পর্ব ছয়
তেঁতুল গোলা জল থেকে কাঁসার থালাটা তুলে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছতে মুছতে মোহনা বাবা-ছেলের কথোপকথন শুনতে পান। দুটি শিশুর কথার স্রােত জলের স্রােতের মতো তার শরীর ভিজিয়ে দেয়। টের পান মোহনা, এই সিক্ত অনুভব মনকে প্রগাঢ় আনন্দে বিহ্বল করে তুলছে।
ঠাকুরের কাছে নিত্যদিন এই আবদারই তো করে যাচ্ছেন তিনি, তার অনি যেন শুদ্ধ মানুষ হয়ে ওঠে। ছেলের শুদ্ধতার আঁচে মনে ঘনীভূত হয়ে ওঠা শংকার পাহাড়ে ধ্বস নামে।
মনে পড়ে যায় ক্লাস নাইনে পড়ার সময় মোহনাও একবার প্রাণের বান্ধবীকে বিজ্ঞান স্যারের শাসনের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। প্র্যাকটিকাল ক্লাসের সময় ল্যাবে স্যার সেদিন কী একটা রাসায়নিক বিক্রিয়া হাতে-কলমে দেখাচ্ছিলেন। হেড স্যারের ডাক পেয়ে স্যার ল্যাব ছেড়ে বের হতেই তনিমা অঘটনটা ঘটিয়েছিল। একটা কাচের জার নাড়াচাড়া করতে গিয়ে হাত থেকে ফেলে দিয়েছিল। খুব ভয় পেয়েছিল তনিমা। বিজ্ঞান স্যার ভীষণ কড়া ছিলেন। তনিমার বাবাও। স্কুল থেকে সামান্য অভিযোগ গেলেও তনিমাকে মারতেন তিনি। স্যার ফিরলে ল্যাবে উপস্থিত অন্য সহপাঠীরা তনিমার নাম বলে দিবে বুঝতে পেরে মোহনা সবাইকে চোখ রাঙিয়েছিলেন, ‘কেউ তনিমার নাম বলবি তো তোদের খবর আছে।’ কী খবর করবে মোহনা নিজেও জানতো না, তবু ওর কথায় সবাই সেদিন চুপ ছিল। যেন কী করে ঘটল বিষয়টা কেউই কিচ্ছুটি টের পায়নি। স্যার কতক্ষণ জেরা করে হুমকি-ধামকি দিয়ে ল্যাব ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আর তনিমা এসে মোহনাকে জড়িয়ে ধরেছিল।
মোহনার ইচ্ছে করে দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরেন। ওর মাথার মখমল চুল এলোমেলো করে দেন। নাহ, এত বড় তো হয়নি ছেলেটা যে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরা যাবে না!
মোহনা কাঁসার থালাটা বুকে চেপে ধীর পায়ে বাবা-ছেলের সামনে দাঁড়ান।
‘খুব তো পুটুরপুটুর কথা হচ্ছে দুজনের। খাওয়ার কথা মনে আছে না ভুলে বসে আছ?’
‘তা তোমার ঐ কাঁসার থালায় খেতে দিবে তো? তাহলে এখনই রাজি আছি।’
শংকরের কণ্ঠে কৌতুক।
‘খেলেই না হয় আজ। বাবাইয়ের মার খাওয়া উপলক্ষে।’
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সত্যি সত্যি কাঁসার থালায় খাবার সাজাতে বসেন মোহনা। এই থালাটা তার স্ত্রীধন। বিয়ের সময় বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া। বাবা নিজে দোকানে গিয়ে অর্ডার দিয়ে থালার ধারে বিশেষ নকশা করিয়ে এনেছিলেন। থালাটা খুব যত্ন করে ব্যবহার করেন মোহনা। ব্যবহারের পর নিজের হাতে ধুয়ে-মুছে তুলে রাখেন।
খাওয়া শেষে থালাটা তাকে তুলতে গিয়ে একটা অঘটন ঘটে। হাত থেকে ছিটকে পড়ে মেঝেতে অনেকদূর গড়িয়ে যায় থালাটা। ঝনঝন ঝনঝন শব্দে মোহনার বুকের ভেতরটা ফড়ফড় করে ওঠে, আবার কোন বিপদ আসছে ঠাকুর!
বিষয়টা চেপে রাখতে চেয়েছিলেন শংকর। ছেলের কারণেই পারলেন না। রাতের খাবার খেয়ে ছেলের ঘরে বসে তিনি যখন কাগজটা দেখছিলেন তখনই অনি প্রশ্নটা করে আর ছেলের প্রশ্নে সচকিত মোহনা শংকরের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাবার মেঘ থমথম মুখ দেখে অনিও বাবার কাছে এসে দাঁড়ায়। ওর মন খারাপ হলে বাবা যেমন ওর কাঁধে হাত রাখে তেমনিভাবে বাবার কাঁধে হাত রাখে অনি।
‘এত কি কাগজ দেখছো বাবা? তুমি না অফিসের কাজ বাসায় করো না!’
‘তুই বুঝবি না।’
‘তুমি এই কথা বলছো বাবা? বুঝিয়ে দিলে আমি কী না বুঝি বলো তো?’
ছেলের কণ্ঠের আক্ষেপের সুর টের পেয়ে শংকর মুহূর্তেই উন্মনা ভাব কাটিয়ে ফেলেন।
‘আরে তাই তো, সবই বুঝিস তুই।’
‘ছেলেকে অতশত বুঝাতে হবে না, আমাকে বুঝাও। বলো কী হয়েছে। কিসের এতো চিন্তায় আছো?’
শংকর খানিকটা বিব্রত দৃষ্টিতে মোহনার দিকে তাকান।
‘মনে আছে তোমার? সেই অনিকে যেবছর স্কুলে দিলাম সে বছর সরকার অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে আমাদের এই বাড়িটাও ক তফসিলভুক্ত করেছিল, সেবার অনেক দৌড়োদৌড়ি করে তালিকা থেকে নাম কাটিয়েছিলাম?’
‘হ্যাঁ। ভুল করেছিল ওরা। এখন কী হলো?’
‘এখন সরকারের কাছ থেকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে এই বাড়িটা লিজ নিয়েছিল বলে মতিন নামের একজন আদালতে মামলা করেছে। আজ আমার নামে আদালতের সমন এসেছে।’
মুহূর্তেই সব পরিষ্কার হয়ে যায় মোহনার কাছে, তিনি বুঝে যান অনির বাবা কেন আজ এত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে এসেছেন।
(চলবে)