জারোয়াদের জঙ্গলে – পর্ব ২

( আগে যা ঘটেছে) – কলকাতা থেকে আন্দামানের রহিতদার বারাটাং অফিসে বেড়াতে এসেছে টিটো আর হীরু। বারাটাং পৌঁছনোর পথে তাঁরা জঙ্গলে জারোয়াদের দেখেছে। রহিতদার অফিস কলিগ প্রনবেশবাবুর উদ্যোগে জারোয়াদের বাসস্থানে মেডিক্যাল ক্যাম্পে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে টিটো আর হীরু। এরপর……)

 

।। ৩ ।।

 

তখনও রাত রয়েছে। রহিতদাদের মেডিক্যাল টিমের সঙ্গে টিটো আর হীরু বারাটাঙের জেটি থেকে মোটর লাগানো ডুঙ্গিতে চেপে লাকরা লুংটা জারোয়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। রওনা দেওয়ার আগেই প্রণবেশবাবু টিটোদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, ওই জারোয়া দ্বীপ মিডল আন্দামানের পশ্চিমদিকে। ভরা জোয়ার চলছে তখন। সমুদ্রের জলে টান রয়েছে ভালো রকমের। আর তেমন ঢেউ। অথৈ সমুদ্রের ঢেউএর ধাক্কায় টালমাটাল ওই মোচার খোলার মতো ডুঙ্গিতে বসে টিটো রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছে। সূর্য সবে পূব আকাশে উঠবে উঠবে করছে। রওনা দেওয়ার আগে টিটোরা যখন জামাকাপড় পরে জেটিতে যাওয়ার জন্য ঘর ছেড়ে বাইরে এসেছিল, প্রণবেশবাবু অবাক হয়ে ওদের দু’জনকে দেখেই বলেছিলেন, “ নো ফুলপ্যান্ট। হাফ প্যান্ট পড়তে হবে। আর মনে রাখবে, প্রথম দিন যে পোষাক পড়ে দ্বীপে যাবে, অন্য কোনদিন সেই দ্বীপে গেলে কিন্তু একই পোষাক পড়তে হবে। এতাই জরোয়াদের নিয়ম। তাতে ওঁদের আমাদের মতো সিভিলিয়ানদের চিনতে সুবিধা হয়। ”

টিটো বা হীরু কেউই কলকাতা থেকে হাফ প্যান্ট সঙ্গে করে নিয়ে আসেনি। এই সমস্যার সমাধান করে দিল রহিতদা। “হাফ প্যান্ট নেই তো! তোদের তো ছোট বারমুডা রয়েছে। সেগুলিই পরে নে। কারন ডুঙ্গি থেকে নেমে জলের মধ্যে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে তবে তো আইল্যান্ডে পৌঁছতে হবে”।

টিটো যে ডুঙ্গিতে রয়েছে, তার সঙ্গে রয়েছে আরও একটি ডুঙ্গি। অন্য ডুঙ্গিতে রয়েছে হীরুদা। আর রয়েছে সাদা পোষাকের দু’জন বন্দুকধারী পুলিশ। টিটো ছিল প্রণবেশবাবুদের সঙ্গে। ডুঙ্গিতে চেপে লাকরা লুংটা দ্বীপে যাওয়ার পথে জারোয়াদের নিয়ে তাঁর নানা অভিজ্ঞতার কথা টিটোকে শোনাচ্ছিলেন প্রণবেশবাবু। বলছিলেন, এখনও জারোয়ারা প্রথমে রহিতদাদের মেডিক্যাল টিমের লোকজনকে অবিশ্বাসের সঙ্গেই দেখে। পরে ডুঙ্গি যখন আইল্যান্ডের কাছাকাছি চলে যায়, তখন জারোয়ারা রহিতদা, প্রণবেশবাবুদের চিনতে পেরে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। কারন এখনও জারোয়ারা সাধারন মানুষের তাঁদের দ্বীপে অনুপ্রবেশ ঠিক সহ্য করতে পারেনা।

“জানো তো, এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। এখনও প্রথমে জারোয়ারা আমাদেরকে অবিশ্বাসের নজরেই দেখে। তবে যখন আমাদেরকে চিনতে পারে, তখন সমুদ্রের পাড় থেকে কিছু দূরের জঙ্গলে গিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়ার মাধ্যমে সাড়া দেয়। আমরাও তো আর খালি হাতে আসিনা। প্রতিবারই জারোয়াদের জন্য নারকেল, কলা, মুড়ি এসব নিয়ে আসি। আগে দু-একবার ভাত রান্না করে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল, জারোয়ারা তাদের প্রয়োজন মতো রান্না করা খাবার খেয়ে, বাকিটা ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখতো। সেই পচা বাসি খাবার খাওয়ার পরিনাম খারাপ হতে পারে, বুঝতে পেরে আমরা এখন প্লাষ্টিকের প্যাকেটে মুড়ি নিয়ে আসি। দেখা গিয়েছে, মুড়ি জারোয়ারা বেশ পছন্দ করছে।

তবে জারোয়ারা এখন দু- তিনটি বাছাই করা জায়গাতেই থাকে। যেমন, লাকরা লুংটা, ছোটা লিম্বাস আর ইয়াভিটা এলাকাগুলোতেই এদের এখন প্রধানত দেখা যায়। আর সত্যি বলতে কি, জারোয়াদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের জন্য আমাদেরকেও জারোয়াদের ভাষাও শিখে নিতে হয়েছে।”

মেডিক্যাল টিমের দুটি ডিঙি দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছতেই যেন সমুদ্রের জলের ঢেউএর দাপট আরও বেড়ে গেল। টিটো তো প্রানপনে ডুঙিটাকে আঁকড়ে ভাবছিল, এই জলের মধ্যে সে ডুঙি থেকে নামবে কি ভাবে ! টিটো পিছনে অন্য ডুঙির দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, হীরুদার অবস্থাও একই রকমের।

ডুঙি দুটো পাড়ের আরও কাছাকাছি আসতেই টিটোর হঠাৎ নজরে এলো, সবুজ জঙ্গলের ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়িয়ে সোনালী বালিতে এসে দাঁড়িয়েছে কালো কালো মানুষের বেশ বড় একটা ভিড়। দূরের আকাশ থেকে উড়ছে কালো ধোঁয়া।

জারোয়া !!

এত জারোয়া একসঙ্গে এখানে ! বিস্ময় কাটছিল না টিটোর। ডুঙির চালক বুঝতে পেরেছিল টিটোর কৌতুহলের কারন। তিনি জানালেন, এই জারোয়াগুলি সমুদ্রতটের চার-ছয় কিলোমিটারের মধ্যেই থাকে। ওঁরা বহুদূরের আওয়াজ শুনতে পায়। আমাদের ডুঙির ইঞ্জিনের শব্দ শুনে, বন্ধু না শত্রু, কে এসেছে দেখে, আগুনের ধোঁয়া জ্বালিয়ে অনেক আগেই এখানে এসে জড়ো হয়েছে।

এ কোথায় এলো ! বিস্ময় কাটছিল না টিটোর। ওঁর বারবার মনে হচ্ছিল, হাজার হাজার বছর আগের কোন এক পৃথিবীতে পৌঁছে গিয়েছে। সে কিছুতেই ভাবতে পারছিল না, এই ধরনের একটা জগৎ ভারতবর্ষের মধ্যেই রয়েছে। আর সেটা ভাবতে ভাবতেই সারা শরীরের মধ্যে শিহরন দিচ্ছিল বারবার।

প্রায় হাঁটু সমান সমুদ্রের জল ঠেলে অনেক কষ্টে দ্বীপে পৌঁছলো টিটো। ততক্ষনে নিয়ে আসা নারকেল, কলা এসব নিতে নিজেদের মধ্যেই হুটোপাটা চলছে জারোয়াদের মধ্যে। হীরুদা টিটোর পরে ডুঙ্গি থেকে নেমেছে। ওঁর চোখে মুখেও বিশ্ময় !

এরমধ্যে হঠাৎ টিটোর নজরে এলো, ভিড়ের বাইরে থেকে একজন জারোয়া স্থির চোখে টিটোকে দেখছে। তাঁর বুক থেকে পেটের নাভি পর্যন্ত গাছের ছালের চেষ্টগার্ড এর মতো কিছু লাগানো রয়েছে। তার কোমরে চকচক করছে একটা ছুরি। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল টিটোর। হঠাৎ ওঁর মায়ের কথা মনে পড়লো। কলকাতায় মা বারবার নিষেধ করেছিল আন্দামানে না আসার জন্য। এমনকি রহিতদার কাজকর্মের কথা শুনে আর টিটো রহিতের সঙ্গে থাকবে, এটা জানতে পেরে মা পইপই করে বলে দিয়েছে, টিটো যেন জারোয়াদের ধারেপাশে না যায়। মা বলেছিল, “জারোয়ারা ভীষন হিংস্র, বর্ব্বর”। ভয়ে টিটো রহিতদাদের মেডিক্যাল টিমের লোকজনদের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে নিল।

 

।। ৪ ।।

 

জুন মাস হওয়াতে রোদের তেজ গায়ে লাগছিল টিটোর। সেই ভোরবেলা রহিতদাদের মেডিক্যাল টিমের সঙ্গে রওনা দেওয়ার কিছুক্ষন পর্যন্ত বেশ ভালোই লাগছিল টিটোর। ডুঙ্গির জার্নি ওঁর কাছে ভয়াবহ হলেও, আরও ভালো লাগছিল, প্রণবেশবাবুর কাছ থেকে জারোয়াদের নিয়ে নানা কথা শুনতে। দ্বীপে পৌঁছেই বারাটাঙ থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা তাঁবুর সব সামগ্রী দিয়ে  সমুদ্রতটের বালির উপরেই ততক্ষনে টেন্ট তৈরির কাজ শেষ করে ফেলেছে মেডিক্যাল টিমের সঙ্গে আসা আরও চারজন লোকেরা। অন্যদিকে, প্রনবেশবাবুকে দু’জন জারোয়ার সঙ্গে কথা বলতে দেখলো টিটো। সমুদ্রের জল থেকে ওঁদের নিয়ে আসা কলার কাদি সংগ্রহ করে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় টিটোর বয়সী এক জারোয়াকে ডেকে কি যেন বলতেও দেখলো প্রণবেশবাবুকে।

এবার সেই জারোয়া ছেলেটির একহাত ধরে প্রনবেশবাবু নিয়ে এলেন টিটোর কাছে। টিটো আর হীরুদা দাঁড়িয়ে ছিল মেডিক্যাল ক্যাম্পের তাঁবুর ছায়াতেই। টিটোর মতো হীরুদাও অবাক হয়ে দেখছিল জারোয়াদের নানা কর্মকান্ড। জারোয়ারা নিজেদের ভাষাতে নানারকম আওয়াজ করছিল মুখ দিয়ে। সেই ভাষার অর্থ টিটোদের বোধগম্য হচ্ছিল না।

প্রনবেশবাবু ওই জারোয়া ছেলেটিকে টিটোর কাছে এনে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “মিলোহালে”। জারোয়া কিশোরটি তাঁর ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হেসে কলার কাদি মাটিতে নামিয়ে দুহাত টিটোর কাঁধে দিয়ে বললো,  “মিলোহালে…মিলোহালে”। কথা বলে সে টিটোর সামনেই দাঁড়িয়ে থাকল।

প্রণবেশবাবু এবার টিটোকে মিলোহালে কথার মানে জানালেন। “টিটো, মিলোহালে কথার মানে হলো জারোয়া ভাষায় বন্ধু্‌,” বললেন প্রণবেশবাবু, “ও তোমাকে বন্ধু হিসাবে মেনে নিয়েছে”।

জারোয়া ভাষাতেই প্রণবেশবাবু ওই কিশোরকে কি যেন জিজ্ঞাসা করায়, সে উত্তর দিল, “লুহা … লুহা।” এক হাত তুলে জঙ্গলের দিকে দেখিয়ে, পরক্ষনেই নিজের দিকে এক আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, “ওহামে।”

প্রণবেশবাবু টিটোকে জানালেন, “ জারোয়া ভাষায় ‘লুহা’ কথার অর্থ ‘জঙ্গলের ভিতরে’। মানে ও বোঝাতে চাইছে, জঙ্গলের ভিতরে আরও জারোয়া রয়েছে। আর ও নিজের নাম বলছে ‘ওহামে’।

টিটো অবাক হয়ে দেখছিল, ওঁর বয়সি একজন জারোয়া কিশোর কি রকম স্বাভাবিকভাবে উলঙ্গ হয়ে থাকতে পারে। ওহামের পরনে কোন পোষাক ছিল না। শুধু কোমড়ে একটা লাল রঙের দড়ি বাঁধা ছিল। একই রকম ঘন হাল্কা খয়েরি রং এর কোঁকড়ানো চুলের সঙ্গে মাথায় বেঁধে রেখেছে লাল রং এর ফিতা। উলঙ্গ হলেও গলায় সামুদ্রিক ঝিনুক দিয়ে তৈরি মালা পড়ে রয়েছে সে। প্রণবেশবাবু টিটোকে দেখিয়ে ওহামেকে বললেন, “টিটো।” ওহামে টিটোর হাত ধরে  পরিচয় করার ভঙ্গিতে বললো, ‘ থিতু … থিতু”। আর হীরুদার সঙ্গে পরিচয়ের পরে বললো, ‘হিয়ু … হিয়ু।”

টিটোরা গতকালই রহিতদাদের কাছ থেকে শুনে রেখেছিল, জারোয়ারা লাল রং ভীষন ভালোবাসে। ওঁরা ডুঙ্গি চেপে এই দ্বীপে পৌঁছনোর আগেই দেখেছিল, বেশ কিছু কালো কালো বেঁটে মানুষ সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মহিলাকেও চোখে পরেছিল টিটোর। টিটোর কাছে বাইনোকুলার ছিল। সে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে জারোয়াদের আরও ভালো ভাবে দেখার চেষ্টা করছিল। ডুঙ্গি যত দ্বীপের কাছে এগোচ্ছিল, তত পরিস্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিল  জারোয়াদের। দেখেছিল, দু’চারজন জারোয়া দু হাত মাথার কাছে জড়ো করে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেউ বা হাঁটাহাঁটি করছে।

ভোরে বারাটাঙ থেকে রওনা দেওয়ার আগে টিটোর গলায় বাইনোকুলার ঝোলাতে দেখেছিল রহিতদা। সাবধান করে তাই বলেছিল, ‘দূরবীন নিয়ে যাচ্ছিস, ওঁরা কিন্তু তেমন হলে তোর থেকে দূরবীন নিয়ে নিতে পারে।” এই বাইনোকুলার টিটোর খুব প্রিয়। সেকারনে  বাইনোকুলার টিটো ডুঙ্গিতে ব্যাগের ভিতরে রেখে তবেই দ্বীপে নেমেছিল। কিন্তু জারোয়ারা ডুঙির মধ্যে উঠে ব্যাগের ভিতর থেকে বাইনোকুলার বের করে নেবে, সেটা ও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।

ওহামে, মানে সদ্য পরিচিত জারোয়া ছেলেটি এর মধ্যেই টিটোর নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছে। অন্যদিকে, প্রণবেশবাবুও মেডিক্যাল ক্যাম্পের তাঁবুতে ফিরে গিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছেন। টিটো দেখলো, রহিতদা তাঁবু থেকে বাইরে বেরিয়ে কি যেন খুঁজছে। টিটোকে দেখেই কাছে টেনে নিয়ে কানে কানে বললো, “ কি বলেছিলাম না, তোর বাইনোকুলার ওঁরা নিয়ে নেবে। আসলে কি জানিস তো, আমাদের প্রতি ওঁদের ভীষন কৌতুহল। তবে চিন্তা করিস না। ওঁদের কৌতুহল মিটতেই তোর বাইনোকুলার ওঁরা ফেরত দিয়ে যাবে। এটা আমার বিশ্বাস। ওঁদের প্রয়োজনে লাগেনা, এমন জিনিষ ওঁরা নেয়না।”

কখন যে ডুঙ্গি থেকে ব্যাগ নিয়ে এসে সেটা খুলে বাইনোকুলার জারোয়ারা বের করে নিয়েছে, টিটোর সেটা নজরে পড়েনি। টিটো অসহায়ের মতো দেখলো, কয়েকজন জারোয়া বাইনোকুলারটিকে নিয়ে উলটো করে চোখে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ওটা যে চোখে দেওয়ার জিনিষ, সেটা জারোয়ারা কিভাবে জানলো, ভেবে পেল না টিটো। তবে কি দ্বীপে পৌঁছনোর আগে, যখন ডুঙ্গি থেকে জারোয়াদের দেখছিল টিটো, সেটা কি জারোয়াদের নজর এড়ায়নি !

জারোয়াদের এই কান্ড দেখে একটু রেগেই হীরুদা বললো, “আমি গিয়ে তোর দূরবীনটা এনে দিচ্ছি। নয়তো জারোয়াগুলো ওটাকে ভেঙ্গে দেবে। এখানে তো তীর ধনুক নিয়ে কোন জারোয়া নেই। কোন ঝামেলা হবে বলে তো মনে হয়না”।

হীরুদার কথা শুনে অসহায়ভাবে রহিতদা বলে উঠলো, “ খবরদার হীরু, ওঁদের সঙ্গে ঝামেলা করতে যেওনা। ওঁরা বাইনোকুলার ঠিক ফেরত দিয়ে দেবে। বললাম না, ওঁদের প্রয়োজনে লাগেনা, এমন কোন জিনিষ ওঁরা কখনই ছিনিয়ে নেয়না।”

কয়েকজন জারোয়া টিটোর দুরবীনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। ওটা যে চোখে লাগাতে হয়, সেটা ওঁরা বুঝতে পেরে নিজেদের চোখের সামনে নিয়ে দেখছিল। অবে দূরবীনটা উলটো করে ব্যবহার করছিল। ওহামে নামের জারোয়া ছেলেটা টিটোকে হাত ধরে নিয়ে যেতে চাইলো ওই দূরবীন নিয়ে ব্যস্ত থাকা অন্য জারোয়াদের জটলার কাছে। কিন্তু যেতে ভয় আর অস্বস্তি হচ্ছিল টিটোর। রহিতদার অভয় বার্তা পেয়ে ওহামের সাথে শেষে গিয়েছিল জারোয়াদের জটলার কাছে। ওহামে জারোয়া দলটির সঙ্গে কথা বলে বাইনোকুলারটা টিটোর হাতে তুলে দিয়ে হাসলো। টিটো ভাবলো, ও বোধহয় বুঝতে পেরেছে বাইনোকুলারটি টিটোর খুব প্রয়োজনীয় জিনিষ। কৃতজ্ঞতায় বাইনোকুলারটি হাতে পেয়ে টিটো ওহামের দুই চোখের সামনে সেটিকে ঠিক করে ধরলো। ওহামের দুই হাতে ধরিয়ে দিলো বাইনোকুলারটিকে। ঠিকভাবে বাইনোকুলারের কাঁচে দৃষ্টি দিয়ে ওহামে তো অবাক ! সেটিকে বারবার করে চোখের  সামনে ধরছিল, আর সরিয়ে নিচ্ছিল। টিটো বুঝতে পারলো, বাইনোকুলারের মজা ওহামে বুঝতে পেরেছে। ওহামে এবার জটলাতে যে জারোয়াগুলো ছিল, তাদের প্রত্যেকের চোখের সামনে বাইনোকুলারটি ধরছিল। দূরের জিনিষ কাছে চলে আসছে, দেখে ওরাও যে মজা পেয়েছে, সেটা টিটো বুঝতে পারলো, যখন ওহামে সহ আরও তিনজন জারোয়া হাত মাটিতে রেখে পা উপরে তুলে আনন্দে হাত দিয়েই হাঁটা শুরু করলো।

কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করছিল রহিতদা। টিটোকে কাছে ডেকে বললো,, “তোর বাইনোকুলারের মজাটা এবার এঁরা বুঝতে পেরেছে। তাই এরকম হাত দিয়ে হাঁটছে। জারোয়ারা খুব আনন্দ পেলে এরকম আচরন করে। মনে হয়, এঁদের কাছে তোর আর কোন ভয় নেই।”

টিটো দেখছিল, ওহামের সারা শরীরে, বিশেষ করে মুখে সাদা আর লাল মাটির প্রলেপ আর দাগ দেওয়া রয়েছে। টিটো নিজের ভাষাতেই দাগগুলোর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “এগুলো কি ? মুখে এগুলো কেন লাগিয়েছো ?”

ওহামে কি বুঝলো কে জানে ! হেসে টিটোর ডান হাত ধরে টেনে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যেতে চাইলো। টিটো এখন ওহামের সঙ্গে অনেক স্বাভাবিক হলেও, হঠাৎ ওঁর এই আচরনে ঘাবড়ে গিয়ে রহিতদার দিকে তাকালো। রহিতদা তখন তাঁবুর দিকে রওনা দিয়েছে। পিছন থেকে টিটোর ডাক শুনে ফিরে দাঁড়িয়ে ঘটনাটি শুনে মাথা নেড়ে সন্মতিসূচক ইশারা করতে টিটো ওহামের সঙ্গে জঙ্গলের দিকে রওনা দিল। ওহামে যে ওকে বন্ধু ভেবে নিয়েছে এবং সেকারনে ওঁর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে, সেটা টিটো বেশ ভালোই বুঝতে পারছে এখন। ওহামে টিটোকে জঙ্গলের ভিতরে, রহিতদাদের মেডিক্যাল ক্যাম্পের কিছুটা দূরে নিয়ে গিয়ে একটা গাছের সামনে দাঁড় করালো। লম্বা ওই গাছের গুড়ি থেকে লতানো অন্য একটা গাছের পাতা ছিঁড়ছে ওহামে। অনেকগুলো পাতা ছিঁড়ে ওহামে হাতের মধ্যে ডলতে লাগলো। টিটো দেখলো, ওহামের হাতে পাতার রস তৈরি হয়েছে। এবার ওই রসের সঙ্গে মাটি মিশিয়ে কাদার মতো করলো। তবে এই কাদা কালো রঙের নয়। কাদাগুলো হলো সাদা রঙের। শুধু কাদাই নয়, ওহামে নামের জারোয়া যুবকটি ছুটে গিয়ে কিচ্ছুক্ষন পরে আবার ফিরে এলো হাতের মুঠি করে সাদা রঙের এক ধরনের তৈলাক্ত জিনিষ নিয়ে। এবার কাদার সঙ্গে সেই সাদা তৈলাক্ত জিনিষ একসঙ্গে মাখিয়ে সেই মিশ্রন ওহামে টিটোর মুখে হাতে লাগিয়ে দিল। ওহামের মুখে সে কি আনন্দের হাসি ! ওহামে আর টিটো কাদা মেখে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ফিরে এলো রহিতদাদের মেডিক্যাল ক্যাম্পে।

টিটোর মুখে হাতে সাদা রঙের মাটির দাগ দেখে রহিতদা তো অবাক ! “এগুলো তোকে এভাবে কে লাগিয়ে দিল ?” জিজ্ঞাসা করলো রহিতদা। টিটোর সঙ্গেই ছিল সেই ওহামে নামের জারোয়া ছেলেটি। ওঁকে দেখিয়ে টিটো রহিতদাকে উত্তর দিল, “তোমাকে জানিয়েই তো গিয়েছিলাম”, ওহামে কে দেখিয়ে ফের বললো, “ওর মুখে, শরীরে এই সাদা দাগ দেখে কারন জিজ্ঞাসা করায়, ও জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে।” এরমধ্যে ওদের কাছে ছুটে এসেছেন প্রণবেশবাবু। টিটোকে এভাবে দেখে প্রথমে সব শুনলেন। তারপরে জানালেন, জারোয়ারা জংলা কিছু বিষাক্ত পোকামাকড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এক ধরনের গাছের পাতার রস মাটি আর শুয়োরের চর্বি দিয়ে মিশিয়ে শরীরে এই ধরনের দাগ লাগিয়ে রাখে। ফের অবাক হয়ে প্রণবেশবাবু জানতে চাইলেন, “কিন্তু জারোয়ারা তো বাংলা বুঝতে পারে না। তোমার ভাষা কি ভাবে বুঝলো টিটো ?”

“আমি কোন জারোয়া ভাষা বলিনি। ওঁকে ইশারায় বুঝিয়ে ছিলাম। তাতেই ওহামে বুঝে নিয়েছে,” টিটো জবাব শেষ করার আগেই মেডিক্যাল ক্যাম্প থেকে এক জারোয়া মহিলা প্রণবেশবাবুকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করতে শুরু করেছেন। ওদের সঙ্গে রহিতদাও ছিল। ওই মহিলা ক্যাম্পের ডাক্তারকে দেখাবেন না। ওঁনার বিশ্বাস, তাঁর যে অসুখ হয়েছে, তা রহিতদা বা প্রণবেশবাবুর দ্বারাই ঠিক হবে। ওই মহিলা ওদের কাছ এসে বলতে শুরু করলেন, “ উলো…উলো…।” আর হাত দিয়ে ডান পা-এর দিকে দেখাতে লাগলেন। দেখা গেল, ওই মহিলার ডান পা এর মাঝ বরাবর ক্ষতের দাগ। সেখান থেকে রক্ত ঝড়ছে। রহিতদা জারোয়া মহিলাটিকে ওখানেই দাঁড়াতে বলে মেডিক্যাল টিমের চিকিৎসকের কাছ থেকে ব্যান্ডজ, তুলো আর ওষুধ নিয়ে এসে ক্ষতের জায়গার রক্ত মুছিয়ে সেখানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। এই জারোয়া মহিলা কিন্তু উলঙ্গ ছিলেন না। তার পরনে ছিল খাটো করে পরা একটি সাধারন শাড়ি।

“বুঝলে তো টিটো বাবু,” কথা বললেন প্রণবেশবাবু, “ এঁদের থেকে এই বিশ্বাস অর্জন করা রাতারাতি সম্ভব হয়নি। প্রথম প্রথম যখন ওষুধপত্র নিয়ে আসতাম, জারোয়ারা খুব সন্দেহ করতো। আমরা মেডিক্যাল ক্যাম্প করতে আসার আগে সাদা পোষাকের আন্দামান পুলিশের লোকজনেরা এসে এঁদের নিজস্ব ভাষাতে সব বুঝিয়ে যেত। তবুও কত সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। সবসময় আমাদের গতিবিধির উপর নজর রাখতো, আমাদের আচরন খেয়াল করতো। ভাবটা এমন ছিল, যেন জারোয়ারাই নৃবিজ্ঞানী, আর আমরা ওঁদের অদ্ভুত সব সাবজেক্ট। এখন তো এঁদের বিশ্বাস জন্মে গিয়েছে। এখন আর ঝামেলা করেনা। আসলে ইংরেজ আমলে এই আন্দামানের লোকজনেরা জারোয়াদের ইংরেজদের দিয়ে নানা রকম অত্যাচার করিয়েছিল। সেই থেকে জারোয়াদের আমাদের উপর অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। সেটা ভেঙে এই বিশ্বাসের জায়গায় আসতে অনেক সময় লেগেছে। তবে সবটাই যে আমরা করেছি, সেটা ঠিক নয়। ”

ওহামের সামনেই জারোয়াদের অত্যাচারিত হওয়ার ইতিহাস সংক্ষেপে বলতে শুরু করলেন। ওহামে কি বুঝছিল টিটো জানেনা। তবে আগ্রহ নিয়ে প্রনবেশবাবুর সব কথা শুনছিল। প্রনবেশবাবু বলে চললেন, সাউথ আন্দামান এলাকার, মানে সাউথ আন্দামান দ্বীপে ইংরেজ আমলে প্রায় পাশাপাশি থকতো জারোয়ারা আর এখানকার আদিবাসী গ্রেট আন্দামানিজরা। এঁদের এই দুটো নামই কিন্তু আসল নাম নয়। আসলে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীরা বেশ কয়েকটি ছোট ছোট গোষ্টী নিয়ে গঠিত ছিল। দিও এখন এঁদের সংখ্যা এখন একদমই কমে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে অনেক চেষ্টার পরেও এঁদের জনসংখ্যা রক্ষা করা বা এঁদের টিকিয়ে রাখা যায়নি। সবই ইংরেজ সম্প্রদায়ের কুভ্যাসের কারনে প্রায় এখন ধ্বংসের মুখে চলে গিয়েছে। যাইহোক, আন্দামানের আদিবাসীদের ‘গ্রেট আন্দামানিজ’ এবং এঁদের ‘জারোয়া’ নামটিও দেয় ইংরেজরা। হয়েছিল কি, ১৮৫৭ সালে আন্দামেনর সাউথ দ্বীপে ব্রিটিশ মানে ইংরেজদের ‘পেনাল সেটেলমেন্ট’ শুরু হওয়ার সময় থেকেই ধীরে ধীরে ইংরেজদের সঙ্গে গ্রেট আন্দামানিজদের ভাব বিনিময়ের কাজ শুরু হয়। কিন্তু সেই ইংরেজদের সেটেলমেন্টের কাজে নিজেদের অস্তিস্ব রক্ষার তাগিদে রুখে দাঁড়িয়েছিল একদল স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়। এই দ্বীপপুঞ্জের পাহাড় ঘেরা জঙ্গলের অধিকার ইংরেজদের হাতে সেই আদিবাসীরা ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি। তখন ইংরেজরা অবাক হয়ে আন্দামানিজদের জিজ্ঞাসা করেছিল, এঁরা তি তোমাদেরই লোক? ইংরেজদের সেই কথার উত্তরে গ্রেট আন্দামানিজরা নিজেদেরকে বাঁচাতে উত্তর দিয়েছিল, ‘ না , ওঁরা জারোয়া ! সেই সময় এই দ্বীপপুঞ্জে তখন আকারিয়া নামে এক ধরনের ভাষার চল ছিল। আকারিয়া ভাষায় জারোয়া কথার অর্থ ‘অপরিচিত’। সেই থেকেই এই সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের নাম ইংরেজদের মাধ্যমেই ছড়িয়ে যায় জারোয়া।

এমনিতে গ্রেট আন্দামানিজরা ইংরেজদের তাবেদারি করলেও জারোয়াদের সঙ্গে বেশ শন্তিতেই ছিল সসময়ে। কিন্তু সেই গ্রেট আন্দামানিজদের একাংশ ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলানোর ফলে এই জারোয়ারা পড়লো মহা সমস্যাতে। জারোয়ারা কিন্তু এই জঙ্গলে নিজেদের অধিকার যেমন ছেড়ে দিতে চাইছিল না, তেমনই মেনে নিতে পারছিল না, ইংরেজদের সাথে গ্রেট আন্দামানিজদের একাংশের করা তাবেদারিও। ফলে সমস্যার শুরু হলো সেখানেই। ইংরেজরা এমনিতেই ছিল খুবই শিকারপ্রিয়। সেই প্রিয় নেশার টানে ইংরেজরা এই দ্বীপের জঙ্গলে ঢুকে পড়তো আর কুকুর নিয়ে বুনো শুয়োর আর হরিনের খোঁজে। কিন্তু অচেনা গভীর জঙ্গলের গলিপথ ইংরেজরা চিনতে না পেরে প্রায়ই বিফল হতো। ইংরেজদের এই বিফলতা কাটাতে এগিয়ে এসেছিল একদল ইংরেজ ভক্ত গ্রেট আন্দামানিজরা। তাঁদের সাহায্যেই ইংরেজরা কুকুর দিয়ে খুঁজে বের করে বন্দুকের গুলিতে হরিন বা শুয়োর মারতো। জারোয়ারা যে ইংরেজদের এই কাজে বাধা দেয়নি, তা নয়। যে সব জারোয়া যুবক সম্প্রদায় বাধা দিতে এসেছিল, তাঁদের একমাত্র অস্ত্র তীর ধনুক, বল্লম নিয়ে, ইংরেজদের বন্দুকের গুলি তাঁদের তীর বা বল্লমকে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছিল। এর ফলে সেসময় ইংরেজদের বন্দুকের গুলিতে মারা যায় অসংখ্য জারোয়া।

সেকারনে আজও কুকুর দেখলে প্রচণ্ড খেপে যায় জারোয়ারা। সেই ইংরেজ আমলের অত্যাচার জারোয়ারা এখনও ভোলেনি। যুগ যুগ ধরে নিজেদের মধ্যে মুখে মুখেই প্রচিলিত হয়ে রয়েছে সেকথা।  একারনে এখনও জারোয়ারা নিজেদের ছাড়া অন্য প্রজাতির কোন মানুষ দেখলেই অবিশ্বাস করে। ওঁদের মনে এখনও সেই অত্যাচারের ঘৃনা জমে রয়েছে। জারোয়ারা এখনও ভুলতে পারেনি সেই গত দুই শতাব্দির ইংরেজদের আত্যাচারের ইতিহাস। এই ইংরেজরাই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়, জারোয়ারা হিংস্র, বর্বর। সেই কথা আজও সাধারন মানুষের মনে গেঁথে রয়েছে। কিন্তু চিন্তা করে দেখা উচিত, জারোয়ারা এমনিতে হিংস্র হয়নি। বরং উলটে তাঁদের উপরেই অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল ইংরেজরা।

প্রনবেশদা বললেন, “ ইংরেজদের বন্দুকের গুলি থেকে বাঁচার চেষ্টাতেই আত্মরক্ষার জন্য এটাই ছিল জারোয়াদের প্রথম প্রতিবাদ। সেই তীর বল্লম দিয়েই ইংরেজদেরকে জারোয়ারা দূরে সরিয়ে রেখে, নিজেদেরকে রক্ষা করেছিল। কিন্তু এখন তো দেশ স্বাধীন হয়েছে, নিয়ম কানুন অনেকটা বদলে গিয়েছে। অনেক চেষ্টার পরে বোঝানো গিয়েছে এই জারোয়া সম্প্রদায়কে। তবে খুবই ধীরে ধীরে, অনেকটা সময় নিয়ে। বুঝলে টিটো, ১৯৭৪ সালে জারোয়াদের সঙ্গে প্রথম ফ্রেন্ডলি কনট্যাক্ট হয়েছিল। আর ওঁদের বাঁচাতে, কিছুটা সিভিলিয়ান করার কজ শুরু হয় ১৯৭৬ সাল থেকে। আমরা এখনও সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রণবেশবাবুর আক্ষেপ করলেন, “লাভের লাভ এটাই হয়েছে, আমাদের আর দেশে ফিরে গিয়ে ছুটির সময় পরিবারের সঙ্গে টানা বেশি দিন থাকা হয় না !”

টিটোর পাশে দাঁড়িয়ে এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল হীরুদা। হীরুদা নিজে থেকেই এক কুচকুচে কালো জারোয়া যুবকের সঙ্গে ভাব করে নিয়েছে। টিটো শুনতে পেল, ওই জারোয়া ছেলেটি হীরুদাকে ডাকছে, “বাবু তোলা ওয়ায়ে” নামে। সেটা শুনে প্রনবেশবাবু হেসে টিটোকে বললেন, “ওই জারোয়াটি হীরুর রোগাসোগা চেহারা নিয়ে ওঁর নাম দিয়েছে। হয়তো হীরুর নাম বলতে কোন অসুবিধা হচ্ছে। ‘বাবু তোলা ওয়ায়ে’ কথার মানে হলো জারোয়া ভাষায়, ‘ ‘রোগাসোগা বাবু।’ হীরুদার এই নাম শুনে ওহামেও খুব মজা পেয়েছে। সেটা ওঁর মুখের হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ওহামেও হীরুদাকে জারোয়া ভাষায় ভেঙেনোর মতো করে বলে চলেছে, ‘বাবু তোলা ওয়ায়ে…… বাবু তোলা ওয়ায়ে………।’ টিটো লক্ষ্য করেছে, এখানকার জারোয়াদের গায়ের চামড়া অদ্ভুত ধরনের কালো এবং চকচকে। ওঁদের গায়ের আলো কেমন যেন পিছলে পিছলে যাচ্ছে – চামড়া এত মসৃন আর উজ্জ্বল।

টিটোর জারোয়া বন্ধু ওহামে কোথা থেকে ঘুরে এসে টিটোর হাতে একটা ছোট গাছের গুড়িকে ফোঁপড়া মতো বানানো জিনিস তুলে দিল। আকৃতিতে সেটা খুব বড় না হলেও, আমাদের ঘরের বড় জামবাটির মতো আকৃতির। টিটো দেখলো, সেই পাত্রের মধ্যে একধরনের তরল পদার্থ রয়েছে। টিটোকে দেখিয়ে ওহামে নিজের হাতের চারটি আঙ্গুলই ডুবিয়ে সামান্য কিছু তরল পদার্থ নিয়ে মুখে দিল। আঙ্গুল চাটতে লাগলো।

টিটো বুঝতে পারলো, এগুলো নিশ্চই কোন খাবার জিনিস। দেখে টিটোর মনে হলো, সম্ভবত তরল পদার্থটি মধু জাতীয় কিছু হতে পারে। ওই পাত্র হাতে ধরে কি করবে ভাবছে, সেই সময় হীরুদা এগিয়ে এসে ওঁর কাছে বললো, “দেখি, জারোয়া ছেলেটা তোকে কি দিল !”  বলেই টিটোর হাত থেকে পাত্রটি ছিনিয়ে নিয়ে সেটার ভিতরে আঙ্গুল ডুবিয়ে ওহামের দেখাদেখি নিজে আঙ্গুল দিয়ে সামান্য ঘন তরল পদার্থ তুলে মুখে দিল।

“আরে !! এতো মধু ! আর কি দারুন খেতে ! এই টিটো, জারোয়া ছেলেটা তোকে মধু খেতে দিয়েছে। খেয়ে দেখ, খুব ভালো খেতে,” বলে নিজেই আবারও আঙ্গুল দিয়েই পাত্র থেকে মধু খেতে শুরু করেছে।

টিটো হীরুদার কথা মতো ওহামে নামের জারোয়া বন্ধুটির দেওয়া পাত্র থেকে মধু তুলে খেয়ে দেখলো, সত্যি সুন্দর স্বাদের খেতে এই মধু। এই ধরনের স্বাদের মধু টিটো এর আগে কখনও খায়নি। কলকাতাতে যে  ধরনের মধু পাওয়া যায়, ওদের বাড়িতে যে জাতীয় মধু নিয়ে আসা হয়, সেগুলিতে নামি কোম্পানীর ছাপ দেওয়া থাকলেও, স্বাদে এই মধুর ধারেপাশে আসেনা। মধু খেয়ে খুব খুশি হলো টিটো। টিটোর খুশির রেশ চোখমুখ দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসছিল। সেই অভিব্যক্তি দেখে টিটোর মনের ভাব বুঝতে অসুবিধা হলো না তাঁর জারোয়া বন্ধু ওহামের। সে আরও বেশি উৎসাহ নিয়ে আরও এক পাত্র মধু নিয়ে হাজির হয়েছে। টিটোর সেই মধু খেতে আর ইচ্ছে করলো না। কারন, টিটো বিশ্বাস করতো, সুস্বাদু জিনিষ অল্প খাওয়াই ভালো। সে তবুও ওহামের নিয়ে আসা মধু ভর্তি পাত্র হাতে নিয়ে দেখতে পেল, তাতে তখনও বেশ কয়েক’টি

মৌমাছি ভেসে রয়েছে এবং সেগুলো সবই জ্যান্ত। এর মানে টিটো বুঝতে পারলো ওঁদেরকে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখে কাছের কোন গাছের মৌচাক থেকে অনায়াসে এই মধু নিয়ে এসেছে ওহামে নামের জারোয়া ছেলেটি। সে সেই মধু খাওয়ার কথা নিষেধ করবে কিভাবে, সেটা ভাবতে ভাবতেই রহিতদা ওঁকে ডেকে বললো, “ আজ আর নয়, এবার ফিরে যেতে হবে। চল, ডুঙ্গিতে চেপে বস। আমরা সবাই এখন ফিরে যাচ্ছি।”

টিটো চারদিকে তাকিয়ে দেখলো, মেডিক্যাল ক্যাম্পের জন্য যে অস্থায়ী টেন্ট বা তাঁবু বানানো হয়েছিল, দলের অন্য লোকেরা সে সেগুলো গুটিয়ে নেওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। টিটো বুঝতে পারলো, আজ তাঁদের প্রথম দিনের জারোয়া দ্বীপের অভিযান এখানেই শেষ হতে বসেছে। মনে আফসোস হলো, কেন জারোয়া ছেলেটির সঙ্গে আরও আগে থেকে পরিচয় হলো না ! তবে ওঁর সঙ্গে আরও কিছুটা বেশি সময় কাটাতে পারতো সে !

 

 

।।  ৫ ।।

 

 

‘হালফা’ হওয়ার কারনে টিটোদের দুদিন রহিতদার বারাটাঙের কোয়াটারে কাটাতে হলো। প্রচন্ড বৃষ্টি হওয়ায় টিটো আর হীরু ঘরের মধ্যে প্রায় বন্দি। ‘হালফা’ যে কি ধরনের মারাত্মক ঝড় হতে পারে, টিটোর সেসম্পর্কে কোনো ধারনাই ছিল না। সেদিন জারোয়াদের দ্বীপ থেকে বিকালের অনেক আগেই রহিতদাদের মেডিক্যাল টিমের ডুঙিতে চেপেই বারাটাঙএ ফিরে এসেছিল। তারপরের দিন সকাল থেকেই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়ে শুরু হয়েছিল তুমুল বৃষ্টি। সেদিন জারোয়াদের দ্বীপ থেকে ফিরে আসার পরে যেন হীরুদা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। আর সেরকম বিজ্ঞদের মতো জ্ঞান দিচ্ছেনা !

মাঝে একবার প্রনবেশবাবু টিটোদের সাথে দেখা করতে রহিতদার কোয়াটারে এসেছিলেন। বর্ষাতি গায়ে মাথায় ছাতা দিয়ে। অল্প সময় গল্প করে আবার অফিসে ফিরে গিয়েছেন। প্রনবেশবাবুর কাছেই ওঁরা জানতে পারলো, হালফা এই সময় আন্দামান সাগরে এক ভয়ংকর বিভীষিকা। ‘হালফা’ হলো উদ্দাম এক সামুদ্রিক ঝড়। বিপজ্জনক হালফার মধ্যে ডুঙ্গি নিয়ে কোনভাবেই সমুদ্র দিয়ে জারোয়াদের ওই দ্বীপে তো বটেই, কোন এলাকাতেই যাওয়া সম্ভব নয়। হালফা যে কোন মুহুর্তে ডুঙ্গি ডুবিয়ে দিতে পারে। আন্দামান সাগরে হালফার দৌরাত্ম্য প্রনবেশবাবুর কাছে জেনেছিল ওঁরা। হীরু-টিটো দু’জনেই প্রনবেশবাবুকে জানিয়েছিল, ওই জারোয়াদের দ্বীপ ওঁদের ভীষন ভালো লেগেছে। জারোয়া সম্পর্কে সভ্য জগতের সাধারন মানুষের ধারনা যে কতটা ভুল, সেই কথাও জানিয়েছিল।

“ শুধু সেন্টিনিলিজদের নিয়েই আমরা চিন্তিত। ওঁদের দ্বীপে যাওয়ার কোন সরকারি নিয়মই নেই। এখনও কোন সভ্য মানুষকে সেন্টিনিলিজরা ওঁদের দ্বীপের ধারেপাশে ভিড়তে দেয়না। আমরাও যাওয়ার চেষ্টা করিনা। সেন্টিনিলিজরাই এখনও আন্দামানের আদিবাসীদের মধ্যে বহুচর্চিত বিষয়,” জানিয়েছিলেন প্রনবেশবাবু। সেদিনের পর থেকে হীরু-টিটো দুজ’নেই প্রনবেশবাবুকে ‘প্রনবেশদা’ বলে ডাকতে শুরু করেছে। রহিতদার সহকর্মী হওয়াতে প্রনবেশবাবুও ওঁদের ‘দাদা’ ডাককে স্বীকৃতি দিয়েছেন। প্রনবেশদা হীরুদাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলো তো তোমাদের সেদিন কিরকম অভিজ্ঞতা হলো ? জারোয়া সম্পর্কে কলকাতায় যা শুনে এসেছিলে, সেগুলোর সঙ্গে কি জারোয়াদের আচরনের কোন মিল পেয়েছিলে ?”

টিটো কিছু বলে ওঠার আগেই হীরুদা বলতে শুরু করেছিল, “ অসাধারন লেগেছে। জারোয়াদের এই রকম বন্ধুত্বপূর্ন ব্যবহার হতে পারে, এটা আমরা ভাবতেই পারিনি। কোথায় জারোয়াদের বিষ মাখানো তীর ! কোথায় এঁরা মানুষকে মেরে তার মাংস খায় ! এখানে আসার আগে কলেজে আমি দু-একজন বন্ধুর সঙ্গে আন্দামান ঘুরতে আসার ব্যাপারে আলোচনা করেছিলাম। ওঁরা সাবধান করেছিল। বলেছিল, খুব সাবধান ! আন্দামানের জারোয়া কিন্তু খুব ভয়ংকর। কোন বেচাল দেখলেই বিষ মাখানো তির চালিয়ে দেয়। জারোয়ারা অসভ্য, বর্বর। কিন্তু এখন শুধু দেখে নয়, একদিন মাত্র জারোয়াদের সঙ্গে মিশে এসে আমি জানাচ্ছি, জারোয়ারা ওরকম নয়। ওঁদের সম্পর্কে মিথ্যা রটনা সভ্যজগতের মানুষেরা ছড়িয়ে রেখেছেন।”

হীরুদার কথা থামতে এবার কথা বলার সুযোগ পেলো টিটো। নিজে কথা বলতে শুরু করলে হীরুদা যে থামতে চায়না, সেই অভ্যাস কখনই ছাড়তে পারেনি হীরুদা।

টিটো বললো, ‘আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেখা উপন্যাস ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’  অনেক আগেই পড়েছিলাম। আর রহিতদা আন্দামানে জারোয়াদের নিয়ে সরকারি চাকরি করে, এটা বোঝার পরে জারোয়ারা যে আমাদের প্রানে মারবে না, এরকম ধারনা আমার ছিল। কিন্তু জারোয়াদের নিজস্ব দ্বীপে গিয়ে, মাত্র একদিন ওঁদের সাথে মেলামেশার সামান্য সুযোগ পেয়ে, যে ধারনা হলো, সেটা সত্যিই ভুলতে পারবো না।  ওহামে নামের যে জারোয়া ছেলেটি আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করলো, ওঁর ব্যবহার আর আথিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। প্রনবেশদা সেদিন লক্ষ্য করেছিলেন, ফেরার সময় ওই ওহামে ঠিক মনে করে আমার বাইনোকুলারটা নিয়ে এসে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আসলে ওঁরা বুঝতে পেরেছিল, আমার ওই দরকারি জিনিসটা ওঁদের কোন প্রয়োজনে লাগবে না। ”

“জারোয়ারা এই ধরনেরই। ওঁদের অপ্রয়োজনীয় জিনিস ওঁরা কখনই নেবে না”, বললেন প্রনবেশদা।

“ আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেই, আমাকে যাতে কোন পোকামাকড় না কামড়াতে পারে, সেজন্য জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ওই গাছের পাতার রস আর মাটি আমার শরীরে মাখিয়ে  দিয়েছিল। আর আমি যে ওদের অতিথি সেজন্য, কোথা থেকে যেন মধু নিয়ে এসে আমাকে খেতে দিয়েছিল। প্রথমে আমি আর হীরুদা প্রায় সম্পূর্ন মধু খাওয়ায় ও বুঝতে পেরেছিল, আমাদের এই মধু পছন্দ হয়েছে। তাই আমাদের কিছু না জানিয়েই আবার ফের নতুন করে মধু নিয়ে এসেছিল। ওই মধুর পাত্রে তো আবার জ্যান্ত মৌমাছিও ছিল। মনে হয়, কাছের কোন গাছের মৌচাক থেকে ওই মধু সংগ্রহ করে এনেছিল সে। যদিও সেই মধু খাওয়ার সময় না হওয়ায় আমি ওহামেকে পাত্রটা ফেরত দিয়ে এসেছি, ” টিটো বললো প্রনবেশদাকে।

প্রনবেশদা অফিস ফিরে যাওয়ার আগে বললেন, “ এবার যেদিন তোমাদের আবার নিয়ে যাবো, সেদিন দেখবে আরও নতুন রকমের অভিজ্ঞতা হবে। এই হালফার প্রকোপ কমলেই আমরা আবার সেই দ্বীপে যাবো। সেদিনও তোমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাবো”।

সেরাতে ন’টা নাগাদ রহিতদার মোবাইল ফোনে টিটোর মা ফোন করলেন। রহিতদার সাথে কথা শেষ করে মা চেয়ে নিলেন টিটোকে। রহিতদার সঙ্গে মা’এর যতক্ষন কথা হয়েছিল, রহিতদা একবারের জন্যও টিটোদেরকে জারোয়া দ্বীপে নিয়ে যাওয়ার সেদিনের কথা তোলেনি। কিন্তু টিটো নিজের উত্তেজনা ধরে রাখতে পারেনি। ও মাকে বলে বসলো, “ জানতো মা, রহিতদারদের মেডিক্যাল টিমের সঙ্গে জারোয়াদের গ্রামের এক দ্বীপে গিয়েছিলাম। কি অসাধারন জারোয়াদের ব্যবহার। আমাকে কি দারুন আপ্যায়ন করেছে। মধু খাইয়েছে…”

মা ফোনে টিটোর কথা শুনে রেগে উঠে বললেন, “ তোকে নিষেধ করেছিলাম না, জারোয়াদের ধারেপাশে না যেতে। আর তুই এসব কি বলছিস ! জারোয়ারা সাংঘাতিক হয়, একথা তোকে কতবার বললে হবে ! দে তো ফোনটা একবার রহিতকে…!”  মায়ের ধমক শুনে টিটো মন খারাপ করে ফোনটা রহিতদার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। রহিতদা টিটোর পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের সব কথাই শুনতে পেয়েছিল। রহিতদা ফোন নিয়ে বললো, “ না ! না ! টিটো তোমায় বানিয়ে গল্প বলছে ! তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। টিটোকে আমি কোনভাবেই জারোয়াদের কাছে যেতে দেবো না। আর টিটোরা তো এখনও জারোয়াদের চোখেই দেখতে পায়নি ”।

ফোন কোনমতে ছেড়ে টিটোর দিকে ফিরে রহিতদা বললো, “ দিচ্ছিলি তো, এখুনি সব প্ল্যান নষ্ট করে ! মাসির কথা শুনলে কিন্তু আর জারোয়াদের দ্বীপে যাওয়া তোদের হবেনা। কি করবি, তোরা একবার ভেবে দেখ। ”

রহিতদার কথায় টিটোর মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু মুখে প্রতিবাদ করে উঠেছিল। প্রতিবাদ করেছিল হীরুও। তারা দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলো,  “ ওসব কথা শুনবো না। কলকাতায় বসে কেউ ভাবতেই পারছে না আসলে জারোয়ারা কেমন ! তাই আবারও তোমরা যেদিন ওই জারোয়াদের দ্বীপে যাবে আমরাও তোমাদের সঙ্গে যাবো। কারো কোন নিষেধ শুনবো না। এটা বলে দিলাম !”

রহিতদা গম্ভীর মুখে শুধু বললো, “ দেখা যাক! কি হয় ! ”

আরও দু’দিন একই রকমভাবে ঝড়বৃষ্টি চললো। ঝড় বৃষ্টি না থামলে রহিতদারা যে জারোয়াদের দ্বীপে যাবেনা, সেটা টিটোরা বেশ ভালোই বুঝতে পারছিল। সেরাতে মা এর ফোন আসার পর থেকে রহিতদা ওঁদেরকে নিয়ে আবার জারোয়া দ্বীপে যাবে কি না- সে বিষয়ে কোন কথা আর আলোচনা করছিল না। রহিতদার এই আচরনে টিটোর মন খারাপ লাগছিল। শুধু মনে হচ্ছিল, সেদিন মুখ ফসকে মাকে ওঁর সব কথা বলা উচিত হয়নি। এবার যদি রহিতদা আর ওঁদের না নিয়ে যায় জারোয়াদের দ্বীপে, সেকথা ভেবে নিজেকেই নিজে দায়ী করছিল টিটো। এসবের পরে হীরুদাও যেন কেমন চুপ করে গিয়েছে। খুব বেশি কথা বলছে না। কলকাতা থেকে নিয়ে আসা জারোয়াদের উপর লেখা বইটা একমনে শুধু পড়ে চলেছে। টিটোর শুধু মনে হচ্ছে, মা নিশ্চই সেদিন ওঁদেরকে কোনভাবেই যাতে জারোয়াদের সামনাসামনি না হয়, সেকথা রহিতদাকে বলে দিয়েছেন। নিষেধ করে দিয়েছেন, কোনভাবেই যাতে টিটোকে নিয়ে  জারোয়া এলাকাতে না যায় ! টিটোর নিজের এই আচরনের জন্য নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে। সে শুধু প্রার্থনা করে চলেছে, আকাশ পরিস্কার হওয়ার পরে যেদিন রহিতদাদের মেডিক্যাল টিম

জারোয়া দ্বীপে যাবে, যেন ওঁদেরকেও সঙ্গে নিয়ে যায়। আন্দামানের ঝড় বৃষ্টির মধ্যে রহিতদার কোয়াটারের ঘরের ভিতরে এভাবে বন্দি হয়ে থাকতে একদমই ভালো লাগছে না টিটোর।

টিটোর প্রার্থনা যে এভাবে সত্যি হবে, সেটা সে ভাবতেও পারেনি। টানা ছয়দিন একনাগাড়ে ঝড় বৃষ্টি সহ হালফা থামতেই আকাশ ঝকঝকে হয়ে গিয়েছে। চারদিকে রোদ ঝকমক করছে। বৃষ্টিতে ভিজে গাছের পাতাগুলোতে রোদের আলো ঝিলিক দিচ্ছে। তবুও টিটোর মনে, সকালে ঘুম থেকে উঠে আকাশ পরিস্কার দেখেও তাঁদেরকে আবারও রহিতদা জারোয়াদের দ্বীপে নিয়ে যাবে কি না, ভেবে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।

এর কিছুক্ষনের মধ্যেই সে সুসংবাদ পেল। অফিস থেকে মাঝে কোয়াটারে এসেছিল রহিতদা। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে টিটো বসেছিল ঘরের বারান্দার চেয়ারে। রহিতদা ওঁকেই জিজ্ঞাসা করলো, “ কি রে, হীরু ঘুম থেকে উঠেছে ? না উঠলে ওকে ডেকে তুলে তৈরি হয়ে নিতে বল। তুই নিজেও তৈরি হয়ে নে। আজ দেরি হলেও একবার জারোয়াদের দ্বীপ লাকড়া লুংটাতে যেতে হবে।”

(চলবে)

 

 

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত