ছাপ/পর্ব-৪ (রহস্য উপন্যাস)

৪.

যে দুঃখবোধটা প্রতিদিনের যাপিত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আমৃত্যু বয়ে বেড়ানোর, ওই দুঃখবোধটা কখনো চোখজোড়াকে ছলছল করে তোলে। কখনও বাঁধ ভাঙা কান্নায় জর্জরিত করে। আবার খুব দ্রুতই চোখ মুছিয়ে, কান্না ছাপিয়ে শুধু ফুসফুস ভড়া দীর্ঘশ্বাস আটকে রেখে স্বাভাবিক হতে শেখায়। কান্না শেষে ফিরোজা খুব নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে প্রশ্ন করে,

– মিটুন আর মিলনের জন্য সকালের নাস্তা বানাতে হবে!

– হ্যাঁ, তবে তোমার সমস্যা হলে থাক। আজ ইচ্ছে করছে কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে সবাই মিলে একসাথে নাস্তা করি, তুমিও চলো।

– নাহ, আমি যাবো না। তোমরা যাও।

এই উত্তরে কাজল বিরক্ত হলেও মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। তাতে বিরক্তি কতটা আড়াল হয় বুঝতে পারে না। কোমল স্বরে বলে,

– তবে থাক। বাইরে থেকে নাস্তা কিনে আনবো, তুমি দুপুরের জন্য কিছু আয়োজন কর।

ফিরোজা রান্না ঘরে যেতে যেতে বলে,

– বাইরে থেকে নাস্তা কিনে আনার দরকার নেই।

মিলন ও মিটুন সকাল দশটার আগেই চলে এসেছে। খাবার টেবিলে বসে কাজল বিস্মিত- বহুদিন পর ফিরোজা নিজ হাতে নাস্তা বানিয়েছে। প্লেটে সাজানো রেল পরোটা আর একটা কারি বোওলে গোরুর মাংস ভুনা। ফিরোজার রান্নার হাত অসাধারণ। ওর রান্না করা গোরুর মাংসের ভুনার স্বাদ অতুলনীয়। মাংস ভুনায় মেথি দেয়, লেবুর খোসা খুব চিকন করে কেটে পরিমাণ মত মেশায়। সামান্য হেরফের হলেই স্বাদের ভুনা বিস্বাদ হয়ে যায়। ফিরোজার কখনো ভুল হয় না। কাজল বিশ্বাস করে রান্না হলো উচ্চাঙ্গ সংগীতের মত, শুদ্ধ স্বরের সাথে কোমল স্বরের মিশ্রণটা সঠিক না হলে, তাল আর লয়ে সমন্বয় না হলে, উপভোগের পরিবর্তে নির্মম নির্যাতনের অস্ত্র হয়ে উঠে।

টেবিলে নাস্তা গুছিয়ে দিয়ে, ফ্লাস্ক ভর্তি চা দিয়ে, ‘তোমরা খাও, কিছু লাগলে আমাকে বোলো..’ বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই মিটুন আপত্তি করে, ‘ধুত্তোরি ভাবী, আপনে কই যান! আমাদের সাথে নাস্তা করতে বসেন তো।’ কাজলও বলে, ‘একসাথে খেয়ে নাও, রান্না ঘরে পরে যাও।’ বিন্দুমাত্র ইচ্ছা না থাকলেও ফিরোজা হাসিমুখে কাজলের পাশে বসে, কাজলের প্লেটে পরোটা তুলে দেয়। আজ সারাটা দিন ওকে এমন অভিনয় করে যেতে হবে- যেন সদ্য বিবাহিত দম্পতি, এখনো হানিমুন পিরিয়ড চলছে।

কাজল বাড়িতে প্রমিত বাংলায় কথা বলে। বাড়িতে প্রমিত বাংলায় কথা বলতে হবে- কাফি জন্মানোর পর এই নিয়ম জারী করেছিলো ফিরোজা। কাফি নেই কিন্তু একটানা বারো বছর পালিত নিয়মটা রয়ে গেছে। কাজল নাস্তা খেতে খেতে বলে,

– রোজা, তোমারে তো বলি নাই। মিটুন আর মিলন মিলে ‍মুভি বানাবে। আমার কাঁধেও বন্দুক ঠেকিয়েছে। আজ মিলন মুভির গল্প বলতে এসেছে। তুমিও শুনো।

ফিরোজা বিস্ময়ের ভান করে বলে,

– বাব্বা! তাই না কি! কোন গল্প নিয়ে ছবি বানানো হবে!

মিলনের স্বরে অস্বস্তি,

– ভাবী, সেদিন ঝোঁকের মাথায় ক্রসফায়ারের একটা ঘটনা নিয়ে মুভি বানানোর প্রস্তাব দিয়েছিলাম। পরে ভাবলাম ওই ঘটনা নিয়ে ‍মুভি বানানো দূরে থাক, কথা না বলাই ভালো।

মিটুন বিরক্ত,

– ধুত্তোরি মিলন ভাই, আপনে দেখি ডরফাড্ডুর মতন কথা কইতাছেন। ক্রসফায়ারের গল্প মানেই তো ওৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীর অতর্কিতে হামলা। আপনার গল্প এর বেশী আর কি হইবো। এসব ঢং বাদ দিয়া গল্পটা কন তো, মানে কঙ্কালটা কন, মাংসটা আমরা তিনজনে মিলা সাজায়া নিমু।

মিলনের পরিবর্তে উত্তর দেয় ফিরোজা,

– সমস্যা হলে থাক, মিলন ভাই যেহেতু বলতে চাইছে না, জোড় করার দরকার কি!

মিটুনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কাজল বলে,

– শোনো মিলন, এই দেশে থ্রিলার মুভি বানানোর ঘটনার অভাব নাই। এখন চলছে সিজন অব ক্যাসিনো রেইড, মানে ক্যাসিনোতে অভিযানের মৌসুম। আজকের পেপার পড়েছো- প্রথম আলোর লিড নিউজ ‘পুলিশ পাহারায় চলত জুয়া’। সমকালের লিড নিউজ ‘কাদের পকেটে যায় ক্যাসিনোর টাকা’। অবশ্য সমকাল প্রথম পাতায় আরেকটা লিড করেছে ‘ছাত্রলীগের পর যুবলীগ ধরেছি : প্রধানমন্ত্রী/ আর নালিশ শুনতে চাই না”। কি বুঝলে, থ্রিলার গল্পের অভাব আছে!

মিলন বিস্মিত.

– অনলাইন আর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আপনে এত মন দিয়ে প্রিন্টেড পত্রিকা পড়েন!

কাজল হাসে,

– পুরানো অভ্যাস। নেশার মত। এখনও দু’টা বাংলা পত্রিকা আর একটা ইংরাজী পত্রিকা রাখি। সোশ্যাল মিডিয়ার হাইব্রিড বিনোদনের যুগে পত্রিকার পাতা ছাড়া আদি ও অকৃত্রিম নির্মল বিনোদন পাবো কোথায়! থ্রিল আর এডভেঞ্চার রস যোগান দিবে কে!

মিটুন মন্তব্য করে.

– ছোটো ছোটো ফন্ট, দুই হাতে পত্রিকা মেইলা লম্বা সময় ধইরা পড়েন কেমনে! এত ধৈর্য কই যে পান! এর মধ্যে আবার বিনোদন, থ্রিল আর এডেভেঞ্চারও উপভোগ করেন! আপনি যে কথা কইলেন তাতে থ্রিল আর বিনোদন কই? 

কাজল হাসে,

– তুমি থ্রিল আর বিনোদন খুঁজে পাচ্ছো না! “ছাত্রলীগের পর যুবলীগ ধরেছি : প্রধানমন্ত্রী/ আর নালিশ শুনতে চাই না” শিরোনামটা কিন্তু থ্রিল আর বিনোদন দু’টাকেই কভার করে। “ছাত্রলীগের পর যুবলীগ ধরেছি”- এটা তো পুরোই থ্রিলার। থ্রিলারের সূচনাতে পৌছতে হলে প্রশ্ন করতে হবে- এদের ছাড়া হলো কবে? ছাড়লো কে? ছাড়ার পর তারা যে ধরা পড়ার মত কর্মকাণ্ড করলো এর পেছনে- সামনে-ডাইনে-বায়ে কারা আছে? ছাড়া থেকে ধরা পর্যন্ত আসার যে দীর্ঘ পথ, ওই পথের প্রদর্শক কে বা কারা? এই পথ অতিক্রমের বাঁকে বাঁকে তারা রাজনীতির মোড়কে যে সন্ত্রাস করেছে, জবর দখল করেছে, খুন করেছে এবং সেসব থেকে যে উপায়ে মুক্ত হয়েছে এই পুরো প্রক্রিয়াটিই তো রোমহর্ষক ক্রাইম থ্রিলার।

– আর বিনোদন?

– বিনোদনের পার্টটা হইলো- ‘আর নালিশ শুনতে চাই না।’ অর্থাৎ নালিশ শোনার আগ পর্যন্ত সমস্যা নাই। নালিশ শুনলেই সমস্যা হবে। সুতরাং নালিশ করাকে প্রতিরোধ কর, নালিশ করার ব্যাপারে সংযত হও। মজা কিন্তু এইখানেই শেষ না, মাসের পর মাস ধরে থানার নাকের ডগায় ক্যাসিনো ব্যবসা চলছে, পুলিশ জানে না। শত কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে এলাকার এমপি জানে না। যেসব ক্লাবে ক্যাসিনো চলে তার সবকটায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা। একটার নির্বাহী কমিটির প্রধান ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগানে বিশ্বাসী ত্যাগী বাম নেতা। ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, মিডিয়া একের পর এক এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার করছে। এটা কি প্রমাণ করে?

মিডিয়ার কথা আসায় মিলন সর্তক হয়, মিডিয়াকে কিছু বললে ওর লাগে। বিরক্ত কণ্ঠে বলে,

– কি প্রমাণ করে!

– প্রমাণ করে যে এসব ঘটনা মিডিয়ার আগেই জানা ছিলো। তাদের কেউ কেউ, মিলন মাইন্ড কোরো না, সাংবাদিক নেতাদের কেউ কেউ হয় তো এসব জায়গা থেকে ভাগও পেত। অথবা কোনো বিশেষ এজেন্সি ক্যাসিনো বিষয়ক তথ্য সরবরাহ করছে। এতদিন নাক ডেকে ঘুমানোরা হঠাৎ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে বীর বিক্রমে জেগে উঠেছে, জেগে উঠেই একের পর এক এক্সক্লুসিভ গোপন তথ্য দিচ্ছে- ইন্টারেস্টিং না!

বিরক্তি গোপন না করেই মিলন প্রশ্ন করে,

– ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে এই অভিযানকে কি সমর্থন করেন না?

কাজল হাসে,

– বিরক্ত হও কেন মিলন! আমার সমর্থনে কি যায় আসে, বলো! তবু সমর্থনের কথা জানতে চাইলে বলতেই হয় ক্যাসিনো চালুর পক্ষেই তো ছিলাম না। আমার বাড়ির দুই কিলোমিটারের মধ্যে এসব ক্যাসিনো বা জুয়ার আড্ডা, এসব আড্ডার কথা কারো অজানা নেই। তাই হঠাৎ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে বীর বিক্রমে জেগে ওঠা গোষ্ঠীর কার্যক্রম দেখে সন্দেহ জাগে। আমি ধরো খারাপ মানুষ, তাই মনে প্রশ্ন আসে, এই ঘুম ভাঙানোর পিছনে চাল চালছে কতবড় জুয়ারী! কোন হিসাবের বুঝাপড়া ঠিকমত না হওয়ায় এই অভিযান! অবশ্য এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের মত আমপাবলিকের কোনো দিন জানা হবে না। তবে একথা লিখে রাখতো পারো, আগামী দু্ই থেকে তিন বছরের মধ্যে ক্যাসিনো কাণ্ডে আটকরা জামিনে বের হয়ে আসবে। নিজ নিজ কাজে মন দিবে। রাজনীতিতে সক্রিয় হবে। লোয়ার কোর্টে দুই একজনের দীর্ঘমেয়াদী সাজা হবে। এতে জনগণ তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে। কিন্তু হাইকোর্ট আর সুপ্রীম কোর্টে গিয়ে সাজা কমবে। এই প্রক্রিয়ার তাদের বের হয়ে আসতে একটু লম্বা সময় লাগবেএর বেশী কিছু হবে না।

মিলনের বিরক্তি কাটে না,

– কাজল ভাই, আপনে সবকিছুর একটা নেগেটিভ সাইড বের করেন। নেগেটিভ চিন্তার বাইরে আসতে পারেন না। এটা ঠিক না।

ফিরোজা গ্লাসে পানি ঢালছিলো, ওর দৃষ্টি কাজলের দিকে ফিরে, খুব শান্ত স্বরে বলে,

– তার মানে তোমার এমন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কথা আর কারো কাছেই গোপন নেই!

কাজল একটু বিরতি নেয়। যেন কি বলবে তা গুছিয়ে নিচ্ছে। তারপর নিজের দোষ স্বীকার করে,

– শোনো মিলন, আমি পোড় খাওয়া মানুষ। তাই তোমাদের মত এত পজেটিভ হতে পারি না।

পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য মিলন বলে,

– আপনি যেসব ঘটনা বললেন তাতে থ্রিলার গল্পের উপাদান কই!

– এসব ঘটনায় থ্রিলার কাহিনীর বহু উপাদান আছে। তুমি তো আর বাস্তব ঘটনার উপর মুভি বানাচ্ছো না, এসব ঘটনাকে ভিত্তি করে কাহিনী রচনা করা যায়। আজ খাবার টেবিলে তোমার গল্প না বলার অস্বস্তি দেখে একটা খাপছাড়া কাহিনী মাথায় এলো। শুনবে?

– বলেন।

কাজল আয়েশ করে বলতে শুরু করে,

– ধরো সাউথ ফ্যাসিল্যান্ড নামে এক দেশ আছে। ওই দেশের এক নেতা, তিনি নিয়মিত ডাক দেন- ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। কিন্তু এ ডাকে দুনিয়ার মজদুর দূরের কথা, তার মহল্লার সকল মজদুরও সাড়া দেয় না। তাতে কি বিপ্লব থেমে যাবে! না, থামবে না, কারণ শ্রমিকদের স্বার্থ আদায়ে নেতা আপোষহীন, শ্রমিকদের দিকে তাকালে তার বুকে বেজে চলে- ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়/লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।’ এই নেতা ছাড়া মজলুম লাখো ইনসানকে জালিমের বিরুদ্ধে কে জাগিয়ে তুলবে! নেতা মনে মনে তাড়না অনুভব করেন নিপীড়িত জনতার “এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে/দিতে হবে ভাষা– এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে/ ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা– ডাকিয়া বলিতে হবে–“,  হ্যা, ডাকিয়া বলিতে হবে – ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই করো।’ বলিতে হবে-  “কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না”, বলিতে হবে- ‘ভাত কাপড় জমি কাজ, তোলো আজ এই আওয়াজ।’ এটাও বলিতে হবে “নৌকা-লাঙল-ধানের শীষ/সব সাপের একই বিষ।” যদিও তিনি ক্ষমতার অংশীদার হবার জন্য, এই তিন সাপের যে কোনোটার সাথে বেড পার্টনার হতে রাজী, কিন্তু কেউ তাকে ডাকে না। কাহিনীর এই অংশে দিনের বেলা তার প্রতিবাদ, গরীব জীবন যাপন, দরিদ্র মানুষের প্রতি ভালবাসা ফোকাস পাবে। সাসপেন্সের জন্য রাতের বেলা দেখা যাবে প্রতিপক্ষ ও বিরোধী পক্ষের নেতাদের সাথে তার আলাপ-আলোচনা আর মৌজ মাস্তি। সন্ত্রাস ও দুর্নীতির গডফাদারদের দয়া-দাক্ষিণ্যে পার্টির লাল নিশানের চেয়ে হালকা রঙের শিশিপানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণের লড়াই।  

সাউথ ফ্যাসিল্যান্ডে একদা নদীমাতৃক দেশ ছিল। যদিও আমরা যে সময়ের কাহিনী বলছি, তখন নদীমাতৃক থেকে প্রমোশন পেয়ে সাউথ ফ্যাসিল্যান্ড উগ্র জাতীয়তাবাদের চেতনামাতৃক দেশে পরিণত হয়েছে। যার কেউ নেই সাউথ ফ্যাসিল্যান্ডে তার ট্রলার আছে। কাহিনীর বাম নেতা কসরৎ করে ট্রলারে উঠে পড়লেন। একটানা কয়েক দশক গণমানুষের(!) পক্ষে রাজনীতি করার পরও গণমানুষের সাথে তার সম্পর্কের মাত্রা এতটাই গভীর যে ভরাডুবির আশঙ্কায় নিজের মার্কায় নির্বাচন করার ভরসা পেলেন না। নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য নিজের মার্কা বিসর্জন দিলেন। অবশ্য আরেক বাম নেতাও মশাল হাতে ট্রলারে উঠে সঙ্গী হলেন- শোলে মুভির অমিতাভ বচ্চন আর ধর্মেন্দ্রের মত ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোরঙ্গে’র মত কঠিন বন্ধুত্ব। ট্রলারবাদী দলে সমর্থনে ট্রলার মার্কায় নির্বাচন করে তিনি সাউথ ফ্যাসিল্যান্ডের জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হলেন।

সাংসদ পদে শপথ গ্রহন করলেন। বিভিন্ন কমিটিতে পদাধিকার বলে স্থান পেলেন। তার সংসদীয় আসনের এলাকায় মের্সাস লজাতুননেছা গার্লস স্কুল ও কলেজসহ দেশের নামকরা অভিজাত স্কুলগুলো অবস্থিত। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হতে সমস্যা হলো না। “জ্ঞানের আলো ঘরে ঘরে জ্বালো” চেতনায় উজ্জীবিত নেতা ফের ডাক দিলেন- ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই করো।’ এবারের ডাকে আশাতীত সাড়া মিললো। ডাকে সাড়া দিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে হাজির হলো স্কুলে ভর্তিবাণিজ্য আর তদবির সিন্ডিকেটের বঞ্চিত শোষিত ক্ষুধার্ত মজদুর সমাজ। আনন্দে নেতার চোখে পানি চলে এলো, এতদিনের রাজনীতি আর সময়মত ডিগবাজী তাকে ক্ষমতাধর করেছে। তাই ডাক দিতেই ঝাঁকে ঝাঁকে মজলুম মজদুরের চলে এসেছে। এসব অনুগত মজদুরদের স্বার্থ রক্ষায় তিনি আপোষহীন অবস্থান গ্রহন করলেন। এবার বিপ্লব শেষ না করে থামবেন না।

এবার মুভিতে কিছু ক্লাইমেক্স যোগ করতে হবে। গণনেতার বিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রতি বিপ্লব শুরু হবে। অভিভাবকরা ভর্তি বাণিজ্যের মজদুরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলতে শুরু করবেন, ‘আমার সন্তানকে কেনো ঘুষ দিয়ে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে?’ সাম্রাজ্যবাদের দোসর পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোও প্রতি বিপ্লবে যোগ দেয়। ঘাম শুকানোর আগে মজদুরের পারিশ্রমিক প্রদানের কথা, অথচ ছাত্র/ছাত্রী প্রতি ভর্তি বাণিজ্যের মজদুরদের মাত্র দশ/বিশ লাখ টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। একদিকে হৈচৈ সামলানো, অন্যদিকে বিপ্লব চালিযে যাওয়া- গণনেতার লড়াইটা তুলে ধরতে হবে। কিছু প্রতিবিপ্লবী গণনেতার নামে মজুরী আদায় করেও নেতার পারিশ্রমিক শোধ করছে না, সিন্ডিকেটের মধ্যে ভাঙন ধরানোর জন্য গেম খেলছে, হামলা হচ্ছে- এমন টুইস্ট গুলোও ফোকাস করতে হবে।

নেতার বিপ্লবে পরাজিত বূর্জোয়াদের ষড়যন্ত্রে প্রতিবিপ্লবীরা রানীকে ভুল বুঝাতে সক্ষম হবে। ‘ভুল বুঝানো নিরসন বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ না থাকার মূল্য দিবে ত্যাগী নেতা। সাউথ ফ্যাসিল্যান্ডের রানী গণনেতাকে এসব স্কুল ও কলেজ কমিটি থেকে নিষ্ক্রিয় করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটিতে আটকে রাখার ব্যবস্থা করেন। ফলে ভর্তি সিন্ডিকেটের মজদুরদের ক্রন্দনে আকাশ-বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে- ‘চোখ ফেটে এল জল/ এমন করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল!’ অনেক অনেক বিপ্লব হলেও, আরও অনেক বিপ্লবের অপার সম্ভাবনা থাকার পরও,  বিপ্লব অর্ধসমাপ্ত থেকে যায়। তবে নেতার পোষা মজদুররা জানে- যতই বাঁধা আসুক, ঝড় আসুক, ঝঞ্ঝা আসুক বিপ্লব থেমে থাকবে না। বিপ্লব এগিয়ে যাবে সমাপ্তির পখে।

ঋতু পরিবর্তনের সময় অল্প কিছুদিনের জন্য শিশুদের ঠাণ্ডা কাশি, জ্বর জ্বারি হয়। শিশুরা মনমরা হয়ে থাকে। এরপর সুস্থ হয়ে শিশুরা আবার দুরন্তপনায় মেতে ওঠে। আমাদের গল্পের বাম নেতাও শিশুদের মত। আপন স্বার্থের শিশুতোষ বিপ্লব ভেস্তে গেলে মন খারাপ করে, কোলদাতার প্রতি নালিশের পাশাপাশি সতর্কও হয়, চুপচাপ থাকে। এরপর আবার ডেকে ওঠে- দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই করো। সাউথ ফ্যাসিল্যান্ডের রানীর কোমল হৃদয়। শিশুদের কান্না, বিশেষত ট্রলার মার্কার শিশুদের দুরন্তপণা সহ্য করতে পারলেও কান্না সহ্য করতে পারেন না। অতীতের সব ভুল ক্ষমা করে, আদুরে স্বরে ‘দুষ্টুমি কোরো না’ বলে তিনি কাহিনীর বাম নেতাকে উড়োজাহাজ ও ভ্রমণ বিষয়ক মন্ত্রীত্ব দান করলেন। 

মন্ত্রীত্ব পাওয়ার পর নেতা আবার ডাক দিলেন- ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই করো।’ এবারের ডাকেও বেশ সাড়া পাওয়া গেলো। লড়াই করার জন্য এগিয়ে এলো উড়োজাহাজের লিজ গ্রহন,  বিমানপোত কেন্দ্রিক চোরাচালান চক্রসহ বিভিন্ন চক্রের নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত মজদুরের দল। এসময়েই ক্যাসিনো মজদুরদের একটা অংশ সফল বিপ্লব ঘটিয়ে নেতাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে গড়ে তোলে ‘ক্যাসিনো রাজকীয়।’ এটিই নিপীড়িত নিষ্পেষিত বঞ্চিত গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কার্ল মার্ক্সের মতাদর্শে পরিচালিত পৃথিবীর একমাত্র শ্রেণি বৈষম্যহীন ক্যাসিনো। এছাড়া, এই মজদুররা নেতার সংসদীয় এলাকায় গড়ে তোলে আরও কয়েকটি বৈপ্লবিক ক্যাসিনো।

বিপ্লবের ধর্ম এই যে প্রতিবিপ্লব ঘটবেই। সাউথ ফ্যাসিল্যান্ডে সাম্প্রতিক নিশিভোট উৎসবের পর ধারাবাহিকভাবে প্রতিবিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। প্রথমে গেছে বাম নেতাদের মন্ত্রীত্ব। রানী বললেন, ‘এত্ত সুন্দর নিশিভোট উৎসব হলো, তবু শত্রুরা সমালোচনা করে। এই সমালোচনার জবাব দিতে বাম শিশুরা বিরোধী দলের আসনে বসবে। তোমাদের চকোলেট আর মিমির সরবরাহে ঘাটতি হবে না। আগামীবার কিন্তু নিজের মার্কায় নির্বাচন করতে হবে, মেন রেখ খোকারা।” রানীর পোষা অন্যসব বামনেতাদের মত কাহিনীর বামনেতাও প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন, শিশুদের মত কান্না করতে করতে বললেন, “আপনাকে ছেড়ে আমরা কোথাও যাবো না, হু। আপনি ছাড়া আমাদের কে আছে, হু! আমাদের তাড়িয়ে দিলে খুব কান্না করবো, হু। হু.. হু… হু.. ।”

আগেই বলেছি, আমাদের গল্পের রানী মানে সাউথ ফ্যাসিল্যান্ডের রানী এসব শিশুদের দুরন্তপনা সহ্য করলেও কান্নাকাটি সহ্য করতে পারেন না। তিনি আর জোড় করলেন না। কিন্তু বামনেতার নেতৃত্বে গণমানুষের লড়াই কি থেমে যাবে! বিপ্লব কি বন্ধ হয়ে যাবে! না, বিপ্লব বন্ধ হয়নি, হবে না। যতদিন দেহে আছে প্রাণ ততদিন আমাদের গল্পের মত ক্যাসিনোপন্থী কমিউনিস্ট নেতারা ধ্বংসস্তুপ থেকে দাঁড়িয়ে ডাক দেবেন- দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই করো।

এই যে বামনেতার জার্নি, ছাত্রনেতা থেকে বুড়ো বয়সে মন্ত্রী হওয়া পর্যন্ত পথের বাঁকে বাঁকে আপোষ, খুন, শত্রুকে মোকাবেলা করা, মজদুরদের পূঁজি করে ক্ষমতার মধু খাওয়া, কার্ল মার্ক্স থেকে ক্যাসিনো পর্যন্ত বিস্তৃত নেতার সফেদ পাঞ্জাবী পায়জামায় পরিমিত কারুকাজ করে দিলেই একটা আদর্শ পলিটিক্যাল থ্রিলার তৈরী হয়ে যায়। কি বলো মিলন!

কাজলের কথার মাঝে কেউ বাঁধা দেয়নি। মিলন ছাত্রাবস্থায় বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল, শ্রেণি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিভোর ছিলো। বিভিন্ন কারণে রাজনীতি থেকে সরে এলেও বাম রাজনীতির প্রতি মায়া রয়ে গেছে। সে কিছুটা আহত স্বরেই প্রতিবাদ করে,

– ভাই, এক-দুইজন নেতা দিয়ে আপনি সম্পূর্ণ বাম রাজনীতিরে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন না।

কাজল হাসে.

– বাম রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করলাম কই! আমাদের ফোকাস তো এই বাম নেতার জার্নি বাই দ্য পাওয়ার, অফ দ্য পাওয়ার, ফর দ্য পাওয়ার। এই বামনেতা কেনো ট্রলারবাদী পার্টির ট্রলারে উঠে, শক্তিশালী ট্রলারবাদী দল কেনো এদের নৌকায় অতিথি মাঝি হিসেবে তুলে- ফোকাস তো সেইটা।

মিলন কিছুটা রাগ আর অভিমানের সাথেই বলে, 

– কাজল ভাই, আপনে যে যুক্তিই দেন, এটা ঠিক না। আমার সাবেক নেতাকে নিয়ে আপনি এভাবে বলতে পারেন না।

কাজল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, কোনো রকমে নিজেকে সামলে নেয়,

– আমি কোনো নাম বললাম না। পরিচয় দিলাম না। তুমি কেন এই নেতাকে কাহিনীর কাল্পনিক চরিত্র না ভেবে তোমার সাবেক নেতা ভাবছো! নিজেই নিজেকে একটু প্রশ্ন করো, সাথে এই প্রশ্নটাও করো নেতার সমালোচনা কেন সহ্য করতে পারো না, বা নেতার সমালোচনায় কেনো খারাপ লাগে।

মিলন বিব্রত হয়। সত্যিই কাজল কারো নাম বলেনি, যেচে নিজের নেতার সাথে মিলানোটা ভুল হয়েছে। আজকাল এমন ভুল প্রায়ই হচ্ছে। মিলনকে উদ্ধার করতে মিটুন এগিয়ে আসে,

– কাজল ভাই, আপনি বিএনপিও করেন না। আওয়ামী লীগও করেন না। বামও না আবার জামাতও না- অথচ আপনে রাজনীতি করেন। রাজনীতি নিয়া আলাপ পাড়েন। আপনার রাজনীতির মাজেজা কি?’

কাজল স্বভাবসুলভ রসিকতার সাথে বলে,

– শোনো মিটুন। বাঙালি মাত্রই রাজনৈতিক জীব, লক্ষ্য থাক বা না থাক বাঙালিরে রাজনীতি করতে হইবো। এটা তার ভবিতব্য। এই যে তুমি রাজনীতি কর না, রাজনীতি ঘৃণা কর, মানে আই হেট পলিটিক্স ফিলোসফির বীর সেনানী- এটাও কিন্তু রাজনীতি। খুব খারাপ ধরণের রাজনীতি। মনে রেখ, জন্মগ্রহনের আগেই বাঙালি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। প্রতিটা বাঙালি নবজাতক বহু রাজনীতি মোকাবিলা করে, বহু রাজনৈতিক পক্ষের প্রভাব স্বীকার ও অস্বীকার করে তবেই জন্মায়।

– কি যে বলেন না, কাজল ভাই! জন্মের আগে আবার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয় কেমনে?

– ভেরি সিম্পল। স্বামী-স্ত্রী সন্তান নিবে কি নিবে না, কোন মুহুর্তে সন্তান নিবে- আমাদের কালচারে এসব নিয়ে পারিবারিক রাজনীতি চলে। স্বামী-স্ত্রীর সাথে এই রাজনীতিতে যুক্ত হয় দাদা ও নানাপক্ষের প্রভাবশালী সদস্যরা। তারা তাদের পরামর্শ মেনে সন্তান নেওয়া বা না নেওয়ার জন্য প্রভাবিত করতে থাকে। কোনো পক্ষ বিত্তবান হলে পরামর্শের সাথে চাপও প্রয়োগ করে, বলে ‘সন্তান নিয়া নাও, টাকার জন্য চিন্তা কোরো না।’ বন্ধুবান্ধব আর প্রতিবেশীরা মিলে তত্ববধায়ক সরকারের মত একটা পক্ষও তৈরী করে- এই পক্ষের রাজনীতি খুব মজার। এরা বিবাদমান দুই পক্ষের পরামর্শে মৃদু সায় দিবে, কিন্তু একপক্ষের সামনে আরেক পক্ষের কুসুম কুসুম বিরোধীতা করে। তবে সরাসরি কোনো অবস্থান নেয় না। ফলে এরা থাকবে নিরাপদ অবস্থানে। ঘটনা যাই ঘটুক, সিদ্ধান্ত যাই আসুক, এরা জোড় গলায় বলবে ‘ এটা তো আমি তো আগেই বলেছিলাম..।’ মিলনরা পত্রিকার ভাষায় এই পক্ষরে বলে ‘সুশীল সমাজ’। অবশেষে বাপ আর মায়ের সিদ্ধান্তেই সন্তান কনসিভ করা হয়, কিন্তু রাজনীতিটা চলমান থাকে।

– ইন্টারেস্টিং তো! রাজনীতিটা শেষ হয় না মানে?

– কনসিভ করার পর তো এক পক্ষের বিজয় ঘটে যায়। কিন্তু অপরপক্ষ রাজনীতি থেকে সরে আসে এমন ধারণাটা ভুল। সবাই তো আর মির্জা ফখরুলের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ফিলোসফিতে বিশ্বাস রাখে না বা ঈদের পর আন্দোলনের জন্য অপেক্ষাও করে না। এবার রাজনীতি হয় নতুন ইস্যুতে। গর্ভবতী স্ত্রী কোন ডাক্তারের কাছে যাবে। কোন প্রফেসর এ বিষয়ে এতটাই দক্ষ যেনো সাক্ষাৎ আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন পীরসাহেব- এসব বাছবিচার নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে রাজনীতি চলে। এরপর সিজার না নরমাল ডেলিভারি হবে, কোনটা ভালো কোনটা খারাপ, কোন হাসপাতাল ডেলিভারির জন্য উত্তম- পক্ষগুলো তাদের পরামর্শ বাস্তবায়নে চাপ দিতে থাকে- এটাও পার্ট অব রাজনীতি। কথা মানা হয়, পরিবারিক রাজনীতির ক্ষেত্রে সে কিছুটা এগিয়ে যায়। অবস্থান পোক্ত হয়। এরপর সন্তানের নাম রাখা নিয়ে দাদাপক্ষ আর নানাপক্ষের মধ্যে নীরব ‍যুদ্ধ চলে। মিটুন, বাঙালি শিশু বিশ্বের আর দশটা শিশুর মত স্বাভাবিকভাবে জন্মায় ও বড় হয় ভেবেছো! অনেক রাজনীতি মোকাবিলা করে, অনেক রাজনীতির সহায়তা নিয়ে তাকে জন্মগ্রহণ করতে হয় এবং বড় হয়। বাঙালি শিশুর জন্ম হয় রাজনীতি পরিবেষ্টিত জলবায়ুতে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে মিলনকে জিজ্ঞেস করো।

মিলন হাসে। মিটুন এভাবে কখনো ভাবেনি। কাজল ভায়ের কথার সবচাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে তিনি কোনটা মজা করে বলছেন, কোনটা সিরিয়াসভাবে- তা বুঝা যায় না। তবে কাজল ভায়ের কথা শুনতে ভালো লাগে। মিটুন প্রশ্ন করে,

– ভাই, আপনার পলিটিক্যাল অবস্থানটা কিন্তু বললেন না!

– মিটুন, তোমার চারজন গার্লফ্রেন্ড।

মিটুন অপ্রস্তুত স্বরে বলে,

– ধুত্তোরি ভাই। ভাবীর সামনেও আমারে পঁচানো শুরু করলেন!

আফরোজার ঠোঁটে হাসি আভাস,  কাজল হাসতে হাসতে বলে,

– সরি, মিটুন। ধরো তোমার চারটা গার্লফ্রেন্ড। নিজেকে কখনো জিজ্ঞেস করেছো- কেন চারজন গার্লফ্রেন্ডকেই তোমার ভালো লাগে? কেনো একজনকে নয়?’ উত্তরটা আমি দেয়ার চেষ্টা করি। তোমার কিন্তু চারজনকেই ভালো লাগে না। চারজনের বিশেষ কিছু গুণ ভালো লাগে। কারো কথা বলার ঢং হয়তো ভালো লাগে, কারো চেহারা আর চাহনী ভালো, কারো সরলতা ভালো লাগে, একান্ত ব্যক্তিগত সময়ে কারো পারফরমেন্স হয় তো অসাধারণ। অর্থাৎ তুমি কিন্তু একজনের মধ্যে সবগুণ পাচ্ছো না, আবার একজনের মধ্যে সবগুলো গুণ চাইছোও না। তুমি অপশন রাখছো। দেখা গেলো, খোদা না করুক, তোমার একটা সম্পর্কও টিকলো না। তোমাকে সংসার করতে হচ্ছে এমন একজনের সাথে যাকে তুমি অতীতে প্রত্যাখান করেছো। অথবা চারজনের একজনের সাথে তুমি সংসার শুরু করলে এবং  আবিষ্কার করলে প্রেম করার সময়ে তোমার হিসাবে ভুল ছিল। কারণ যাদের প্রত্যাখান করেছ শেষ বিচারে তাদের সাথে এর বেসিক কোনো পার্থক্য নাই। হিসেব নিকেশে বুজতে পারলে যাকে বেছে নিয়েছ সে অধিকতর প্রত্যাখানযোগ্য। তখন তোমার অবস্থানটা কি হবে!

– রাজনীতির পয়েন্টে আপনার প্রশ্ন বুঝি নাই। তবে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে কপাল চাপড়ামু, ডিভোর্স সম্ভব না হলে সংসার করে যাব।

– শোন, স্বৈরাচার এরশাদকে হটানোর পর আমরা যাদের বেছে নিয়েছিলাম বা যাদের প্রেমে পড়ে আমরা স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটানোর জন্য জান-মাল তুচ্ছ করে আন্দোলন করেছিলাম, শেষ বিচারে দেখেছি তারা আরও বড় এরশাদ। তোমার চার গার্লফ্রেন্ড- তুমি অপশন রাখছো, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা নিন্দনীয় এবং নৈতিক অপরাধ। কিন্তু এটাকে যদি পলিটিক্সের কনটেক্সটে দেখ- তবে খুব ভালো সিদ্ধান্ত। তোমার কাছে বেছে নেওয়ার মত চারটা পক্ষ আছে। ফলে তোমার পছন্দের তালিকায় থাকার জন্য পক্ষগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। তোমার প্রতি দায়বদ্ধতাও থাকবে। যে গুণের অভাবে তোমার পছন্দ থেকে বাদ পড়ে যাবার আশঙ্কা থাকবে, ওসব গুণ ধারণ করার চেষ্টা করবে। জবাবদিহিতা থাকবে। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত হবে। আমি চাই রাজনীতিকরাই রাজনীতিটা করুক। জনগণের প্রতি রাজনীতিক এবং রাজনৈতিক দলের দায়বদ্ধতার সাথে জবাবদিহিতাটাও থাকুক। দিনের ভোট দিনেই হোক, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যেন শুনতে না হয় ‘আপনার ভোট দেওযা হয়ে গেছে, বাসায় যান।’ অপরাজনীতি নিপাত যাক। আমার অবস্থান কোন দলের পক্ষে বা বিপক্ষে না, আমি ক্লিয়ারলি ওই সিস্টেমের বিপক্ষে যে সিস্টেম এরশাদ থেকে হিটলার পয়দা করে।

মিটুন মাথা দোলায়। কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর বলে,

– মিলন ভাই, রাজনীতির আলাপে থাকলে কোনো কাজ আগে বাড়ব না। আপনে যে গল্পটা বলতে চাইছিলেন, বলেন তো।

মিলনের পরিবর্তে উত্তর দেয় কাজল,

– মিটৃন, তুমি পলিটিক্স হেট করেও কিন্তু পলিটিক্সের আলাপের বাইরে থাকতে পারছ না। আমরা অত্যাধিক রাজনীতি প্রবণ। তাই বাসর রাতে বর-বউয়ের আলাপেও লোকাল থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রসঙ্গ চলে আসে। অনেক বাজে কথা বলেছি। মুখ ব্যাখা করছে। মিলন, এবার তোমার গল্পটা বলো।

মিলনের উত্তর দেবার আগেই ‘আরেকটু চা করে আনি, তারপর গল্প শোনা যাবে’ বলে আফরোজা রান্না ঘরের দিকে যায়। ‘তোমরা কেউ সিগারেট খাবে?’ বলে কাজলও উঠে পড়ে, ওকে অনুসরণ করে মিলন আর মিটুন বারান্দায় যায়। সিগারেট ধরায়। বাইরে রোদ্র উজ্জ্বল দিন। মিলন আকাশের দিকে তাকায়- আকাশের রঙ উদাসীনতার মত নীল। বেশ মেঘও আছে। মিলন সিগারেটে টান দিতে দিতে নিজের মত করে গল্পটা গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।

(চলবে)

সকল চরিত্র কাল্পনিক।

পূর্বের পর্বসমূহ

ছাপ (রহস্য উপন্যাস)/ পর্ব ৩

ছাপ (রহস্য উপন্যাস)/ পর্ব ২

ছাপ (রহস্য উপন্যাস)/ পর্ব ১

 

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত