বনলতা — (১)

১.

বারান্দা থেকে কাপড় তুলতে তুলতে বনলতা ভাবে বাবার পাঠানো টাকা দিয়ে বই কিনবে সে। পাঠিয়েছেন জন্মদিনে উপহার কেনার জন্য । বই প্রাণের রসদ। রসদ না থাকলে প্রাণ থেকেও প্রাণহীন। আজকাল তার নিজেকে প্রাণহীন মনে হয়। কী কী বই কিনতে হবে লিস্ট করেছে মনেমনে।

বাঙালি সাধারণ আর পাঁচজন ঘরোয়া নারীদের একজন সে, নাম বনলতা ইসলাম। বাংলা আর আরবি শব্দের মিশ্রণে নামটি তার চরিত্রের মতো রহস্যময় কৌতুহলী প্রাচীর গড়ে দিয়েছে মানুষ বনলতার সত্তাকে ঘিরে।

সাউন্ড ক্লাউড এর প্লেলিস্ট ঘেটে গান বের করে। ‘ আমি একদিনও না দেখিলাম তারে ‘ ফরিদা পারভীন এর কন্ঠে, গানের শুরুর বাঁশিটা বুকের ভেতর হুহু করে ওঠার মতো। তারও করে। এই হাহাকার বোধ নিয়ে খুব অস্বস্তি হতো একসময়। আজকাল অন্যরকম একটা আবেশ অনুভব করে। একা থাকার, হাহাকার বোধের ছন্দটা মাঝেমাঝে ধরা দিতে দিতেও দেয় না তাকে। তখন নিজেকে সর্বহারা মনে হয় বনলতার।

বর্ষাকাল চলে যাবার পর আকাশে অদ্ভুত রূপখেলার সাথে বনলতার মনের তুলনা চলে। কখনো সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আবার কখনও একপশলা ঝুম বৃষ্টি। সেই আকাশেই ঝকঝকে রোদ আবার গোধুলির কমলা ধূসর, নীল, লাল সব রঙ খেলা নিজের মতো। নিয়ন্ত্রণহীন। সংসারে এমন ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো মনের মানুষকে অনেক ভুগতে হয়। এমন মানুষ গুলো নিজেরাই নিজেকে চেনে না।

মন কেন এমন হয় বা এমন করে – এই প্রশ্ন নিজের ভেতর বয়ে নিয়ে চলতে বনলতার ভালো লাগে। মনের গভীরতা মাপার, বোঝার কোনো যন্ত্র হয়না। হলে ভালো হতো। কবি, দার্শনিকদের মনের গভীরতা সম্পর্কে জানা যেতো ভাবে বনলতা। আজকাল গভীরে যাবার সময় কোথায় মানুষের। সবাই উপর উপর দেখে আন্দাজ করে নিতে চায়। তারপর হাল ছেড়ে দেয়।

গভীর মনের মানুষ চেনার উপায় খুঁজেও বনলতার লাভ নেই। সে সারাদিন ঘরে থাকে। লোকজন ক’জনের সাথেই বা সাক্ষাৎ হয় কতদিনে। আর নিত্য জীবন যাপনে যাদের সাথে ওঠা বসা তাদের কেমন যেন যন্ত্র মনে হয়।

২.

ধারেকাছে কোথাও দোয়েল শিষ দিচ্ছে তারস্বরে। এটা কি তার সেই দোয়েল! বনলতার বারান্দায় কাপড় শুকনোর দড়ির আরো বেশ খানিকটা উপর দিয়ে ডিশ অ্যানটেনার তার গেছে। এক সন্ধ্যায় কাপড় তুলতে গিয়ে খেয়াল করে সে একটা দোয়েল চুপ করে বসে আছে। বনলতার ভীষণ ভালো লাগে ভেবে, এই পাখিটি তার সঙ্গী। ভোরবেলা অন্ধকার থাকতেই এমন শিস দেয়া শুরু করে ঘুম ভেঙে যায় তার মনে হয় পাখিটি তাকে বলে যাচ্ছে। সেও মনে মনে বলে – যাও এখন, সন্ধ্যায় আবার চলে এসো।

মনেমনে কথা বলার অভ্যাস বনলতার বহু আগে থেকে। খুব ছোটো থেকেই। মুখে যে কথা গুলো উচ্চারণ সম্ভব না বা হয়তো বলতে গেলে নানান ঝামেলা হবার সম্ভাবনা থাকে সে কথা গুলো মনেমনে বলে। অভ্যাসটা একদিকে ভালো। অনেক ঝঞ্জাট এড়ানো যায়, অন্য কেউ না শুনুক তবু বলা হয়ে গেলে মনের চাপ কমে। অন্যদিকে মন্দ এই হিসেবে, তার কথা বলার ইচ্ছে ফুরিয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। অবশ্য কেউ বসেও নেই তার কথা শোনার জন্য।

আয়নায় তাকায় বনলতা। নিজেকে খুব ম্লান লাগছে। ক্লান্ত চোখের নিচটা অনেক খানি ডেবে গেছে। শুকনো ঠোঁটে হাত বুলিয়ে ভাবে – বাহ! বেশ এগুচ্ছি তবে!

ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা ফোন সাইলেন্ট মোডে আছে। ফোন এসেছে। পাঁচ ইঞ্চি এই স্ক্রিনটা বনলাতার জীবনে এখন একাকিত্বের সঙ্গী। সেই দোয়েল যে রোজ সন্ধ্যায় এসে বসতো বনলতার শোবার ঘরের বারান্দায় সে আর আসেনা। আরেকটি দোয়েল সহ কয়েকদিন বসেছিলো। তারপর আর আসেনা। হয়তো বাসা বেঁধেছে।

ফোন ধরে বনলতা। মা ফোন করেছেন।

‘দুইবার ফোন দিলাম আগে, কোথায় ছিলি?’

মা একটু বিরক্ত কন্ঠে বুঝে নেয় বনলতা। সে গায়ে লাগায়না। কথা গায়ে না লাগানোর সিস্টেম সে রপ্ত করে ফেলেছে। কিন্তু অপর পক্ষ সেই উদাসিনতা যেন ধরতে না পারে সেভাবে বুঝে উত্তর দিতে হয়। সে বলে

‘আমি খেয়াল করিনি মা, হয়তো বারান্দায় ছিলাম’

আগের থেকেও বিরক্ত হয়ে মা বলেন –
‘ফোন সাইলেন্ট রাখিস কেন? এইজন্য তো রফিক রাগ করে ‘

বনলতা চুপ করে থাকে। এই কথার কোনো উত্তর হয়না। হ্যাঁ রফিক, তার স্বামী, খুবই রাগ করে ফোন সাইলেন্ট রাখে বলে। এবং এর জন্য সবার কাছে অভিযোগ, নালিশ করে বেরায়।

মা জিজ্ঞেস করেন ‘বলেছিলি নিউমার্কেট যাবি, কবে যাবি?’

‘কেন মা? ঠিক করিনি কবে যাবো’

মা বলেন ‘ তুই একলা গেলেই রফিক রাগ করবে, তোর আব্বা বললেন আমাকে নিয়ে যেতে’

‘রফিক তো ঢাকায় নেই। সে রাগ করবে কেন?’ অফিসের কাজে রফিককে প্রায়ই ঢাকার বাইরে যেতে হয়। একটি প্রাইভেট অফিসে রফিক উচ্চ পদে নিযুক্ত। আরো তিনটি জেলার ব্রাঞ্চগুলোর কাজ কর্মের হিসাব নিয়মিত আপডেট রাখা প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তত্বাবধান দায়িত্ব তার উপর।

এবার মা চরম বিরক্ত এবং হতাশ হন মেয়ের কথায়। বলেন ‘ঢাকায় নেই তাতে কি, সে এসে শুনবে না? জানবে না? বাসায় তোর ননদ দেবর শাশুড়ী সবাই আছে না? ননদকে নিলে ঝামেলা তাই বলছিলাম এসে আমাকে নিয়ে চলো। ‘

বনলতার কথা বাড়াতে ইচ্ছে করে না। সে বলে ‘আচ্ছা মা, আমি যেদিন যাবো তোমাকে নিয়ে যাবো। ‘

অহেতুক কথা থামানোর জন্য সবকিছুতেই সম্মতি দান চমৎকার পদ্ধতি মনে হয় বনলতার।

মা ফোন রাখেন। আগামীকাল বনলতার জন্মদিন। গত পাঁচ বছরে রফিকের এদিনটি কখনও মনে পড়েনি নিজে থেকে। বাড়ির অন্য কেউ মনে করে দিলে যখন তার মনে হয় তখন বেশ ধুমধামে আয়োজন করা হয়। বনলতার বিয়ের পর প্রথম দু তিন বছর ভালো লেগেছে। সবাইকে ডাকে রফিক। বেশ আয়োজন, আড্ডা হয় বাপের বাড়ি, শশুড়বাড়ির আত্নীয়স্বজন মিলে। কিন্তু দিন শেষে যখন ঠাণ্ডা রাত গুলো নামে। বনলতার ভালো লাগেনা। রফিক বলে সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোমার, রান্নাবান্না, মেহমানদারী, ক্লান্ত তুমি, ঘুমিয়ে পড়ো। সে সময় বনলতার মনে হতো কতো খেয়াল করে মানুষটা। এখন আর তেমন মনে হয় না।

সময় গুলো কিভাবে যেন বেঈমান হয়ে ওঠে। একসময় যা কিছু সুন্দর মনে হয়, পরসময় তাই হয়ে ওঠে নির্মম। একসময়ের ঘোর অন্য সময়ের বিষন্নতা। চঞ্চল সময় আশ্রয় নেয় কবিতার বইয়ে। সময়ের এ-ই নিষ্ঠুরতা ধীরে ধীরে বনলতাকে গ্রাস করে। হয়তো তারই অজান্তে।

কাজের মেয়েটা এসে ডাকে দুপুরের খাবার খেতে। দোতলা বাড়ির নিচতলায় বনলতার শশুর শাশুড়ী আর ননদ থাকে এক বাচ্চা নিয়ে। নিচে খাবার ঘর, ড্রইংরুম। উপরে বনলতার শোবার ঘর। পাশের ঘরে দেবর থাকে। বাকিটুকু খোলা ছাদ, রেলিং দেওয়া।

রান্নার দায়িত্ব বনলতার উপর বিয়ের পর থেকে। বড় বউ সে। দায়িত্বে অবহেলার দুর্নাম নেই তার। তবে বেশ কদিন ধরে জ্বর জ্বর থাকায় শাশুড়ী বারণ করছেন অপ্রয়োজনে নিচে নামতে।

একা একা উপরের ঘরে থাকতে তার ভালো লাগেনা। এতো বড় ঘর তবুও নিশ্বাস বন্ধ হয় আসে। রফিক খুব নিয়মে চলা মানুষ। জীবন কে সে একমুহূর্ত অপচয় করে না। জীবন নিয়ে দুই মানুষের দোলাচল চলে একঘরে।

৩.

জীবনের সংজ্ঞা খুঁজতে থাকে বনলতা প্রতি মুহূর্তে। মায়ের গর্ভে শুরু হয় জীবন। বিন্দু থেকে। মানুষ রূপে বের হয়ে সেই যে চলা শুরু, শেষ নিশ্বাস অব্দি চলতে থাকে বিরামহীন জীবন। সে জীবন কোথায়?

শাশুড়ী তাকে দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করেন, আজ শরীর কেমন? রফিক ফোন করেছিলো কিনা।

বনলতা হাসিমুখে অল্প কথায় উত্তর দেয়। হ্যাঁ, শরীর ভালো মা। আজ এই পর্যন্ত রফিক তিন বার ফোন করেছে।

ছেলের দায়িত্ব পরায়ণ কার্যক্রম জেনে তৃপ্ত চোখে হাসিমুখে তাকান শাশুড়ী। আড়ালের চেষ্টায় বিফল তার কৌতুহলী দৃষ্টি – বনলতা বোঝে। বোঝে তার মনের গভীরে থাকা প্রশ্ন গুলো। সব ঠিক থাকা স্বত্তেও কেন বনলতা আজকাল মনমরা থাকে। আগে হলে এই দৃষ্টির মূল্য ঘোচাতে ব্যস্ত হতো বনলতা। এখন আর কিছুতেই সে ব্যস্ততা অনুভব করে না।

খাবার টেবিলে আর কোনো কথা হয় না বউ শাশুড়ীর মাঝে। ননদ আর তার মেয়ে বেড়াতে গেছে। হয়তো তারা থাকলে আরও কিছু কথা হতো।

নিজের ঘরে ফিরে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়, বনলতা, নামটি রেখেছিলেন তার দাদা। কিন্তু বাংলা নাম মানেই তো হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাববে সমাজ তাই অনেক ভেবে তার বাবা ইসলাম যোগ করে দেন। তবুও জীবনে বহুবার মানুষের অবাক দৃষ্টি দেখতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে বনলতা নাম কেন রাখা হয়েছে, কে রেখেছে এমন নাম। নামই তো তবুও কতো অনাস্থা পদে পদে।

এখন বোঝে বনলতা নামের প্রভাবে বিশ্বাস করে তার পরিবার খুব সচেতন ভাবে কবিতা থেকে তাকে দূরে রাখার ব্যবস্থায় নিয়োজিত ছিলো। তাতে কি খুব ভালো কিছু ঘটেছে তার জীবনে! বন্ধুহীন শৈশব কৈশোর তবুও বরং ভালো ছিলো। মানিয়ে চলার, গুছিয়ে বলার চর্চা করতে হতোনা সেই সময়ে। অদ্ভুত ফ্যান্টাসি তৈরী করে তার ভিতর ডুবে থাকতে পারা যেতো। হ্যাঁ, অন্যমনস্কতার জন্য মায়ের কাছে খুব বকা শুনতে হতো। তবুও একটা স্বাধীনতা ছিলো কোথাও।

ইউটিউবে বাংলা কবিতা ছেড়ে হেডফোন কানে লাগায়। কবিতা তেমন বোঝেনা সে। তবে কোথায় যেন শুনেছিলো – কবিতা দুঃখ শুষে নেয়। এরপর সে মন দিয়ে কবিতা পড়তে চেয়েছে। তবুও খুব বেশি ঢুকতে পারেনি কবিতার অন্দরমহলে।
এ কারণে সুক্ষ কিন্তু তীব্র দুঃখ ছিলো তার ভেতর। একদিন শম্ভু মিত্রের আবৃত্তি করা বোধ ‘ কবিতা তার লহমায় সেই দুঃখ থেকে মুক্তি দিয়েছিল। প্রতিটি কথা যেন কবি বনলতার মনের কথা বলেছেন। জীবনান্দ দাশের প্রতি প্রবল আগ্রহ অনুভব করতে থাকে তখন থেকে। এর আগে হাতে গোনা নির্দিষ্ট কিছু কবিতার সাথেই পরিচয় ছিলো তার। একের পরে এক কবিতা তখন কোথায় মনের কোন কোণ উন্মোচন করতে থাকে বনলতা শিহরিত হয় কেবল।

বনলতার কাব্য প্রীতি দাম্পত্য জীবনে আরো একটু শীতলতা যোগ করে যেন। তাতে নতুন করে কিছু এসে যায় না তার। তবে রফিকের খিটখিটে মেজাজে নতুন মাত্রা যোগ হয়। সুযোগ পেলে কবিতা নিয়ে খোঁটা দিতে ভুল করেনা। বনলতা অবাক হয়ে দেখে কেবল মানুষ মানুষকে রক্তপাতহীন ক্ষতবিক্ষত করতে কতটা পারদর্শী।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত