কালিপূজোর দিন দুপুরে খাওয়ার টেবিলে মেসো বললেন, ‘চলুন শংকরদা, আগামীকাল আপনাদের গৌড় ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।’ ইতিহাসের বইতে বাংলার প্রাচীন রাজধানী হিসাবে গৌড়ের নাম পড়েছিল টিপু। সে কলকাতার একটি ইংরেজি স্কুলের ক্লাস ফাইভের ছাত্র। ভাইফোঁটায় ওঁরা বেড়াতে এসেছে মাসির বাড়ি মালদায়। টিপুর মেসো উত্তম দাস মালদার এক গ্রামের হাইস্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক। পূজোর সময় মাসি মেসোর সঙ্গে মাসতুতো বোন মৌ কলকাতায় টিপুদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। তখনই ঠিক হয়, কালিপূজোর সময় টিপুরা মালদায় ঘুরতে আসবে। মৌ সায়নকে ভাইফোঁটা দেবে।
ভোরের ট্রেনে বাবা মার সঙ্গে টিপু মালদায় এসে পৌঁছেছে। খুব ছোটবেলায় কয়েকবার মালদায় মাসির বাড়ি এলেও সেই কথা এখন মনে নেই টিপুর। মাসতুতো বোন মৌ টিপুর এক বছরের ছোট। মালদার একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলের ক্লাস ফোরের ছাত্রী। বেশ কয়েক বছর বাদে টিপুর সাথে মৌ এর দেখা হয়েছিল কলকাতায়। এবার পূজোর সময়। তখন থেকে দুজনের বন্ধুত্ব জমে ওঠে। পূজোয় বড়দের সঙ্গে থেকেও মৌ আর টিপু আনন্দে মেতে উঠেছিল নিজেদের মতো করে। মৌ সেসময় নিজেই টিপুকে প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘দাদা, তোকে ভাইফোটা দেব এবার। তোরা মালদায় আমাদের বাড়িতে আসবি?’
টিপু এই কথা দূর্গাপূজোর নবমীর সকালে তুলেছিল মাসি, সেসো , মৌ এর সামনেই নিজের বাবা মার কাছে। মৌ এর জেদ, আর মাসি মেসোর অনুরোধ টিপুর বাবা শংকর চৌধুরি ফেলতে পারেননি। বলেছিলেন, ‘আমি তো ব্যবসায়ী। আমার তো আর অফিসের ছুটি নেওয়ার ব্যাপার নেই। কিন্তু টিপুর স্কুল তো খুলে যাবে !’
ভাইফোটার রাতে মালদা থেকে কলকাতা ফেরার ট্রেনে চাপলে যে টিপুর স্কুল কামাই হবেনা, সেটা আলোচনায় উঠে এলে শংকরবাবু শেষে রাজি হয়েছিলেন।
মালদায় কালিপূজোর রাতে মৌদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন উত্তমবাবুর স্কুলের কলিগ সমীরবাবু। পরের দিন ওঁদের গৌড় ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা শুনে তিনি তাঁর বাড়িতে দুপুরের খাওয়ার নেমন্তন্নও করে গেলেন। তাঁর বাড়ি মালদা থেকে গৌড় যাওয়ার পথেই পড়ে আর সেই জায়গা গৌড়ের খুব কাছেই এবং প্রায় বাংলাদেশের বর্ডার লাগোয়া। ওখানে গেলে গৌড়ের সাথে ওঁরা বাংলাদেশের বর্ডারও দেখে নিতে পারবে বলে কেউ আর আপত্তি করলো না।
।। ২।।
কালীপুজোর পরদিন খুব সকালে ভাড়া করা স্করপিও গাড়িতে চেপে ঘুরতে বেড়িয়েছিল টিপুরা। মালদার কিছুদূরের আদিনার ডিয়ার পার্কের হরিণ, পরিযায়ী পাখি, পান্ডুয়ার পুরানো মসজিদ দেখে এগারোটা নাগাদ টিপুরা পৌঁছেছিল গৌড় এ। গতরাতে মালদার কিছু কালিপুজোর প্যান্ডেল ঘুরে দেখেছিল টিপুরা। তার আগে মাসির বাড়ির সামনের খোলা জায়গাতে মৌ আর টিপু যথেষ্ট বাজি পুড়িয়েছে।
সকালে যখন ভাড়া গাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য রওনা হচ্ছিল, টিপুকে ড্রাইভারের পাশে উত্তমবাবুর সঙ্গে বসতে বলেছিলেন বাবা। কিন্তু টিপু রাজি হয়নি। সে গাড়ির পিছন দিকে মৌ এর মুখোমুখি বসেছে। সারা রাস্তা গল্প করেছে দু-জনে। মাঝের সিটে বসেছেন টিপুর মা অমিতাদেবী, মাসি সুমিত্রা দেবী আর বাবা শংকরবাবু।
টিপুর মেসো উত্তমবাবু ইতিহাসের শিক্ষক হওয়ার কারনে মালদার পুরানো দিনের নানা কাহিনী বলছিলেন। সবই ঐতিহাসিক নানা ঘটনা। অমিতাদেবী আর সুমিত্রাদেবী ব্যস্ত নিজেদের সাংসারিক আলোচনায়। টিপুর মেসো বলে জাচ্ছিলেন, ‘জানেন তো, গৌড় অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল পুন্ড্রবর্ধন রাজ্য। ৬০২ খ্রীষ্টাব্দে রাজা শশাঙ্ক এই রাজ্য তৈরি করেন। সেসময় তার রাজধানী ছিল কর্নসুবর্নে’। উত্তমবাবুর কথা কতটা মন দিয়ে শংকরবাবু শুনছেন, সেটা বুঝতে বারবার পিছনে মাথা ঘুরিয়ে দেখে দেখে বললেন, ‘বুঝলেন তো শংকরদা, শশাঙ্কের মৃত্যুর অনেক পরে গোপালদেব রাজধানী তৈরি করেন গৌড়ে। ধর্মপাল, দেবপালের পরে ১১২০ খ্রীষ্টাব্দে রাজা রামপালের মৃত্যুর পরে গৌড়ের দখল যায় সেনবংশের হাতে। ১২০২ সালে শেষ হিন্দু রাজা লক্ষন সেনের আমলে এই গৌড়ের দখল নেন বখতিয়ার খিলজি। হিন্দু রাজের অবসান হয়।’ উত্তমবাবু জানালেন, ‘এখন গৌড়ে যে স্থাপত্য নিদর্শংনগুলি দেখা যায় তা সবই নবাবদের আমলের।’
গৌড় পৌঁছনোর গাড়িটিকে একটি পুকুরের ধারে থামাতে বললেন উত্তমবাবু। এবার সবাইকে গাড়ি থেকে নীচে নামার কথা বলে শুরু করলেন, ‘চলুন, নেমে দেখে নিন জায়গাটা। এই পুকুর আগে ছিল একটি বড় দিঘী। এর নাম ছিল পিয়াসবারি’। গাড়ির সবার সঙ্গে নীচে নেমে এলো মৌ, টিপু। মেসো টিপুকে বললেন, ‘বুঝলে টিপুবাবু এই গৌড়ের এক সম্রাট ছিলেন, তাঁর নাম ছিল নসরৎ শাহ। তিনি ছিলেন ভয়ংকর রকমের নিষ্টুর। এই দিঘীর ধারে একটি বাড়ি ছিল। সেখানে বন্দি করে রাখতেন অপরাধী বা রাজদ্রোহীদের। যেসব বন্দিকে তিনি মৃত্যুদন্ড দিতেন, তাদেরকে অদ্ভুতভাবে সাজা দেওয়া হতো।’
টিপু কৌতুহলে জানতে চাইলো, ‘তাঁদের হত্যা করে কি দিঘীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হতো, না জলে ডুবিয়ে হিত্যা করা হতো ?’
‘না, না, মৃত্যুদন্ড ছিল অদ্ভুত রকমের।’
‘কি রকম ?’
উত্তমবাবু টিপুর কৌতুহল দেখে একটু খুশিই হলেন। বললেন, ‘যাঁকে সম্রাট মৃত্যুদন্ড দিতেন, তাঁকে আকন্ঠ মিষ্টি খাওয়ানো হতো। কিন্তু কখনই এক ফোঁটা জল বন্দিকে দেওয়া হতোনা। তারপর বন্দি করে রাখা হতো সেই বাড়ির একটি ঘরে। সেই ঘর থেকে খুব কাছেই ছিল দিঘীর জল। আকন্ঠ মিষ্টি খেয়ে বন্দি জল পিপাসায় কাতরাতো। চোখের সামনে এক দিঘীর টলটলে জল দেখতে পেলেও সেই জলের নাগাল পাওয়া দুঃসাধ্যের ব্যাপার ছিল। জলের পিপাসায় কষ্ট পেয়ে অবশেষে মারা যেত সেই বন্দি।’
গল্পটা শুনে টিপুর মা অমিতাদেবী মন্তব্য করলেন, ‘বড় অদ্ভুত তো ঘটনাটি !!’
উত্তমবাবু বললেন, ‘ তা হলে আর বলছি কি দিদি ! গৌড়ের ইতিহাস কিন্তু বেশ রহস্যময় ! এখানে মুসলিম শাসন যেমন ছিল, তেমনই বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবও ভালো ছিল। স্বয়ং চৈতন্যদেব ১৫০৬ সালে বৃন্দাবন যাওয়ার পথে এই গৌড়ে এসেছিলেন। এখনও রামকেলি গ্রামে সেই চিহ্ন রয়েছে। গৌড় থেকে মালদায় বাড়ি ফেরার পথে আমরা রামকেলির সেই জায়গা হয়েই না হয় ফিরবো।’
(চলবে)