দশ
অনির খুব ছটফট লাগছে। এরই মধ্যে অন্তত তিনবার রুম থেকে বের হয়ে এক মগ করে পানি খেয়ে এসেছে। তবু যেন গলাটা শুকিয়ে আসছে।
অনি দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে ম্যাগাজিনটা আবার হাতে নেয়। কভার পেইজ পেরিয়ে দুই পৃষ্ঠাই অনি এগোতে পারেনি। কভার পেইজের ছবিতে মডেলের একরোখা দৃষ্টিতে চোখ পড়ে থমকে যাচ্ছে।
প্রথমবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে অনির শরীর কেমন করছিল। নিম্নাঙ্গে সরসর করে সরে যাচ্ছিল কিছু, কান ঝা ঝা করছিল। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আবার তাকিয়ে ছিল সেদিকে। তখন টের পেয়েছে ছবিগুলোর নগ্নদেহের অভিব্যক্তি আকৃষ্ট করছে না ওকে, ওর গা গোলাচ্ছিল ভীষণ। ম্যাগাজিনটা তোশকের নিচে চাপা দিয়ে অনি বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে খুব করে পানি দিয়েছে। এরপর যতোই পাতা উল্টাচ্ছে অদ্ভুত সব শিহরণ জাগছে শরীরে।
এমন অনুভবের সঙ্গে এর আগে পরিচয় ঘটেনি ওর। টিভিতে মুভি চলাকালীন বা বিজ্ঞাপন বিরতিতে নায়ক-নায়িকার কোনো ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত চলে এলে বরাবর নতমুখে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অনি। তোড়া ওর অবস্থা দেখে মিটমিট করে হেসেছে। এমনকি বাবাও অহরহ মজা করেছে অনির বিব্রতভাব নিয়ে। আর আজ!
গতকাল আজমাইন অনিকে ম্যাগাজিনটা দিয়েছিল। বার কয়েক না করে করেও কী এক অদম্য কৌতূহলে সেই না’য়ে জোর দিতে পারেনি অনি। বাসায় আসা অবধি অনির প্রথম দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, মা যদি টিফিনের বাটি বের করার সুযোগে ম্যাগাজিনটা দেখে ফেলে। বাসায় ফিরে অনি আজ লক্ষ্মী ছেলের মতে নিজেই টিফিন বাটি বের করে রান্নাঘরে রেখে এসেছে। মা দেখে হেসে বলেছে, বাহবা, ‘আজ দেখি বাবাই বড় ভাল ছেলে হয়েছে। খেয়েছিসতো পুরোটা?’
অনি কোনোরকম মাথা নেড়ে মায়ের সামনে থেকে পালিয়ে বেঁচেছে। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেনি। কী এক অচেনা দ্বন্দ্বে ছটফট করেছে। মনের ভেতর থেকে আজমাইনের কণ্ঠস্বও অনুকরণ করে কে যেন বলছিল, ‘আয় আয়…এই দুনিয়ার মজা দ্যাখ। কত সুন্দর সব শরীরের গল্প! চেটেপুটে পড়ে নে।’
আবার কোন একটা নারী কণ্ঠস্বর পিছু ডাকছিল, ‘ওখানে যাসনে। ওতে আনন্দ নেইরে! বিষ শুধু, নীল বিষ!’
অনি এসব পিছু ডাক উপেক্ষ করে চট করে বিছানা থেকে উঠে পড়েছিল। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ম্যাগাজিনটা খুলে পড়ে চুপিচুপি। ওর মন বার বার না করলেও শরীর যেন বার বার ডাকছিল। কিন্তু সাহস করে ঘরের আলো জ্বালাতে পারছিল না অনি। যদি মা এসে পড়ে! এমনিতেই আজ মায়ের দিব্যি না মেনে ও ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়েছে। এই করতে করতেই একসময় ভোর হয়ে গেছে।
অনি আজ খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে স্কুলের জন্য বের হয়ে পড়েছে। মা পিছু ডেকে ছাতা দিয়েছে। বাইরে খুব বৃষ্টি। অনি ছাতা মাথায় এগোতে এগাতে অনেকটা ভিজে যায়। মা ও শিশু স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের সামনের রাস্তায় এসে অনি থমকে দাঁড়ায়। স্কুলের রাস্তার সামনে প্রায় হাঁটু পানি। অনি বেকায়দা দেখে প্যান্ট গুটিয়ে জুতো-মোজা খুলে হাতে নেয়। নাহ, যাই হোক, আজ স্কুলে যেতেই হবে। আজমাইনকে জিনিসটা ফেরত দিতে হবে। হঠাৎ ধীমানকে দেখা যায়। ধীমান প্যান্ট ভিজিয়ে স্কুলের রাস্তা ধরে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে আসছে। অনিকে দেখে ধীমান হাঁক দেয়, ‘আজ ছুটিরে, অনি ক্লাস হবে না। চল, কলোনীর মাঠে ফুটবল খেলি।’
‘আজ তো দাদা অন্য খেলা খেলবে!’
ধীমানের পেছনে আজমাইনও এসে দাঁড়িয়েছে। আজমাইনের হাসি, চোখের ইশারা, কথা বলার কায়দা দেখে অনি আড়ষ্ট হয়ে যায় আরও।
‘কী ডুড কেমন লাগল! জোশ না?’
ধীমান কৌতূহলী হয়ে দুই বন্ধুর দিকে তাকায়।
‘কী রে? আমাকে বলবি না?’
আজমাইন এগিয়ে এসে ধীমানের পিঠে হাত রাখে।
‘না বলে উপায় আছে! তবে সব জানলে তোদের মতো গুড বয় টাইপ ছেলেরা না আবার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করে বসিস!’
আজমাইনের কণ্ঠস্বরের নির্লিপ্ত ভাব দেখে অনি অবাক হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি মুগ্ধ হয়। কী করে এমন অভিনেতাসুলভ কায়দায় কথা বলতে পারে আজমাইন! আর কেউ না জানুক অনি তো জানে, আজমাইন যে ধরনের ছেলে ওর নির্ঘাৎ ম্যাগাজিনটা লোক ডেকে ডেকে দেখানোর আগ্রহ আর উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসছে।
ওরা জলাবদ্ধ রাস্তা ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তার উঁচু ফুটপাতে উঠে এসেছে। অনি এক ফাঁকে মলাটে মোড়ানো ম্যাগাজিনটা আজমাইনের ব্যাগে চালান করে দিয়েছে। এবার অনেকটা হালকা লাগছে ওর। শরীর-মনের অদৃশ্য সব চাপ মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেছে। এতক্ষণে আত্মবিশ্বাসটা পুরোনো জায়গায় ফিরে আসায় অনি স্পষ্টস্বরে বলে, ‘ধীমান, তুই আজমাইনের পাল্লায় পড়িস না তো। ওসব তোর দেখা লাগবে না। তুই আমাদের গুড বয় গুড বয়ই থাক।’
দাঁত মুখ খিঁচিয়ে এবার আজমাইন ভেঙচে ওঠে, ‘ওরে আমার গুড বয় রে! পাঠ্য বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে কী কী লাড়েলাপ্পা পড়ে তোদের গুড বয় আমি জানি না বুঝি! ঐ দিন যে লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার পড়ছিলি, ও কি খুব ভাল বই? সব জানি আমি। মুভি দেখেছি, সেই হট সব ব্যাপার-স্যাপার!’
এবার ওদের দুজনকে চমকে দিয়ে ধীমান উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।
(চলবে)