‘জালনোট চক্রের সন্ধানে’ – চতুর্থ পর্ব–

আগে যা ঘটেছে—

 

টিপু জালনোটের কারবারিদের ডেরা থেকে পালিয়ে বাড়িতে এসে অর্ক আর মৌ এর কথা জনিয়েছে। স্থানীয় থানায় বাড়ির পুরুষের খবর দিয়ে সেই মাটির ঢিবির দিকে রওনা হয়েছে। ইতিমধ্যে অর্কদের বাড়িতে মুক্তিপন চেয়ে ফোন এলে বাড়ির মহিলারা নার্ভাস হয়ে গিয়েছেন। পুলিশের এস পি পদ মর্যাদার অফিসার সহ আরও পুলিশ এসে গৌড়ের সেই মাটির ঢিবির ভিতরে তল্লাসী চালিয়ে একটি ল্যাপটপ কম্পিউটার উদ্ধার করেছে। পুলিশে খবর দেওয়ার অপরাধে মৌ আর অর্কের মুক্তিপনের অঙ্ক দ্বিগুন করে ফের অর্কদের বাড়িতে ফোন করেছে জালনোট কারবারিবা।

এরপর………

 

।। ৭ ।।

 

ঘুলঘুলি দিয়ে আলো দেখেই অর্ক বুঝেছিল পাশের ঘরে লোক রয়েছে। এই ঘরের একপাশে মৌ হাত বাঁধা অবস্থায় বসে রয়েছে। অর্কর হাত পিছন মুড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিয়েছে হরিয়া নামের লোকটি। বাইরে যে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে, অর্ক সেটা আন্দাজ করতে পেরেছে। এতক্ষনে অর্ক, মৌ ওঁদের যাঁরা বন্দি করে রেখেছে, সেই তিনজনের নাম জেনে গিয়েছে। মৌকে যে ঘরের ভিতরে ধরেছিল, তাঁর নাম হারুন। টিপুর পিছনে ঢিবির উপরে উঠে যে ধাওয়া করতে গিয়েও ধরতে পারেনি, তাঁকে দুলাল নামে ডাকতে শুনেছে অন্যজনের নাম সুলতান।

দুপুরে ওই সুরঙ্গ থেকে দড়ির মই বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করেও পারেনি অর্ক। সুলতান তাঁর ডান হাত চেপে ধরে টেনে ওই কৃত্রিম ঘরের ভিতরে টেনে নিয়ে বন্দি করেছিল। তখন দুলালকে উদ্দেশ্যে বলেছিল, ‘ওই ব্যাটা পালিয়ে গেলো। এটাকে ধরতে পারলাম। ছেলে মেয়ে দুটোকে বেঁধে রাখ।’ দুজনকে বেঁধে রেখে অন্যদিকে গিয়ে দুলাল টেলিফোনে কোন কথা বলে ফিরে এসে হারুনকে জানিয়েছে, ‘বস্‌কে সব ঘটনা ফোন করে জানিয়েছি। বস্‌ বলেছে, দুজনকেই ডেরায় নিয়ে যেতে।’

হারুন বললো, ‘পাশের আম বাগানের পিছনের জঙ্গলে গাড়ি রাখা আছে। আমাদের বেশি সময় এখানে নষ্ট করা ঠিক হবেনা। আমাদের এখুনি বেরিয়ে যাওয়া উচিত।’

ততক্ষনে দুলাল ফিরে এসেছে। টিপুকে যে সে ধরতে পারেনি, সেটা নিয়ে আফসোস করছিল। তিনজন তাড়াতাড়ি ওঁদের কাপড় জামা দিয়ে অর্ক আর মৌ এর চোখ আর মুখ বেঁধে দিল। সুলতান বাকি দুজনকে নির্দেশ দিল, ‘এখানে বাইরের দরজা বন্ধ করে দড়ির মই দিয়ে উপরে উঠে মই তুলে নেবো। আর গর্তের মুখ ফের মাটি চাপা দিয়ে চলে যাবো।’

প্রথমে ওঁদের কেউ একজন মৌকে কাঁধে তুলে নিয়েছিল। অর্কর চোখ বাঁধা থাকায় দেখতে পারছিল না। মৌ এর গলার চিৎকারে আন্দাজ করেছিল। মৌ অস্পষ্টভাবে বলছিল, ‘আমাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দাও। আমার ব্যাথা লাগছে।’ এরপরেই হারুনের ধমক শুনেছিল অর্ক।

