১
‘একটা গল্প শুনবেন? ভূতের গল্প!’
উজ্জ্বল শ্যামলা, লম্বা প্রায় ৬ ফিট, খাঁড়া নাক, বুদ্ধিদীপ্ত চোখের এক ভদ্রলোক শাহেদের সামনের সিটে বসা। ভদ্রলোকের বয়স আনুমানিক ষাট। মাথার অবশিষ্ট চুল ক’টা যক্ষের ধনের মত সযত্নে আলগানো, ক্লিন শেভড, পরনে হালকা খয়েরি রঙের দামি ব্রান্ডের একটা টি- শার্ট আর নীল জিন্সের প্যান্ট, পায়ে ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙের মোজা। হলুদ রঙের মোজা শাহেদ জীবনে পড়েছে কিনা সন্দেহ! ভদ্রলোকের বেশভূষায় আভিজাত্যর ছাপ থাকলেও রুচি নিয়ে শাহেদের মনে সন্দেহ দেখা দিলো। হলুদ রংটাই তার কাছে অসহ্য। একবার তার হুমায়ূন ভক্ত স্ত্রী রুমি হিমু সাজানোর জন্য এই রকম হলুদ রঙের এক পাঞ্জাবী বানিয়েছিলো। পাঞ্জাবির আবার পকেট নেই। সেই কিম্ভুতকার মেয়েদের কামিজ পরে কি এক বিড়ম্বনায় যে শাহেদ পড়েছিলো তা বলে বোঝানো যাবে না। সব কিছু ছেড়ে ভদ্রলোকের এই হলুদ মোজার দিকেই বারবার চোখ যাচ্ছে। রঙের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষনিক মনের উপর প্রভাব ফেলে। শাহেদ ভদ্রলোকের ওপর কেন জানি চরম বিরক্ত, কিন্তু বিরক্তি চেপে রেখে বলল,
‘বলেন। আপনার ভূতের গল্পই শুনি’।
ভদ্রলোকের সঙ্গে ট্রেনেই পরিচয়। সালটা ২০১৩। বাংলাদেশের জন্য ঘটনা বহুল এক বছর। প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু ঘটছে। একদিকে শাহবাগের গণজাগরণ, আরেক দিকে হেফাজত ইসলামের উত্থান। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। তার ওপর আবার জাতীয় নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দলগুলো বেশ সরগরম। সারা দেশ অবরুদ্ধ। চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। পেট্রলবোমায় পুড়ে মরছে মানুষ। রেলের স্লিপার খুলে ফেলা হচ্ছে। পারতপক্ষে দূরপাল্লায় কেউ যাচ্ছে না। সবার ভেতর আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা। সাথে আছে সন্দেহ আর অবিশ্বাস। কিন্তু একরকম নিরুপায় হয়ে খুলনাগামী ট্রেনে চড়ে বসেছে শাহেদ। পুরো কামরায় শাহেদ আর এই ভদ্রলোক। ভদ্রলোক উঠেছেন কমলাপুর থেকে আর শাহেদ এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে। ওঠার পর থেকে শুনছে ওনার নাসিকা গর্জন। যেন প্লেন চলছে ট্রেনের বার্থে। কিছুক্ষণ আগে উনি ঘুম থেকে উঠলেন। “উঠলেন” বলার চেয়ে “ওঠানো হলো” বলা ভালো। আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। বাধ্য হয়েই ঘুম ভাঙাল শাহেদ। কিন্তু ঘুম থেকেই উঠেই যে উনি গল্প শুরু করবেন এমন প্রত্যাশা করেনি। শীতের হাওয়া বইছে হু হু করে, জানলা খোলার উপায় নেই, তা ছাড়া এই রাতে বাইরে দেখার মতো কোনো দৃশ্য নেই। নাসিকা গর্জন শোনার চেয়ে গল্প শোনা ভালো- সে চিন্তায় ফ্লোর দিয়েছিল।
বাঙালি মাত্রই রাজনীতির গল্প থাকবে আর এই ভদ্রলোকও ব্যতিক্রম নন, শুরু করেছিলেন রাজনীতি দিয়েই। মোটাদাগে এই বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তার কথার সারমর্ম ছিল-
‘Right to live বা বেঁচে থাকবার অধিকার হচ্ছে মানুষের প্রধান অধিকার। এখন এই বেঁচে থাকবার অধিকার নিশ্চিত করবে কে? অবশ্যই রাষ্ট্র এবং সরকার। এই যে পেট্রল বোমায় মানুষ পুড়ে মরছে এর দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে’।
শাহেদ মনে মনে একটা গালি দিলেও বয়স্ক লোক দেখে মুখে বলল, ‘জ্বী, তাতো ঠিকই’।
গল্পের সবকিছুতেই ভদ্রলোক সরকারের দোষে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বিরোধী দল ধোয়া তুলসী পাতা। যদিও ভদ্রলোকের রাজনৈতিক অবস্থান ঠিক শাহেদের কাছে পরিষ্কার হয়নি, এই মনে হচ্ছে বিরোধী দল তো আবার পরক্ষণেই সরকারি দল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে ভদ্রলোকের মূল্যায়ন ইন্টারেস্টিং।
‘গণতন্ত্রের প্রাথমিক সূত্রকে বরখেলাপ করে যে সরকার গঠিত তা কীভাবে গণতন্ত্র রক্ষার সরকার হয়?’
