান-প্রদানের ফুটো। বোঝা গেল এলাকায় চোরের আনাগোনা আছে এবং দোকানদার সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন।
দোকানদার মোবাইলে ওয়াজ শুনছিল।
সে কারো উপস্থিতি টের পেল বটে কিন্তু মোবাইল থেকে চোখ তুলল না। বোঝা গেল সে ভীষণ ব্যস্ত আছে ওয়াজে।
কেরামত আলী কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। দোকানদার এক সময় চোখ তুলে তার দিকে তাকাবে—এই আশায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
এমন সময় হঠাৎ একটি কুকুর তাকে ঘেঁষে বাতাসের বেগে শাঁ করে দৌড়ে গেল। আগের কুকুরের পেছন পেছন আর একটি কুকুরের দৌড়ে যাওয়া দেখে কেরামত আলী বুঝতে পারল— একটি আর একটিকে দাবড়ানি দিচ্ছে। আধিপত্তবিস্তারমূলক এ-ধরনের দাবড়ানি সব এলাকাতেই আছে। পরিচিত দৃশ্য।
দোকানদার কেরামত আলীর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল বটে যদিও তার দৃষ্টি ওয়াজেই নিবদ্ধ রইল।
কেরামত আলী বলল, ‘বাড়ি নাম্বার ষোল। মালিকের নাম—রাকিবুল হাসান রাকিব। শুক্রাবাদ।’
দোকানদার কেরামত আলীর কথা এক কানে শুনল অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়ে মোবাইলের দিকে তাকাল।
কেরামত আলী আবার একই কথা বলল, ‘বাড়ি নাম্বার ষোল। মালিকের নাম—রাকিবুল হাসান রাকিব।’
দোকানদার ওয়াজ পজ দিয়ে বলল, ‘আমি কী করব?’
‘না না। আপনাকে কিছু করতে হবে না। আমি বাড়িটা খুঁজছি।’
‘আরো খোঁজেন।’
‘প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে খুঁজলাম। কিন্তু পেলাম না। মানে ১৫ নাম্বার বাড়িটা পাই কিন্তু ১৬ নাম্বারটা পাচ্ছি না।’
হেঁটে যাওয়ারত পাঞ্জাবি-টুপি পরা একজন মানুষকে দেখিয়ে দোকানদার বলল, ‘ওই যে দেখেন যাইতেছে লোকটা, উনি যে বাড়িতে থাকেন সেটাই ষোলো নাম্বার বাড়ি।’
‘ধন্যবাদ।’
কেরামত আলী পাঞ্জাবি-টুপি পরা লোকটার পিছু নিল।
লোকটার কাঁধ ঈষৎ বাঁকা। হয়তো জন্মগত ত্র“টি। তাই কাঁধটা বামের দিকে ঝুঁকে থাকে। হাঁটার সময় হাত দুটো বেশ দোলে। হাত দুলুনির দিকে ভালোভাবে খেয়াল করলে স্পষ্ট হয়, তার হাঁটার মধ্যে কিছুটা অসামঞ্জস্য রয়েছে।
তার পায়ে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। টাকনুর উপরে পাজামা পরা। মনে হয় নামায পড়ে বাসায় ফিরছেন।
লোকটা প্রথমে একট গলা খাঁকারি দিল। তারপর লম্বাটে একটি কাশি। এক কাশিতেই এক দলা আঁঠাল থুতু বেরিয়ে এল। থুক করে কফ ফেলল রাস্তায়। সে কেফ ফেলার সময় তার মুখের একটা অংশ দেখতে পেল কেরামত আলী। লেবাস দেখে কেরামত আলী ভেবেছিল লোকটার দাড়ি আছে কিন্তু নেই। ক্লিন শেভড।
কেরামত আলী তার হাঁটার গতি বাড়াল।
কাঁধ বাঁকা লোকটার কাছাকাছি গিয়ে নিজে একটা গলা খাঁকারি দিয়ে কেরামত আলী বলল, ‘এক্সকিউজ মি!’
কাঁধ বাঁকা লোকটা ঘুরে দাঁড়াল।
‘আমি ষোল নাম্বার বাড়িটা খুঁজছিলাম। একটু কি এ ব্যাপারে সহায়তা করতে পারেন?’
‘এদিকে তো চারটা ব্লক। এ, বি, সি, ডি। আর চারটা ব্লকেই ষোল নাম্বার বাড়ি আছে। আপনি কোন ব্লকে যাবেন?’
‘ব্লক নাম্বার জানি না ভাই। তবে বাড়িঅলার নাম জানি।’
‘বাড়িঅলার নাম কী?’
‘রাকিবুল হাসান রাকিব।’
কাঁধ বাঁকা লোকটি যেন চমকে উঠলেন। কেরামত আলীর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন। ‘চিনতে পারলাম না ভাই। স্যরি।’
‘ইটস ওকে।’
কাঁধ বাঁকা লোকটা আর কিছু না বলে হেঁটে যেতে লাগলেন।
কী মনে করে কেরামত আলী তাকে আবার ডাকল, ‘ভাই আর একটা কথা।’
‘জি বলেন।’
‘না মানে বলছিলাম এটা কোন ব্লক?’
‘এ ব্লক।’
‘ধন্যবাদ।’
কেরামত আলী থেমে পড়ল। ভাবল, ডানে-বামের কোনো গলিতে ঢুকে পড়বে। তাই হাঁটা দিল। হঠাৎ কী মনে করে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল কাঁধ বাঁকা লোকটা উধাও। সে অবাক হল।
কোথায় গেলেন লোকটা!
সিদ্ধান্ত বদল করল কেরামত আলী। লোকটা যেদিকে গিয়েছেন সেও সেদিকে হাঁটা দিল। কয়েক কদম হাঁটার পর হাতের বাম পাশে চোখে পড়ল ষোল নাম্বার বাড়িটা। নেইম প্লেটে লেখা বাড়ির মালিকের নাম—ইঞ্জিনিয়ার আমাজদ আলী। বাড়ির নাম—সুফিয়া মঞ্জিল। ব্লক এ। বাড়ি নাম্বার ১৬।
তারমানে এটা নয়। পুতুল যে বাড়িতে থাকে সে বাড়ির মালিকের নাম—রাকিবুল হাসান রাকিব।
কেরামত আলী নিজের অজান্তেই উপরের দিকে তাকাল এবং দেখতে পেল, তিনতলার বারান্দা হতে কাঁধ বাঁকা লোকটা ঠিক তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। কেরামত আলীর চোখে চোখ পড়তেই লোকটা বারান্দা হতে ভেতরে চলে গেল।
কেরামত আলী নিজেও আর দেরি করার প্রয়োজন মনে করল না।

বাকি তিন ব্লকের ষোল নাম্বার বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল বটে কিন্তু কোনো বাড়ির মালিকের নাম রাকিবুল হাসান রাকিব নয়। অর্থাৎ বি ব্লকের বাড়ির মালিকের নাম—আশরাফ আলী। সি ব্লকের মালিকের নাম—মোাতাহার আলী এবং ডি ব্লকের বাড়ির মালিক—পরিতোষ হালদার।
পুতুলের বাবা কি তবে ভুল বলল?—মনে হয় না। নিজের মেয়ে যে বাড়িতে কাজ করে সে বাড়ির তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে মেয়ের বাবার ভুল হওয়ার কথা নয়। যদি পুতুলের বাবার দেওয়া তথ্য ঠিকই থাকে তাহলে ভুলটা হচ্ছে কোথায়? রাকিবুল হাসান রাকিব মিসিং হয়ে যাচ্ছেন কেন, এটাই মেলাতে পারছে না কেরামত আলী।
তবে ব্যাপার কি এমন হতে পারে, পুতুল যার বাসায় কাজ করে সে বাড়ির মালিক নন? অর্থাৎ সে হল—ভাড়াটিয়া। হ্যাঁ, এটা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। গ্রামের গরিব মানুষের কাছে ঢাকা শহরের বাড়িঅলা ও ভাড়াটিয়ার পার্থক্য স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে যাদের বাসায় কাজের বুয়া থাকে তাদেরকে তারা বাড়ির মালিকই মনে করে।
ঘটনা যদি সেরকম হয় তাহলে রাকিবুল হাসান রাকিবকে খুঁজে বের করতে হলে চারটি বাড়ির প্রত্যেকটি ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়ার নাম জানতে হবে। ধরা যাক প্রতিটা বাড়িতে দশজন ভাড়াটিয়া থাকে। দশ ইন্টু চার= চল্লিশ জন ভাড়াটিয়া। না। এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
কেরামত আলী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

চায়ের দোকানদার কেরামত আলীর সামনে চায়ের কাপ বাড়িয়ে ধরল। কিন্তু কেরামত আলী তা দেখতে পেল না।
দোকানদার বাধ্য হয়ে বলল, ‘চা লন।’
কেরামত আলী ভাড়াটিয়াদের চিন্তা থেকে বেরিয়ে এল। দোকানদারের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে তাতে চুমুক দিতে যাবে তখন দেখতে পেল, চায়ের কাপে একটি কালো পিঁপড়া ভাসছে। সে একবার ভাসমান পিঁপড়ের দিকে আর একবার দোকানদারের দিকে তাকাল। চুমুক দেওয়ার আগেই দেখে ফেলেছিল বলে রক্ষা। না হলে এতক্ষণে সেটি তার পেটের ভেতর চলে যেত।
কেরামত আলী কাপটি কাৎ করে সন্তর্পণে পিঁপড়েটি ফেলে দিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে চায়ে চুমুক দিল।
কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় ফিরে সরাসরি বাসায় না গিয়ে কেরামত আলী শুক্রাবাদ চলে এসেছে। সে জানে, বাসায় গেলে মালেকা বিবি আজ আর বের হতে দেবে না। দিলেও একশো একটা প্রশ্ন করবে। তাই কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে কাঁঠালবাগান না গিয়ে শুক্রাবাদ আসা।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সময় তার লাগেজটি রেখেছে এই চায়ের দোকানদার। এ সময়টা সে চারটি ব্লকের ষোল নাম্বার বাড়ি খুঁজে বের করেছে। দুঘণ্টা পর এসে চায়ের কাপে একটি কালো পিঁপড়ে দেখে সে যদি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তবে সেটা অকৃজ্ঞতা হবে। তাই কোনোমতে চা শেষ করে উঠে পড়ল।
এতটা সময় লাগেজ রাখার জন্য সে তার সর্বোচ্চ মোলায়েম ভাষায় দোকানদারকে বিশেষ ধন্যবাদ দিল।
দোকানদার চায়ের কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে বলল, ‘ভাই, আমরা দশ জন চড়ায়া খাই। দেখলেই চিনি কে চোর আর কে বাটপার। আপনাকে দেখে ভালো মানুষ মনে হইছে বলেই ব্যাগ রাখছি। নাইলে রাখতাম না।’
কেরামত আলী বলল, ‘ধন্যবাদ ভাই। আসি। ভালো থাকবেন।’

বাসায় ফিরে কেরামত আলী নতুন এক মালেকা বিবিকে দেখতে পেল। এতটা সুচিবাই আগে কখনো মনে হয় নি তাকে। এমনকি করোনার সময়গুলোতেও এত তীব্র ছিল না তার সুচিবায়িতা।
মালেকা বিবি ব্যাগ-পত্তরসহ কেরামত আলীকে দাঁড় করিয়ে দিল ড্রইং রুমে। বলল, ‘মরা-বাড়ি থেকে এসেছ। শোবার ঘরে ঢোকা যাবে না। কোনোকিছু স্পর্শও করা যাবে না।’
কেরামত আলী বলল, ‘কিন্তু ড্রইং রুমে এভাবে তাল গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকলে তো আমার পা ব্যথা হয়ে যাবে।’
‘ও মা! তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে কে! গোসলখানায় ঢোকো। জামা-কাপড় ধুয়ে গোসল করে সাফ-সুফ হয়ে এস।’
কেরামত আলী বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, যাচ্ছি।’
‘সে কি! তোমার লাগেজের কাপড়গুলো কে ধোবে বল দেকিনি? লাগেজ সুদ্ধ গোসলখানায় নিয়ে যাও।’
‘লাগেজও ধুতে হবে?’
‘তো কী? মরা-বাড়ি থেকে ফিরেছ। তোমার লাগেজও ফিরেছে। সাফ-সুফ না-হলে আমার ঘরে তোমাদের কারোরই জায়গা হবে না।’
‘আচ্ছা যাই তবে।’
‘জুতো-মুজোও নিয়ে নিয়ো।’
‘আমার জুতোজোড়া একবার দাও তো!’
‘তার মানে তুমি আমাকে দিয়ে মরা-বাড়ির ঐ জুতো ধরাবে? তোমার ইচ্ছেটা কী, বল দেকিনি? আমার প্রতি দেখি তোমার একটুও যত্ন-আত্তি অবশিষ্ট নেই দেকছি।’
‘আচ্ছা আমি নিজেই নিয়ে নিচ্ছি। কষ্ট করে তোমাকে দিতে হবে না।’
বসার ঘরে স্যানিটাইজার স্প্রে করতে করতে মালেকা বিবি বলল, ‘এই তো বুঝেছ। মাঝেমাঝে তুমি অনেক ভালো বোঝো। মাঝেমাঝে কিছুই বোঝ না। শোনো, মরা-বাড়ি থেকে ফেরা যেনতেন কথা নয়।’
‘বুঝতে পেরেছি। তুমি স্যানিটাইজার স্প্রে করো। আমি টুপ করে গোসলটা করে আসি।’
‘না না না টুপ করে কেনে, সময় নিয়ে গোসল করো। সাবান-শ্যাম্পু ভালোভাবে মাখবে। জামা-কাপড়-লাগেজ-জাঙ্গিয়া, কানের ফুটো, হাত-পায়ের নখের কোণা, পায়ুপথ পরিস্কার করবে। আমি তোমার জন্য গরম জল বসাচ্ছি। গোসল শেষ করে এসে গরম জল খাবে।’
কেরামত আলী প্রক্ষালন কক্ষে হতে অসহায় দৃষ্টিতে মালেকার দিকে তাকিয়ে রইল।
মালেকা অবাক হয়ে বলল, ‘দয়া করে কোনো কিছু না-ধুয়ে আবার বলবে না, ধুয়েছি। আমি কিন্তু প্রতিটা কাপড় শুঁকে দেখব।’
মাত্র দুদিনে মালেকা বিবির এতটা বদলে যাওয়ার কারণ কী হতে পারে—কেরামত আলী কিছুই বুঝতে পারল না। সে কী বলবে বুঝে উঠতে না পেরে চট করে চটকদার একটি কথা বলল, ‘তুমি দুদিনেই বেশ সুন্দর হয়ে উঠেছ।’
‘এসব বললে কিছুই হবে না। আগামি সাতদিন তুমি ভুলেও আমার দিকে তাকাবে না—এই বলে রাখলাম।’

জামা-কাপড় কাচার সময় প্রক্ষালন কক্ষ সাবানের ফেনায় ভরে উঠল। বিশেষ প্রয়োজনে সিনেমার পর্দায় যেমন একজন মানুষের একাধিক ছবি দেখা যায় তেমনি সাবানের ফেনার বাবলের স্বচ্ছ দেয়ালে কেরামত আলী হঠাৎ কাঁধ বাঁকা লোকটার মুখ দেখতে পেল। দেখে যারপরনাই চমকে উঠল সে।
সে কাপড় কাচা রেখে নিজের সাথে নিজে কথা বলতে শুরু করল। 

—লোকটা কে? তার ছবি কেন দেখা যাচ্ছে? সে কি পুতুলের মালিক?
—কোনো যুক্তিতেই লোকটা পুতুলের মালিক নন। যেহেতু চারটি ব্লকের চারটি ষোল নাম্বার বাড়ির কোনো মালিকই রাকিবুল হাসান রাকিব নন সেহেতু কাঁধ বাঁকা লোকটিও পুতুলের মালিক নন।
কিন্তু তিনি বারান্দা থেকে কেরামত আলীর দিকে তাকিয়েছিলেন কেন? কেরামত আলী ষোল নাম্বার বাড়ির গেইটে গিয়েছিল বলে তিনি তাকে সন্দেহ করেছিলেন?—সেটাও হতে পারে। অপরিচিত একজন লোক গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে সে বাড়ির বাসিন্দা তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতেই পারেন।
কেরামত আলী কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না। একবার মনে হল—কাঁধ বাঁকা লোকটা তাকে সন্দেহজনক মনে করে ওভাবে তাকিয়েছিলেন আবার মনে হল—ওই লোকটাই সন্দেহজনক। ফলে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে জামা-কাপড়-লাগেজ ইত্যাদি ধুতে এবং গোসল করতে করতে এশার আযান পড়ে গেল।

প্রক্ষালন কক্ষের দরজায় মৃদু শব্দ হল। ততক্ষণে কেরামত আলীর গোসল শেষ। গামছায় শরীর মুছছে। টিঙটিঙে-হাড্ডিসার খোলা গায়ে দরজা খুললে মালেকা বিবি রাগ করতে পারে ভেবে সে কোনো রা করল না। এর মধ্যে আর একবার ঠকঠক শব্দ হল।
এবার কেরামত আলী দরজা ঈষৎ খুলে বাইরের দিকে তাকাল।
মালেকা বিবি বলল, ‘আমি ভাবলাম গোসল করতে করতে তুমি ঘুমিয়ে পড়লে কি-না।’
‘না না। ঘুমাই নি তো।’
‘তা সবকিছু ধোয়া হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, শেষ।’
মালেকা বিবি আর কিছু না বলে চলে গেল।

(চলবে)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত