৩
৩রা, জুন, ২০১০। তারিখটা পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলি মহল্লার জন্য বিভিষিকাময় এক রাত। রাত ১০:৩০ এর দিকে শুরু হয়েছে এ এলাকায় আগুন। শেফালীও পুড়েছে। তবে আগুনে না। তার জীবনেরও সবচেয়ে বিভিষিকাময় রাত এটা। পেটিস আর চা শেষ করে পাবলিক লাইব্রেরি অডিটোরিয়ামে ছবি দেখতে বসেছিল শেফালী। স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি। আজকালকার স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিগুলো কেমন যেন একঘেয়ে লাগে। গতনাগতিক কাহিনী। তবে শেফালী যে সিনেমা দেখতে বসেছে গত বছর তার প্রচার এমন ঢাক ঢোল পিটিয়ে করা হয়েছিলো যে না দেখে কারো উপায় ছিলো না। অনেকেই এই ছবি গত বছর দেখে ফেলেছে। সিনেমার নাম “First ten minutes.” পরিচালক মায়াবতী চোধুরী। পত্রিকা, টক শো তে মায়াবতী চোধুরীর উপস্থিতি, তর্কাতর্কি, বিজ্ঞাপন তো আছেই, এরপরও টিভিতে সংবাদপত্রে কিছু তথাকথিত বিশিষ্ট মানুষজনের মুখ দিয়ে প্রশংসা করানো হইয়েছিলো এমন ছবি কেউ এর আগে বানাইনি। বিশাল ভাবনা চিন্তার ফসল এই ছবি। তাছাড়া এই সিনেমায় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। পরিচালক মায়াবতী চৌধুরী তার সিনেমার নায়িকা লোপাকে প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে চড় মেড়ে বসেছে। মারবেইবা না কেন? লোপা এক পত্রিকায় দাবী করে বসেছে তার অভিনয়ের গুনেই এই ছবির সফলতা। মায়াবতীর পরিচালনা না। এই চড় নিয়ে সামাজীক যোগাযোগ মাধ্যমে হুলুস্থুল চলেছে কয়েক মাস। তারপর অনেকে ভুলতে বসেছিলো কিন্তু মাস ছয়েক আগে পরিচালক মায়াবতীর কিছু নগ্ন ছবি ছড়িয়ে পড়লো। মায়াবতী চোধুরী আত্মহত্যা করলেন। সব মিলিয়ে এক নতুন সিনেমার গল্প যেন। শেফালীর এই ছবি আগে দেখা হয়নি। আজ পাবলিক লাইব্রেরীতে চলছে দেখে বসে গেছে দেখতে। এদিকে কক্ষন যে রাত ৯টা বেজে গেছে খেয়ালই করেনি। সিনেমার নাম দশ মিনিট হলেও পুরো ৮০ মিনিটের ছবি। ছবিটা একেবারে খারাপ না। মায়াবতী চোধুরি বেচে থাকলে আরো কিছু ভাল ভাল ছবি পাওয়া যেত। নায়িকা লোপাও খারাপ করেনি। শেফালীর তাই মনে হলো। কিন্তু এই ছবির পর এই নায়িকা কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে? কেউ আর তার কোন নতুন সিনেমা দেখে নি। মায়াবতীর আত্মহত্যা নিয়ে অভিনেত্রী লোপাকে জড়িয়ে অনেকগুলো পত্রিকা বেশ কিছুদিন নিউজ করেছিলো বটে তবে তা আর বেশীদিন চলেনি। পাবলিক আজকাল বেশীদিন এক খবর খেতে চাই না। নতুন নতুন খবর এসে ভীড় করে। এত এত খবর চারিদিকে অনেক খবরই আজকাল আর খবর হয়ে ওঠে না।
শেফালী বাইরে এসে বুঝতে পারল লক্ষণ খারাপ। ঝুম বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা। বাসে ওঠার চিন্তা বাদ দিতে হলো। অনেক কষ্টে একটা সিএনজি ধরা গেল। কথা না বাড়িয়ে ২০ টাকা বাড়তি ভাড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চেপে বসেছিল। সঙ্গে সঙ্গেই প্রকৃতি তার সব দুঃখ উজাড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মহাখালী রেলক্রসিংয়ের কাছে এসে জ্যামের দৈর্ঘ্য দেখেই বুঝতে পারল কপালে খারাবি আছে। পরের এক ঘণ্টার মধ্যে দফারফা সারা। আশপাশ দিয়ে প্রবল বেগে ধাবিত হওয়া সদ্য আমদানি করা গাড়ির কারণে ময়লা পানিতে শাড়ি ভিজে একাকার। ষোলো কলা পূর্ণ হলো কাকলীর কাছে এসে। জমে থাকা পানিতে সিএনজি গেল বন্ধ হয়ে। শত চেষ্টা বিফলে যাওয়ায় বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে ড্রাইভার জানাল অতিরিক্ত ২০ টাকা দিতে হবে না। মিটারে যা ভাড়া তা দিয়ে নেমে পড়লেই হবে।
রাত তখন সাড়ে দশটা। সে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ঠিক মাঝের ফুটপাতে। অল্প অল্প বৃষ্টি তখনো হচ্ছে। চারদিকে পানি জমেছে। দুই পাশেই পানি, তাই কোনো দিকেই যেতে পারছিল না। ভয়ও লাগছে তার। না, ভূতকে না, মানুষকে!
কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যখন, ঠিক এ সময় একটা গাড়ি পাশে এসে ব্রেক করল। জানালা নামিয়ে এক বয়স্ক লোক জিজ্ঞাসা করছে –
‘কোনো সাহায্য করতে পারি?’
দেখেও না দেখার ভান করে থাকতে পারল না শেফালি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল-
‘সিএনজি নষ্ট হয়ে গেছে। আরেকটার অপেক্ষায় আছি’।
‘কিছু মনে না করলে আপনাকে উত্তরা অবধি লিফট দিতে পারি’।
‘না ঠিক আছে। পেয়ে যাব। আর আমাকে টঙ্গী যেতে হবে’।
‘মনে হয় পাবেন না। যে পানি জমেছে’।
এ দেখি নাছোড়বান্দা। কী বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সেই আবার কথা বলে উঠল-
‘কিছু মনে করবেন না। আমি হাসান চৌধুরী। একজন ডাক্তার। আপনি অযথা ভিজবেন না। উত্তরা পর্যন্ত গেলে একটা রিকশা নিয়ে টঙ্গী চলে যেতে পারবেন’।
হাসান সাহেবের গলার স্বরটা ছিল অদ্ভুত সম্মোহনী জাগানো। কেমন যেন ভরসা জোগায়। আর ডাক্তার শুনেই কী যেন কী ভেবে উঠে বসল শেফালী। হয়তো আর কোনো উপায় ছিল না। মানুষ কত অসহায় এ দেশে আরেকবার আবিষ্কার করল। লোকটা সারা পথ একটিও কথা বলেনি।
খিলক্ষেত পার হতেই মুখ খুলল-
‘টঙ্গীতে কোথায় যাবেন?’
‘স্টেশন রোড’।
‘আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি?’
‘না অনেক কষ্ট করেছেন। আমাকে উত্তরার যে কোনোখানে ছেড়ে দিলেই হবে’।
‘না! এ আর এমন কী?’
‘আপনার বাসা কি উত্তরায়?’
‘না মিরপুর’।
‘উত্তরায় কোথায় যাচ্ছেন?’
‘উত্তরায় যাওয়ার কথা ছিল না। আপনাকে মিথ্যা বলেছিলাম’।
‘মিথ্যা কেন বললেন?’
‘আমি যদি বলতাম আমি মিরপুর যাচ্ছি তবে কি আপনি আমার গাড়িতে উঠতেন?’
‘আমাকে গাড়িতে তোলার জন্য আপনি উত্তরা অবধি এসেছেন?’
‘না হলে যে আপনার ভারী বিপদ হতো।’
‘কী বিপদ হতো?’
‘রাত এগারোটার সময় একাকী একটা মেয়ে। কত ধরনের বিপদই তো হতে পারে’।
‘আপনি গাড়ি থামান’।
‘কেন?’
‘গাড়ি থামাতে বলেছি। থামান’।
‘জায়গাটা নির্জন। আরেকটু পথ গেলেই উত্তরা। আপনাকে ওখানেই ড্রপ করছি’।
‘না আপনি এখনই গাড়ি থামাবেন। জাস্ট নাও’।
অগত্যা গাড়ি ব্রেক করে হাসান সাহেব। কোনো কথা না বলে শেফালি নেমে পড়ে। হঠাৎ রাগ উঠে গেছে। কেন যে এত রাগ উঠল তাও বোধগম্য হচ্ছে না। কেন জানি মনে একটা কু ডাক দিচ্ছিল। অশুভ কিছু ঘটতে পারে মনে হচ্ছিল। শেফালিকে নামিয়ে হাসান সাহেব গাড়ি নিয়ে চলে গেছেন। দুই-একবার চেষ্টা করেছিল শেফালিকে আবার গাড়িতে তোলার। কিন্তু শেফালির অগ্নিমূর্তি দেখে কথা বেশি বাড়াননি। শেফালি আশপাশে কোনো জনমানবের দেখা পাচ্ছে না। কোথায় আছে ও এখন? খিলক্ষেত-উত্তরার মাঝামাঝি কোথাও হবে। জায়গাটার নাম বোধ হয় কাওলা। শেফালি একবার শুনেছিল কারও মুখে। কিন্তু কোনো সাইনবোর্ডও দেখা যাচ্ছে না। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও কম। এই সময় কোথা থেকে আবারও ঝুম বৃষ্টি। একটু পরপরই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোতেই শেফালির মনে হলো সামনে কোথাও একটা যাত্রী ছাউনি আছে। জোরে জোরে হাঁটা শুরু করেছে। কিছু দূর আসতেই ছাউনিটা স্পষ্ট হলো। ছাউনির তলে বেঞ্চে একটি মেয়ে বসে আছে। অর্ধ নগ্ন। শেফালি থমকে দাঁড়াল।
শেফালিকে দেখেও বেঞ্চে বসে থাকা মেয়েটির ভ্রুক্ষেপ হলো না। শেফালিও কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। মেয়েটির ওপরের দিকে এক চিলতে কাপড় নেই। মাথা নিচু করে বসে আছে। কত বয়স হবে? বাইশ/তেইশ। মেয়েটিকে দেখেই মনে হচ্ছে পরিশ্রান্ত। চুলগুলোও এলোমেলো। মুখ চুলে ঢাকা। বিজলির চমকে হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠল পুরো এলাকা ক্ষণিকের জন্য। তাতেই খেয়াল হলো সারা শরীরই মেয়েটার ক্ষতবিক্ষত। রক্তাক্ত। শেফালির বুঝতে বাকি নেই কী হয়েছে মেয়েটার সঙ্গে। দমকা হাওয়ায় মুখ থেকে চুল সরে গেছে মেয়েটার। আর তাতেই মেয়েটার চেহারাটা আরও স্পষ্ট হলো। অনেকটা শেফালির মতো দেখতে। না অনেকটা না অবিকল শেফালির মতো। এক চিলতে পার্থক্য নেই। যেন শেফালিই বসে আছে। ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এ অবিশ্বাস্য। মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাবে। কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল শেফালী। কে যেন এ সময় কথা বলে উঠল?
একটা গাড়ি শেফালির পাশে এসে ব্রেক করেছে। জানালা নামিয়ে এক বয়স্ক লোক জিজ্ঞাসা করছে –
‘কিছু মনে করবেন না। আমি হাসান। একজন ডাক্তার। আপনি অযথা ভিজবেন না। উত্তরা পর্যন্ত গেলে একটা রিকশা নিয়ে টঙ্গী চলে যেতে পারবেন।‘
এ কথা শুনতেই শেফালির পুরো স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল। এই কথাগুলোই সে আগে শুনেছে। এরপর সে গাড়িতে চড়ে বসেছে। আর খিলক্ষেত অবধি পৌঁছানোর পর হাসান সাহেব মিরপুর যাবে শুনে কাওলার কাছাকাছি কোথাও নেমে পড়েছে। আর সেখানেই বসে আছে অবিকল শেফালির মতো দেখতে বিবস্ত্র এক নারী। শেফালি কি তাহলে আবার স্বপ্ন দেখছে। নিজের শরীরে নিজেই চিমটি কাটে শেফালি। না স্বপ্ন দেখছে না। হাসান সাহেব গাড়ির গ্লাস এখনো নামিয়ে রেখেছে। কিন্তু শেফালি কিছুতেই এবার গাড়িতে উঠবে না। ভয়ংকর স্বপ্নের মুখোমুখি সে হবে না।
: থ্যাংক ইউ। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি চলে যাব।
: কীভাবে যাবেন?
: সেটা আমার ব্যাপার। আপনাকে না ভাবলেও চলবে। লিভ মি অ্যালোন।
বলেই শেফালি মুখ ঘুরিয়ে নিল। মেয়েটা এমন রিঅ্যাক্ট করবে বুঝতে পারেননি হাসান সাহেব। রাগ, দুঃখ এবং বিস্ময়ে বেচারার মুখ কাল হয়ে গেল, তিনি আর কথা বাড়াননি। চলে গেছেন। শেফালি একাকী দাঁড়িয়ে আছে সিএনজি যেখানে নষ্ট হয়েছে সেই খানেই। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। বনানী স্টেশনের দিকে এগোতে লাগল শেফালি। এই সময় প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ। শেফালির ঠিক পাশেই একটা সাদা রঙের মাইক্রো ব্রেক কষে দাঁড়িয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুখ চেপে শেফালিকে মাইক্রোতে তুলে নিল তিনটে পুরুষ।
তারপর একটু আগে দেখা স্বপ্ন সত্যি হল। শেফালি অর্ধ নগ্ন হয়ে বসে ছিলো কাওলার এক যাত্রী ছাউনিতে। চারপাশে সুনসান নিস্তব্ধতা। ঘোর অন্ধকার। প্রবল হাওয়ার দাপটের সঙ্গে বয়ে চলেছে। বৃষ্টি নেই। একটু বৃষ্টি কি এখন হতে পারে না থকথকে বীর্য ধুয়ে দিতে গা থেকে। যদিও ঘন ঘন বজ্র বিদ্যুতের চমকানি আর তার হুঙ্কার থেমে নেই। মাঝে মাঝে কড়াৎ কড়াৎ শব্দে চারদিক বিদীর্ণ করে পড়ছে বাজ। তারই মধ্যে পুরো এলাকা বিদ্যুতহীন।
কেউ জানে না, একটু আগে শেফালীর সঙ্গে জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকরতম ঘটনাটা ঘটে গেছে। ধর্ষিত হয়েছে সে মাইক্রোর ভিতর। তিন তিনজন পুরুষের কাছে। নিমতলীর আগুনের ভয়াবহতা চলেছে তিন ঘন্টা ধরে। শেফালীরও এই তিন ঘন্টা জীবন্ত দগ্ধ হোওয়ার মত। শাহেদ কি আঁচ করতে পেরেছিলো?