পর্ব সাত
দেশভাগের সময় অনির ঠাকুরদা ভাস্কর দেশ ছাড়তে পারেননি। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার আঁচ এসে লেগেছিল এই শহরেও। প্রাণনাশের আশংকা আর ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার কথা ভেবে বহু স্বজন দেশের মাটি ছাড়লেও ভাস্কর পারেননি। নিজের ভিটেমাটি আঁকড়ে এদেশেই থেকেছেন।
মোহনা দেখেননি মানুষটাকে। শাশুড়ির কাছ থেকে শুনেছেন, ভাস্কর সাহা এই জেলার কোর্টের ফৌজদারী মামলার উকিল ছিলেন। গরীব মক্কেলদের কাছ থেকে তিনি ফি নিতেন না। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিলেন মানুষটা। বিদেশী বস্ত্র ত্যাগ করে এক প্যাঁচে ধুতি পরতেন। ভাস্কর সাহা খেতে পছন্দ করতেন কিন্তু পরিমিত খেতেন সবসময়। সকালে দুধে ভিজানো চিড়া খেয়ে তার দিন শুরু হতো। তিনি পাঠার মাংস খেতেন। তবে নিরামিষটাই বেশী পছন্দ করতেন। তার বসার জন্য আলাদা চেয়ার ছিল খেতেনও আলাদা টেবিলে। তার বিছানা বেশ উঁচু ছিল। সেগুন কাঠের সিংহের পায়ের নকশা করা পায়ার খাটের চারপাশে দারুণ সুক্ষ্ম সব কাজ ছিল। দূর্গাপুজার সময় দশমীর দিন শহরের প্রায় সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিমন্ত্রণ থাকত এই বাড়িতে। মকর সংক্রান্তি বা পৌষ সংক্রান্তি, দূর্গা পূজা, লক্ষ্মী পূজা, সরস্বতী পূজা, দোল পূর্ণিমাতে খুব ধূমধামে হতো। ঐ সময়ে এই পরিবারের সদস্যরা দূর্গা পুজোয় কোন মাটির মূর্তি ব্যবহার করতো না। পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় শহরের ধনী-দরিদ্র্য নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে উৎসবে মেতে উঠতেন ভাস্কর সাহা। দেশকে, দেশের মানুষকে বড় ভালোবাসতেন তিনি।
সেই মানুষটির ভিটেবাড়ি কিনা অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকারি গেজেটের ক তফসিলভূক্ত করেছিল! ভাস্কর সাহা নাকি ভারতবাসী! আবেদনপত্র দিয়ে অনেক ছুটোছুটি করে শংকর এই বাড়ির স্বত্ব-দখল ধরে রেখেছিল। সরকারও ভুল হয়েছে বলে তালিকা থেকে শংকরের পৈতৃক ভিটেবাড়ি বাদ দিয়েছিল। যদিও বিষয়টা ভেবে আজও শংকরের মনে অভিমান জাগে। ওরা এদেশকে ওদের ভাবলেও, এদেশ কি তা ভাবে না?
শংকর মোহনাকে এই অভিমানের পূর্বাপর না জানালেও মোহনা ঠিকই সব টের পান। একটু বেশি বয়সেই বিয়ে করেছিলেন শংকর, আজকাল আরও যেন বুড়িয়ে যাচ্ছে মানুষটা। আজ অফিসে যাওয়ার সময় ঘাড় নিচু করে কেমন হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে যে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল সে, দেখে মোহনার বুকের ভেতরে হাহাকার করে উঠেছিল।
মোহনার কাজে মন নেই তখন থেকে। টেবিলে নাস্তা দিয়ে ছেলেকে ডাকেন তিনি। তখনই কর্কশ শব্দে কলিংবেল বেজে ওঠে। আনমনা মোহনা বেলের শব্দে চমকে ওঠেন, কে এলো অসময়ে!
অনি দরজার বাইরে থেকে বলে, ‘কে?’
‘আমরা। তোমার বাবাকে ডাকো।’
‘আপনারা কারা?’
‘তুমি আমাদের চিনবে না। তোমার বাবাকে ডাকো।’
‘বাবা বাড়িতে নেই।’
ওপাশ থেকে বিশ্রি ভঙ্গিতে হাসে কেউ, তারচেয়েও বিশ্রি ভঙ্গিতে বলে, ‘পালিয়েছে…।’ এরপর হাসি থেমে যায়। গম্ভীর কণ্ঠে কেউ একজন বলে, ‘তোমার বাবাকে বলবে মতিন প্রামাণিক এসেছিল।’
নামটা শোনামাত্র বিহ্বল মোহনার হাত থেকে চামচ পড়ে যায়। মেঝেতে গড়ানো চামচের শব্দ থেমে যেতেই চারপাশ অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে আসে।
(চলবে)
(চলবে)