‘এই মেয়ে চুপ কর। বেশি জোরে কথা বললে কিন্তু আরও শক্ত করে মুখ বেঁধে দেবো,’ গলাটা যে দুলালের ছিল, সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিল অর্ক। এরপরে অর্ককে ধরে কেউ শুন্যে তুলে নিলেও সে কোন কথা বলেনি। সে টের পেয়েছিল, দড়ির মই দিয়ে তাঁকে নিয়ে উপরে উঠছে সুলতান। হারুন দড়ি দিইয়ে উঠতে উঠতে বললো, ‘গাড়িটা সামনের দিকে নিয়ে এসেছিস তো !’

গাড়ি চালিয়ে ওঁদেরকে দূরের কোথাও নিয়ে এসেছে ওঁরা তিনজন। অনেকক্ষন গাড়ি চলার পরে ওঁদের নামিয়ে হাঁটিয়ে একটা বাড়ির ভিতরের ঘরে নিয়ে এলো সুলতান আর দুলাল। সুলতান আর দুলালই ওঁদের চোখ, মুখের বাঁধন খুলে দেয়। হারুন তখনই এসে খবর দিল, ‘বস্‌ এসেছে !’

অর্ক দেখলো, চেক লুঙ্গি পরে মোটা কালো চেহারার একজন এসে ঘরে ঢুকেছে। অর্কের দিকে তাকিয়ে কালো চেহারা নির্দেশ দিলো, ‘তোদের বাড়িতে কি ফোন আছে ? থাকলে ফোন নম্বর বল্‌ !’ বিকট চেহারার সঙ্গে কর্কশ গলার স্বর শুনে ঘাবড়ে গিয়ে অর্ক বাড়ির ল্যান্ড নম্বরটা বলে দিল।

ফোন নম্বরটা লিখে নিয়ে ‘বস্‌’ বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিন সাকরেদকে বলো, ‘এদের আটকে রাখা। খেতে দিস। এঁদের নিয়ে অন্য প্ল্যান মাথায় এসেছে। দেখিস যেন কোনভাবে পালাতে না পারে !’ ওদেরকে ঘরের ভিতরে বসিয়ে রেখে চারজনই বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজা বন্ধ করে দিল। আবার ঘর বন্দি হয়ে পড়লো মৌ আর অর্ক। এবার আবার অচেনা আজানা নতুন জায়গাতে। ঘরের ভিতরে এক কোনে একটা মোটা কাঠের ডান্ডা র‍্যেছে। শেটা নজর এড়ায়নি অর্কর।

এই ঘরের ভিতরে যে ইলেক্ট্রিকের আলো টিমটিম করে জ্বলছিল, সেটাও ওঁরা চলে যাওয়ার পরে নিবে গেলো। ওঁরাই নিবিয়ে দিল। দরজাও বাইরে থেকে বন্ধ। শুধু ঘুলঘুলি দিয়ে পাশের ঘরের যেটুকু আলো আসছিল, তাতে মৌ – অর্ক নিজেদেরকে ছায়ার মতো দেখতে পাচ্ছে শুধু।

 

।। ৮ ।।

কালিয়াচক এলাকার এই ঘরটি বেশ বড়সর। আধুনিক সব আসবাব দিয়ে সাজানো। দেওয়ালের একদিকে লাগানো রয়েছে বস বড় আকারের এলসিডি টেলিভিশন। ঘরের একদিকে এক পেল্লাই সাইজের টেবিলের ওপাশে রিভলবিং চেয়ারে বসে রয়েছেন সুলতানদের ‘বস্‌’ ইসমাইল হক। জাল নোতের কারবার, স্মাগ্লিং, ড্রাগস্‌ এর ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন তিনি। সেই টেবিলের অন্যদিকে চেয়ারে বসে রয়েছে, তিনজন। দুলাল, হারুন আর সুলতান। এই তিন জনকেই তাঁদের বস্‌ ইসমাইল হক ডেকে পাঠিয়েছেন। গৌড়ের মতো শান্ত সীমান্তের ধারের এলাকায় বস্‌ এর জাল নোট মজুদ করার ঠিকানা এই তিনজন বাচ্চা কিভাবে জানলো আর তাঁদের মধ্যে থেকে একজন কিভাবে তিনজনের ক্ষপ্পড় থেকে পালিয়ে বেঁচে পালালো, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। সবারই মুখ ভার। বস্‌ কিছুতেই মানতে চাইছে না, এই ঘটনায় দুলাল, হারুন বা সুলতানের কোন গাফিলতি ছিলনা। বসে্‌র বিশ্বাস, এই তিনজনের কোন গাফিলতিতেই তাঁর বহুদিনের নিরাপদ গোপন ডেরার খবর শেষ পর্যন্ত পুলিশের নজরে এলো। তার উপরে বস্‌ আরও ক্ষেপেছেন, যখন জানতে পেরেছেন, সব ‘নকলি্‌’ নোট সেখানেই রেখে এঁরা ওই দুই বাচ্চাকে নিয়ে কালিয়াচকে এসেছে।

‘বিশ্বাস করো বস্‌, আমাদের কোন দোষই নেই। কিভাবে যে তিনজন ওই সুরঙ্গের ভিতরে ঢুকে এলো, আমরা নিজেরাও বুঝতে পারছি না,’ বললো দুলাল।

সুলতান সঙ্গে বলে উঠলো, ‘আমরা তখন এতটাই নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম, এমনকি যে ছেলেটা পালিয়ে গেলো, তাঁকে ধরতে পিস্তল থেকে এক রাউন্ড গুলিও চালানো হয়েছিল। তারমধ্যেও ছেলেটা ভেগে গেলো।’

দুলালের কথাকে সমর্থন করে হারুন বললো, ‘বস্‌, আমি নিজে দু নম্বর গর্তের উপর মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে উপরে মাটি চাপা দিয়েছিলাম। কিন্তু তা সত্বেও ওঁরা কিভাবে ভিতরে ঢুকলো, এখনও ঘটনাটা ভাবতে অবাক লাগছে।’

ইসমাইল হক ক্রুদ্ধ চোখে তিনজনের দিকেই ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছেন। দুলাল- হারুনের পরে সুলতান বস্‌কে খুশি করতেই বলে উঠলো, ‘তবে বস্‌, এটা মানতেই হবে, যে আমরা দুজনকে ধরে ফেলেছি। যেটা পালিয়েছে, সেটা এতটাই ভয় পেয়েছে, যে মুখ খুলবে বলে মনে হয়না। তাছাড়া বস্‌, তোমার কথা মতো দুজনকে কালিয়াচকের অন্য ডেরায় যে সরিয়ে এসেছি, তা তো নিজের চোখেই দেখে আসলে। ওঁদের পাহারায় ইকবাল আর মইনুদ্দিনকে রেখেছি। তুমি কোন চিন্তা করোনা। কোন ঝামেলা হবে না।’

এতক্ষন চুপচাপ সব শুনছিলেন ইসমাইল হক। এবার ক্ষেপে   দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, ‘খুব বড় কাম করেছিস তোরা ! মাল ওখানেই রেখে এসেছিস। যদি পুলিশ নিয়ে ঐ ছেলেটা ফের যায়, কি হবে তোদের ধারনা আছে ! তোদের ওইদিন যে ল্যাপটপটা দিলাম, সেটা কোথায় ! ফেলে এসেছিল তো ! ওতে কি আছে জানিস। পুলিশ যদি ওটার খোঁজ পায়, তবে তোদের সাথে আমাকেও ভিতরে যেতে হবে। আর এই যা কেস দেবে না, বিশেষ করে কেস যদি ইডি নেয়, তাহলে তো আর কথাই নেই, আর বলছিস, বেফিকর থাকবো আমি !’

এবার কিছুটা শান্ত হয়ে ইসমাইল বলে ওঠে, ‘তার চেয়ে এক কাজ কর, যে টাকা ওঁই বাচ্চাদের বাড়িতে চেয়েছিস, সেটা দ্বিগুন বাড়িয়ে দে। একদিকের লোকসান অন্যভাবে তো পোষাতে হবে আমাকে ! আর পুলিশের থানাগুলোও হয়েছে এখন এক চিড়িয়াখানা ! আগে কোথাও কিছু করতে যাওয়ার আগে খবর দিত। এখন আর দেয় না। নকলি্‌ নোটের বিষয় নাকি এখন সব দিল্লি না কলকাতার অফিসাররা দেখভাল করে।’

দুলাল এবার আমতা আমতা করে বললো, ‘ কিন্তু বস্‌, ছেলে মেয়ে দুটোই মহা বিচ্ছু। ওঁদের নিয়ে কি করবো সেটা তো বলবে !’

ইসমাইল ভেবে বলে, ‘আজ রাতটা আটকে রাখ্‌। দেখছি কি হচ্ছে !!’

এবার কথা বললো সুলতান। দীর্ঘদিন বিহারের জেলে থাকার পরে ছাড়া পেয়ে কিছুদিন আগে মালদায় এসেছে ইসমাইলের হয়ে কাজ করতে। ও দুলালকে বললো, ‘ বস্‌এর কাছে তো ওদের বাড়ির টেলিফোন নম্বর আছে। এখান থেকেই আবার ফোন করে কুড়ি লাখকে চল্লিশ লাখ বলে চাপ দে। তবেই খেল জমবে। আমরাও কয়েকদিনের জন্য গা-ঢাকা দিতে পারবো। এদিকে নকলি্‌ নোটের কিসসা ঠান্ডা হতেই আবার ফিরে আসবো বসে্‌র কাছে।’

ওঁদের গা ঢাকা দেওয়ার বিষয়টা মনপুতঃ না হলেও ইসমাইল হক পাঞ্জাবির পকেট থেকে নম্বর লেখা কাগজটা দুলালের দিকে এগিয়ে দিলেন। বস্‌ টেবিলের ফোন সাধারনত ওঁরা ব্যবহার করেনা, কিন্তু এই বিষয়টা আলাদা বলে বস্‌ বিশেষ আপত্তি তুললেন না।

দুলাল টেলিফোনের নম্বর ডায়াল করলো। ততক্ষনে গৌড়ের সমীরবাবুর গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছে টিপুরা। ফোনের রিং হতেই ফোন তুললেন সমীরবাবু। আসলে সবাই টেলিফোনকে ঘিরেই এতক্ষন বসেছিলেন। যদি কোন খবর পাওয়া যায় পুলিশের পক্ষ থেকে ! দুলাল যতটা কঠিন গলা তাঁর পক্ষে করা সম্ভব, সেভাবে ‘বস্‌’এর শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলি আওড়ে গেল। কথা শুনে, শুধু ‘দেখছি’ বলে টেলিফোনের রিসিভারটাকে ক্রেডেলে রেখে দিলেন। ঘরে উপস্থিত সবাই তখন উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়ে রয়েছেন সমীরবাবুর দিকে। ‘আবার কি ওঁরা’, ‘কি বলছে আবার’- প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন ঘরে থাকা সবাই। সমীরবাবু এই ঘটনা গ্রামের আর পাঁচজনকে বলেননি। তাঁর মনে হয়েছিল, সেটায় বিপদ আরও বাড়বে। সমীরবাবু ঘরে উপস্থিত সকলের সামনে ফোনের ওপাড় থেকে শোনা কথাগুলো বলতেই ঘরে ফের গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো। ডুকরে কেঁদে উঠলেন অমিতাদেবী। সমীরবাবু সেই অবস্থাতেও মাথা ঠান্ডা করে নিজের বুক পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে থানার ও সি পরেশবাবুর নম্বরটা ডায়াল করলেন। বিকালেই থানার ও সি পরেশবাবু তাঁকে  নিজের ফেলফোন নম্বরটি দিয়েছিলেন। এখন সেটা কাজে লাগলো।

ওপাড়ে দুবার রিং হতেই পরেশবাবুর গলা পেলেন সমীরবাবু। প্রায় এক নিঃশ্বাসে মুক্তিপনের টাকা বেড়ে যাওয়ার সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন আমরা কি করবো ! এতটাকা এভাবে এখুনি জোগাড় করা আমাদের কারোর পক্ষেই সম্ভব না। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না !’ পরেশবাবু সমীরবাবুকে আস্বস্ত করে বললেন, ‘একটু ধৈর্য্য ধরুন। পুলিশের উপরে একটু ভরসা রাখুন। আশাকরি,আমরা কিছু একটা করতে পারবো। আমি কিছুক্ষন পরে আপনাকে রিংব্যাক করছি।’

 

(আগামীকাল শেষ পর্ব)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত