জারোয়াদের জঙ্গলে – পর্ব – ৪

আগে যা ঘটেছে —

 

( আন্দামানে গিয়ে টিটো তাঁর জারোয়া বন্ধু ওহামের বাড়ি অর্থাৎ চাড্ডায় বেড়াতে গিয়েছে। সেখানে ওহামের মাএর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে টিটোর। সেদিন টিটো সঙ্গে করে তাঁর মাউথ অরগানটা নিয়ে গিয়ে ওহামেকে দেখিয়েছে, মাউথ ওরগানে কিভাবে শব্দ করতে হয়। ওহামে জারোয়া পদ্ধতিতে সেদ্ধ করা শুয়োরের মাংস টিটোকে খাওয়ানোর চেষ্টা করেও পারেনি। টিটো দেখে এসেছে, আন্দামানের দ্বীপে জারোয়ারা কিভাবে রান্না করে আর কি পদ্ধতিতে খায়। এরপর …………)

 

 

 

।। ৮ ।।

 

এদিকে মেডিক্যাল ক্যাম্প থেকে টিটো তাঁর জারোয়া বন্ধু ওহামের সঙ্গে জঙ্গলের ভিতরে ঘুরতে যাওয়ার ঘটনায় হীরুর মনে  হলো, সে যদি কোন জারোয়ার বাড়িতে না যেতে পারে, তবে টিটো ওঁর চেয়ে অভিজ্ঞতায় অনেকটাই এগিয়ে যাবে। সেই ব্যাপারটা ভালোভাবে মেনে নিতে পারছিল না হীরু। সে সোজা রহিতদার কাছে গিয়ে  প্রস্তাব দিল, সেও জারোয়াদের বাড়ি ঘুরে দেখতে যাবো। হীরুর কথা শুনে রহিতদা পড়লো আকাশ থেকে। কোন জারোয়ার সঙ্গে সে হীরুকে পাঠাবে জারোয়াদের চাড্ডায়। আর হীরুর এই কয়েক দিনের আচরন দেখে মুখে কিছু না বললেও রহিতদা মোটেও সন্তুষ্ট ছিলনা হীরুর উপরে। হীরু জারোয়াদের চাড্ডায় গিয়ে কোন গন্ডগোল পাকাতে পারে, এই আশঙ্কাতেই হীরুকে রহিতদা বললো, “ তুই এবিষয়ে প্রনবেশবাবুর সঙ্গে কথা বল। প্রনবেশবাবুই তোকে বলতে পারবেন কোনো পরিচিত জারোয়ার সঙ্গে তোকে জঙ্গলের ভিতরে পাঠানো যায় কি না ! ”

হীরু গিয়ে এবার দেখলো, প্রনবেশদা কয়েকজন জারোয়ার চিকিৎসা নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে রয়েছে। জারোয়াদের দেখে মনে হলো, খুব সম্ভবত এই অসুস্থ জারোয়ারা পেটের কোন অসুখে ভুগছে। প্রনবেশদাকে হীরু কিছু বলে ওঠার আগেই হীরুর দিকে তাকিয়ে প্রনবেশদা বলে উঠলেন, “ দেখো হীরু, আমাদের কি ধরনের কাজ করতে হয় ! এঁদের সাবধান করলেও শোনেনা। নোংরা জল তো খায়ই, তা ছাড়াও এঁদের বাসি খাবার খাওয়ার একটা প্রবনতা এঁদের মধ্যে রয়েছে। আমরা এত করে জারোয়াদের এখানে এসে বোঝাচ্ছি, তবুও কথা শুনছে না ! শুধু শুধু পেটের অসুখে পড়ছে !”

এদিকে প্রনবেশবাবু হীরুর জারোয়া গ্রামে ঘুরতে যাওয়ার জেদ নিয়ে কি করলেন, সেটা দেখতে রহিতদা এগিয়ে এসেছে ওঁদের কাছে। অসুস্থ জারোয়াদের দেখেই জারোয়া ভাষাতে রহিতদা কি যেন জিজ্ঞাসা করলো। জারোয়ারা সবাই একসঙ্গে কি যেন বলতে রহিতদা প্রনবেশবাবুকে বললো, “ আসলে এঁরা জঙ্গলের এলাকাতে খালি পা-এ ঘোরার কারনে কুমিরের সিস্ট এঁদের পা- এর নীচ দিয়ে শরীরের ভিতরে ঢুকে গিয়ে পেটের অসুখ বাঁধাচ্ছে। এঁদেরকে বরঞ্চ নিষেধ করে দিচ্ছি, কুমির রয়েছে বা কুমির ঘোরাঘুরি করে, এমন জায়গা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতে।”

রহিতদার কথা শুনে প্রনবেশবাবু বললেন, “ স্যর, গোটা আন্দামান সাগর এলাকাতেই কুমির ঘোরাঘুরি করে। এঁরা কি আপনার এই কথা মেনে চলবে কিভাবে। শিকারের খোঁজে তো এঁদের নানা জায়গাতেই যেতে হয়। সেই কারনে বলছি, কুমিরের সিস্ট এড়িয়ে চলা জারোয়াদের পক্ষে অসম্ভব। দেখি, ওষুধ দিয়ে আপাতত এঁদের পেটের অসুখটা সারানো যায় কি না। ”

“দেখুন, যেটা ভালো বোঝেন”, বললো রহিতদা, “ তবে, এই মুহুর্তে হীরুর কথা নিয়ে ভেবে দেখুন, ওঁকে কি জারোয়াদের চাড্ডাতে যেতে দেওয়া ঠিক হবে কি না ! আর তাছাড়া, কোন জারোয়ার সঙ্গেই বা হীরুকে জারোয়াদের গ্রামে পাঠাবেন !”

রহিতদা আর প্রনবেশবাবু- দুজনের কথাই মন দিয়ে শুনছিল হীরু। প্রনবেশবাবু কোন উত্তর দেওয়ার আগেই সে বলে উঠলো, “আমার পরিচিত এক জারোয়া যুবক তো এখানে রয়েছে। যদিও তাঁর সঙ্গে আমার কোন কথা হয়নি। আসলে আমি তো জারোয়াদের ভাষা ঠিকমতো বুঝিনা। তাই ওঁর কোন কথার জবাব দিতে পারিনি। তবে ওঁর আচরন দেখে আমার মনে হয়েছে, সে আমাকেও বন্ধু বলে মনে করেছে। সব কথাই হয়েছে আকার ইঙ্গিতে। তোমরা কেউ যদি তাঁকে জারোয়া ভাষায় ব্যাপারটা বুঝিয়ে দাও, আমার মনে হয়, সে তোমাদের প্রস্তাব ফেরাবে না। ”

“কে সেই জারোয়া ছেলেটি ?” রহিতদা হীরুকে জিজ্ঞাসা করলো।

“ ওই তো ওদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে !” হীরু আঙ্গুল তুলে দেখালো একদল জারোয়াদের দিকে। রহিতদা আর প্রনবেশদা একসঙ্গে হীরুর দেখানো জারোয়াদের দিকে তাকালেও ঠিক ঠাওর করতে পারলেন না। বিষয়টা আন্দাজ করে হীরু নিজেই এগিয়ে গেল, জারোয়া দলটির দিকে। এক জারোয়া যুবকের সমনে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে রহিতদাদের দেখালো। আর ইশারাতে বোঝাতে চাইলো, যে রহিতদারা ওঁকে ডাকছেন।

হীরুর ইশারা দেখেও জারোয়া যুবকটি তেমন পাত্তা দিল বলে মনে হলো না প্রনবেশবাবুর। হীরু জারোয়া ছেলেটিকে সঙ্গে করে নিয়ে না আসতে পেরে, কিছুটা হতাশ হয়ে ফিরে এসে রহিতদাকে জানালো, “ ছেলেটি হয়তো আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছে না ! তুমি একটু গিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলো না ! প্লিজ। ”

প্রনবেশবাবু যে জারোয়াগুলোর পেটের রোগের চিকিৎসা করছিলেন, তাঁদের মধ্যে থেকে একজনকে জারোয়া ভাষায় কিছু বলতে, এবার সে জারোয়া দলটির দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলে সঙ্গে করে সেই ছেলেটিকে নিয়ে এলো। রহিতদা দেখলো, এই দু-দিন, যে জারোয়া যুবকটিকে হীরুর পাশে দেখেছে, এই যুবকটি সেই। এবার ওই ছেলেটির সঙ্গে রহিতদা আর প্রনবেশবাবু কিছুক্ষন জারোয়া ভাষাতে কি যেন কথা বললো। হীরু আন্দাজ করতে পারলো, প্রথমে রাজি না হলেও, হয়তো রহিতদাদের বোঝানোয় সে সেই কথাতে সন্মতি দিল। প্রনবেশবাবু জারোয়া ছেলেটিকে আঙ্গুল দিয়ে হীরুকে দেখিয়ে দিতে জারোয়া ছেলেটি ওঁর দিকে তাকিয়ে হাসলো। হীরু নিশ্চিন্ত হলো, কাজ হয়ে গিয়েছে। জারোয়াটি ওঁকে নিজের এলাকাতে মানে বাড়িতে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছে। হীরুও পালটা হেসে জবাব দিল।

রহিতদা এবার হীরুকে সাবধান করে বললো, “ না গেলেই কি নয়, হীরু ?”

“কেন জারোয়া গ্রামের ভিতরে গেলে কি হবে রহিতদা ! টিটোও তো একজন্য জারোয়া ছেলের সঙ্গে ওঁদের গ্রামে ঘুরতে গেল !”

প্রনবেশদা এবার হেসে বলে উঠলেন, “ও এটা বুঝি টিটোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা !”

তবে রহিতদা হীরুকে বারবার সাবধান করে বলতে থাকলেন, “ আমার খুব একটা ইচ্ছা নেই তোকে ওঁর সঙ্গে জারোয়াদের গ্রামের ভিতরে পাঠানোর। কিন্তু এত জেদ করছিস যখন, তখন একবার ঘুরে আয় ! আর আমি তো জানি, এই অভিজ্ঞতা তোর আর এই জীবনে দ্বিতীয়বার হবে না। সে কারনে মাসির এত নিষেধ সত্বেও তোকে আর টিটোকে দু’বার জারোয়া দ্বীপে নিয়ে এসেছি। আমার মান রাখিস, এই টুকুই শুধু তোর কাছে আমার রিকোয়েষ্ট। আর আবার সাবধান করছি, জারোয়া গ্রামে গিয়ে কোন গন্ডগোল করবি না ! ওঁরা এমনিতে যথেষ্ট নীরিহ। কিন্তু ওদের পছন্দ হয় না, এমন কাজ বা আচরন ওঁরা কিন্তু বরদাস্ত করেনা। কথাটা সব সময় খেয়াল রাখবি ! আর টিটো যে জারোয়া গ্রামে গিয়েছে, তাতে তোর হিংসের কি আছে রে ! তুই তো বয়সে টিটোর থেকে বয়সেও বড়। যাইহোক, এই সুযোগ হাতছাড়া হলে আর পাবি না বলে তোকে জারোয়া গ্রামের ভিতরে যাওয়ার পারমিশন দিলাম। কোন যেন গণ্ডগোল না হয়, সেটা আবারও বলে রাখছি। ”

“শোন হীরু” এবার বললেন প্রনবেশদা, “ওঁরা কিছু খেতে দিলে কিন্তু খাবেনা। মধু দিলে অবশ্য আলাদা কথা। এর আগের দিন তো তোমরা মধু খেয়েছো। শুধু দেখবে, আর ফিরে চলে আসবে ! কোন বিষয়ে জড়াবে না ! আর কোন প্রানীকে মারার চেষ্টা কোরো না ! জঙ্গলে কিন্তু ভয়ানক সব প্রানী রয়েছে। সাপ বা জোঁক থেকেও কিন্তু সাবধান !”

হীরু খুশি হয়ে মজা করার জন্য বললো, “তবে কি জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে আমি ডায়নোসরের দেখা পাবো ! কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। আমি ঠিকমতোই ফিরে আসবো। শুধু জারোয়াদের গ্রাম্য জীবনের লাইফ স্টাইল না দেখলে, কলকাতায় কলেজের বন্ধুদের কাছে আর কি গল্প করবো ! সেই জন্যই জারোয়া গ্রামের ভিতরের পরিবেশ দেখার এত ইচ্ছা !”

রহিতদা হীরুকে ফের বললো, “একদম দেরি করবি না। যাবি, দেখবি আর ঘুরে চলে আসবি ! আমাদের কিন্তু ফিরে যেতে হবে, সেটা যেন খেয়াল থাকে ! আমি অবশ্য জারোয়া ছেলেটিকেও ফিরে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কথা বলে দিচ্ছি !”

রহিতদা জারোয়া ভাষাতে জারোয়া ছেলেটির সঙ্গে কথা বলার পরে হীরুর ডানহাত ধরে নিয়ে জারোয়া ছেলেটি জঙ্গলের দিকে এগিয়ে চললো। হীরু পিছনে তাকিয়ে দেখলো, নিজেদের কাজ ছেড়ে রহিতদা, প্রনবেশবাবু ওঁর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

জারোয়া ছেলেটি হীরুর নাম আগেই জেনেছিল। একটু আগেও রহিতদা ওঁকে হীরুর নাম বলে দিয়েছে। জারোয়া ছেলেটি হীরুকে ডাকছে ‘হীয়ু’ নামে। হীরু ভাবলো,  আগের দিনও তো ওঁকে এই নামেই জারোয়াদের এই জারোয়া ছেলেটি ডেকেছিল। হয়তো জারোয়া ভাষায় হীরু কথার উচ্চারন হীয়ু। যাইহোক, হীরুও জারোয়া ছেলেটির সঙ্গে জঙ্গলের ভিতরের দিকে এগিয়ে চললো।

জঙ্গলের এই এলাকায় গাছ খুব বড়। মাথার উপর গাছগুলির ঘন পাতার ছায়ার কারনে সূর্যের আলো মাটি পর্যন্ত ঠিকমতো এসে পৌঁছচ্ছে না। তবে ঘন অন্ধকার নয়। ছায়া ঘেরা রয়েছে এই জঙ্গলের এলাকা। এখানে রাস্তা বা পা-এ হাঁটা পথ বলতে  কিছুই নেই। জারোয়া ছেলেটি  নিজের মনে জারোয়া ভাষায় কি যেন বলে চলেছে। হীরুর মনে হলো, ছেলেটি যেন কিছুটা নিজের অমতে তাঁকে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছে। যদিও ছেলেটি ওঁর সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোন খারাপ ব্যবহার করেনি।

ঘন জঙ্গলের মধ্যে ছেলেটির হাতে উঠে এসেছে ধারালো একটা ছুরি। হয়তো এটা আগে থেকেই ওঁর কোমড়ে গোঁজা ছিল। হীরুর চোখে পড়েনি। এই ছুরির সাহায্যে জারোয়া ছেলেটি বড় বড় গাছের জঙ্গলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লতাপাতাগুলো কেটে যাওয়ার রাস্তা করে নিচ্ছে। ওঁর পিছনে পিছনে সেই পথ দিয়েই চলেছে হীরু। তবে যেতে হীরুর কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এভাবে তাঁরা বেশ কিছুটা এলাকা জঙ্গলের ভিতরে চলে এসেছে। হীরুর যে খুব একটা ভয় করছিল, তা নয়। এমনিতেই তাঁর নিজের ভয় অনুভুতিয়াই কম। তবে আন্দামানে আসার সময়েও সে যে এভাবে জারোয়ার সঙ্গে একা একা গভীর জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতে পারার সুযোগ পাবে, সেটা তাঁর নিজের কাছেও কল্পনার বাইরে ছিল। যদি না আজ টিটো তাঁকে কিছু না জানিয়ে জারোয়া ছেলেটির সঙ্গে জঙ্গলের ভিতরে জারোয়াদের নিজেদের গ্রাম দেখতে না যেত, তবে হয়তো তাঁর নিজেরও মাথায় এই পরিকল্পনা আসতো না। টিটো জারোয়া গ্রামের ভিতরে যাবে, আর ওঁ নিজে কি দ্বীপে এসেও সমুদ্রের ধারে রহিতদাদের মেডিক্যাল ক্যাম্পে অসুস্থ জারোয়াদের দেখবে আর বসে বসে কলা খাবে ! টিটোর এত সাহস, যে এক জারোয়া ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে সেই ছেলেটির সঙ্গে জারোয়াদের গ্রামে ঘুরতে চলে গেল ! একবার তাঁকে বলে যাওয়ার প্রয়োজন  পর্যন্ত মনে করলো না ! হীরু না এলে কি টিটো এই আন্দামানে আসতে পারতো ! টিটোর মা তো রাজিই হচ্ছিলেন না, টিটোকে আন্দামানে আসতে দিতে। হীরুকে সঙ্গে পাহারায় দিয়ে তবেই নিজের ছেলেকে পাঠিয়েছেন টিটোর মা ! আর সেই টিটো ! এখানে এসে সব ভুলে গিয়ে হীরুদাকে এতটা অবহেলার বস্তু করে তুললো ! এটা কিভাবে মেনে নেবে সে !

আর সে নিজেও কি কম নাকি ! জারোয়াদের গ্রামে টিটোকে রওনা হতে দেখেই, নিজেই রহিতদাকে গিয়ে গ্রাম ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। জারোয়াদের নিয়ে সে নিজে প্রচুর পড়াশোনা করেছে। টিটো তো এসবের কিছুই পড়েনি। জানেই না কিছু জারোয়াদের সম্পর্কে। আর সে কি না জারোয়া গ্রামে একা একা ঘুরে এসে ওঁর কাছে সে বিষয়ে গল্প করবে ! টিটোর এত বড় আস্পর্দ্ধা কি মেনে নেওয়া যায় ! আর রহিতদারাও যেমন, টিটোর বেলায় জারোয়া গ্রামের ভিতরে ঘুরতে যাওয়ার বিষয়ে একবারের জন্যও নিষেধ করলো না ! সব নিষেধাজ্ঞা, সব কি তাঁর নিজের ব্যাপারে !

চক্রান্ত ! সব চক্রান্ত !! আসলে রহিতদারা কেউ চায়নি, হীরু জারোয়া গ্রাম ঘুরে এসে অভিজ্ঞতা অর্জন করুক ! সেই চক্রান্তের শিকার সে ! আসলে টিটোর সঙ্গে রহিতদার রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। ওঁর সঙ্গে সেসব তো কিছু নেই। হতে পারে, টিটোই রহিতদার কাছে তাঁর সম্পর্কে নানা খারাপ কথা বলে কান ভারী করেছে। যে কারনে আজ হীরু যখন জারোয়া গ্রামে আসতে চাইলো, নানা ভাবে তাঁকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এভাবে চক্রান্ত করে তাঁকে চুপ করিয়ে রাখা কি সহজ কথা ! তাঁর নিজের বুদ্ধি আছে না ! সেই বুদ্ধির জোরেই তো এখন সে এই গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলেছে এক জারোয়া যুবকের সঙ্গে জারোয়া গ্রাম দেখতে !

 

 

 

।। ৯ ।।

 

ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই ধরনের ফাঁকা এলাকা দেখে হীরু অবাক হয়ে গিয়েছে ! ঘন জঙ্গলের ভিতরের এই ফাঁকা প্রায় পরিস্কার জায়গাতে তবে জারোয়ারা থাকে ! এখানেই নিজস্ব ডেরা তৈরি করে ! নিজেদের রাত্রে থাকার জন্য তৈরি করে নিয়েছে গাছের শুকনো ডালপাতা দিয়ে কয়েকটি ছোট ছোট তাঁবুর মতো জায়গা। এগুলোকে চাড্ডা বলে, সেটা হীরু আগেই রহিতদার কাছ থেকে শুনে এসেছিল। আজ নিজের চোখে দেখলো জারোয়াদের তৈরি সেই চাড্ডা। এটাও একটা বড় অভিজ্ঞাতা হীরুর কাছে। সে জারোয়াদের নিয়ে যে এত নানারকম বই গত কয়েক দিন যাবৎ পড়ছে, সেখানে এই চাড্ডার কোন বিষয়ের কোন উল্লেখ সে পায়নি। আসলে তাঁর পড়া বইগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল, জারোয়াদের আদি বংশ নিয়ে লেখা বিভিন্ন পর্যটকদের লেখা। সেখানে জারোয়াদের উৎপত্তিস্থলের সম্পর্কে নানা কথা বা পর্যটকদের নিজস্ব চিন্তা ভাবনার কথা লেখা থাকলেও জারোয়ারারা আন্দামানের বিভিন্ন দ্বীপের ঘন জঙ্গলের ভিতরে কি ভাবে জীবনযাপন করে, সেকথার কোন উল্লেখ নেই।

রহিতদাকে রাজি করিয়ে এই এলাকাতে না এলে হীরু জানতেই পারতো না, জারোয়াদের জীবনযাত্রার এই দিক গুলো। হীরু মনে মনে ভাবলো, তাঁর মস্ত ভুল হয়েছে, আন্দামান আসার সুযোগ যখন পেয়েছিল, নিজেই জানতে পেরেছিল, টিটোর সঙ্গে রহিতদার কাছে তাঁরা ঘুরতে যাচ্ছে, আর রহিতদা নিজেই জারোয়াদের নিয়ে কাজ করে, তখন জারোয়া ভাষা শেখার জন্য বই পড়ার। হয়তো কলকাতায় কলেজ স্ট্রীটে গিয়ে খুঁজলে পেলে পেতেও পারতো। মনে বড় আফসোস হলো, নিশ্চয়ই এই সম্পর্কে বই মিললেও মিলতে পারতো। খুঁজে দেখতে তো আর কোন দোষ ছিল না কলেজ স্ট্রীটের বই এর দোকানগুলোতে। লোকে কথায় বলে, কলকাতায় চাইলে নাকি বাঘের চোখও পাওয়া যায় ! এখন আর আফসোস করে লাভ কি ! যদি আজ হীরু নিজেই জারোয়া ভাষার বই পড়ে কিছুমাত্র আয়ত্ত করতে পারতো, তাহলে কি আজ রহিতদার পারমিশনের জন্য ওঁকে এত অনুরোধ করতে হতো ! আর সেই জায়গাতে হীরু পড়েছে কি না, জারোয়াদের নিয়ে লেখা নানা তাত্বিক ধরনের বই। যেগুলোর সঙ্গে বাস্তবের জারোয়াদের কোন মিলই নেই। আর নিজে জারোয়া ভাষা জানলে কিংবা বুঝতে পারলে, জারোয়াদের সম্পর্কে কতটা বেশি জ্ঞান নিতে পারতো ! কিন্তু এখন তো আর এসব ভেবে কোন লাভ নেই ! দীর্ঘশ্বাস ফেললো হীরু।

বই পড়ে কোন অজানা ভাষা বলা যে খুব একটা সহজ নয়, হীরু সেটা জানে। কলকাতায় একবার সে ফরাসী ভাষা শেখার জন্য এক বন্ধুর পাল্লায় কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিল। সেখানে বেশ কয়েকদিন ট্রেনিং এর পরে ভাষার কয়েকটা শব্দ বুঝলেও ফরাসী ভাষা বলা যে তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব সেটা সে ভালো করেই বুঝে গিয়েছিল। আর ধৈর্যতে কুলোয়নি। কয়েকদিনের মধ্যেই যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, সেই ফরাসী ভাষা শেখানোর কোচিং সেন্টারে। বেশ কিছু টাকা গচ্চা গিয়েছিল। বাড়িতে সেই ব্যাপারটা যে কিভাবে ম্যানেজ করেছিল, সেটা হীরুই জানে ! তাই এখন ওঁর আফসোস হচ্ছে, কেন  জারোয়া ভাষা শেখার বই কেনার খোঁজ সে কলকাতার কলেজ স্ট্রীটে করলো না ! তাতে অন্তত কিছু জারোয়া শব্দের উচ্চারন তো তাঁর নিজের বোধগম্য হতো। রহিতদা বা প্রনবেশবাবুদের উপরে অপেক্ষা করে থাকতে হতো না !

তবে হীরু, জারোয়াদের সম্পর্কে যে বইগুলো পড়েছে, তাতে একটা বিষয়ে নিশ্চিত, বহু পুরানো সভ্যতার সঙ্গে হয়তো জারোয়াদের কোন সম্পর্ক রয়েছে। নয়তো সমুদ্রে যখন ভয়ংকর সুনামি হয়েছিল, তখন তো আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ছোট ছোট এই দ্বীপগুলিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু সুনামির আগাম পূর্বাভাস জারোয়ারা কিভাবে পেয়েছিল ! ভারতের মূল ভূখন্ডের বেশ কিছু এলাকার মানুষের জীবন যেখানে সুনামিতে বিপন্ন হয়ে গিয়েছিল, সেখানে এই গভীর জঙ্গলের ভিতরে এই শুকনো পাতা দিয়ে তৈরি চাড্ডাতে আশ্রয় নিয়ে জারোয়ারা বেঁচে রইলো কি ভাবে ! তবে কি সুনামির আগাম আভাষ পেয়ে জারোয়ারা সবাই দল বেঁধে কোন উঁচু জায়গা বা এই বিভিন্ন দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত উঁচু পাহাড়ের উপরে উঠে নিজেদেরকে রক্ষা করেছিল ! শুনামির জল সরে যাওয়ার পরে আবার নিজেদের এলাকাতে ফিরে এসেছে ! এই দু’দিন জারোয়াদের এই দ্বীপে এসে বেশ কিছু জারোয়াকে নানা ধরনের পোষাক পড়ে থাকতে দেখেছে হীরু। তবে অধিকাংশ জারোয়াই থাকে উলঙ্গ। সুনামির সময় এই পোষাক কি জারোয়ারা সঙ্গে করে সেই উঁচু আশ্রয়ের জায়গাতে নিয়ে গিয়েছিল ! সেই সঙ্গে তাঁদের নিত্য ব্যবহারের জিনিষপত্রও। হীরুর পড়া বইগুলোতে এসবের কোন উল্লেখ নেই।

হীরু যে জারোয়া ছেলেটির সঙ্গে জারোয়াদের এই গ্রামে এসেছে, সেই ছেলেটা হীরুকে এভাবে একমনে চিন্তা করতে দেখে কি যেন বললো। ভাষা সমস্যায় সেকথা বোধগম্য হলোনা হীরুর। ওই ছেলেটি নিজের একহাত নিজের বুকের কাছে নিয়ে এসে ইশারায় হীরুকে বললো, “ওয়াঙ্গে”………”ওয়াঙ্গে………।”

ছেলেটি নিজের নাম ‘ওয়াঙ্গে’ বলে নিজেকে যে হীরুর কাছে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করছে, সেটা এবার হীরু বুঝতে পারলো। তার মানে এই জারোয়া ছেলেটির নাম ওয়াঙ্গে। হীরু বিষয়টা বুঝে বলে উঠলো, “ওয়াঙ্গে”। হীরুকে ওয়াঙ্গে শব্দটি বলতে শুনে জারোয়া ছেলেটি যে ভীষন আনন্দ পেয়েছে, সেটা ওঁর মুখের হাসি দেখেই হীরু বুঝতে পারলো। ওয়াঙ্গে এবার মুখ দিয়ে শব্দ করে উঠলো, “হীয়ু……… হীয়ু”। ওয়াঙ্গে হীরুর নাম যে ‘হীয়ু” বলছে সেটা আগেই জানতো সে। ওয়াঙ্গে একবার নিজের বুকের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলছে, ‘ওয়াঙ্গে’, আর একবার হীরুর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলছে ‘হীয়ু’। হীরু এবার পরিস্কারভাবে বুঝতে পারলো, জারোয়া ছেলেটি নিজেকে ওয়াঙ্গে নামে পরিচিয় দিচ্ছে। জারোয়া ভাষা হীরু বুঝতে না পারলেও ইশারায় নিজের মনের নানা ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করছে ওয়াঙ্গে। হীরুও নিজের মনের ভাব বলছে সেই একই রকম ইশারাতেই।

এভাবেই ওয়াঙ্গের ইশারা মতো হীরু গিয়ে ঢুকলো একটা চাড্ডার মধ্যে। ঢুকেই এক বিশ্রী দূর্গন্ধ নাকে এসে লাগলো নেকের ভিতরে। প্রায় বমি করে দিচ্ছিল হীরু। চাড্ডার ভিতরে কয়েক দিন আগের হালফা নামের ঝড়ের সঙ্গে তুমুল বৃষ্টির জল জমে দূর্গন্ধ হয়ে ছিল। হীরু চাড্ডার ভিতরটা ভালো করে না দেখেই দৌঁড়ে বাইরের খোলা জায়গায় এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। জোরে একবার নিঃশ্বাস নিল। কি বিশ্রি ! কি দূর্গন্ধময় এই জারোয়াদের চাড্ডাগুলো। এখানে জারোয়ারা থাকলে ওঁদের চিকিৎসা করে কি করবে রহিতদারা। সম্ভবত এটা ওয়াঙ্গের চাড্ডা। হয়তো স্থায়ী, হয়তো বা অস্থায়ী। কিন্তু হীরু যেটুকু সময় সেই চাড্ডার ভিতরে ছিল, তাতে একটা জিনিষ চোখ টেনে নিয়েছিল হীরুর। ওয়াঙ্গের চাড্ডার শুকনো পাতা দিয়ে তৈরি দেওয়ালে একটা ছাতা গুঁজে রাখা রয়েছে ! কোন ফোল্ডিং ছাতা নয়। প্রমান মাপের বড় লোহার ডান্ডি লাগানো ছাতা। তবে কি বৃষ্টির দিনে প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য জারোয়ারা আধুনিক মানুষদের মতো ছাতা ব্যবহার করে ! ভেবে কোনো কিনারা পেল না হীরু।

হীরুর এই অবস্থা দেখে হেসে প্রায় মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল ওয়াঙ্গে। ওয়াঙ্গের হাসি দেখে হীরুর রাগ আরও বেড়ে যাচ্ছিল। শেষে ওয়াঙ্গে হীরুকে চাড্ডার সামনে দাঁড়াতে ইঙ্গিত করে অন্যদিকে চলে গেল। ওয়াঙ্গের এই চলে যাওয়ায় হীরুর মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ওয়াঙ্গে ইচ্ছা করে ওঁকে এই দূর্গন্ধময় চাড্ডায় ঢোকায়নি তো ! এমনিতে প্রথমে সে যে হীরুকে নিজেদের বসবাসকারী এলাকাতে নিয়ে আসার বিপক্ষে ছিল, রহিতদাদের সঙ্গে ওয়াঙ্গের জারোয়া ভাষাতে কথা বলার সময় তাঁর আকার ইঙ্গিতে আন্দাজ করতে পেরেছিল হীরু। তাই সন্দেহ দেখা দিল এই ভেবে যে আবার কোন কারনে হয়তো নতুন করে অপদস্থ করার ধান্ধা করছে জারোয়া ছেলেটি। তাই নিজেই ওপাশের দিকে উঁকে মারতে গেল হীরু। যদিও দুজনের পরিচয় করার সময় যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখিয়েছিল ওয়াঙ্গে নামের এই জারোয়া ছেলেটি। কে জানে, ওঁকে গ্রামে নিয়ে অপদস্থ করার কথা রহিতদাই ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলে দিয়েছে কি না ! ওঁদের কথা তো হচ্ছিল জারোয়া ভাষায়। যার বিন্দু বিসর্গ বোঝেনি হীরু। রহিতদা কি সেই সুযোগটাই নিয়েছে !

ওয়াঙ্গে নামের জারোয়া ছেলেটি যেদিকে চলে গিয়েছিল, সেদিকে তাকিয়ে আরও কয়েকটি চাড্ডা চোখে পড়লো হীরুর। দেখলো আরও কয়েকজন জারোয়া সেখানে রয়েছে। ভালো করে খেয়াল করতেই নজরে এলো, জারোয়াদের মধ্যে একজন হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে এক জারোয়া ছেলে। ছেলেটির বয়স খুব বেশি নয় বলেই হীরুর মনে হলো। হীরুর আন্দাজে ওই জারোয়া ছোট ছেলেটির বয়স হতে পারে আন্দাজ পাঁচ বছরের আশেপাশে। কিছুক্ষন একভাবে দাঁড়িয়ে হীরু তাকিয়ে থাকলো জারোয়াদের ছোট দলটির দিকে। হীরু খেয়াল করলো, যে জারোয়া লোকটি মাটিতে বসে রয়েছে, সে ছোট বাচ্চা জারোয়াটিকে তীর ধনুক চালানো শেখাচ্ছে। ছোট জারোয়াটির হাতে রয়েছে নিজের মাপ মতো একটা ধনুক। আর জারোয়াটি ছেলেটির কাঁধের কাছে এসে মাটিতে বসে একটা একটা করে তীর এগিয়ে দিচ্ছে বাচ্চা জারোয়াটির হাতে। বাচ্চা জারোয়াটি সেই তীর ধনুকে লাগিয়ে লক্ষ্য করে চালাচ্ছে একটা গাছের ডালের দিকে। হীরু এবার সেই গাছের ডালের দিকে নজর দিল। বাচ্চা জারোয়াটি তীর যেদিকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ছে, সেদিকে তাকিয়ে নজরে এলো গাছের ডালের উপরে রয়েছে একটি বেশ বড় মাপের গিরগিটি। আর বাচ্চা জারোয়াটি সেই গিরগিটিকেই লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ছে নিজের ধনুক থেকে। হীরুর মনে হলো বাবা জারোয়াটি তাঁর ছেলেকে শিকার করার প্রশিক্ষন দিচ্ছে।

এই দৃশ্য দেখতে দেখতে হীরু এতটাই তন্ময় হয়ে পড়েছিল, যে মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল, যে কোথায় সে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং এখানে কেন সে এসেছে ! এরমধ্যেই ফিরে এসেছে ওয়াঙ্গে। তাঁর ডান হাতের তালুতে রয়েছে গাছের কান্ড দিয়ে বাটির মতো তৈরি করা একটি পাত্র। এই ধরনের পাত্র জারোয়াদের কাছে এর আগের দিনও দেখেছিল হীরু। ওই পাত্রতে জারোয়া একটি ছেলে, যে আজ টিটোকে সঙ্গে করে নিজের গ্রামে নিয়ে গিয়েছে, সে মধু নিয়ে এসেছিল। মধু সেদিন খুবই সুস্বাদু ছিল। আজ এই ওয়াঙ্গে কি নিয়ে এসেছে, কে জানে ! তবে যাই নিয়ে আসুক না কেন, হীরু আজ এখানে একা ! সেদিন তাও টিটো সঙ্গে ছিল। আর ছিল কিছু দূরেই রহিতদাদের মেডিক্যাল টিম। আজ যা করবে, সেটা তাঁকে নিজেকেই ভেবে চিন্তে করতে হবে। কেননা, এই ওয়াঙ্গে নামের জারোয়াটিকে কেন যেন হীরুর মনে হচ্ছে খুব সুবিধার নয় !

হীরু দেখলো এই পাত্রে কিছুটা পরিমান মধু নিয়ে এসেছে। মধু আগের দিনের মতো ঘন না হলেও খুব পাতলা নয়, সেটা চোখে দেখেই আন্দাজ করলো হীরু। এর মধ্যে কোন বিষ নেই তো আবার ! হীরু শুনেছে, জারোয়ারা তাঁদের তীরের ফলার মাথায় প্রানী হত্যা করার জন্য একরকমের বিষ ব্যবহার করে থাকে। ওয়াঙ্গে এবার মধু ভর্তি পাত্রটি তুলে দিল হীরুর হাতে। হীরু পাত্রটি হাতে নিলেও সেই মধু খাবে কি না, সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়লো। আগের দিন টিটোকে ওই জারোয়া ছেলেটি যে মধু দিয়েছিল, সেটা টিটোর আগে হীরুই খেয়েছিল। অপূর্ব স্বাদ ছিল সেই মধুর। সেই স্বাদের কথা মনে হওয়াতে মধু খেতে লোভও হচ্ছে। আবার এর মধ্যে কোন বিষ রয়েছে কিনা, সেই সন্দেহ মনে হওয়াতে খেতে চাইছে না। হীরু মধুর পাত্রটি নিয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে এসব চিন্তা করছে। সেটা দেখে ওয়াঙ্গে হয়তো কিছু আন্দাজ করে নিয়েছে। কারন, সে দু’বার হীরুকে মধু খেতে ইশারা করে চুপ করে হীরুর দিকে তাকিয়ে রইলো। হীরু যে মধু খেতে ইতস্তত করছে, সেটা বুঝতে পেরে ওয়াঙ্গে নিজেই এবার মধুর পাত্র থেকে আগে নিজে সেই মধু হাতে তুলে নিয়ে মুখে দিল। ওয়াঙ্গেকে আগে মধু খেতে দেখে হীরু মনে ভাবলো, আর যাইহোক, এই মধুর মধ্যে কোন বিষাক্ত কিছু নেই। ওয়াঙ্গের দেখাদেখি এবার হীরুও মধুর পাত্রটিকে মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে দুবারের চুমুকে প্রায় সবটা মধু খেয়ে নিল। সত্যি, এই মধুর স্বাদও বেশ ভালো। মধু খেয়ে শারিরীকভাবে কোন অসস্বস্তি হলো না হীরুর। আবারও ওয়াঙ্গের প্রতি তাঁর বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। প্রায় খালি সেই পাত্রটি হীরু ওয়াঙ্গেকে ফেরত দিয়ে দিল। ওয়াঙ্গে হীরুকে মধু খাইয়ে খুব খুশি হয়েছে, সেটা তাঁর মুখের হাসি দেখেই হীরু আন্দাজ করে নিয়েছে।