‘‘জ্বী, তাতো ঠিকই’
‘গণতন্ত্রের প্রথম কথা কী?’
‘ জনগণে…’ শাহেদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ভদ্রলোক বলতে থাকেন-
‘ হ্যাঁ, প্রথম কথা জনগণের রায়ে সরকার প্রধান হবে, জনগণের রায় দেবার সুযোগ কোথায়? চোর কখনো চোরকে বিশ্বাস করতে পারে না। কারণ সে নিজের স্বভাব ভালো করেই জানে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কখনোই মানুষের স্বার্থ রক্ষক সরকার নয়। এটি শাসক শ্রেণির পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির আপৎকালীন ব্যবস্থা’।
দেশি রাজনীতি থেকে উনি একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে টার্ন নিলেন। আমাদের রাজনীতিবিদের সঙ্গে উদাহরণ টানতে চলে গেলেন নেলসন ম্যান্ডেলায়। নেলসন ম্যান্ডেলা এ বছর ইহলোক ত্যাগ করেছেন শাহেদের জানা ছিল না, জানার ইচ্ছাও শাহেদের নেই। বলতে গেলে, শাহেদ রাজনীতির প্যাচাল থেকে বাঁচতেই ভূতের গল্প শুনতে আগ্রহ দেখাল।
ভদ্রলোকও অতি দ্রুত দু-চারবার কাশাকাশি করে গল্প শুরু করলেন।
‘আমি বাবা-মার একমাত্র ছেলে। অভাব কী জিনিস কোনোকালে প্রত্যক্ষ করিনি। সাতপুরুষ খেলেও শেষ হবে না- এমন সম্পদ ছিল আমাদের’।
গল্পের এমন শুরু শুনেই শাহেদ মনে মনে ভাবল কী ভুলটাই না করেছি। এ এখন তার সম্পদের বিবরণী পড়ে শোনাবে। চরম বিরক্তিকর। বিরক্তি প্রকাশ করতেই একটা সিগারেট ধরাল।
‘দেন আমাকেও একটা সিগারেট দেন। ভূতের গল্প সিগারেট খেতে খেতে করতে হয়’।
অগত্যা তাকেও একটা সিগারেট দিতে হলো। ভদ্রলোকের সিগারেট চাওয়ার ভঙ্গীটা ছোটলোকদের মত। এতক্ষণ যে আভিজাত্যর মোড়কে ভদ্রলোক ঢাকা ছিলেন নিমিষেই ধূলোই মিটিয়ে গেলো – এই সিগারেট চাওয়ার ভঙ্গীতে। শাহেদ ভদ্রলোককে নিরীক্ষণ করছে আর উনি গল্প বলে চলেছেন।
‘আমার ছিল প্রচণ্ড খাওয়ার নেশা। ঢাকা শহরে এমন কোনো রেস্টুরেন্ট নেই যে আমি বোধহয় খাইনি। একটা সময় ঢাকা ছেড়ে বিদেশ গেলাম। দুনিয়ার তাবৎ রেস্টুরেন্টে বসে খেতে লাগলাম। স্পেনের পায়েলা, থাইল্যান্ডের সম টাম, মেক্সিকোর টাকোস, কানাডার পুটিন, জার্মানির মার্জিপান, হংকংয়ের ফ্রেঞ্চ টোস্ট, টেক্সাসের শূকরের বারবিকিউ- মোট কথা পুরান ঢাকার বিউটি লাচ্ছি থেকে তুরস্কের ভেড়ার জিহ্বার স্যুপ সবই আমার টেস্ট করা সারা’।
এ তো খাওয়ার গল্প শুরু করল! ভূতের গল্প কোথায়? শাহেদ এড়ানোর জন্য চোখ বুজল। কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করার সময় কোথায় ভদ্রলোকের? উনি এক নিশ্বাসে বলে যাচ্ছেন।
‘তো এই দুনিয়াব্যাপী খেতে খেতে এক রেস্টুরেন্টে আমার সঙ্গে লিমা নামে এক মেয়ের পরিচয়। মেয়েটার নাম আসলে হালিমা। আমি ‘হা’ বাদ দিয়ে দিয়েছি। লিমা, লিমা বলি। মেয়েটা ওই রেস্টুরেন্টেই জব করে। ও রেস্টুরেন্টের নাম বলা হয়নি। রেস্টুরেন্ট প্লাকা। জার্মানির হাম শহরে। হাম শহরে হালিমা। হা হা হা _–’
শাহেদও ভদ্রতার খাতিরে হাসিতে যোগ দিলো। ভদ্রলোক হালিমা’র গল্প বলে চলেছেন।
‘লিমা অবশ্য জার্মান নয়। ঢাকার মেয়ে। স্টুডেন্ট ভিসায় গিয়েছে। হাম শহরে বাঙালি মেয়ের দর্শন পাব, কল্পনাতেও ছিল না। লিমার ইউনিভার্সিটিও হামে না। সে কেন হাম শহরে সেই গল্প বলতে গেলে আর ভুতের গল্প করা হবে না। আরেকদিন করবো।‘
ভদ্রলোক গল্প ভাল বলতে পারেন। একটা আয়েসী ব্যপার আছে ভদ্রলোকের গল্প বলার স্টযাইলে। শাহেদ গল্পে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলো। ভদ্রলোক বলে চলেছেন –
‘তারপর যা হয়। প্রথম দর্শনেই প্রেম। অবশ্য লিমা প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ার মতো। সব পুরুষই প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ে, মেয়েরা তৃতীয় দর্শনে। কথায় বলে, আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী। গুণও অবশ্য লিমার কম না। ওই যে একটা কথা আছে না রূপে, গুণে অনন্যা ধরেন সে তাই’।
শাহেদ তাল মিলিয়ে হা হু করে যাচ্ছে আর ভূতের অপেক্ষায় আছে। গল্পে ভূত কখন ঢুকবে? কিন্তু জনবান্ধবহীন বগিতে ভদ্রলোকের গল্পে মনোনিবেশ করতে করতে আর একটানা ট্রেনের চলতে থাকা দুলুনিতে কখন যেন ঘুম চলে এল তার টের পাইনি। ট্রেন তখন যমুনা সেতুর কাছাকাছি। এ সময় হঠাৎ ব্রেক কষে একটা বড় ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন থামল। চারদিকে একটা হট্টগোলের আওয়াজ। সামনে বসা ভদ্রলোক ঝাঁকি খেয়ে সামনের সিট থেকে শাহেদের গায়ে এসে পড়েছে। ‘সর্যি’ বলে সরতেই, শাহেদ কি হয়েছে দেখতে জানলা খুলল আর ট্রেনের জানলা দিয়ে মুখ বের করে প্রথমেই মা’কে দেখল। শাহেদের মা আজমীরা বেগম সেই সাধারণ আটপৌরে সুতির শাড়িতে ঘোমটা টানা। ২৪ ঘণ্টা বাবার ভয়ে ভীত হয়ে থাকা সেই দুই জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে। সময় যেন তৎক্ষণাৎ স্থির হয়ে গেল। শুধু একটি কথায় কানে বাজল-
‘বাবা, যা কিছুই হোক তুই যেন ট্রেন থেকে নামিস না। কোনো অবস্থাতেই না’।
জানলা খুলতেই একটা লোমশ হাত শাহেদের ঘাড় স্পর্শ করেছে। এ কোনো মানুষের হাত নয়। এত শীতল হাত মানুষের হতে পারে না। মুহূর্তেই সারা শরীর যেন ঠান্ডা হয়ে গেল। বিশ্রী একটা গন্ধ নাকে এসে ঠেকছে। কাঁচা মাংসের উৎকট গন্ধ। শাহেদের গা গুলিয়ে উঠলো। একটু দূরে লোমশ দুটো প্রাণী। প্রাণীদের চেহারা, ছবি, বর্ণনা করা যাবে না। ইহজগতের কোনো প্রাণীর সঙ্গে এদের মিল নেই। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার চোখের সামনে জ্যান্ত মানুষের কলিজা বের করে খাওয়া শুরু করেছে। একটা চিৎকার শাহেদের মুখ দিয়ে বেরোতে গিয়েও বেরোতে পারল না। গলাতেই আটকে গেলো। দু’চোখ প্রবল আতঙ্কে আর বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে প্রাণীদের নর ভোজ উৎসব দেখছে। দুটি নয় শ’য়ে শ’য়ে কতগুলো ভয়াবহ অপার্থিব জীব ট্রেনের যাত্রীদের ওপর ঝুঁকে পড়ে হাঁ করে দাঁত বসিয়ে যাচ্ছে। শাহেদকে দেখে চতুষ্পদ জন্তুর মতো চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে দুটো এগিয়ে আসতে লাগল। জীবগুলোর চোখদুটোয় দুনিয়ার হিংস্রতা , হাঁ করা মুখের ভেতরের দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লাল রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। শাহেদ আর সহ্য করতে পারল না। চোখ বন্ধ করে ফেললো। একটা বিদঘুটে আওয়াজ ভেসে আসছে। হাসির শব্দ। দুই কানের পর্দা মনে হয় ফেটে যাবে। জীব দুটা হাসছে। “….আমাকে চিনতে পারছিস!” – ফ্যাস্ফেসে কন্ঠস্বরে বলে উঠল একটা। কি ভয়ানক কন্ঠস্বর! – “….তোর সঙ্গে শেষপর্যন্ত মুখোমুখি দেখা হয়েই গেল”, পেছন থেকে ফের ভেসে এলো সেই কন্ঠস্বর। আওয়াজ সামনে থেকে না এসে পিছন থেকে কিভাবে আসছে? সহ্য করতে না পেরে দুই কানে হাত চাপা দিল শাহেদ। চেষ্টা করেও পিছন দিকে ঘুরে তাকাতে পারল না। শরীরটা আগেই অবশ হয়ে গেছে শাহেদের। চার হাতে-পায়ে ভর দিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে প্রানী দুটো। এ সময় হঠাৎ টের পেল, কেউ একজন শাহেদকেও ঠেলছে। জানলা দিয়ে তাকেও ফেলে দেবে। এবং আর সেটি কেউ না সহযাত্রী ভদ্রলোকটি। শাহেদ প্রাণপণ শক্তি দিয়ে নিজেকে আটকে রেখেছে।
‘ট্রেন থেকে নামিস না’- মায়ের কথাটাই সে বারবার জপে চলেছে। মাকে কোথাও আর দেখতে পাচ্ছে না। তবে গায়ে এক অসুরের শক্তি যেন এসে ভর করলো। এমন কোনো শক্তি নেই যে তাকে ট্রেন থেকে নামাতে পারে। লোমশ হাতগুলো মাথা ধরে টানছে। তবে শাহেদ বুঝে ফেলেছে যতক্ষণ ট্রেনে আছে এদের কিছু করার সামর্থ্য নেই। ট্রেন থেকে নামলেই ওরা তাকে ধরে ফেলবে। জানলা থেকে মাথাটা ভেতরে ঢোকাতে হবে। অনেক কষ্টে এক ঝটকায় মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়েও ফেলল। কিভাবে এই শক্তি অর্জন করলো কে জানে? মাথা ঢুকিয়ে জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়ে সীমাহীন আতংক নিয়ে বসে আছে। কতক্ষণ সময় গেল জানে না শাহেদ। একটু পরে দেখল কামরা যেমন ছিল তেমনি আছে। সহযাত্রী ভদ্রলোক একচুলও স্থান পরিবর্তন করেছেন বলে মনে হলো না। পাশের সিটে যেভাবে শুয়ে ছিলেন সেভাবেই আছেন। তার গল্পও থামেনি। শুধু শাহেদ কিছু অংশ মিস করে গেছে। লিমার সঙ্গে ভদ্রলোকের বিয়ে হয়ে গেছে বুঝতে পারছে। তারা ঢাকার গুলশানে একটা রেস্তোরাঁয় বসে আছে। রোম, প্যারিস, লন্ডন থেকে কীভাবে ঢাকার গুলশানে এসেছে সেই অংশ শুধু সে শুনতে পায়নি।
তার চোখমুখের ফ্যাকাশে ভাবটা ভদ্রলোক দেখতে পাচ্ছেন না। ট্রেনের বার্থ অন্ধকার। তিনি আপন মনে গল্প করে যাচ্ছেন। শাহেদ জানলার দিকে আরেকবার তাকাল। ট্রেন ধীরে ধীরে যমুনা সেতু পাড়ি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে একটু জোড়ে চললেই সেতু ভেঙে ট্রেন নদীর অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে। কিন্তু এ বাদে কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ছে না। চোখ-মুখে পানি দেওয়া দরকার। লাইট জ্বালিয়ে দাঁড়াল। লাইট জ্বালাতেই ভদ্রলোকের গল্প থেমে গেল। তিনিও চেহারা দেখে বুঝতে পারছেন কিছু একটা হয়েছে। পা দুটো এত টলমল করে উঠলো যেন হাঁটু মুড়ে পড়ে যাবে মেঝের ওপর শাহেদ। ভদ্রলোক লাফ দিয়ে উঠে ধরলেন। উনি না ধরলে মাথা ঘুরে ঠিকই পড়ে যেত। এতক্ষন কেন জ্ঞান হারায়নি সেও এক বিস্ময়!
ভদ্রলোকের সাহায্যে নিয়ে বাথরুমে গেল। চোখ-মুখে পানি দিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হলো। কিন্তু কিছুতেই নারকীয় দৃশ্যগুলো ভুলতে পারছিল না। ভদ্রলোকও জিজ্ঞাসা করেননি কী হয়েছে? শাহেদও তাকে বলবে কি না বুঝে উঠতে পারছিল না।
কিছুটা সময় পর অনেকখানি ধাতস্থ হল শাহেদ। কম্বল গায়ের ওপর জড়সড় করে টেনে বসলো। ভদ্রলোক জানলা খুলে বাতাস গায়ে লাগতে দিয়েছে। হ্যালুসিনেশন হয়েছিল মনকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করছে শাহেদ। হ্যালুসিনেশন আর ইলিউশন নিয়ে বিস্তর পড়া আছে। শোনার হ্যালুসিনেশন, ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন, ত্বকের হ্যালুসিনেশন, জিহ্বা আর নাসিকার হ্যালুসিনেশন – বিভিন্ন ধরনের হ্যালুসিনেশন হয়। কিন্তু সব কটি একসঙ্গে হয় কি না মনে করতে পারল না। মনে পড়ল, গতরাতে এই ধরনের একটা হলিউডের মুভি দেখেছে রুমি আর শ্যালিকা সুমি কে সাথে নিয়ে। ট্রেনের দুলনিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল আর অবচেতন মনে তার কোনো ইম্প্যাক্ট পড়েছে – মনকে প্রবোধ দিল । এখন অবশ্য ভীষণ হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে শাহেদ যেন একায় এই ট্রেনে ছুটে চলেছে। ট্রেন অগ্রসর হচ্ছে অজানার পথে। কোন পিছুটান নেই। শাহেদেরও কোন ভীতি, চিন্তা, ক্লান্তি – কিছুই আর নেই। সে যেন একটা মুক্ত স্বাধীন পাখির মত দু ডানা মেলে উড়ে ঊড়ে বেড়াচ্ছে নদীর উপর। এভাবেই যমুনা ব্রীজ পার হলো। পার হয়ে অবশ্য আবার দাঁড়িয়েছে ট্রেন। তবে এবার শাহেদ কিছুতেই জানলা দিয়ে মাথা বের করবে না। চোখ বন্ধ করে আবার হারিয়ে যেত চাইলো পাখির মত। কিন্তু নিরাবতা ভংগ করে সেই ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন,
‘ভাই, ভূতের গল্পটা কি শেষ করব?’
শাহেদ ফ্যাস ফ্যাসে গলায় ধমকে বলল, ‘না’।
‘না’ বলায় একটা মেয়েলি কণ্ঠ বলল, ‘বলুক না, এখানে খেতে বসেই ভূত হলো হালিমা ভাবি’।
শাহেদ চমকে উঠে পুরো কামরা চোখ বুলাল। মেয়েলি কণ্ঠের কোনো উৎস থাকার প্রশ্নই আসে না। শাহেদের মাথা আবার কাজ করছে না। চোখ ঘোলা হয়ে আসছে। এসব কী হচ্ছে? হার্টফেল করার আগেই আপার বার্থ থেকে রিনরিনে গলায় হাসির শব্দ শোনা গেল। ওপর থেকে এক মেয়ে নেমে আসল। এই মেয়েটির পরনেও টি শার্ট আর জিন্স। চুল ছোট করে কাটা। শাহেদ এই মেয়েটাকে চেনে। এই মেয়েটার এক হাতে ছয় আঙ্গুল। ওর নাম শেফালি। কিন্তু এ কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটির! প্রাণচঞ্চল এক তরুণী, যেন পঁয়ষট্টি বছরের বুড়িতে পরিণত হয়েছে। বছর তিনেক আগে ওর সঙ্গে প্রথম দেখা শাহেদের।