৭
এখন ঘড়িতে আন্দাজ ভোর সাড়ে চারটা৷ চারপাশে হাসান সাহেবের নাক ডাকার বিচিত্র শব্দে কামড়াটা ছমছম করছে৷ রাসেল আর শেফালী দু’জনেই কামরায় ঢুকেছে। ঢুকেই আচমকা শাহেদের কলার চেপে ধরেছে শেফালী। শাহেদ অস্ফুট স্বরে বলল-
: স্যরি।
: স্যরি? স্যরি? তিনজন আমাকে রেপ করল। আমার জীবনটা তছনছ হয়ে গেল আর আপনি বলছে স্যরি, জাস্ট স্যরি?
শাহেদ কী বলবে বুঝতে পারে না। উন্মত্ত ক্রোধের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে শেফালী। আচমকা সীমাহীন দুর্স্মৃবিষহ স্মৃতি যে হ্রদয় পুড়িয়ে দিচ্ছে, সেটা স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে।
: আপনাকে শাস্তি পেতে হবে।
: শাস্তি! শাস্তি আসলেই আমার পাওয়া উচিৎ। গড উইল পানিশ মি।
: নাহ। গডের অপেক্ষায় অনেক থেকেছি। শাস্তি আমি দেব। আমার জীবন যারা তছনছ করেছে তাদের প্রত্যেকেই শাস্তি পেয়েছে। মামুন স্যার, বগা ভাই দুটোই শেষ। আমার শরীর নিয়ে খেলা করার শাস্তি।
শাহেদ, রাসেলের দিকে তাকিয়ে আছে।
: এবার আপনার পালা শাহেদ সাহেব। তারপর খুঁজে বের করব ওই তিন হারামজাদাকে। যারা আমার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে। একবার শুধু খুঁজে পাই।
শেফালির হাতে ছোট্ট একটা ছুরি। রাসেল শাহেদকে জাপ্টে ধরেছে। শেফালীর চোখে মুখে হিংস্র বন্যতা। এখনই ছুড়ির ফলা বোধয় শাহেদের গলাতে বসিয়ে দেবে। এত সবের ভিড়ে হাসান সাহেব বেঘোর ঘুমে। নাক ডাকছেন। ড্রাগের কারণে বোধয় শাহেদের শরীরে কোনো জোর নেই। তবু শাহেদ কোথা থেকে যেন সব শক্তি জোর করো বলল,
ঃ আমি জানি কারা তোমাকে রেইপ করেছে? আই নো। গড প্রমিস। আমি জানি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কাউকে বলাটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। কথার সঠিক সময়ে উপস্থাপন এর জন্য হয়তো এমন কিছু পেয়ে যাওয়া যায় যাকে এক কথায় যাকে বলে, বাজিমাৎ! যদিও বলাটা অসম্ভব কঠিন। তারপরও শাহেদ অনেক দিনের অভিজ্পঞটায় এই একটা ব্যাপার ভালই রপ্ত করেছে। শাহেদ অফিশিয়াল মীটিং এও যখন এমন কিছু বলে বসে সবাই তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এখানেও ব্যপারটা সেরকমই ঘটলো। রাসেল শাহেদকে ছেড়ে দিয়েছে। শেফালিও একটু থমকে দাঁড়িয়েছে।
জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে শাহেদ আবার বলতে শুরু করল-
: তোমাকে রেইপ করেছে জালাল। আমার ছোট ভাই বলতে পারো আবার বন্ধুও বলতে পারো। যে রাতে তুমি রেইপ হয়েছিলে সেদিনই আমরা সিদ্ধান্ত নিই এক বাড়িতে বিয়ে করব। জালালই বলেছিল। বড়লোকের মেয়ে। দুই বোন ভাগাভাগি করে নেবে। ওদের কাকাতো বোন পুষ্পের বিয়ে ছিল ওই রাতে। আমাদের দাওয়াত ছিল। যদিও আমাদের উদ্দেশ্য খবিরুদ্দিনের দুই মেয়ে রুমি আর সুমিকে দেখা। আমি গিয়েছিলাম, কিন্তু জালাল আসেনি ওই রাতে। আমি দেখি রাতে জালাল তুলে নিচ্ছে তোমাকে। ও আমাকে একটা লোভনীয় চাকরির অফার করে ছিল ওই দিন । আমি তাই ওই দিন ওকে তোমাকে মাইক্রোতে তুলতে দেখেও চাকরি হারানোর ভয়ে কিছু বলতে পারিনি। আমি আসলেই অমানুষ। আমার অক্ষমতা কে ক্ষমা কর।
কথা গুলো শাহেদ এক নিশ্বাসে বলেছে। কীভাবে বলল কে জানে? শেফালী ঠিক বিশ্বাস করল কি না জানে না কিন্তু রাসেলকে দেখে মনে হলো সে বিশ্বাস করেছে। শাহেদের এই অক্ষমতাকে রাসেল মেনে নিয়েছে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে রাসেল একবার পড়েছিল। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন সেটি নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে তীব্র বিরোধের কারণে সহিংস পরিবেশ ঘিরে বিরোধীদের আন্দোলনের ফসল হিসাবে সুশীল সমাজের মোড়কে সামরিক সরকার ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত। নতুন করে সামরিক হস্তক্ষেপ অনেককেই চমকে দিয়েছিল। সে চমক দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল দুই নেত্রীকে মাইনাস করতে মাইনাস টু ফরমুলা আসাতে। জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাসেলদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড একবারেই বন্ধ। এরই ভেতর খেলা দেখার সময় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্র ও সেনা সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা নিয়েই মূলত সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। রাসেল তখন খেলার মাঠে উপস্থিত। রাসেলের এক বন্ধুকে বেদম প্রহার করেছিল রাসেলের সামনে সেদিন। পাশে থেকেও রাসেল কিছু বলতে পারেনি। যদিও এর পর পুরো দেশব্যাপী আন্দোলন দানা বাঁধে। কিন্তু সেদিনের সেই অক্ষমতা রাসেলকে এখনো পোড়ায়।
আজ অবশ্য তা সুদূর অতীত। রাসেল একটা বেসরকারি স্কুলে চাকরি করে। স্কুলে ক্লাস করানোর পাশাপাশি বাসায় বাচ্চাদের ড্রয়িং শেখায়। আয়-ইনকাম মন্দ না। অথচ এক সময় কত স্বপ্ন ছিল ভ্যানগগ, পিকাসো হবে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো সত্যজিৎ, হিচকক, বুনোয়েল হতে। সিনেমা বানিয়ে হইচই ফেলে দেবে। সমাজ বদলের স্বপ্নও ছিল। বিপ্লব বিপ্লব করে আজিজ সুপার মার্কেট, মুক্তাঙ্গন, পল্টন চষে বেড়িয়েছে। কমরেড, প্রলেতারিয়েত, বুর্জোয়া, শ্রেণিশত্রু, শ্রেণি সংগ্রাম, সর্বহারা, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, মার্কস, লেনিন, মাও সে তুং, কাস্ত্রো, জ্যোতিবসু সব মাথা থেকে ঝেড়ে এখন বাস্তবতা হলো দুপুর তিনটা বাজতেই সব বাচ্চারা মা-বাবা সমেত দল বেঁধে হাজির বাড়িতে। বাড়ি বলতে এগারো শ স্কয়ার ফিটের ভাড়া করা একটা অ্যাপার্টমেন্ট। বাসায় একাই থাকা হয়। বাবা-মা গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় পা রাখেনি। আর বিয়েশাদি তো অদ্যাবধি করা হলো না। কাজকর্ম করার জন্য কলিম বলে একটা ছেলে আছে। রান্না-বান্না করা, ঘরদোর গোছানো সবই ওই কলিমই করে। বছর তিনেক হলো সঙ্গেই আছে। ছেলেটা করিতকর্মা। একা হাতে সব সামলাতে পারে। এই যে বাচ্চারা ড্রয়িং শিখতে আসছে তাদের ম্যানেজমেন্টও কলিমের হাতে। রাসেল মাঝে মাঝে ভাবে ড্রয়িং শেখানোর দায়িত্বটাও কলিমকে ট্রান্সফার করলে হয়। ছেলেটার আঁকার হাতও ভালো। ফল, ফুল, লতাপাতার আঁকিবুঁকি ওই শেখাতে পারবে। এ আর এমনকি কঠিন? সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে হতাশ হয়ে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছা করে। একা একা আর কত স্বপ্ন বনা যায়? রাসেল যে স্বপ্ন বুনে চলে, যে রাজনীতি করে সেখানে তার সামনে পিছনে মানুষ কোথাও? যে মানুষ সে দেখেছিলো ৫ই মে।
৫ মে সকালে রাসেল গিয়ে বসেছিল হেফাজত ইসলামের একটা দলের সঙ্গে একটা পয়েন্টে। ছোটবেলা থেকেই মানুষ দেখার খুব শখ। মানুষ দেখতে ভালোলাগে। রাসেলের পরিচিত মানুষও আছে। যাদের সঙ্গে সকাল-বিকাল দেখা হয়। হেফাজতের সবাই যে দূরদূরান্ত থেকে আসছে এমন তো নয়। সবাই যে সম্বলহীন মাদ্রাসা ছাত্র ব্যাপারটা এ রকমও নয়। ঢাকাবাসীর একটা অংশও তাদের সঙ্গে আছে। মাথায় টুপি দেখে যাদের কেউ কেউ যেমন এড়িয়ে চলে- বয়ান দিয়ে এখনই হয়তো নামাজ পড়াতে নিয়ে যাবে সেই চিন্তায়। তো রাসেল পরিচিতজনদের মাঝে বসে মানুষ দেখছে । হাজার হাজারে মানুষ। মানুষের মধ্যে রাসেলের মতো উৎসুক জনতাও আছে। যাদের দাবি নাই কিন্তু কী হয় দেখতে আসছে।
একটা সময় তারা মতিঝিলের পথ ধরল। রাসেল ওভারব্রিজ থেকে তাদের যাওয়াটা দেখতে লাগল। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্পে পড়েছে। কিন্তু বাঁশি বাজায়ে যে মানুষ এমন সম্মোহন করা যায় তা বাস্তবে দেখে নাই। শফি হুজুরের প্রতি ঈর্ষা হলো। লোকটার ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হলো। একবারের জন্য মনে হলো বঙ্গবন্ধুরও বুঝি এই রকম ক্ষমতা ছিল। শফি হুজুরের চেয়ে হাজার গুন বেশি। সেই ছফার লেখায় পড়ছিল, ‘তাকে অনুসরণ করার অভ্যেস জনগণের বহুদিনের, ভেড়ার পালের মতো তাদের তাড়িত করার স্বভাবটিও তাঁর বহু পুরনো’।
রাসেলদের পূর্বপুরুষও একদিন এমনি পায়ে হেটেঁ তার আহ্বানে উপস্থিত হয়ে দেশটা স্বাধীন করেছিল। তা ছাড়া রাসেলরাও তো সেই কবে থেকে আওড়েছে ‘ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ’। রাসেলরাও তো স্বপ্নে দেখছে এমনি জনস্রোতের। শুধু যে পোশাকের জনস্রোত দেখার আশায় থেকেছে সেই পোশাকটা ওই দিন কারো গায়ে ছিল না।
রাসেল মতিঝিল কেন গেল না? যাওয়ার দরকার মনে করে নাই। বিপদের আশঙ্কাও ছিল। তা ছাড়া রাসেল তো দাবি নিয়ে আসে নাই। দাবির সঙ্গে একাত্মতাও ঘোষণা করে নাই। রাসেলের কাছে টিভির চ্যানেল ধরাটাই একমাত্র অবলম্বন হয়ে থাকল। দেখি কী হয় বলে গ্যালারিতে বসার মতো একটা ব্যাপার। কিছু একটা হবে আবার নাও হতে পারে। আগেও তো তারা জমায়েত হয়েছিল। আগের বারের মতো ঘটনার ইতি ঘটবে, এমন ভেবেই টিভি চ্যানেল এদিক-সেদিক করছে রাসেল। বিক্ষিপ্তভাবে এদিক-সেদিক গ্যাঞ্জাম হয়েছে। মতিঝিলে কী হচ্ছে তার কোনো খবর নাই। শফি হুজুর কখন আসবে, সেই প্রতীক্ষা করছে সবাই ।
ঘটনার ভেতর নতুন কিছু ঘটবে এটা বুঝতে পারল রাতের দিকে। তার মনে হলো রাসেলের পরিচিত তো অনেকেই গেল। তারা কী ফিরে আসছে, না মতিঝিলেই আছে। দু-চারজনের সঙ্গে কথা কইল। শুনল তারা মতিঝিল পৌঁছাতেই পারে নাই। আগেই গ্যাঞ্জাম-ফ্যাসাদ আর পুলিশি বাধার মুখে কাছাকাছি পথ গিয়ে ফিরে আসছে। একটা সময় লাইভ টিভি বন্ধ হয়ে গেল। তারপর কী হলো, আগের কালে মুভি অব দ্যা উইকের শেষ দৃশ্যের আগেই কারেন্ট চলে গেলে যে অতৃপ্তির ভাব নিয়ে থাকত- সেই রকমই একটা ফিলিংস ছাড়া আর কিছুই হলো না। এরা যে মানুষ, এরা যে মরে যেতে পারে, আজ রাসেলও কোনো দাবি নিয়ে এমন মিছিলে থাকতে পারত আর একই পরিণতি হতে পারত- সেটা ঘুণাক্ষরেও মনে হলো না। টিভির একটা চ্যানেল ধরে কখন ঘুমিয়েছে খেয়াল নাই। সকালে উঠে শুনল হেফাজত ঢাকা ছেড়েছে। সারাদিনই বিভিন্ন খবরাখবর পড়ল, দেখল। সত্যা-মিথ্যা হোক অনেক খবরই পাইল। ২২ জন থেকে ২২ হাজার সব সংখ্যায় শুনল। সবার কাছে সংখ্যাটাই মুখ্য হয়ে গেল। একটা প্রাণ আসলে প্রাণ না। ভাবটা এমন ‘রানা প্লাজার ১২০০ মানুষ হজম কইরা ফেলাইছি আর তুমি কী কও’? প্রাণের দাম বাংলাদেশে কবে কমে গেল? আমাদের বোধশূণ্য করা কবে শুরু হলো। সামরিক সরকারগুলো যা পারে নাই, গণতান্ত্রিক সরকারগুলো কবে থেকে পারা শুরু করল? অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়া বুদ্ধিজীবী মানুষ শূন্য সমাজ কেমনে আমরা গঠন করে ফেললাম? এ রাজাকার, এ মৌলবাদী, এ নাস্তিক, এ আওয়ামী লীগ, এ জামায়াত, এ বিএনপি, এ চেতনাবাজ, শাহবাগী, এ লুল- এ কোন র্সবনাশী ট্যাগ দেওয়া সমাজ আমরা গঠন করছি? কী করতে গিয়ে, কী চাইতে গিয়ে কী করে ফেলা হয়েছে? নতুনত্ব বলতে একটা জিনিসই চোখে পড়ল, যারা খুব উৎসাহী ছিল হেফাজত নিয়ে, তারাও চরম ভয় পেয়ে গেলো একটা র্পযায়ে। হেফাজত ঢাকা ছাড়ছে এ সংবাদে সবারই চোখে-মুখে একটি পরিতৃপ্তির ছায়া ছড়িয়ে পড়ল।