ওয়াঙ্গে আবারও হীরুকে একা দাঁড় করিয়ে রেখে কোথায় যেন চলে গেল। হীরু আবার নজর দিয়েছে, সেই ছোট জারোয়া ছেলেটির দিকে। হীরুর এবার দেখতে পেল, ছোট ছেলেটি গাছের উপরে থাকা সেই গিরগিটিকে ততক্ষনে তীরবিদ্ধ করে ফেলেছে। গিরগিটিটি তীরের আঘাতে আহত হয়ে গাছের ডাল থেকে মাটিতে পড়ে গিয়েছে। সেটাকে নিয়ে চলছে বাবা এবং ছেলের নানা আলোচনা। ছেলেটির বাবা আর সঙ্গে থাকা কয়েকজন জারোয়া লোকের মুখে তখন হাসি ফুটেছে। তাঁরা সব নিজেদের মধ্যে এই গিরগিটি শিকারে ছোট জারোয়াটির সাফল্য নিয়ে হয়তো জারোয়া ভাষাতে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ছোট জারোয়া ছেলেটি আহত গিরগিটিকে একটা লোহার ফলার মধ্যে গেঁথে নিতে উদ্যোগ নিল। ওদের বাড়িতে শিকার নিয়ে গিয়ে পরে রান্না করে খাবে। ছোট জারোয়া ছেলেটির হাবভাব দেখে হীরু আন্দাজ করলো,  হয়তো এই গিরগিটি ওঁর জীবনের প্রথম শিকার। গিরগিটি শিকার নিয়ে এবার জারোয়াদের দলটি জঙ্গলের অন্য দিকে চলে গেল।

হীরু পুরো ব্যাপারটা দেখতে দেখতে এতটাই অন্ময় হয়ে গিয়েছিল, যে খেয়ালই করেনি কখন ওয়াঙ্গে ওঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এবার ওয়াঙ্গের সঙ্গে রয়েছে এক জারোয়া মহিলা। জারোয়া মহিলাটির বয়স যে ওয়াঙ্গের মতোই হবে, সেটা হীরু তাঁকে দেখেই আন্দাজ করেছে। এটা কে ! ওয়াঙ্গের বৌ নাকি ! এই বয়সেই ওয়াঙ্গে বিয়ে করে নিয়েছে ! ওয়াঙ্গে মহিলাটিকে দেখিয়ে হীরুকে জারোয়া ভাষাতে কি যেন বললো। কিন্তু হীরু কিছুই বুঝতে পারলো না। মহিলাটিকে হীরুর দিকে দেখিয়ে জারোয়া ভাষায় ফের কি যেন বললো ওয়াঙ্গে। তার মধ্যে দু’বার নিজের নামের উচ্চারন শুনতে পেল হীরু। যদিও সেই নাম হীরুর নামের জারোয়া ভাষার উচ্চারন ‘হীয়ু’। মহিলাটি হীরুর দিকে তাকিয়ে হাসলো। মহিলা যে ওয়াঙ্গের স্ত্রী সে বিষয়ে আর মনে কোন সন্দেহ থাকলো না হীরুর। মহিলাটি কিন্তু সম্পূর্ন উলঙ্গ নয়। কাপড়ের তৈরি ম্যাক্সি ধরনের এক পোষাক দিয়ে সে নিজের শরীরের লজ্জা নিবারনের ব্যবস্থা করেছে। এর আগে রহিতদাদের মেডিক্যাল ক্যাম্পে হীরু যে জারোয়া মহিলাদের দেখেছে, তাঁরা সবাই হয় উলঙ্গ ছিল, নয়তো গাছের শুকনো বাকল বা লাল কাপড় দিয়ে নিজেদের লজ্জা নিবারনের জন্য শরীরের নীচের দিকে লাগিয়ে রেখেছিল। তবে শরীরের অন্য অংশে কোন পোষাকের বালাই ছিল না। এই মহিলা তাঁদের থেকে কিছুটা হলেও আলাদা। কারন শরীরের উপর এবং নীচের সব এলাকাই তাঁর ঢাকা রয়েছে। এই ম্যাক্সি জাতীয় পোষাক বেশ পুরানো। কারন প্রায় সম্পূর্ন পোষাকের আসল রঙ উবে গিয়েছে। তবে মহিলাও অন্য জারোয়াদের মতো মুখে বা শরীরের খোলা অংশে সাদা  সাদা  নানা রকমের দাগ কেটে রেখেছে। মহিলা ওয়াঙ্গেকে জারোয়া ভাষাতে কিছু বলে আবার চলে গেল। হীরুর দিকে ফিরেও তাকালো না। হীরু ভাবলো, ভাষা না জানার কারনে সে কথা বলতে পারছে না বলে হয়তো অস্বস্তিতে মহিলা ফিরে গিয়েছে।

কিন্তু হীরুকে অবাক করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাতে ফের একটা পাত্র নিয়ে ফিরে এলো। পাত্রটি মহিলা ওয়াঙ্গের হাতে দিয়ে হীরুর দিকে ইশারা করে কিছু বললো। ওয়াঙ্গেও মাথা ঝাঁকিয়ে পাত্রটি হীরুর হাতে তুলে দিল। হীরু দেখলো, এবার আর  মধু নয়। পাত্রের ভিতরে রয়েছে কাঠালের বিচির আকৃতির কয়েকটি জিনিষ। হীরু বুঝলো মহিলা তাঁকে খেতে দিয়েছে। হীরু কিছু ভেবে ওঠার আগেই ওয়াঙ্গে পাত্র থেকে একটা বিচি তুলে দাঁত দিয়ে উপরের পাতলা আবরন ছাড়িয়ে নিয়ে, মুখে দিয়ে চেবাতে লাগলো। হীরু কি করবে ভেবে ঠিক করতে পারছিল না। হীরুকে ভাবতে দেখে ওয়াঙ্গে আবারও আরও একটি বিচি পাত্র থেকে তুলে নিয়ে একই ভাবে মুখে দিয়ে চেবাতে লাগলো। এবার ওয়াঙ্গে হীরুকে ইশারা করলো, পাত্রের ভিতরে রাখা কাঠালের বিচির মতো জিনিষগুলোকে মুখে নিয়ে খেতে। একটু আগে হীরু ওয়াঙ্গের দেওয়া প্রায় এক বাটি পরিমান মধু খেয়েছে। পেট বেশ ভার হয়েছিল হীরুর।  তবুও ওয়াঙ্গের অনুরোধের ইশারায় একটা বিচির মতো বস্তু হাতে তুলে নিয়ে ওয়াঙ্গের কায়দাতেই দাঁত দিয়ে উপরের আস্তরন ছাঁড়িয়ে মুখে দিল হীরু। চিবিয়েই বুঝতে পারলো, আগুনে সেদ্ধ করা এগুলো কাঠাল জাতীয় ফলের বিচি। খেতে খুব সুস্বাদু না হলেও কেমন যেন একটা টক স্বাদ। একটা বিচি খেয়ে সেই পাত্র হীরু সরাসরি ওয়াঙ্গের স্ত্রীর হাতে ফেরত দিয়ে দিল হীরু। মুখে হেসে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো, এই খাবার তাঁর পছন্দ হয়েছে এবং সে আর এর বেশি খেতে পারবে না। জারোয়া মহিলাটি, যে ওয়াঙ্গের স্ত্রী, সেও হাসির মুখেই পাত্রটিকে ফেরত নিল। পাত্রটি নিয়ে সে আবার একটা চাড্ডার দিকে চলে গেল।

আবার নিজের সেই চাড্ডার ভিতরে ঢুকলো ওয়াঙ্গে। ফিরে এলো সেই ছাতাটি নিয়ে। যেটা হীরু অল্প সময়ের জন্য ওয়াঙ্গের চাড্ডার ভিতরে গিয়ে নজর করেছিল। ছাতাটিকে দেখিয়ে জারোয়া ভাষায় কিছু বললো ওয়াঙ্গে। যথারীতি সেই কথা হীরু বুঝতে পারলো না। তবে আন্দাজ করলো, এটা কোন সময়ে হয়তো পেয়েছিল ওয়াঙ্গে। কিন্তু ছাতার ব্যবহার যে জানে না, সেটা মুখে না বললেও আচরনেই বুঝতে পারলো হীরু। কারন, ছাতাটি কিভাবে খুলতে হয়, সেটা ওয়াঙ্গে দেখালো না। ছাতাটিকে সে একটি হাতিয়ার হিসাবে মনে করেছে। হীরু ছাতাটি ওয়াঙ্গের থেকে নিয়ে ছাতা যে পদ্ধতিতে খোলে, সেভাবে খুলে ওয়াঙ্গের মাথার উপরে মেলে ধরলো। ওয়াঙ্গে যে শুধু অবাকই হয়নি, তাঁর সংগ্রহে থাকা বস্তুটি যে এভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটা দেখে আনন্দে দু’পা একসঙ্গে জড়ো করে সেখানেই লাফাতে লাগলো। হীরু ফের ছাতাটিকে নিদির্ষ্ট পদ্ধতিতেই বন্ধ করে দিয়েছে। ওয়াঙ্গে ছাতাটি নিজের হাতে নিয়ে খোলার চেষ্টা করেও পারলো না। এবার হীরু তাঁকে ছাতা খোলা এবং বন্ধ করার পদ্ধতি দেখিয়ে দিতে ওয়াঙ্গে নিজেই বারবার ছাতাটি খুলতে আর বন্ধ করতে করতে এলাকা জুড়ে গোল করে ঘুরে নাচতে লাগলো। ওঁর কান্ড দেখে হীরুও না হেসে আর পারলো না।

ছাতা নিয়ে নাচতে নাচতে হঠাৎ হীরুর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো ওয়াঙ্গে। হীরুর মুখের দিকে তাকিয়ে, কি যেন হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছে, এমন ভাবভঙ্গি করে ছাতাটি হীরুর হাতে দিয়ে দৌঁড়ে ফের গিয়ে ঢুকলো চাড্ডার ভিতরে। এবার বাইরে এলো হাতে করে গাছের শুকনো ছাল দিয়ে মোড়ানো একটা পোটলার মতো জিনিষ নিয়ে। কোন কিছু না বলে সেটা তুলে দিল হীরুর হাতে। হীরু দেখলো গাছের শুকনো লতা দড়ির মতো করে, সেটা দিয়ে পাতার পোটলাটি বাঁধা রয়েছে। হীরুকে সেই বাঁধন  খোলার ইঙ্গিত করলো ওয়াঙ্গে। হীরুও কৌতুহলে সেই শুকনো লতার গিঁট খুলে দেখলো, ভিতরে রয়েছে গোটা দশেক প্রাচীন কোন মুদ্রার মতো জিনিষ। যে পাতার বান্ডিলের মধ্যে এগুলো ছিল, সেই পাতাটিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে কয়েন গুলোকে হাতের তালুতে রাখলো হীরু।

হীরু ভালো করে কয়েনগুলো দেখেই বুঝতে পারলো, এক অতি দুস্প্রাপ্য জিনিষ তাঁর হাতের তালুর উপরে রয়েছে ! অনেক দিনের পুরানো হওয়ায় কয়েনগুলোর রঙ কালো হয়ে গিয়েছে। তবুও কয়েনের গায়ের উপরে লেখা বোঝা যাচ্ছে। যত দেখছে, হীরু তত অবাক হচ্ছে। কয়েনগুলোর গায়ের উপরে লেখা রয়েছে ইংরেজি অক্ষরে। যে সময়ের এই কয়েনগুলো, তার সালটাও পরিস্কারভাবে পড়া যাচ্ছে। জারোয়াদের ঘরে এই অতি প্রাচীন কয়েন এলো কি ভাবে ! প্রতিটা কয়েন খুঁটিয়ে দেখে, হীরু বুঝতে পারলো, পরাধীন ভারতের ইংরেজ আমলের ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সময়ের তৈরি এই কয়েনগুলো। সেগুলো দেখেই হীরুর লোভ হলো ! কলকাতায় যদি এগুলো কোনভাবে নিয়ে যাওয়া যায়, তবে ভালো টাকা দাম পাওয়া যাবে। জারোয়ারা এই অমুল্য কয়েন অযত্নে জঙ্গলের ভিতরে চাড্ডার ভিতরে ফেলে রেখে করবে কি ! কোনভাবে যদি এই কয়েনগুলোকে ওয়াঙ্গেকে বুঝিয়ে নেওয়া যায়, তবে হীরু কলকাতায় পৌঁছে এগুলো বিক্রি করে মোটা টাকা রোজগার করতে পারবে ! টাকার অঙ্কটাও নেহাত কম হবে বলে মনে হয় না !

লোভে চোখ চকচক করে উঠলো হীরুর ! অশিক্ষিত জারোয়ারা এর কোন মূল্য বুঝবে না সেটা হীরু নিজেই এতক্ষনে বুঝতে পেরেছে। ও কি ওয়াঙ্গেকে বলবে এই  কয়েনগুলোকে ওঁকে দিয়ে দিতে ! যদি না দেয়, তবে এগুলো ওয়াঙ্গের কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়েই যাবে মনস্থির করে ফেলেছে হীরু। সে গুনে দেখলো মোট বারোটা কয়েন রয়েছে। তবে কয়েনগুলো সোনা বা দামি কোন ধাতুর তৈরি নয়। কিন্তু পুরানো কয়েনের দাম ভালো, এটা হীরু জানে।

হীরুর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল ! কয়েনগুলো হাতের মধ্যে রেখে হাতের ইশারায় চাড্ডার দিকে দেখিয়ে ওয়াঙ্গেকে অন্য মনস্ক করার বুদ্ধি করে অন্তত দুটো তিনটে কয়েন পকেটে ভরে নেওয়ার ফন্দি আঁটলো সে ! যেমন বুদ্ধি, ঠিক তেমনই কাজ করলো হীরু। ওয়াঙ্গেকে তাঁর চাড্ডার দিকে দেখিয়ে নজর ঘুরিয়ে বাংলায় বলে উঠলো, “ওখানে ওটা কি !”

হীরুর হাতের ইঙ্গিতে নিজের চাড্ডার দিকে স্বভাবতই নজর ঘুরিয়ে কয়েনগুলোর দিক থেকে অন্য মনস্ক হয়ে পড়লো ওয়াঙ্গে। এরমধ্যেই হাতের সাফাই করে ওয়াঙ্গের নজর এড়িয়ে নিজের পরনের বারমুডার দু’দিকের পকেটের ভিতরে দুটো কয়েন ঢুকিয়ে নিয়েছে হীরু। ওয়াঙ্গে হীরুর এই কাণ্ডের কিছুই আঁচ করতে পারলো না। চাড্ডাতে অস্বাভাবিক কিছু না দেখে সে অবাক চোখে হীরুর দিকে তাকালো। হীরু ফের নিজের ব্যস্ততার অভিনয় শুরু করেছে কয়েনগুলিকে নিয়ে। ওঁর ভাবটা এমন যেন এই কয়েনগুলি নেহাতই ওয়াঙ্গের সংগ্রহে ছাতা থাকার মতো বিষয়। ছাতার মতোই এগুলোর কোন মূল্যই নেই। মনে মনে হীরু ভাবছিল, এভাবে উৎসাহ সে কম দেখালে এই জারোয়া ছেলে ওয়াঙ্গের থেকে এই মহা মূল্যবান কয়েনগুলো তাঁর পেতে সুবিধা হবে। হীরু মনে মনে ভাবলো, জারোয়ারা তো পড়াশোনা জানে না। তাই কতগুলো কয়েন সহ শুকনো পাতার পোটলাটা হীরুর হাতে তুলে দিয়েছিল, সেটার হিসাব জারোয়াটির কাছে থাকবে না। ইতিমধ্যে যে এর থেকে দুটো কয়েন হীরু নিজের পকেটে ভরে নিয়েছে, সেটা জারোয়া ওয়াঙ্গে এখনও বুঝতে পারেনি। এভাবে যদি আরও কয়েকটি কয়েন পকেটে নেওয়া যায়, তবে বেশ ভালো হয় ! কিন্তু এভাবে তো সবগুলো কয়েন পকেটে ওয়াঙ্গেকে না জানিয়ে নেওয়া যাবে না। কারন বারমুডা প্যান্টের পকেটের ভিতরে হাঁটাচলা করার সময় সেগুলো আওয়াজ করতে পারে। আর কয়েনের ঝনঝনানির শব্দও হতে পারে। এই নিস্তব্দ জঙ্গলের ভিতর থেকে ওয়াঙ্গের সাহায্য ছাড়া সে নিজে রাস্তা চিনে রহিতদাদের মেডিক্যাল ক্যাম্পের এলাকাতে ফিরে যেতে পারবে না।

কিন্তু কয়েনগুলো হাতানোর লোভ ছাড়তে পারছে না হীরু ! হীরু সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল, যে সে এই কয়েনের পোটলাটি  ওয়াঙ্গের থেকে চেয়ে নেবে। জারোয়া ভাষা তো জানে না ! তাই ইশারাতেই বিষয়টা ওয়াঙ্গেকে জানাবে। ভাষা সমস্যায় একান্তই যদি জারোয়াটিকে সে ইশারাতে বোঝাতে না পারে, তবে ছিনিয়েই নেবে এগুলো সে। এই জারোয়াটি সম্ভবত ভদ্র স্বভাবের বলেই মনে হয়েছে হীরুর। কারন, জঙ্গলের ভিতরে নিজের চাড্ডায় নিয়ে এসে দু’বার হীরুকে বিভিন্ন মধু আর বিচির সেদ্ধ খাইয়েছে। আর হীরু কি ওয়াঙ্গের কোন উপকার করে নি ! সে ছাতা খোলার পদ্ধতি না দেখিয়ে দিলে, তো এই জারোয়া ছেলেটি জানতেই পারতো না সেটা কি কাজে লাগে ! এই উপকারের বদলে কি এই বোকা জারোয়াগুলোর কাছ থেকে এই টুকু জিনিষ স্মৃতি হিসাবে সে পেতে পারেনা ! মনে হয়, ওয়াঙ্গে নিষেধ করবে না ! আসলে এগুলো যে কি জিনিষ, সেটা তো এই জারোয়ারা জানেই না। সভ্য জগতে এই জিনিষ যে কতটা মূল্যবান, এই অসভ্য বর্বর জারোয়ারা তো জানে না !

এসব ভাবতেই হীরু দেখলো, ওয়াঙ্গে তাঁর হাতের তালুতে থাকা কয়েনগুলোর দিকে কেমন যেন অবাক দৃষ্টিতে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে !  তা সত্বেও হীরু ওয়াঙ্গের দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় একটা কয়েন তুলে নিজের পকেটে ভরার ইঙ্গিত করলো। হীরুকে অবাক করে দিয়ে বিষয়টি জারোয়া ওয়াঙ্গে নামের ছেলেটি যে বুঝতে পেরেছে, সেটা বুঝিয়ে দুদিকে ঘনঘন

৩৯

 

মাথা নাড়তে লাগলো ! মানে, ওয়াঙ্গে হীরুকে এই কয়েনগুলো দিয়ে অস্বীকার করছে ! হীরু ওঁর ইশারা বুঝতে পারলেও, কিছু না বোঝার ভান করে ফের একই রকম ইঙ্গিত করলো। এবার ওয়াঙ্গে নামের জারোয়াটির মুখের ভঙ্গি বেশ বদলে গিয়েছে। চোখ, মুখ দিয়ে রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ পেতে লাগলো। যেন মুখের ভঙ্গিতেই বোঝাতে চাইছে, বিশ্বাসঘাতক ! তোমাকে আমি আমার নিজস্ব জিনিষ দেখিয়েছি, আর তুমি সেগুলো নিজে নেওয়ার মতলব করছো ! কিছুতেই সেটা মনবো না !

ওয়াঙ্গের আচরন এবার সম্পূর্ন বদলে গিয়েছে। সে শুধু মাথা দুদিকে নাডিয়ে মানাই শুধু করছে না, হাত নেড়েও নিষেধ করতে শুরু করলো। হীরু ওয়াঙ্গের নিষেধকে পাত্তা না দিয়ে কয়েনগুলোকে পকেটে ভরতে শুরু করতেই ওয়াঙ্গে হীরুর হাত থেকে কয়েনগুলোকে প্রায় ছিনিয়ে নিলো। ওয়াঙ্গের এই কান্ড দেখে নিজের প্ল্যান ভেস্তে যেতে বসেছে, আন্দাজ করে হীরুও হাতের মুঠো বন্ধ কওরে দিয়েছে। ওয়াঙ্গে যাতে কোনভাবেই তাঁর হাতের থেকে কয়েনগুলোকে ছিনিয়ে নিতে না পারে সেজন্য হাতটি পিঠের পাছন দিকে নিয়ে চলে গিয়েছে। ওয়াঙ্গেও জোর করে সেই হাত সামনে এনে হীরুর হাতের মুঠোর ভিতর থেকে কয়েনগুলোকে নেওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করলো। এবার শুরু হলো ওয়াঙ্গের সঙ্গে হীরুর ধস্তাধ্বস্তি। আর তখনই হীরুর বারমুডা প্যান্টের পকেটের ভিতরে আগে থেকে লুকিয়ে রাখা কয়েন দুটো এসে ওয়াঙ্গের হাতে লাগলো। ওয়াঙ্গে আবাক হয়ে হীরুর দিকে তাকিয়ে একবার প্যান্টের পকেট আর হাতের মুঠো খুলতে মরিয়া চেষ্টা করে যেতে থাকলো। হীরু  গায়ের জোরে ওয়াঙ্গের সঙ্গে পেরে না উঠে তাঁর থেকে কিছুটা দূরে সরে গেল। ওয়াঙ্গে কিছুতেই হীরুকে ছাড়বে না ! আর হীরুও আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে, কয়েনগুলো নিজে্র কাছে রাখতে। এভাবে বেশ কিছুক্ষন হীরু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে আসার সময় ওয়াঙ্গে জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরির জন্য যে ছুরিটা ব্যবহার করেছিল, সেটা নিজের কোমড়ে থাকলেও সেটা দিয়ে হীরুকে আঘাত করার কোন চেষ্টা করছে না। ওয়াঙ্গের সঙ্গে ধস্তাধ্বস্তি করতে করতে ওঁরা দু’জনেই আগের জায়গা থেকে অনেকটা সরে গিয়েছে। এর পাশেই রয়েছে বেশ বড় বড় গাছের জঙ্গল। হীরু নিজেকে ওয়াঙ্গের হাত থেকে বাঁচাতে, ওয়াঙ্গের কোমড়ে গুঁজে রাখা ছুরিটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই ওয়াঙ্গে নিজের গায়ের জোরে হীরুকে দিল এক ধাক্কা। আর হীরু গিয়ে ছিটকে পড়লো পাশের এক বড় গাছের গুঁড়ির কাছে। আর ওঁর নিজের মাথা গিয়ে সজোরে ধাক্কা খেল গাছের গুঁড়ির সঙ্গে। হীরু চোখে সর্যে ফুল দেখলো। দেখলো, চোখের দৃষ্টির সামনে সাদা সাদা বুদবুদ ভেসে যাচ্ছে। হীরু অজ্ঞান হওয়ার আগেই টের পেল, তাঁর হাতের থেকে কয়েনগুলো ছিটকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে !

 

( শেষ পর্ব আগামীকাল )

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত