৮
কাঁদতে কাঁদতে কইতরি বেগমের গলা বসে গেছে। তার কণ্ঠ থেকে আর কান্না বের হচ্ছে না। চোখ দুটোও ফুলে গেছে, চোখের ভেতর টকটকে লাল। ছেলের শোকে সম্পূর্ণ বদলে গেছে তার চেহারা।
একটু আগে কইতরি বেগমের ছোট দেবর আব্দুর রহমান এসেছে। আব্দুর রহমানের বাড়ি শরিয়তপুরে। ভাতিজার মৃত্যুর খবর পেয়ে সুদূর শরিয়তপুর থেকে ছুটে এসেছে সে।
কিন্তু সে মৃত্যুর খবর শুনে আসবে কেন? আসবে তো ভাতিজার বিয়ে খেতে। তারমানে কি কইতরি বেগমের সাথে তার দেবরের সম্পর্কের টানাপড়েন? কেরামত আলী ভাবল, হতে পারে।
কইতরি বেগম পাগলীনির মতো আব্দুর রহমানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ তুলল, ‘ওরে পরানের দেবর রে! নাই নাই নাই রে! আমার কলিজার ধন নাই রে!’
আব্দুর রহমান কান্না চেপে রাখতে পারল না। কইতরি বেগমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। দর্শনার্থীরা দেবর-ভাবীর হৃদয়বিদারক কান্নার দৃশ্য দেখে নিজেদের চোখের জল ধরে রাখতে পারল না।
আব্দুর রহমান বলল, ‘ভাবী! কাইন্দেন না। শত কাঁদলেও আর বশিরুল্লাহকে ফিরে পাওয়া যাবে না!’
‘ওরে আব্দুর রহমান! বশিরুল্লাহকে ছাড়া আমি কেমনে বাঁচব? বলে দাও—বাঁচব কেমনে?’
কইতরি বেগমের চোখের জল মুছে দিয়ে আব্দুর রহমান বলল, ‘ভাবী, শান্ত হন। এ-রকম করলে তো আপনিও বাঁচতে পারবেন না।’
‘আমি তো বাঁচতে চাই না। আমি আমার বশিরুল্লাহর কাছে যেতে চাই।’
কে যেন এক গ্লাস শরবত ধরিয়ে দিল আব্দুর রহমানের হাতে। দিয়ে ইশারায় কইতরি বেগমকে খাওয়াতে বলল।
আব্দুর রহমান শরবতের গ্লাস নিয়ে বলল, ‘ভাবী এক চুমুকে শরবতটা খান।’
‘বশিরুল্লাহকে রেখে আমি শরবত খাব? এই নাকি তোর আক্কেল? তুই কি পাগল হয়েছিস রে আব্দুর রহমান? তোর মাথা কি ঠিক আছে রে আব্দুর রহমান?…’
‘না ভাবী, এসব কথা বলা যাবে না। আমরা সবাই মরে যাব। দুনিয়াতে কেউ বেঁচে থাকে না। মিঞা ভাই কি বেঁচে আছে? মিঞা ভাইকে ছাড়া আপনি বেঁচে রইছেন না? আপনার মা-বাবা কি এই দুনিয়াতে বেঁচে আছেন? তাদের ছাড়া আপনি বেঁচে আছেন না? তাদের জন্য কি কোনো কিছু থেমে আছে? কোনোকিছু কি থেমে থাকে? ভাবী না ভালো, আমার কথা শোনেন। এক ঢোক পানি খান।’
‘নাহ। কিছুই খাব না।’
‘আমার কথা রাখেন ভাবী। আমার কথা না রাখলে আমি খুব কষ্ট পাব ভাবী!’
‘আমার যখন বিয়ে হয় তখন তুই তখন ন্যাংটা ছেলে। আমি তোকে নিজের সন্তানের মতো লালন-পালন করে বড় করছি। কিন্তু ভাইয়ের সাথে ঝগড়া বাধায়ে তুই শরিয়তপুর চলে গেলি—শ্বশুরবাড়ি। সেই যে গেলি আর ফিরলি না। একবারও কি আমার কথা মনে পড়ে না তোর?’
‘মনে পড়ে ভাবী। খুব মনে পড়ে। কিন্তু আপনি এই শরবতটা খান। না-হলে কিন্তু আমি এক্ষুনি শরযিতপুর চলে যাব।’
‘চলে যাবি?—আচ্ছা দে খাই। ভাত তো আর না, শরবত। শরবত আর কী এমন জিনিস? দে খাই।’—বলে শরবতের গ্লাসে চুমুক দিল। তারপর বলল, ‘শরবত কে বানাইছে? একটুও চিনি হয় নাই।’
মধ্যবয়স্ক এক মহিলা—যে কি-না একটু আগে আব্দুর রহমানের হাতে শরবতের গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়েছিল, সে বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে চাচিআম্মা, দেন, আর এক চামচ চিনি মিশায়ে দেই।’
কইতরি বেগম বলল, ‘তোর শরবত তুই নিজেই খা।’
কেরামত আলী এক পা দুপা করে ভেতর বাড়ি থেকে বাইর বাড়িতে এল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল নারকোল-সুপারি বাগানের এক কোণে।
এ-রকম গল্প প্রায়ই শোনা যায়—ঢাকা শহরে এমন কিছু ছেলেপেলে আছে যারা ৫/১০ হাজার টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করে দেয়। গাঞ্জুইট্টা ছেলেটা কি সেই গ্র“পের সদস্য, যে ভাড়াটিয়া খুনী হিসেবে কাজ করেছে? খুন করার আগে এই গ্রামে এসে বশিরুল্লাহর সাথে খাতির জমিয়েছে। বন্ধুত্ব করেছে। বশিরুল্লাহ যেহেতু বোকা কিসিমের সুতরাং সে কিছুই বুঝতে পারে নি। বরং নিজের অজান্তে খুনীকে খুন করতে সহায়তা করেছে। না-হলে খুনীর সাথে সে বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড়ে যাবে কেন? সেখানে গিয়েছিল বলেই না খুনী তার গলায় ড্যাগার চালাতে পেরেছে।
শাহীন মাহমুদ যদিও ময়নাতদন্তের আগে হীরার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নন কিন্তু কেরামত আলী ব্যাপারটাকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, গাঞ্জুইট্টা ছেলেটার সম্পর্কে হীরার মন্তব্য কী—সেটা জানা দরকার। সে এ এলাকায় কতদিন এসেছে, কেন এসেছে, কী বলেছে—এসব তথ্য জানা দরকার। সুতরাং তাদেকে হীরার কাছে যেতে হবে।
হয়তো ছেলেটা এলাকায় কয়েকদিন রেকি করেছে। বশিরুল্লাহর সাথে খাতির জমিয়েছে। যখন খাতির জমানো ফাইনাল তখন তাকে গোপনীয় কিছু বলার নাম করে বাঁশঝাড়ে নিয়ে গেছে। গিয়ে গলায় ড্যাগার মেরে পালিয়েছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটেছে আর অতি অল্প সময়ের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে বশিরুল্লাহ।
এমন কি হতে পারে না—মজনু এই গাঞ্জুইট্টা ছেলেটাকে ভাড়া করেছিল তার পথের কাঁটা বশিরুল্লাহকে চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে?—হতেই পারে। নিজের প্রেম হাসিল করার জন্য প্রেমিকপুরুষ কি-না করতে পারে!
ঘটনা যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে এটা নিশ্চিত, এই খুনের সাথে পুতুলও জড়িত। কে জানে, হয়তো পুতুল ও মজনুর যোগসাজশেই ঘটনাটি ঘটেছে। সেক্ষেত্রে মজনু এবং পুতুলের সাথে কথা বলা দরকার। কিন্তু কে কথা বলবে? দারোগা বাবু ব্যস্ত। গোয়েন্দা প্রধান ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে না পেলে কাউকে জেরা করবেন না। তাহলে বশিরুল্লাহর খুনী ধরা পড়বে কীভাবে? আদৌ পড়বে কি? আলামত যা লক্ষ করা যাচ্ছে তাতে কেরামত আলীর যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে, এই খুনের তদন্তের ব্যাপারে। তার মনে হচ্ছে, একটা মামলা হবে, কিছুদিন তদন্তের কাজ চলবে, তারপর তা ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে থাকবে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে। দেশে এ-রকম অসংখ্য মামলা রয়েছে।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কেরামত আলী।
হঠাৎ তার মোবাইল বেজে উঠল। মালেকা বিবির ফোন।
সে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মালেকা বিবি বলে উঠল, ‘কী ব্যাপার—খালাবাড়ি গিয়ে দেখি আমার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছ…খুব মজা করছ তাই না?..তা তো করবেই…সাথে আমি নেই এখন তো তোমার পুরোটা দিন স্বাধীনতা দিবস!’
‘না না না, তুমি যা ভাবছ—ব্যাপার মোটেও সেরকম নয়।’
‘তবে কীরকম বল দেকিনি।’
‘এদিকে বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।’
‘দুর্ঘটনা! বল কি!’
‘হ্যাঁ, তোমাকে কেমন করে যে বলি ব্যাপারটা…আমার খালাতভাই বশিরুল্লাহ নেই।’
‘নেই মানে কী?’
‘মারা গিয়েছে।’
‘কী বলছ!’
‘হ্যাঁ, সে খুন হয়েছে!’
‘খুন! ওরকম ক্যাবলাকান্তকে আবার খুন করল কে?’
‘সেটাই তো প্রশ্ন মালেকা—আমিও একই কথা ভাবছি।’
‘দেখ দেকিনি। এদিকে আমি বাতের ব্যথায় ছটফট করছি আর তুমি পড়ে গেছ আর এক বিপদে। তা লাশ কি দাফন হয়েছে?’
‘আরে না—লাশ দাফন করার সাধ্যি কার? পুলিস কেস না? ওরা লাশ নিয়ে গেছে ময়না তদন্তের জন্যে।’
‘ও! তারমানে তো লম্বা হ্যাপা। তা তুমি এখ কী করবে? ওখানে থেকে যাবে নাকি বাসায় চলে আসবে? তোমাকে তো সবদিক সামলাতে হবে, নাকি? একদিকে বেশি সময় দিলে যদি আমি এদিকে পটল তুলে বসি তখন কী করবে?’
‘বালাই ষাট। তুমি পটল তুলতে যাবে কেনে? এমন অলক্ষুণে কথা ভুলেও মুখে আনতে নেই। আমি শীগ্রই চলে আসব। শুক্র-আর শনি—এই দুটো দিন তুমি একটু কষ্ট কর।’
‘ও বুঝতে পেরেছি—তুমি সম্পূর্ণ ছুটি কাটিয়েই তবে আসবে…এদিকে আমার লাশ যদি পিঁপড়ায় খেতে খেতে শেষ করেও ফেলে তাতেও তোমার ফেরার গরজ হবে না।’
‘আরে কী বলছ এসব—মালেকা? আমি কি কখনো তোমার ব্যাপারে কখনো অবহেলা করি? সবার আগে তুমি আমার প্রায়োরিটি। তারপর অন্যকিছু। এ-কথা তো তুমি খুব ভালো করেই জানো, নাকি জানো না?’
‘হয়েছে হয়েছে—ঘুষ দিয়ে আর ফোলাতে হবে না আমায়! তুমি ওখানেই থাকবে—এ আমি বুঝতে পেরেছি। আর এও বুঝতে পেরেছি—খুনের রহস্য বের না করে তুমি ফিরছ না।’
‘আহা আমি খুনের রহস্য বের করব কীভাবে? আমি কি পুলিস নাকি গোয়েন্দা? বলতে পারো—আমি আমার খালাকে সঙ্গ দিচ্ছি। বেচারি কাঁদতে কাঁদতে একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে। তার মুখ থেকে আর শব্দই বেরুচ্ছে না। চোখের জল শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন কাঁদছে বটে তবে চোখ থেকে আর জল বের হচ্ছে না।’
‘আহা! কী দরদি ভাগিনে তুমি! অথচ আমি সারারাত বাতের ব্যথায় ছটফট করি—তুমি কোনোদিন ফিরেও তাকাও না। এ-রকম দরদের ছিটেফাঁটা যদি কোনোদিনও দেখতাম!’
‘আল্লাহ ভরসা। কিচ্ছু হবে না। তুমি একদম নিশ্চিন্ত থাক তো!’
‘হ্যাঁ, আমার বেলায় আল্লাহ ভরসা আর খালায় বেলায় সঙ্গ দেওয়া। তা দাও। আমি কোনো আপিত্তি করছিনে। তবে একটা কথাই শুধু বলার আছে আমার—আর তা হল— শনিবারের মধ্যে বাসায় না ফিরলে ঢাকায় এসে আমায় আর পাবে না তুমি।’
‘তোমায় পাব না মানে?—তুমি কোথায় যাবে?’
‘দরজায় তালা মেরে আমি সোজা চলে যাব বাপের বাড়ি—তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল। এখন রাখি। আমার বাতের ব্যথা শুরু হয়ে গেছে।’—সঙ্গে সঙ্গে ফোনের লাইন কেটে দিল মালেকা বিবি।
কেরামত আলী বউয়ের সাথে কথা বলার পর কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ-মনুমেন্টের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে ধাতস্ত হল আর ভাবল, শুক্র আছে, শনি আছে। শনিবারের মধ্যে গেলেই ঘরে আগুন লাগবে না এবং যে-ভাবেই হোক, সে শনিবারে বাসায় যাবে।
(চলবে)