একটা ‘বেহাত বিপ্লব’ হয়ে যাচ্ছিল সেই পেরেশানি থেকে মুক্তির আনন্দে সবাইকে গা ভাসাতে দেখল রাসেল। কিন্তু এ ঘটনা রাসেলের চিন্তাভাবনার জগতে নতুন একটা পরিবর্তন তৈরি করল। পরদিন ফেসবুকে একখান স্ট্যাটাস দিল রাসেল –
‘আমরা হেফাজতকে এ যাত্রায় থামালাম কিন্তু পরবর্তীতে থামাব কী করে? গার্মেন্টস শ্রমিকদের এ যাত্রায় থামালাম পরবর্তীতে থামাব কি করে? যুদ্ধাপরাধীকে চাদে দেখা গ্রাম্বাসিকে এ যাত্রায় থামালাম পরবর্তীতে থামাব কী করে? গুলি করে লাশ পাওয়া যায় কিন্তু সমাধান না। কেন হেফাজত ১৩ দফা দিল ২০১৩ সালে এসে সেটা আমরা কখনোই খতিয়ে দেখি না। কারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, কারা তাদের পশ্চাৎপদ করে রেখেছে সেটা সবাই জানি কিন্তু তাদের কিছু বলছি না শুধু অবুঝ কতগুলো মাদ্রাসার ছেলেকে লাশ বানিয়ে পুণ্য অর্জন করছি। কী করলে গার্মেন্টস শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে সেটি না করে দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছি। যুদ্ধাপরাধীদের ৪২ বছর পেলে পুলে যারা বড় করল তাদের ব্যাপারে আমরা কখনোই চিন্তিত নয়, চিন্তিত তাদের চাদে দেখা গেছে বিশ্বাস করা নিরীহ গ্রামবাসীকে নিয়ে। তাদের গুলি করে মারলেই সমাধান। এই হেফাজত, এই গার্মেন্টস শ্রমিক, এই নিরীহ গ্রামবাসীকে যদি সমাধান দেওয়া না যায় তবে ঢাকা শহরে যারা আছি তাদের কপালে খারাবি আছে’।
রাসেল পরদিন অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠল। শেফালী মামুন ভাইকে খুন করতে না পেরে এখন বগা কে খুন করতে চাই। এ দুজনের সাথেই রাসেল একই মেসে দু বছর কাটিয়েছে। কখনও মনে হয় নি এরা অপরাধী। মামুন ভাই সারাদিন রাত ছাদে কাটাত। আর বগা ডিকশনারি নিয়ে পড়ে থাকত। আজ শেফালির সাথে এই ইংরেজ বগাকে নিয়ে প্লান করতে হবে। সে নাকি দেশে এসেছে।
শেফালী আছে হাসান সাহেবের ওখানে। সকাল নয়টায় নাশতা খেয়ে খেয়ে পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে নিলেন হাসান সাহেব। এইসময় তার খুব আরাম লাগে। সপ্তাহে ছয় দিন তিনি কেডস, গেঞ্জি আর জিনসের প্যান্ট পড়েন শুধু এই একদিন পাঞ্জাবি আর পায়জামা। শুক্রবার সকালে মনটাও অন্যরকম থাকে। আয়নায় নিজেকে দেখলেন। ষাট বছর বয়সে শরীর ভারী হয়েছে, চুল দাড়ি সব পেকেছে। লিমা মারা গেছে দু’বছর হলো, প্রত্যেক শুক্রবার তিনি লিমার কবরে যান, আজ তার সঙ্গে শেফালী আছে। লিমার কবরের সামনে দু’জনায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে । অনেকক্ষণ পর শেফালি নীরবতা ভাঙে।
: আপনি শুধু কবরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, কোনো দোয়া করেন না কেন?
: কোনো দোয়া তো আমি জানি না। আমি অজ্ঞেয়বাদী মানুষ।
: আপনি আল্লাহকে বিশ্বাস করেন না।
: করি, আবার করি না।
: মানে?
: আল্লাহ বল বা সৃষ্টিকর্তা – এতে আমার বিশ্বাস আছে। সৃষ্টিকর্তা না থাকলে এত বড় বিশ্ব কীভাবে তৈরি হলো? কীভাবেই বা চলছে? কিন্তু ধর্মে বিশ্বাস করি না। সব ধর্মই আমার কাছে বানানো মনে হয়।
: হা হা। আল্লাহকে বিশ্বাস করেন কিন্তু ইসলামে বিশ্বাস নেই। আপনি এক কাজ করেন। নামাজ পড়া শুরু করেন। দেখবেন আসতে আসতে আপনার সব প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে যাচ্ছে। আমার এক ফুফু ছিল। সে সব সময় বলত নামাজ পড়লে আসতে আসতে সব শয়তানি চিন্তা দূর হয়ে যায়।
: নামাজ মানে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ। আল্লার সঙ্গে দেখা করতে ভয় লাগে। এই পাপী মন নিয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়াব কেমনে?
: বুঝি নাই।
: ধর তুমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাবা। তোমারে একটা প্রস্তুতি নিতে হবে না,
: নামাজ পড়ার আগে সবাই তো প্রস্তুতি নেই, অজু করে পাক পবিত্র হয়।
: সে হয়, কিন্তু তুমি যদি চোর হও, দুর্নীতিবাজ হও, ঘুষ খোর হও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তোমার বুক কাঁপবে, চোখে চোখে রেখে কথা বলতে পারবে? – আমার নামাজে দাঁড়াইতে ভয় লাগে। আল্লার সামনে এই পাপী মন নিয়ে কেমনে দাঁড়াব? আমার পাপে আল্লাহর আরশ ময়লা হয়ে যাবে।
: পুকুরে না নামলে কি গায়ের ময়লা দূর হবে? গায়ের ময়লায় পুকুর ময়লা হয় না হাসান চাচা। ধরেন আপনি গায়ে ময়লা নিয়ে এক দিঘির সামনে বসে আছেন। ভাবছেন দিঘির টলমলে জল আপনি নামলে ময়লা হয়ে যাবে। কিন্তু এভাবে সারাজীবন দীঘর পাশে থাকলেও তো আপনার ময়লা দূর হবে না। আপনার ময়লায় কিছু সময়ের জন্য দীঘির কিছু অংশ নোংরা হবে। পুরো দীঘি নোংরা করার সাধ্যি কি কারো আছে। আপনি নামাজ পড়া শুরু করেন। আপনার সব পাপ আল্লাহ মাফ করে দেবেন।
শেফালী কথাগুলো বলার সময় মনে হলো সে অন্য মানুষ, অচেনা, গলার স্বরটাও যেন অন্যরকম।
হাসান সাহেব এই যুক্তিতে পরাস্ত হলেন। তিনি ভাবলেন আজ নামাজ পরবেন। শেফালী অবশ্য যুক্তিতে পরাস্ত করতে পেরে খুব খুশি তা না। তার খুশি প্রতিশোধে। শফিকুল ইসলাম বগার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ। তার সাবেক প্রেমিক।
৭.০৩
শফিকুল ইসলামের ডাক নাম ‘বগা’। জন্মের সময় বকের মতো সাদা হয়েছিল বলে আশপাশের সবাই ‘বগা, বগা’ বলত। ছোটবেলায় সাধারণত সবারই এমন নাম থাকে। সেসব নাম বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায়। কিন্তু শফিকুল ইসলামের বেলায় তেমনটি ঘটেনি। তার ‘বগা’ নামটি বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। ছোটবেলার নাম বড় বেলায় বয়ে বেড়াচ্ছে। নামে কিবা আসে যায়? মুখে বলা সহজ হলেও এই নাম নিয়ে স্কুল, কলেজ এমনকি ইউনিভার্সটি লাইফে কম বিড়ম্বনায় পড়েনি। বহুবার চেষ্টা করেছে শফিকুল কিম্বা শফিক নামটাকে প্রচার করা যায় কিনা? কিন্তু কীভাবে কীভাবে জানি সবাই তার ‘বগা’ নামটা জেনে যায়। তারপর বগা, বগা ভাই এখন হয়েছে বগা স্যার। বয়স পয়ত্রিশ ছুই ছুই । মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। থাকে বার্লিনে। একটা ল্যাবে চাকরি করে। প্রায় দশ বছর পর দেশে ফিরেছে। পথঘাট সব কিছু কেমন যেন অচেনা লাগছে। বগা মূলত এসেছে বিয়ে করতে। বগার বোন এর পরিচিত মেয়ে। কথা বারতা অনেক দূর আগানো। হয়ত বগার পছন্দ হলে কাবিন হয়ে যাবে আজই। প্রথমে বগা উঠেছে হোটেলে। সাত দিন চুপচাপ কাউকে কিছু না বলে একা একা ঢাকা শহর দেখে বেড়াচ্ছে। দুলাভাই কে বিশেষ পছন্দ না বগার। বগা যখন বেকার খুব অপমান করত। তাই বোনের বাসায় না উঠে হোটেলে উঠা। ঢাকা শহর দিন কে দিন চেঞ্জ হচ্ছে। কত বড় বড় বিল্ডিং উঠেছে। ফ্লাইওভার হচ্ছে অনেক। পদ্মা ব্রিজ হচ্ছে। বগা পত্রিকা পড়ে জেনেছে অনেক অনেক রাস্তা চার লেন হচ্ছে, ফ্লাই ওভার, সেতু হচ্ছে। এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা মেট্রোরেল, কর্ণফূলি টানেল, মেরিন ড্রাইভ রোড সম্ভবত পেয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশাল বিশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিরমান হচ্ছে। উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে দুর্নীতি। টপ টু বটম একটা চোরের জাতিতে পরিনত হয়েছে। তা হোক কিন্তু কথা হইতেছে – এতসব রাস্তা ব্রীজ লইয়া আসলে আমরা কি করিবো? শিল্প ও কৃষির যুগপৎ বিকাশ ঘটাবার জন্য এই সব অবকাঠামোগত উন্নতিকে কেন্দ্র করে কি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে? আল্লাহ না করুক বিশ্ব ব্যাপি অস্থিরতা শুরু হলে আমাদের প্রবাসী ভাই/বোনরা দেশে ফিরতে বাধ্য হলে, তৈরী পোশাক সহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানী নিয়ে বিপাকে পড়লে, কিম্বা পরপর বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখিন হলে দেশের জনগণের জন্য প্লান বি হিসাবে কি কিছু রাখা আছে? নতুবা এতসব নতুন নতুন রাস্তা, ব্রীজের উপর থালা হাতে সবাই বসে আছি দেখতে কি ভাল ঠেকবে? বগা এসব ভাবে আর উন্নয়ন দেখতে দেখতে পথ চলে।
আজ বোনের বাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছে। শাহবাগ থেকে হাটা পথ। আগে কতবার গিয়েছে। কিন্তু আজ যেন কেমন অচেনা ঠেকছে। তবু বগা মটামুটি মনে করে করে পথ চলছে। বগার মনে হল , ঢাকা শহরে দুটো পাখি ভালো রকমেই আছে- চড়ুই আর শালিক। মাঝে মাঝে দু-একটা দোয়েলও দেখা যায়। আগে এক সময় প্রচুর কাক ছিল। ইদানীং কাকের সংখ্যাও কমে গেছে। এই শীতের সকালে এক ঝাঁক শালিক কী যেন খুটে খাচ্ছে। মাঝে মাঝে চলছে খুনসুটি। অন্য সময় হলে প্রাণভরে উপভোগ করা যেত পাখিদের খুনসুটি। কিন্তু বগার মেজাজ এখন ভয়ংকর খারাপ। যে খারাপের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। হঠাৎ কোথা থেকে এক বুড়ো চাচা সামনে দাঁড়িয়ে পরে বলল-
: স্যার হাঁস কিনবেন? রাজহাঁস। পাঁচ কেজি ওজনের হাঁস। একটাই আছে। পানির দামে দিয়ে দেব। খাসির লাহান রাজহাঁস।
চাচার কথায় সংবিৎ ফিরে পায় বগা।
: হুমম, বড়ই তো মনে হচ্ছে।
: ধইরা দেখেন স্যার, একবার ওজনটা দেখেন।
চাচা হাঁসটা এগিয়ে দেয়।
রাজহাঁসটা আসলেই বড়। পালকগুলোও লম্বা লম্বা। রেড ইন্ডিয়ানদের মাথায় পরা পাখির পালকের মুকুটগুলোর প্যান-মেসো আমেরিকান পালক অলংকরণের যে শিল্প সেখানে কি রাজহাঁসের পালক ব্যবহার করা যায়? বোধ হয় যায়। ক্যালি প্যাটারসন না কি নামে যেন পালক অলংকরণ শিল্পী আছেন। অসাধারণ তার কাজ।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কোন কুক্ষণে মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল-
‘কত টাকা?’
আর যায় কোথায় চাচা আর পিছু ছাড়ে না। শেষমেশ সতেরো শ টাকায় দফারফা করে সাত সকালে রাজহাঁস একটা ঝুলাতে ঝুলাতে বোনের বাড়ি ঢুকে বগা। শেষ কবে রাজহাঁস খেয়েছে মনে করতে পারল না। একবার কোটচাঁদপুরে ফুটবল খেলা হলো। বিজয়ী দল পেল একটি খাসি আর রানার আপ দল রাজহাঁস । বগারা রানার্সআপ হয়েছিল। সেই রাজহাঁস নিয়ে চলে গেল ডুমুরতলার জঙ্গলে। খিচুড়ি আর হাঁসের মাংস হবে। রাজহাঁসের পালক তুলে পরিষ্কার করা কি চাট্টিখানি কথা। এর জন্য গরম পানি লাগে। ডুমুর তলায় গরম পানি কই? এক ঘণ্টা ধরে চলল পালক বাছা। খিচুড়ি ঠান্ডা হওয়া সারা। বগাদের বাড়িতেও হাঁস ছিল। শীত শুরু হলেই রাজহাঁস জবাই হতো। চালের আটার রুটি দিয়ে হাঁসের মাংসের স্মৃতি অতুলনীয়।
পাঁচ কেজি ওজনের রাজহাঁস ঝুলাতে ঝুলাতে বাসায় এসে দেখে বাড়িতে কেউ নেই। তালা মারা। বাইরে কোথাও গেছে হয়তো। বগার কাছে চাবি থাকার প্রশ্ন উঠে না। সবে আমেরিকা থেকে ফিরেছে। সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে এ কি বিড়ম্বনা। মোবাইলে অজস্রবার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু আপা ফোন ধরে না। উপায় না পেয়ে রাজহাঁস নিয়ে কিছুক্ষণ সিঁড়িতে বসেছিল। তারপর ভাবল, ছাদে যাওয়া যাক। রাজহাঁসটা কতক্ষণ আর উল্টো ঝুলে থাকবে। একটু ছেড়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু রাজহাঁস ছাড়তেই যে সেটা লাফ দিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে চলে যাবে এ কল্পনাতেও ছিল না। এখন আপাদের জন্য অপেক্ষা করবে না পাশের বিল্ডিংয়ে যাবে, রাজহাঁস ধরতে কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আপাও যে কেন ফোন ধরছে না। মানুষ মরেও গেলেও এতক্ষণ ফোন বাজলে জ্যান্ত হয়ে ফোন ধরার কথা। এ ছাদ থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওই ছাদে রাজহাঁসের বিচরণ দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। চোখ সরালে আবার ফাজিল রাজহাঁস কোন ছাদে চলে যাবে কে জানে। সতেরো শ টাকায় শেষতক দেখা যাবে গচ্চা গেছে।
মেজাজ খারাপের ষোলো আনা পুরা হলো যখন পকেটে হাত দিয়ে দেখে সিগারেটের প্যাকেটটা ঠিকই আছে কিন্তু ম্যাচে একটাও কাঠি নেই। মুখে একটা নেভা সিগারেটই ধরিয়ে যখন মেজাজ ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে তখন ওই বাড়ির ছাদে এক তরুণীর আগমন। মোবাইলে কার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ছাদে উঠেছে। চেহারায় অদ্ভুত সারল্য। মেয়ে পছন্দ করা নিয়েও অ্যালার্জি আছে বগার। স্কুল, কলেজ কিংবা এই এখনো কত মেয়েই হাবভাবে প্রেম নিবেদন করল। কত জনের সঙ্গেই তো ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল। কত জনের সাথে শারীরিক সম্পর্ক হল। কিন্তু বগা কেন জানি কারও মধ্যেই যা মনেপ্রাণে চায় খুঁজে পায় না। সবাই শুধু বিয়ে করতে চাই। প্রেম মানেই যে বিয়ে না, শারীরিক সম্পর্ক মানেই যে বিয়ের বাঁধনে বাঁধতে হবে – এই মনোভাব মেয়েদের মন থেকে তাড়ানো গেল না। এ মেয়েটিকে দেখে চোখ ফেরাবার উপায় নেই। বয়স কত হবে? কুড়ি! প্রথম দর্শনেই বগা মেয়েটিকে তার সেক্স পার্টনার হিসাবে কল্পনা করে ফেলল। রাজহাঁস কোলে করে মেয়েটি বসে আছে নদীর তীরে- এমন এক দৃশ্যে কল্পনাও করে ফেলল। বগা সেই নদীর তীরে মেয়েটাকে রেইপ করছে এমন একটা কল্পনা মনে আসায় শিশ্ন দাড়িয়ে গেলো। মেয়ে দেখলেই যৌন আকাঙ্ক্ষা জাগার ভূত বগার যাবে না। এমনত হতে পারে এই মেয়েটাকেই আপা ঠিক করেছে বগার জন্য। বগা মেয়েটির ছবি দেখেছে। ছবির সাথে চেহারা মেলাবার চেষ্টা করলো।
এই মুহূর্তে বগা কিংবা রাজহাঁস কোনোদিকেই মেয়েটির ভ্রুক্ষেপ নেই। নেভা সিগরেটটাতেই দু’টান দিয়ে বগা দু-একবার হাত উঁচিয়ে মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। মেয়েটির সাহায্যে রাজহাঁসটার যদি একটা গতি করা যায়! সেক্স পার্টনার বা বিয়ে পরেও করা যাবে। একবার গলাখাঁকারি দিয়ে কাশল। কিন্তু কিছুতেই গোচর হচ্ছে না দেখে আগ-পিছ না ভেবে ফস করে হাতের ম্যাচটার খোল মেয়েটার দিকে ছুড়ে মেরেছে। ম্যাচটি ছুড়তেই মেয়েটিও বগার দিকে মোবাইলে কথা বলতে বলতে মুখ ফিরিয়েছে আর লেগেছে একেবারে কপাল বরাবর। অবাক বিস্ময়ে মেয়েটি তাকিয়ে আছে বগার দিকে। মেয়েটিকে কিছুতেই বোঝানো গেল না একটা রাজহাঁস তার ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উপায়ন্তর না পেয়ে পাশের ফ্ল্যাটে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল।
কিন্তু তার আগেই ভয়ংকর ঘটনার শিকার হলো সে। একটা মাইক্রোবাস এসে তুলে নিল তাকে। পুরো দেশে গুম এক ভয়াবহ রূপ পেয়েছে শুনেছে সে। কিন্তু সে এর শিকার হতে পারে কল্পনাতে আসে নি। রাজহাঁস ধরার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামতেই একটা হঠাৎ একটা মাইক্রো এসে পাশে থামল।
: আপনি ওসমান খন্দকার না? ভেতরে ওঠেন, কথা আছে।
একবার বলার চেষ্টা করছিল সে ওসমান খন্দকার না কিন্তু লোকটার অদ্ভুত কমান্ডিং ভয়েস।
: সেইটা আমরা বুঝব, আপনি ওঠেন।
ভেবেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের কেউ হবে। শুনেছে মাঝে মাঝে এমন মাইক্রো করেই তারা ঘোরে।
মাইক্রোতে উঠতেই আপাদমস্তক চেক করা হয় তার।
: আপনি ওসমান খন্দকার না বুঝলাম কিন্তু ভুল যখন একটা হয়েই গেছে এইটা তো শুদ্ধ করা লাগে। তিন লাখ টাকার ব্যবস্থা করেন।
তিন লাখ টাকা কী চাট্টিখানি কথা। হইচই করতেই ডান গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে যায়। একজন কোমরে গোঁজা পিস্তলটা দেখিয়ে দেয়।
: ফোন দে। কার কার থেকে টাকা পাইতে পারস ফোন দে। কবি হঠাৎ জরুরি দরকার হইয়া পড়ছে। ধার দরকার। প্রথমে জিগাবি কত দিতে পারব, তারপর টাকা বিকাশ করতে বলবি। যদি ক্যাশ দেয় তাও সমস্যা নাই। তুই আগে ফোন দে।
চোখ বেঁধে ফেলা হয়েছে বগার। মাইক্রো ছুটছে আশিতে। কোথাও ব্রেক করেনি। এত ফাঁকা রাস্তা ঢাকা শহরের কোথাও থাকার কথা না।
: কিরে, ফোন নম্বর ক, কারে প্রথম ফোন দিবি। অফিসের কাউরে ফোন দে।
বগা কাকে ফোন দেবে? বারবার বলার চেষ্টা করছে সে বিদেশ থেকে এসেছে। তার কাছে টাকা নেই।
ঃ টাকা নাই, ডলার দে।
ঃ ডলারও নাই। এক দুইশ বোধহয় আছে। আর টাকা আছে হাজার পাঁচেক।
ঃ মিয়া, মশকরা কর। বিদেশ থেকে আসছ দুইশ ডলার নিয়ে।
বগা বোঝায় টাকা দিতে হলে তাকে ছাড়তে হবে। হোটেল থেকে ব্যাঙ্ক এ যেতে হবে। তারপর যদি টাকার জোগাড় হয়। কিন্তু তারা সিধান্ত নিতে পারল না। মাইক্রো থেকে নামিয়ে দেওয়া হলো বগাকে। সে আর পেছনে তাকায় না। ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। একটা ইঞ্জেকশন জাতীয় কিছু একটা পুশ করেছিল এরা মাইক্রোতে। কিন্তু কী মনে করে যেন ওরা ছেড়ে দিল তাকে। শেফালীদের সঙ্গে কন্টাক্ট ছিল শফিক সাহেবকে তুলে নিয়ে রাত দু’টার সময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ হাইওয়ে রোডে ছেড়ে দেবে। ৩০ হাজার টাকার কন্টাক্ট। তাই ছেড়ে দিয়েছে বদি।
বগা নামার পর দেখল , চাঁদটা এখন তার আধখানা শরীর নিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে থাকলেও একটা সময় চোখ তার মধ্যেও আলো খুঁজে নেয়৷ ঘোলাটে জোছনায় এখান থেকেই রাস্তাটা বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। হাইওয়ে রোড হবে। চারিদিকে বোধহয় সবুজের হাতছানি। আর বোধহয় নদী এবং নদীর তীর ধরে গড়ে ওঠা সারি সারি কারখানা। বগা মনে হল শীতলক্ষ্যা নদীর আশেপাশে সে আছে। এখানে বগা আগেও এসেছে। এক বছর চাকরীও করেছিল। এখানকার কারখানার ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় আকাশের রং পরিবর্তন হয়ে যায়। আর নদীর পানিতে মিশে যায় কারখানার বর্জ্য। বগা বুঝতে পারলো সে কাঞ্চন ব্রীজ পার হয়ে কোথাও আছে। তার বামে আছে একটা পেট্রোল প্যাম্প। বাম দিয়ে শীতলক্ষা নদীর যে অংশটা বয়ে চলেছে, তার সমান্তরালে সামনের দিকে যতদূর চোখ যায়, শুধু কল কারখানা। বহুদূরে সেগুলোর কোথাও কোথাও আলো জ্বলছে । ডানে আছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে ওঠা ঝোঁপঝাড়ের জঙ্গল। একটা পরিত্যক্ত বাড়ী চোখে পড়লো। অন্ধকারে দেখে ভয়ে গা কেমন শিরশির করে ওঠে। পীচ ঢালা পথ ধরে মোটামুটি কোয়ার্টার মাইল এগোলে সে। মন্দের ভালো বলতে, আজকের আবহাওয়াটা ভালো। ঝড় বৃষ্টির কোন লক্ষণ নেই।
চোখমুখে পানি দেওয়া দরকার। কোনো চায়ের দোকান পাওয়া গেলে ভালো হয়। চোখ এদিক-সেদিক তেমন কিছুই খুঁজছিল, আর ঠিক তখনই দেখতে পেল ব্যাপারটা। ফাঁকা রাস্তার ওপর লাল-নীল কিছু আলো। আলোগুলো দিয়ে কোনো একটা চিত্র তৈরি হচ্ছে আবার নিমেষেই মিলিয়ে যাচ্ছে। আলোর কোনো উৎসও দেখা যাচ্ছে না। গভীর একটা বিষাদ সংগীতের সুর ভেসে এল। সেই সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়েই আলোগুলো জড়ো হচ্ছে। সুরের মূর্ছনায় এমন এক সম্মোহনী শক্তি যা বাধ্য করে এগিয়ে যেতে। এগোতেই আলোগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। বিষাদ সংগীতও থেমে গেছে। কার যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ একজন এদিকেই আসছে। ঠিক সামনে থেকে না পেছন থেকে বোঝার উপায় নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে যে আসছিল চাঁদের আলোয় তার ছায়া স্পষ্ট হলো। নারীর অবয়ব। কিন্তু এ কোনো সাধারণ ছায়া নয়। যেন ছায়াই বগার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কী মায়া ভরা চোখ! ছায়ার কি চোখ হতে পারে? তাকানোর ক্ষমতা আছে?
ছায়ার মানুষটিকে দেখতে পেছনে ফেরে বগা। চকিত চোখে তাকিয়ে দেখে শেফালি দাঁড়িয়ে। কত বছর পর দেখা? প্রথম প্রেম বগার। ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা। কী জীবন্ত! কী বিস্ময় চোখে-মুখে! কিন্তু এ কি? শেফালীর হাতে কি একটা গরু জবাইয়ের ছুরি। খুব ধীরে এগিয়ে আসছে। কি হতে চলেছে বুঝে গেছে বগা। মেরুদণ্ডে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের কমান্ডগুলো বহু আগেই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ফ্রিজ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ডুমুরতলার জঙ্গলের রাজহাঁসটার কথা মনে পড়লো। জবাইয়ের আগে অবাক বিস্ময়ে ছুরিটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কোন প্রানী জবাইয়ের আগে ছটফট না করে এমন ফ্রিজ হয়ে তাকিয়ে থাকাটা বেশ ক দিন ভাবিয়ে ছিল বগা কে।
এটাই তার জীবনের শেষ দৃশ্য হবে তা-ও সে জানত না। প্রচণ্ড গতিতে আসা ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হবে তার , নিমেষে তলিয়ে যাবে অন্ধকারে- কখনো ভাবেনি বগা। তীব্র আলোর ঝলকানিতে হুঁশ ফিরতে দেরি হয়ে যায় তার। নারায়ণগঞ্জ থেকে জরিনার শরীরের গন্ধ নাকে নিয়ে কেরুর নেশায় উল্লসিত আসাদ ট্রাক চালিয়ে আসছিল খুব স্পিডে। কেরুর আর কী দোষ? লং রোডে মাঝ রাস্তায় কোন পাগল এমনতর দাঁড়িয়ে থাকে? ট্রাক থামানোর অবস্থায় তখন সে ছিলও না। আঠারো টন ট্রাকের চাকায় বগার মগজ পিষ্ট করে চলে যায় । রক্ত মাখা মগজ পিচ ঢালা পথ থেকে পাশের মাটিতে ছিটকে পড়ে। রাতের নীরবতা ভেঙে একটাই আওয়াজ তখন বাতাসে- ‘ওস্তাদ স্পিড কমায়েন না, যা হইছে হোক টাইনা যান’।
শেফালীর ভাগ্য কি ভাল না খারাপ বুঝতে পারছে না শেফালী। দু দু বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। শিকার হাতের নাগালে কিন্তু শিকারির হাতে মারা পড়ছে না। অন্য কেউ তার হয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। এ কি সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য?