১০
কিন্তু সে ভীষণ খটকায় পড়ে গেল।
আজ ছিল পুতুলের বিয়ের দিন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সে আজকে শ্বশুরবাড়ি যেত। কিন্তু যার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সে অপঘাতে মারা গেছে বলে কি আজকেই ঢাকা চলে যাবে? কোনো শোক-তাপ নেই মনে? এতটা পাষাণ হৃদয়ের মেয়ে বশিরুল্লাহর বউ হতে যাচ্ছিল? কিংবা তার নিয়তির উপর কি কোনো ক্ষোভ নেই? বিয়ে হল না-বলে ঢাকায় চলে যাবে? মানুষের জীবন এত সরল-স্বাভাবিক, নির্মোহ? নাকি তার এই চলে যাওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বড় কোনো রহস্য?
একদম তাই, এটা ঘোরতর সন্দেহের ব্যাপার—কেরামত আলী ভাবল, যেহেতু সে বশিরুল্লাহর খুনের সাথে জড়িত সুতরাং সে আর এখানে থাকবে না। ঝুট-ঝামেলা মাথায় নেবে না। কিন্তু কিছুদিন পর পরিবেশ শান্ত হলে সে ঠিকই ফিরে আসবে। কিংবা মজনু চলে যাবে তার কাছে। তারা গোপনে বিয়ে করে সংসার শুরু করবে।
ব্যাপারটা দারোগা বাবুকে জানানো দরকার।
দারোগা বাবুর কথা মনে হতেই কেরামত আলী সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোন দিল।
‘স্যার স্লামালাইকুম।’
‘অলেকুমস্লাম।’
‘স্যার আমি নাম কেরামত আলী বলছিলাম।’
‘কেমন আছিস রে কেরামত?’
‘ভালো আছি স্যার। আপনি কেমন আছেন?’
‘আমিও ভালো আছি। বল, তারপর তোর কী অবস্থা? এলাকার কী অবস্থা?’
‘স্যার খুনীর সন্ধান পাওয়া গেছে।’
‘খুনী! কিসের খুনী?’
‘স্যার বশিরুল্লাহর খুনী।’
‘বশিরুল্লাহ আবার কে?’
‘আমার খালাত ভাই স্যার।’
‘আপনি কে?’
‘আমার নাম—কেরামত আলী, এ্যাসিসটেন্ট ক্লার্ক, মৎস্য বিপণন বিভাগ, কাওরান বাজার—ঢাকা।’
‘ও আচ্ছা আপনি? স্যরি। আমার এক দূরসম্পর্কের চাচাত ভাই আছে—তার নামও কেরামত আলী। আমি তাকে মনে করেই এতক্ষণ আপনার সাথে কথা বলছিলাম। সে যাইহোক। কী যেন বলছিলেন—আবার বলেন?’
‘না মানে স্যার বলছিলাম যে, বশিরুল্লাহর খুনীর সন্ধান পাওয়া গেছে।’
‘কে খুনী?’
‘সে হল—পুতুল।’
‘পুতুল কে?’
‘যার সাথে বশিরুল্লাহর বিবাহ হওয়ার কথা ছিল।’
‘তা আপনি কী করে বুঝলেন যে, পুতুলই খুনী?’
‘কারণ—সে আজকে ঢাকা চলে গেছে।’
‘কাজ থাকলে তো যাবেই। আপওি তো যাবেন নাকি সারাজীবনের জন্য আলমডাঙ্গা থাকতে এসেছেন?’
‘জি না স্যার। আমিও যাব।’
‘তাহলে?’
‘না মানে স্যার বলছিলাম যে—মেয়েটার এভাবে চলে যাওয়াটা সন্দেহের ব্যাপার না? আজকে যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সে মরে গেছে বলেই কি সে ঢাকা চলে যাবে? এটা কি সন্দেহেরে ব্যাপার নয় স্যার?’
‘সন্দেহের তো কোনো সীমা-পরিসীমা নাইরে ভাই। আপনি নিজেও সন্দেহের বাইরে নন?’
‘কী বলছেন স্যার? আমিও?’
’হ্যাঁ, আমার সহকর্মী মধু আপনাকে সন্দেহ করে।’
‘ও।’
‘ভয় পেয়ে গেলেন বোধ হয়?’
‘না ইয়ে মানে স্যার, ছোটবেলা থেকেই থানা-পুলিসে আমার খুব ভয়।’
‘হা হা হা…সেটা আমি আপনাকে গতকাল দেখেই বুঝতে পেরেছি। ব্যাপার না। শোনেন। পুতুল কাজে গেছে এবং সে আমাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যেই আছে। আমরা চলে আসতে বললে সে যেকোনো সময় এসে হাজিরা দেবে।’
‘ও। তাহলে তো দারুণ।’
‘তবে আপনার এই সচেতনতার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। রাখি বাই।’—দারোগা বাবু ফোন রেখে দিলেন।
কেরামত আলী বেশ অনুপ্রাণিত হল। তারমানে সে যে বশিরুল্লাহর খুনের রহস্য নিয়ে কাজ করছে—এই ব্যাপারটা দারোগা বাবুর নজরে এসেছে! এবং সে জন্য তিনি তাকে ধন্যবাদও দিয়ে দিলেন। বাহ!
যদিও দারোগা বাবু ফোন রেখে দিয়েছেন তবুও কেরামত আলী তার প্রতি কৃতজ্ঞতাপ্রকাশমূলক বিড়বিড় করল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।’
বিজনের চায়ের দোকানে ঢুকল কেরামত আলী।
তখন চায়ের দোকানে খুব ভিড়। চায়ের কাপের টুংটাং, বিড়ি-সিগরেটের ধোঁয়া আর দেয়ালে ঝোলানো এলইডি টিভিতে বাংলা ছায়াছবির সংলাপে সরগরম বিজনের দোকান।
কেরামত আলী ঘরের কোণার দিকে—বেঞ্চির শেষ প্রান্তে এক চিলতে ফাঁকা জায়গায় বসল। কাস্টমাররা সবাই যেহেতু বাংলা ছায়াছবিতে মশগুল তাই তার আগমনে তাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেল না।
কিন্তু বিজন চায়ের কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে ঠিকই তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। এবং চায়ের কাপটি তার হাতে দেওয়ার সময় আস্তে করে বলল, ‘কথা হইছে?’
তারমানে কেরামত আলী পুতুলের সাথে কথা বলতে গেছিল—ব্যাপারটা বিজন জানে। অর্থাৎ যখন সে এখানে বসে নৃপেন বাবুর সাথে পুতুলের ব্যাপারে কথা বলছিল তখন থেকেই সে মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনেছিল।
কেরামত আলী বলল, ‘না। সে তো ঢাকা চলে গেছে।’
বিজন বলল, ‘আপনিও কি এখন ঢাকা চলে যাবেন?’
‘না। আমি যাব আমার খালাবাড়ি।’
বিজনের কথা শেষ। তবু সে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হল—সে আরো কিছু বলতে চায়।
কেরামত আলী তার দিকে তাকিয়ে অর্থহীন হাসি হাসল।
বিজন বলল, ‘যদি কিছু মনে না করেন তো একটা কথা বলতাম।’
কেরামত আলী বলল, ‘নিশ্চয়। কী বলবেন—বলুন।’
‘আপনারা কী কী মাছ বেচেন?’
‘নানারকম মাছ। নদীর মাছ। সাগরের মাছ।’
‘এটা কি সরকারি অফিস নাকি বেসরকারি?’
‘সরকারি।’
বিজন চাপা কণ্ঠে অনেকটা ফিসফিসানির স্বরে বলল ‘মারিংকাটিঙের ব্যবস্থা কেমন?’
‘চাইলেই সে ব্যবস্থা আছে কিন্তু আমি মারিংকাটিং করি না।’
‘আপনি যে মারিংকাটিং করেন না—এটা আপনাকে দেখেই বোঝা যায়। আপনি আমাকে ওই দোকানে ঢোকানোর ব্যবস্থা করেন। দেখবেন—মারিংকাটিং কাকে বলে এবং কত প্রকার। আমাকে ওই দোকানে ঢোকালে আপনার চেহারা বদলে যাবে।’
বিজনের কথা থেকে কেরামত আলী দুটি বিষয় পিক করল। ১. কেরামত আলীকে দেখলেই বোঝা যায় সে মারিংকাটিং করে না এবং ২. বিজনকে তার দোকানে ঢোকালে তার চেহারা বদলে যাবে। কেরামত আলী ভাবল, ব্যাপার দুটোর মানে জানা দরকার। বলল, ‘আমাকে দেখলেই বোঝা যায় আমি মারিংকাটিং করি না—এর মানে কী?’
বিজন বলল, ‘মানে হল—আপনি সহজ-সরল। মানে বোকা লোক। বোকা লোকেরা মারিংকাটিং করতে পারে না।’
‘আর আপনি গেলে আমার চেহারা বদলে যাবে—এটার মানে কী?’
‘এটার মানে হল—আমি প্রচুর মারিংকাটিং করব। করে আপনাকে ফিট খাওয়াব। ফিট খেয়ে তিন মাসের মধ্যে আপনার চেহারা পাল্টে যাবে।’
‘ও আচ্ছা। এইবার বুঝতে পেরেছি।’
‘তা আমার পিলানিং কি আপনার পছন্দ হয়েছে?’
‘খুব পছন্দ হয়েছে।’
‘আমাকে কবে আপনার মৎস্য দোকানে ঢোকাবেন?’
‘কোনোদিনই না।’
‘কেন?’
‘কারণ আপনার চিন্তা-ভাবনা ময়লাযুক্ত। যদি ভালো চিন্তা করতে পারেন তাহলে আমার সাথে যোগাযোাগ করবেন। আমি আপনার জন্য চেষ্টা করব। আর যদি এ-রকম ময়লা চিন্তা করেন তাহলে যোগাযোগ করার দরকার নেই। এই নিন আমার কার্ড। আর এই নিন চায়ের বিল।’
বিজন থ মেরে তাকিয়ে রইল।
ফিরতি টাকা দিতে দিতে বিজন বলল, ‘আপনি কি আমার কথায় মাইন্ড খাইলেন?’
কেরামত আলী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘না।’
তারপর কেরামত আলী বিজনের দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ল।
বিস্মিত দৃষ্টিতে কেরামত আলীর দিকে তাকিয়ে রইল বিজন। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করল না সে।
পুতুলদের বাড়ি ভিজিট করে যাওার পর কেরামত আলীর সন্দেহ প্রায় সত্যে পরিণত হল। এখন সে চাইলে ঢাকায় চলে যেতে পারে। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে মালেকা বিবির পা টিপে দেওয়া ছাড়া তার কোনো কাজ নেই। সুতরাং ভুলেও ঢাকা যাওয়া যাবে না।
খালা তাকে পেলে আবারও তার ক্রন্দন পদাবলী শুরু করবে। সেখানেও যাওয়া যাবে না। এসব থেকে দূরে থাকতে হবে। তারচে খুব ভালো হয় শহরে গিয়ে ঘোরাফেরা করতে পারলে।
যে চিন্তা সেই কাজ।
সে আলমডাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।
কিন্তু ছোট্ট শহরটাতে দেখার মতো তেমন কিছু নেই। ফলে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি করার পর একটা চটপটির দোকানে বসল।
চটপটিঅলা পানখোর। হেসে কথা বলে। গোঁফ আছে। দাড়ি নেই।
তাকে দেখে কেরামত আলীর পছন্দ হল। ভাবল, এই লোকের চটপটি নিশ্চয় সুস্বাদু হবে।
কিন্তু না। সম্পূর্ণ বিপরীত। মানে তার চটপটি খুবই বিস্বাদ। একেবারেই মুখে দেওয়ার মতো নয়।
কেরামত আলী একবার টক নিল। একবার ঝাল বাড়িয়ে নিল। তবে এসব করেও স্বাদের তারতম্য ঘটাতে পারল না।
চটপটিঅলা বলল, ‘স্বাদ হল মনের ব্যাপার। আপনি যদি মনে করেন স্বাদ হয়েছে তাহলেই স্বাদ। আর যদি মনে করেন স্বাদ হয় নাই তাহলেই বিস্বাদ।’
চটপটিঅলার কথাটা তার মনে ধরল। সে ভাবল, এই সূত্রে ঘোরাফেরার ব্যাপারটাও বদলে যেতে পারে।
চটপটিঅলার সূত্র মতে কেরামত আলী একটা রিকশা নিল। এবং মজার ব্যাপার হল, তার সবকিছু ভালোলাগা শুরু হল। একটু আগে যে রাস্তাটা তার ভালোলাগে নি, এখন সেটা ভালোলাগছে, একটু আগে যে দেওয়ালটা কটকটে লেগেছে এখন সেটা মোলায়েম মনে হচ্ছে।
হঠাৎ একটি শাদা রঙের প্রাইভেট কার তার রিকশাটি ওভারটেক করে একেবারে রাস্তার কিনারে থামিয়ে দিল। কেরামত আলী ভয়ে-ভয়ে গাড়ির দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হল। কেননা সে দেখতে পেল, জানালা দিয়ে হাসন্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন গোয়েন্দা প্রধান শাহিন মাহমুদ।
কেরামত আলী বলে উঠল, ‘আরে স্যার আপনি!’
শাহিন মাহমুদ বললেন, ‘গাড়িতে ওঠেন।’
কেরামত আলী দ্রুত রিকশা বিদায় করে শাহিন মাহমুদের গাড়িতে উঠল।
এক টানে গাড়ি চলে গেল শহরের শেষ প্রান্তে—নদীলাগোয়া ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টে। সুন্দর, মনোরোম রেস্টুরেন্ট—পানসি।
ভেতরের দিকে—ছোট্ট একটা রুমে বসলেন শাহিন মাহমুদ। আলো-আঁধারি রুম। মৃদৃ শব্দে বিদেশি মিউজিক বেজে চলেছে। মনে হল—এ রুমটি একান্তই তার।
ঠিক উয়েটার নয় তবে উয়েটারের মতো দেখতে এক তরুণ মদের বোতল আর দুটি গ্লাস নিয়ে এল। আয়োজনের আলামত টের পেয়ে কেরামত আলীর গলা শুকিয়ে এল ভয়ে। মদ সে বিশেষ একটা খায় না। কিন্তু সে যে মদ খায় না এ কথাটা বলবে কেমন করে! বললে যদি স্যার তাকে ভর্ৎসনা করেন? যদি ভাবেন যে সে অনাধুনিক?
তরুণ ছেলেটা গ্লাসে দুপেগ মদ দিয়ে চলে গেল।
শাহিন মাহমুদ গ্লাস উঁচু করলেন চিয়ার্স বলার জন্য।
কেরামত আলী তার গ্লাসটি উঁচু করে ধরলেন। একটি গ্লাসের সাথে আর একটি গ্লাসের হালকা ছোঁয়া লাগতেই টুং করে শব্দ হল।
শাহিন মাহমুদ গ্লাসে চুমুক দিলেন।
কেরামত আলীও চুমুক দেওয়ার ভান করল তবে পানীয় মুখে নিল না।
শাহিন মামুদ বললেন, ‘চানাচুর নেন।’
কেরামত আলী বলল, ‘থ্যাঙ্কস।’
‘চিপসও আছে।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।’
দ্বিতীয় সিপ মুখে নিয়ে শাহিন মাহমুদ বললেন, ‘কদ্দূর এগুলেন?’
‘বেশি না স্যার। খুবই সামান্য।’
‘লেগে থাকতে হবে—বুঝলেন? এই আমাকে দেখেন, চাকরিটা ভাগানোর জন্য টানা তিন বছর লেগে থেকেছি। ছাত্রজীবনে পলিটিকস করতাম। বর্তমানে আমার দল ক্ষমতায়। তারপরও তিন বছর লাগল। সাথে কিছু মালপানিও খসাতে হয়েছে।’
কেরামত আলী বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আবার মালপানিও খসাতে হয়েছে?’
‘তো কী? কথায় কি আর চিড়ে ভেজে? আরে ভাই, এমনি এমনি কিছুই হয় না। যাককে। এগুলো গোপন কথা। গোপন কথা গোপন থাকাই ভালো। কাউকে বলবেন না যেন।’
‘অবশ্যই স্যার। আমি কখনো একজনের কথা অন্যের কাছে বলে ঝামেলা পাকাই না। আমার পেটে সহজেই কথা হজম হয় স্যার।’
‘গুড। তো এখন কী করবেন বলে ভাবছেন?’
‘আমার পদ-পদবী নেই। ক্ষমতা নেই। সাহস নেই। আমি তো ঢোঁড়া সাপ। আমি আর কী করব স্যার?’
‘শোনেন। এইসব প্যারা মাথায় নিয়েন না। এইগুলা দীর্ঘ মেয়াদী প্যারা। মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। তার চে ভালো আপনি আপনার বাসায় চলে যান। সংসারে সময় দেন।’
‘যাব স্যার। আমার স্ত্রীও আমাকে চলে যেতে বলেছেন।’
‘দেখলেন, আমার সাথে আপনার স্ত্রীর কীভাবে মিলে গেল? তিনি নিশ্চয় এইসব ঝামেলা সম্পর্কে জানেন। কিন্তু আপনি জানেন না। আরে আপনি তো কিছুই খান নি? খান। চুমুক দেন।’
কেরামত আলী শেষতক এক সিপ মদ মুখে নিতে এবং গিলতে বাধ্য হল।
শাহিন মাহমুদ হাসতে হাসতে বললেন, ‘দারুণ বলেছেন।’
কেরামত আলী বলল, ‘কোনটা যেন স্যার?’
‘ঢোঁড়া সাপ।’
‘আসলেই তো। আমি কি মিথ্যা বলেছি স্যার?’
শাহিন মাহমুদ ডান হাতটি সাপের ফণার মতো তুলে বললেন, ‘আপনার গোখরা সাপ হওয়ার শখ, তাই না?’
‘পৃথিবীর সকল ঢোঁড়া সাপদেরই গোখরা সাপ হওয়ার শখ স্যার। যার যেটা নেই সে সেটা হতে চায়। আশা করি আপনি আমার সাথে একমত।’
‘আরে একমত মানে—বলেন সহমত। পুরোপুরি সহমত।’
শাহিন মাহমুদ রীতিমতো টলছেন।
কেরামত আলীর অবস্থাও তথৈবচ। দুসিপেই মাথাটা বেশ চক্কর দিয়েছে। চোখে ঝাপসা দেখছে। ভুলে যাচ্ছে—একটু আগে বলা কথাটি।
অবস্থা বেগতিক দেখে কেরামত আলী মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল।
শাহিন মাহমুদ কেরামত আলীর দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘টল ফিগার—নামায-টামায পড়ে—মুরুব্বিদের আদাব-লেহাজ করে—মনে আছে তো?’
‘জি স্যার মনে আছে। আমি ঢাকায় গিয়েই আপনার জন্য পাত্রীর সন্ধান করব।’
‘আমার প্রিয় নায়িকার নাম কী, জানেন?’
‘না স্যার।’
‘প্রিয়াঙ্কা চোপড়া।’
‘তাই!’
‘চেনেন নাকি?’
‘জি স্যার। কয়েক বছর আগে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাকে নিয়ে রঙ্গরস করেছিলেন আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। ইউটিউবে সেই রঙ্গরস দেখে আমি খুব মজা পেয়েছিলাম স্যার।’
‘আপনি রাষ্ট্রপতির ভিডিও দেখেন?’
‘দেখি স্যার। খুব মজা লাগে।’
‘ইউটিউবে আর কী দেখেন?’
‘রিপন ভিডিও দেখি। আজাইরা লিমিটেড দেখি। আরো অনেক আছে স্যার।’
‘বাহ আপনি তো অনেক কিছুর খবরই রাখেন। বেশ ভালো। তো যাইহোক। যেটা বলছিলাম—ফিগারটা প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মতো হলে ভালো হয় আর কি।’
‘ওরকম পাবেন না স্যার। কারণ—আমাদের দেশের মেয়েদের গড়ন আলাদা। তাছাড়া তারা খায় বেশি পরিশ্রম করে কম। তাই শরীর ঠিক থাকে না। তারপরও আমি চেষ্টা করব স্যার।’
তারপর দুজনের মধ্যে আর কোনো কথা নেই। ছায়ান্ধকার ঘরটিতে নেমে এল পিনপতন নিরবতা।
বেশ কিছুক্ষণ পর কেরামত আলী বলে উঠল, ‘মূলহোতা হল চিকনি চামেলি।’
‘কে?’—যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলেন শাহিন মাহমুদ।
‘স্যার চিকনি চামেলি।’
‘চিকনি চামেলি কে?’
‘পুতুল। মানে—যার সাথে বশিরুল্লাহর বিয়ে হচ্ছিল।’
‘সে কিভাবে চিকনি চামেলি হল?’
‘আমার খালাত ভাই বশিরুল্লাহ আমাকে ফোন করে নিজের হবু স্ত্রী সম্পর্কে এমনটাই বলেছিল।’
‘ত— সে কি সত্যি সত্যিই চিকনি চামেলি?’
‘জানি না স্যার।’
‘জানেন না মানে?’
‘মানে—আমি তাকে কখনো দেখি নি। অবশ্য আজকে তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার বাড়িতে গিয়ে শুনি, সে ঢাকায় চলে গেছে। এজন্যই তো আমি তাকে সন্দেহ করছি। বলুন স্যার, আমার সন্দেহ কি অমূলক?’
‘না। একদমই না। আপনার সন্দেহ কোনোভাবেই অমূলক হতে পারে না।’
‘তাহলে আপনারা তাকে জেরা করছেন না কেন?’
‘জেরা করা তো আমাদের কাজ না। এটা পুলিসের কাজ।’
‘পুলিসকে একটু বলে দেন না—যাতে তারা ভালোভাবে জেরা করে।’
‘না, এ ব্যাপারে পুলিসকে কিছু বলা ঠিক হবে না।’
‘কেন স্যার?’
‘কারণ—পুলিসকে অনুরোধ করলেই কাজটা পিছিয়ে যাবে।’
‘কেন স্যার?’
শাহিন মাহমুদ মনের অজান্তেই বেশ শব্দ করে টেবিলে গ্লাস রাখলেন। তারপর বললেন, ‘চিকনি চামেলি ইজ এ পারফেক্ট উয়ার্ড। আই লাইক ইট। আমি হয়তো এটাই বলতে চেয়েছিলাম। চিকনি চামেলি…আহ কি সুন্দর এক্সপ্রেশন…যেন আমার চোখের সামনে প্রজাপতির মতো নেচে বেড়াচ্ছে…হুয়াট আ বিউটি…’
(চলবে)