এবার শেষ পর্ব পড়ুন:
১১
নজরুলের পরিবারও চায় নজরুল দ্রুত গুছিয়ে উঠুক। গুছিয়ে ওঠা মানে নজরুল নিজের পায়ের উপর দাঁড়াক। এটা খুব করে চায় নজরুলের পরিবার। এই চাওয়া শুধু নজরুলের পরিবারের কেন সবার পরিবারেরই চাওয়া তাদের সন্তানেরা নিজ পায়ের উপর দাঁড়াবে। এই চাওয়া সব বাবা মায়েরই চাওয়া। নজরুলের পরিবারে আছে নজরুলের বাবা মা ও বোনেরা। নজরুল নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে না পারলে তাদেরও সমস্যা হইতেছে লোক সমাজের কাছে পরিচয় দিতে। তার চাইতে বড় কথা নজরুল যদি প্রফেশনে না যায় তাহলে পরিবারেরও বিরাট ক্ষতি হবে। বিশেষ করে এ সংসার চলবে কেমন করে? সে চিন্তায় নজরুলের মা বেশ দুঃশ্চিন্তায় থাকে। পরিবারের একমাত্র ছেলেই নজরুল। তো এ নজরুলই যদি দাঁড়াতে না পারে তাহলে তো মুখ থুবড়ে পড়বে সংসারের। উপার্জনই বা করবে কে? এ সংসারের হাল ধরবে কে? যখন তারা থাকবেনা তখন নজরুল কিভাবে চলবে? নজরুলের জন্য এমন কিছু তো রেখে যেতে পারছে না যে নজরুল লাট সাহেবের মতো পায়ের উপর পা তুলে খেতে পারবে। এদিকে নজরুলের বয়সও বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে। কবে বিয়ে করবে, নাতিপুতি দেখবে সে চিন্তায় নজরুলের মা সব সময়ই দুশ্চিন্তায় থাকে। নজরুলের মা প্রতি ওয়াক্তিয়া নামাযে বসেই ছেলের জন্য দোয়া করে।
হে আল্লাহ হামার সোলোক হেফাজত করো। যাতে হামাগোরে মুখ উং উজ্জ্বল করবের পারে! সাকিব, মুশফিকের মতো যান বড় হয়ে উঠে। যাতে লোকজন ওক লিয়ে গর্ব করবের পারে।
দিন যায় রাত যায় কিন্তু নজরুলের মায়ের এ আশা, এ স্বপ্ন আগের অবস্থাতেই থাকে। পাল্টায় না কোনো পরিস্থিতি। অর্থনীতির গ্রাফটাও আগের অবস্থাতেই থাকে। লোকসমাজের ছেলের কথা কেউ জিজ্ঞেস করলেই নজরুলের মায়ের মুখ লজ্জ্বায় লাল হয়ে ওঠে। বলতে পারেনা কাউকে যে, তার ছেলে এ বয়সেও মানে ৩৬, ৩৭ বছরেও বেকার। নজরুলও লোকসমাজে বলতে পারেনা কিছু- বলে, এই করছি, করবো, কাজ প্রসেসিং হচ্ছে এ কথা বলে জিজ্ঞেসওয়ালা থেকে সটকে পড়তে চায় দ্রুত। কিংবা এখন তুমি কি করছো বলে কেউ জিজ্ঞেস করলে রাগে, দ্বিধান্বিত হয়ে বলতে ইচ্ছে করে নজরুলকে, যে এখন আমি আঙুল চুষশি! এই কিছু না করতে পারা মানে সংসারের কোনোই উপকারে আসতে না পারাটা তো নজরুলকেও তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। এর যন্ত্রনা তো কম নয় আর। কিন্তু নজরুলের মায়ের ব্যথা কিংবা বেদনাবোধ আরো বেশি। একই সমাজে বসবাস করে যদি অমুকের ছেলে এতো বেশি আয় রোজগার করে সংসারের হাল ধরতে পারে তাহলে নজরুল কেনো তার পরিবারের হাল ধরতে পারছেনা। কেনো মাথা উঁচু করে বলতে পারেনা আমার ছেলে ব্যারিস্টার, পুলিশ সুপার কিংবা জজ। এই মনোবেদনা কম না নজরুলের মায়ের। পাশের বাড়ির ছেলে মেয়েদের যখন সু সংবাদ আসে তখন তাদের মা বাবাদের কতোই না আনন্দ হয়। কিন্তু নজরুলের বেলায় দুঃসংবাদ ছাড়া নজরুলের মা আর কি পেলো? এ অতৃপ্তি নিয়ে নিয়ে কালো চুল শাদা হয়ে গেলো তবু এ স্বপ্ন কিংবা আক্ষেপ রয়েই গেলো। অথচ কতো স্বপ্ন দেখতো তাকে নিয়ে যে, এই নজরুল একদিন বড় হবে- মানুষের মতো মানুষ হয়ে আর দশ গ্রামের ভেতর মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু না নজরুল কি এক অজানার খোঁজে তার মন নিবিষ্ট রেখেছে যে, তার থেকে বের হতে পারছেনা। ঐ শৃংখল ভেদ করে সামনে যেতে পারছেনা। -আচ্ছা মানুষের নামের সাথে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য কি লুকিয়ে থাকে? যেমন, নজরুলের নাম নজরুল না রেখে যদি অংশু নামটা রাখা হতো তাহলে কি তার ছেলে আলোকিত হতো। কিংবা যার নাম রাখা হয়েছে বিপ্লব সে কি সত্যিকারের বিপ্লব এনে দিতে পারে? এমন ভাবনা নজরুলের মায়ের মাথায় খেলে যায়। নজরুলের মা পরক্ষনেই ভাবে, তার ছেলে যখন তার গর্ভে তখন নামায কালাম, দোয়া দরুদ অর্থ্যাৎ আল্লাহ রাসুলকে রাজি খুশি রাখার এমন কিছু নাই যে, করেনি। তবু কেনো নজরুলের উপর আল্লাহ সহায় হচ্ছেনা এ কথা ভাবতে ভাবতে দু’ চোখে পানি চলে আসে তার।
-আরো কদ্দিন এ সোলের ফুল ফুটবি বারে! সগলি বিয়ে শাদি করে চার পাঁচটা করে সোলপোল লিয়ে টেপটেপা হলো আর হামার সোলের বিয়ের ফুলই ফুটলো না এখনো।
এ নিয়েও অনেক চিন্তা নজরুলের মায়ের। পাশের বাড়ির দু’একজনের সাথে এ নিয়ে আলাপও করে। কিন্তু তারা সান্ত্বনার বাণী শোনায়,
জন্ম মৃত্যু আর বিয়ে আল্লাহর হাতোত বারে! এল্লে লিয়ে টেনশন করে চুল পাক্যা লাভ নাই। আল্লার যখন হুকুম হবি তখন দেখবে হিনি বেটিসোলের বাপ মাওরা হুড়মুড় করে ঘরোত ঢুকে পড়বি! ওল্লে লিয়ে টেনশন করো না বুবু।
কিন্তু টেনশন না করতে চাইলেই কি টেনশন চলে যাবে? টেনশনের তো হাত পা নাই যে চলে যাবে! যদি টেনশনের হাত পাও নাই থাকে তাহলে টেনশন আলো ক্যাং করে?
নজরুল যে বিয়ে হচ্ছে না তাতেও আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে সমাজে। আড়ালে আবডালে লোকজন নানান কটু কথা বলাবলি করছে।
-কেরো বুবু নজরুল খোজা লিকি? এদ্দিনেও কোমা বিয়ে করেনা?
এসব কথা শুনে নজরুল হাসে- কিন্তু সে হাসির ভেতর এক প্রকারের যাতনা ও বেদনা দুইই থাকে। সমাজের মানুষদের সে কি বোঝাবে যে, সে যা চায় না তা পায়না- যা পায় তা সে চায়না! নজরুলের পক্ষে সম্ভব নয় একেবারে নিচুস্তরের কোনো ফ্যামিলিতে বিয়ে করা। সে যে মিডলক্লাস। মিডলক্লাসদের বিভিন্ন সমস্যা। এ মিডলক্লাসরা না পারে সমাজে দাঁত বের করে হাসতে, না পারে দাঁত ঢেকে রাখতে। এক প্রকারের উভয় সংকটে থাকে এ শ্রেনী। ফলে, মিডলক্লাস শ্রেনীর যে মেয়েটিকে নজরুল ভালবেসে বিয়ে করতে চায় সে মেয়েটি আবার উচ্চতর শ্রেনীর দিকে তাকায়ে থাকে। ফলে, এক ধরণের সংকট লেগেই থাকে।
-এল্লে লিয়ে ধরে থাকলে হবি?
মানুষ তো স্বপ্ন দেখে, কল্পনা করে। তাই বলে কি সব মানুষের সব কিছুই পূর্ণ হয়? চেষ্টা করেছো কিন্তু হয় নাই। যেহেতু হয় নাই সেহেতু সে জিনিস নিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখার কোনো মানেই নাই। জীবনটা তো একটা প্রকল্প। একেক সময়ে একে প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে হয়। তোমার ঐ প্রজেক্ট শেষ। এখন নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করো। নতুন প্রজেক্ট মানে তা যেমনই হোক অর্থ্যাৎ যে শ্রেনীরই হোক বিয়ে করে সংসার করা।
বিয়ে না করা পর্যন্ত তোমার কোনো গোত হবিনে হামি কয়ে দিনু।
নজরুল এবং কালু সুখ দুঃখের গল্পে করতে করতে কালু নজরুলকে বলে।
নজরুল নিজেও বোঝে ওর দ্রুত বিয়ের পিঁড়িতে বসা দরকার। সংসার করা দরকার। একটা সময়ে এই নারী নারী করে কতো জল ঘোলা হয়েছে নজরুলের। পাশের বাড়ীর অর্থ্যাৎ পাড়া প্রতিবেশি এক চাচাতো বোনকে ভালবাসতে গিয়ে কতো কিচ্ছা কাহিনীই না হয়েছিলো একদা।
যে মেয়েটিকে ভালবাসতো নজরুল সে মেয়েটির বড় ভাই এলাকায় প্রভাবশালী মাস্তান। তো একদিন জানতে পায় যে, নজরুল তার বোনকে ভালবাসে। ঐ মেয়েটিও নজরুলকে মনে মনে ভালবাসলেও মুখ ফুটে কিছু বলেনা। না বলার কারণ হয়তো তার ভাইই। নজরুলকে ভালবাসে এই কথা জানতে পারলে নজরুলের আস্ত রাখবেনা যে। তবু নজরুল প্রতিনিয়ত তাকে দেখার জন্য ঐ মেয়েটি যে পথ ধরে স্কুলে যায় সে পথে দাড়ায়া থাকে। তাকে দেখে হাসে, চোখ টিপি মারে। কোনো কোনোদিন আগ বাড়িয়ে কথাও বলে। মেয়েটি কথা বলতে চায়না,
বলে, দেখেন, হামার সাথে কথা কওয়া দেখলে আপনের চান্দি ফাট্যা দিবি হামার ভাই।
নজরুল কয়, হ, দিক! তোমার জন্যি হামি মরবের পর্যন্ত পারি। হ হ, এল্লে মিছে কথা। একুনি যদি কওয়া হয়, বিষ খান। বিষ খাবেন লিকি।
নজরুল কয়, হ খামু! মেয়েটি বলে, যান যান বিশ্বপ্রেমিক হওয়া লাগবির লয়! আপনি হামাক ভালবাসলেও হামি আপনেক ভালবাসবার পারমুনা। হামাক ভালবাসলে আপনের সত্যিকারের আগুনোত ঝাঁপ দেওয়া লাগপি। তার চাইতে আপনে হামার কাছ সরে যান, সরে যায়্যা আরেকজনের সাথে প্রেম করেন।
মেয়েটির সাথে নজরুলের এই আলাপ এলাকার কেউ একজন দেখে ফেলে। সে কথা আবার মেয়েটির ঐ বড় ভাইকে বলে যে, নজরুল না সিম্মিক ডিস্টার্ব করে। সিম্মিক দেখে খারাপ খারাপ কথা কয় নজরুল। সিম্মির বড় ভাই, বেশ কড়া টাইপের রাগি মানুষ।
সে কয়, এই এলাকাত হামার বোনোক কেউ ডিস্টার্ব করবি আর হামি তাক বাঁচে থুমু লিকি?
সুযোগ মতো একদিন সিম্মির বড় ভাই এলাকার মাস্তান টাইপের আরো কয়েকজনকে দিয়ে নজরুলকে তুলে নিয়ে যায়। নজরুলকে চোখ বেঁধে যে জায়গায় নিয়ে গেছে সে জায়গায় কেউ নেই। ধু ধু বালুচর। এটা কাক পক্কির সাউন্ডও নাই। শুধু শো শো বাতাসের আওয়াজ। মনে হচ্ছে এই হিন্দি সিরিয়াল শুরু হবে। তার ইন্ট্রো শুরু হচ্ছে। সিম্মির ভাই, নজরুলের নাক সাপটে একটা ঘুঁষি মেরে বলে,
ক, শুয়োরের বাচ্চা, কদ্দিন থেকে হামার বোনের পিছোত লাগছু!
শুয়োরের বাচ্চা স্কুলোত যাওয়ার সমি হামার বোনোক দেখে টিস্ করিস। লয়? এই দেকচু এডে রাম দাও, ঘাড়োত থাক্যা কাল্লা আলাদা করে দেমু।
এই শুয়োরের বাচ্চা প্রেম ভালবাসা হামরাও করসি, কিন্তু তোর মতো লয়, জোর করে ভালবাসিনি। হামার বোন যদি তোক বালবাসলোহিনি তালে পরে না হয় এটা হলোহিনি। এক হাতে তালি বাজাবের চালেও তালি বাজপি? ক?
-কদ্দিন থাক্যা হামার বোনের পিছ ছাড়বু? আরেকজন কয়ে উঠে, সাওত এনা লাগাস না ক্যা! লাগালেই বুঝপি হিনি।
এদিকে নজরুল কাকুতি মিনতি করে ভাই হামাক ছাড়্যা দেন। আর কুনোদিন ডিস্টার্ব করমুনা ভাই।
-মনে থাকপি তো?
-হ, ভাই।
তারপরও তাকে ছেড়ে দেয়না। মুখ থেকে স্যাপ ফেলে দিয়ে তাকে চেটে খেতে বলে। নজরুল স্যাপ চেটে খেতে ধোনোমনো করতে করতেই পেছন থেকে কে যেনো কান সাড়া জুড়ে একটা থাপ্পড় লাগালো। রাতের আঁধারে তাকে টের না পেলেও থাপ্পড়ের ওজনে সে ধপাস করে মাটির উপর পড়ে যায়। কান তালি মারে আসে। মনে হচ্ছে নজরুলের মাথার ভেতর কেউ নষ্ট হোন্ডা চালাচ্চে, যাচ্ছেনা কিন্তু গোঁ গোঁ করে শব্দ করছে। আরেকজন দাঁত কেলিয়ে হাসে তা দেখে।
হে হে, এটা থাপ্পড়োতই কাত হয়া পড়ছু। তাতি তুই বলে সাটেল মদ্দা! বাপের ব্যাটা সাদ্দাম!
সে কোনো মতো সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হাত জোড় করে, মাফ চেয়ে চলে আসে। এসে গম্ভীর হয়ে থাকে। সে ভেবে পায়না এভাবে তাকে অপমান করলো, পিটালো! না হয় তাও হলো, তাই বলে বাড়ি থেকে তুলে লিয়ে যাবি? এডে কোনো কথা?
বুকোত কি খালি অরি হিম্মত আছে আর কারো নাই? ওরি গেরে চায়ে গায়োত কি কম রক্ত আছে নিকি? চৌধুরী ব্যাটার গায়োত হাত দেয়!
নজরুল ভাবে, এডের এটা বিধিব্যবস্থা করাই লাগবি। বিধি ব্যবস্থা না করলে ওরা মাথার উপর উঠে লাচবি।
সেও তার কলেজ লেভেলে পড়াশুনা করা বন্ধু বান্ধবদের বললে, তারাও রেগে ফায়ার হয়ে যায়!
-বলে, চ, উই ক্যাংকা মাস্তান, হামরাও এনা দেকি! তাকে ধরার জন্য একদিন ৮/১০ জন মিলে রামদা, ছোঁড়া, রিভলবার নিয়ে রাস্তায় মহড়া দেয়।
বাড়ির সামনে দিয়ে ডাক সারে, বাড়িত থেকে বাড়া- তুই বলে অনেক বড় মাস্তান হছু, আজকে বারে বাড়া, তোর মাস্তানি ছোটামু আজকে।
কিন্তু সেদিন তাকে কোথাও খুঁজে না পাওয়ার কারনে অনাকাংখিত কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এ ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে পরদিন মেয়ের বাবা- মা রা নজরুলের বাবা মা কে বলে দিলে, নজরুলের পরিবার নজরুলকে এমন শাস্তি দেয় যে, মাটিতে নাক ছেঁছুড় দিয়ে তওবা পড়তে হয় নজরুলকে।
সেই থেকে নজরুল সিম্মির দিকে আর কখনো তাকায় নি। অথচ সিম্মিও গোপনে ভালবাসতো নজরুলকে। কিন্তু সিম্মির কোনো সময়েই ফাস্ট চয়েসের তালিকায় নাম থাকতোনা নজরুলের। যদি প্রথম কিংবা দ্বিতীয় জন মিসিং হয় তার লাইফে তাহলে নজরুলকে অল্টারনেটিভ হিসেবে ভাববে।
এইসব ঘটনা নজরুলের কৈশোর পেরুবে পেরুবে এমন সময়ের কথা। এরকম আরো দুরন্তপনা ঘটনা আছে নজরুলের জীবনে।
একদিন বন্ধুরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো আজ সিনেমা দেখতে যাবে। সে সময় সিনেমা দেখা মানেই অনেক কিছু। যেহেতু সময়ের সন্তান তারা সেহেতু সময়োপযোগী হিসেবে তাদের চলতে হবে। ফলে, শহরের আর দশটা ছেলেপুলে যেভাবে বড় হচ্ছে তাদের মতো তাদেরকেও চলতে হবে। ফলে সবাই দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যায়। নজরুলের সিনেমা দেখা যতোটা না ভালো লাগে তার চাইতে বেশি ভাল লাগে তার সিনেমার টিকিট কাটাতে। সিনেমা হলের ম্যাক্সিমাম টিকিটই ব্ল্যাকে বিক্রি হয়। ফলে, সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ থেকে যে অল্প কিছু টিকিট বিক্রি করার জন্য ছাড়া হলো তার জন্য টিকিট কাউন্টারে প্রচুর মারামারি করতে হয়। তো নজরুলেরাও পিছিয়ে নেই এই কাজে। বরং ভালই লাগে তাদের। বাড়তি থ্রিল অনুভব করে। নজরুল বাস্তবের হিরো এটাই প্রমাণ করার জন্য নজরুল থাকে সবার সামনে। নজরুল দো-হারা গড়নের। সুলতানের আঁকা পেশির মতো নজরুলের পেশি। ফলে নজরুলের পক্ষে দুই একজনকে কাত করা কোনো ব্যাপারই না। ফলে, কোমড় থেকে বেল্ট খুলে পেটাতে পেটাতে টিকিট কাউন্টার ফাঁকা করে ফেলে নিমিষেই। সিনেমা দেখা শেষ হলে যখন বাড়িতে ফিরতো তখন রাত অনেক পেরিয়ে যায়। এ ঘটনা প্রায়ই ঘটতো নজরুলের। মায়ের আঁচল থেকে ৫ টাকা চুরি করে কিংবা এলাকার কোনো বড় ভাইদের কাছ থেকে ৫ টাকা ধার করে সিনেমা দেখা একপ্রকারের দৈনন্দিন রুটিন ছিলো। এর জন্য কম গালি খেতে হয়নি নজরুলকে। মায়ের কানমলাও খেয়েছে অনেক। তবু নজরুলের স্বভাব বদলায় নি। কতোদিন যে, সিনেমা দেখে চোরের মতো ঘরে ঢুকে হাত মুখ পরিস্কার না করেই যে চুপি চুপি ঘুমিয়ে পড়তো নজরুল। যাতে করে কোনো কাক পক্ষীও যেনো টের না পায় । সে সব সময়ের থ্রিল অনেক। অনেক অভিনব- অনেক মজার।
নজরুলেরা দলবেঁধে অনেক কিছুই করেছে একসঙ্গে। খেলাধুলা, চলাফেরা, মিছিলমিটিং কিই না করেনি তারা। তারা ফাইনাল খেলায় জেতার জন্য ফসলের জমি থেকে ফসল চুরি করেছে পর্যন্ত। সে চুরি করা ফসল বিক্রি করে যে টাকা তারা পেয়েছিল সে টাকা দিয়ে শহর থেকে খেলোয়ার হায়ের করে এনে তাদের নিজেদের ক্লাব ভিলেজ ভয়েজকে চ্যাম্পিয়ন করেছিল। তারা খেলার জন্য যে চুরি করেছিল তার জন্য তারা শ্লাঘা অনুভব করেনা। এটা অপরাধ বলে মনেও করেনা। বরঞ্চ, এর ভেতর তারা আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলো। ঢেঁকুর তুলেছিল আত্মতৃপ্তির। নজরুলের মনে পড়লো সেই চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নিয়ে প্রতি হাট-বাজারের দোকানগুলি থেকে আর নেতৃত্বস্থানীয় লোকেদের থেকে চাঁদা তুলে ইয়া বড় একটা পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছিলো গ্রামে। সাদা ভাত আর আলুঘাটির তরকারীতে ভোজনরসিকেরা পেট পুরে খেতে পেরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলো।
আজ সে দিনের মধুর স্মৃতিগুলোর কথা মনে পড়লে মনটা হুঁ হুঁ করে ওঠে। এখন আর সেসব নাই। যার যা বাস্তবতার জগতে গিয়ে আর কেউ ফিরে আসেনি।
অর্থের খপ্পরে পড়ে সবাই বিলীন হয়ে গেছে। অর্থ একটা অজগর সাপ যে সাপ হা করে তার ভেতরে উঠে যাওয়া হয়ে গেছে নজরুলসহ সকলের। বাস্তবতা কঠিন- বাস্তব এবং তা বড়ই নির্মম। সুখের কিংবা কল্পনার রাজ্য থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেয়। এসব ভাবতে ভাবতেই মসজিদের মাইকে ভোরের আজান বাজতেছে আল্লাহু আকবার- আল্লাহু আকবার, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ট- আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। আর অল্প কিছুক্ষণ পরই সবাই ঘুম থেকে জেগে উঠবে। আর নজরুল কিনা যাচ্ছে মাত্র ঘুমাতে।
১২
আজ শুক্রবার। আফসানার সাথে শাহবাগে দেখা করার দিন আজ। আজই সে জানাবে বিয়ের ব্যাপারে চুড়ান্ত কথা। প্রায় ১২ টার সময় ঘুম ভেঙ্গে তরিঘরি করে উঠে গোসল করতে করতেই তার প্রায় আধাঘন্টা চলে যায়। পরে দুপুরের খাবার খেয়ে এবং শার্ট প্যান্ট পরে রেডি হতে হতেই প্রায় দেড়টা বেজে যায়। আফসানার সঙ্গে নজরুলের দেখা করার টাইম ফিক্সড করা হয়েছে সাড়ে তিনটার সময়। ইডেন কলেজ থেকে ওর টিএসসিতে আসতে চারটা বেজে যাওয়ার কথা। আর নজরুলের কল্যানপুর থেকে শাহবাগে পৌঁছাতে পৌঁছাতে টাইম লাগবে একঘন্টা। সব মিলিয়ে আফসানার দেওয়া সময়মতো পৌঁছা যাবে।
বাসস্ট্যান্ড থেকে গাড়িতে উঠে রওনা দিয়েছে নজরুল। ফার্মগেটে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই আফসানার ফোন। আফসানা আজ দেখা করতে পারবেনা। ওর মা ওকে দ্রুত বাসায় যেতে বলেছে। একথা শোনার পর ওর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা। এত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ও যে দেখা করতে চেয়েও দেখা করলোনা এটা নিশ্চয় নেগেটিভ সংবাদ হবে। সে জিজ্ঞাসা করলো তাহলে আমাদের যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিলো তার কি হবে। সে জানালো রাতে ফোনে বলবে অথবা সামনের অফ ডে তে দেখা করে দেখা করে জানাবে। এত সাজ সজ্জা করে মাঞ্জা মেরে যে নজরুল দেখা করার জন্য বের হলো তা ভেস্তে গেলো। এত সাইজসুইজ করে যে বের হলো তা আর দেখানো হলোনা আফসানাকে। যাই হোক দেখা করবে এবং জানাবে এটাই ভরসা। তবে যে রেজাল্ট তারপক্ষে আসবেনা এটা মোটামুটি আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। কেননা আগের রাতের কনভার্সেশন আর আজকে দেখা করতে চেয়েও দেখা না করার মাধ্যমে বোঝা যায়। গতরাতে অনেক কথার পর সে ষ্পষ্টতই বলেছেঃ
মা’য় কছে, তুমি ঠুল্লোর মতো ঘোরো। তাই মায়ে রাজি নয়।
আফসানা বলে, হামি কি করি কও, তুমি তো ঠুল্লোই। একুনি যদি তোমার কাছে যাই তালে পরে কি হবি? ক্যাং করে তুমি হামাক খিলেবা? এডে তো সিনেমা লয় যে, কোনো সাগড়পারোত যায়্যা আগুন জ্বলে রাত পোহামু আর বাসর ঘর করমু? তুমি আগে কিছু এডা করো। তারপর ভাবমু হিনি।
আফসানা তার বাবা মার বিপক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত দেবেনা
কিংবা সে নিজেও একাকি কোনো সিদ্ধান্ত নেবেনা।
সে জানায়, হামি বাপ মায়ের বাইরে কিছু করব্যার পামু না। বাপ মাও যা কবি হামি তাই করমু।
নজরুল নিজে নিজে ভাবে তাহলে প্রেম ভালবাসার মানেটা কি? যদি সবকিছুই পিতা মাতার নির্দেশে করো তাহলে প্রেম করতে এসেছিলো কেনো? নজরুল এসব ভাবতে থাকে আর সিদ্ধান্ত নেয় যেকোনো উপায়েই হোক তাকে পেতে হবে। কিন্তু তার কথারও যুক্তি আছে। সে এখনো বেকার, বাবার অবস্থাও ভাল না-পকেটের অবস্থাও শূন্য। এই মুহুর্তে বিয়ে করা মানেই নিশ্চিত মরণ। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবে সবাই তো এরকম শুন্য অবস্থাতেই বিয়ে করে। সে বিখ্যাত ব্যক্তি হোক কিংবা অখ্যাত ব্যক্তি হোক। বিয়ে করার পরই মানুষ সব কিছুতেই গেইন করতে পারে। বিয়ে করার আগে প্রত্যেক মানুষের ভেতরই ঠুল্লোগিরি থাকে। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, বাস্তবতাকে তার মেনে নিতে হবে। সে এমন কোনো কাজও করতে পারবেনা যে যেটা করলে আফসানা খুশি হয়ে বাবা মাকে বলতে পারে। কিন্তু নজরুলের অপেক্ষা না সওয়ার পেছনের কারণ হলো, যা দিনকাল পড়েছে কখন যে নজরুলকে ছেড়ে অন্যের হাত ধরে। নজরুলের চাইতে ভালো ছেলে পেলে আফসানা তো হাতের গ্রীপ থেকে ছুটে যাবে। আর আফসানার বাবাও চাইবে তার মেয়েকে ভাল একটা ছেলের হাতে পাত্রস্থ করতে। নজরুল জানে যত দিন যাবে তার অবস্থা আরো অনিশ্চয়তায় ভরে উঠবে। অতএব অনিশ্চয়তা সঙ্গী হওয়ার আগেই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলাই উত্তম কাজ হবে। বিয়ে হয়ে গেলে তো আর কিছুই করার থাকবেনা। এরপর থেকে নজরুল যতোবারই ফোন দেয় আফসানাকে ততোবারই ফোনের লাইন কেটে যায়। অনেক অনেকবার ফোন দেওয়ার পর হ্যালো হ্যালো বলেই কেটে যায়। কখনো কখনো কল ওয়েটিং থাকে। নজরুলের আর বুঝতে বাকি থাকেনা যে, আফসানার সাথে তার সম্পর্কের চ্যাপ্টার হয়তো এখানেই ক্লোজ হতে যাচ্ছে। এভাবে কয়েকদিন ফোনিং হওয়ার পরও যখন রেস্পন্স না আসে তখন নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আফসানার সাথে নজরুলের সম্পর্ক ডিসমিস পর্যায়ে চলে গেছে।
তার দমবন্ধ হয়ে আসার মতো অবস্থা। আস্তে আস্তে সকল দরজা ক্লোজ হয়ে যাচ্ছে তার এটা ভেবে সে ঘেমে উঠতে থাকে, ক্রমশ। সর্বশেষ যে একটা উপায় ছিলো ভালো থাকার সেটাও নষ্ট হয়ে গেলো। এখন কি করবে নজরুল? সে ভাবে কতোদিনই আর অপেক্ষা করতে পারে একজন মানুষ। কিংবা যাকে সে আশা দিয়েছে সে আশাটুকুও তো সে বাস্তবে রূপ দিতে পারে নি। এ ব্যর্থতা আফসানার নয় এ ব্যর্থতা নজরুলের। নজরুল তাকে যে স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলো সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কিন্তু নজরুল বুঝতে চায়-মানুষের স্বপ্ন তো স্বপ্নই। স্বপ্ন তো সবসময় বাস্তবের বাইরে থাকে। সে কিভাবে পূর্ণ হয়? অতএব, আফসানার স্বপ্ন পূরণ করতে না পারাটাও বাস্তবতারই একটা পার্ট। ফলে আফসানার ভুল বোঝাটা হঠকারিতা এবং আবেগী চিন্তার ফলপ্রকাশ। কিংবা আফসানাও সত্য, কে চায় অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে পথ চলতে।
এদিকে নজরুল আরো বিপদে পড়তে থাকে। তার পকেটের টাকা একেবারেই শূন্যের পর্যায়ে। ১ মাসের বাসা ভাড়া ইতোমধ্যে দিতে না পারার কারণে মেসের সদস্যের কাছে থেকে নানান প্রকার কটু কথা হজম করতে হয়েছে তাকে।
ওঁকি ঢাকাত কে দিবি চাকরি? মোল্লার দৌড় মসজিদ পন্তোই। খালি মানষের মুক চিনলেই হয়না। মুক চিনলেই যদি সবি হলোনি তালে পরে তো কামই হলোনি।
মেসের এক সদস্য বলে। তার পাশে থেকে আরেকজন বলে ওঠে-
ওঁর খালি ভটভটানিই সার। হ্যাং করেঙ্গা তেং করেঙ্গা। খালি কয়ে বেড়ায় ওটি ওমুক বড় ভাই আছে ওর- ওটি বন্ধু আছে ওঁর। কথা শুনে সাউয়োর তল পন্তো জ্বলে ওঠে। মনে হয় উয়ি সবি আর হামরা চ্যাটের বাল। দে সাউয়োর বালোক মেস থেকে বার কর্যা দে। অকজুবি ঢাকাত্ অ্যাসে ভাব লিচ্চে!
সেদিন পহেলা বৈশাখ। তার এক কৈশোরের বন্ধু ডিপজল মেসে এসেছে গ্রাম থেকে। রাতে খেয়ে দেয়ে তারা ব্যালকোনিতে গল্প করে:
এটি ইংকে করে পড়ে থাকার চেয়ে গ্রামোত পত্তে ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়া ভালো বার্যা। এটি কে দেকপি তোমাক? সগলি তো ইংকেই। ট্যাকা থাকলে পুছলো হিনি।
নজরুল মেনে নেয় তার কথা। কেননা বাস্তবতাকে মোকাবেলা করে ব্যর্থ হয়েছে সে। এখন যা করতে হবে বাস্তবতার সাথে সমঝোতা করেই চলতে হবে। সে নিজেও জানে এবার যদি শহর থেকে গ্রামে ব্যাক করে তাহলে তার আর কখনো শহরে থাকা হবেনা-সাহিত্যিক হওয়া যাবেনা। তবু এ যাত্রায় শহর থেকে ফেরে গ্রামের পথে। ফিরতে ফিরতে হেডফোনে গান বাজে..
ও আমার বন্ধু গো- চিরসাথী পথ চলায়. .
কিন্তু এখনো সে চিরসাথীর দেখা পায় নাই। অর্থ্যাৎ এখনো সে যে বন্ধুর খোঁজ করতেছে তার দেখা পায় নাই। সে যা পেয়েছে তা বন্ধুর মতো দেখতে। মতো’র মতো। কিন্তু মতো কি আর হুবহু হয়? চোখ দিয়ে অশ্রু গড়ে পড়ছে কিন্তু দেখার কেউ নাই। দেখবেও না কেউ। কোনো কোনো অশ্রু কাউকে দেখতে দিতেও হয়না।
গ্রামে ফিরে তার ঘোর কাটতে কাটতেই তিন চারদিন চলে যায়। নিজের পছন্দমাফিক চলা কিংবা নিজের পায়ের উপর দাঁড়ানো কোনোকিছুই আর হলোনা, হবেও না। সারাজীবন ঠুল্লোর মতো মানবজীবন নিয়েই তাকে চলতে হবে এ গ্রামের পথে পথে-এ বাংলার সমাজে।
(শেষ)