সুপ্রিয় অনি

পর্ব পাঁচ

ধীমান এমন একজন বোলার যার কনুই বোলিং এর সময় এক ইঞ্চিও বাঁকা হয় না। মূলত ধীমান উইকেট কিপার যদিও কিপ করার চেয়ে হাত পাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গা দিয়ে তাকে বেশি বল ঠেকাতে দেখা যায়। তবে যেদিন ধীমান বুক দিয়ে বল ঠেকায় সেদিন আর কিপ করতে চায় না। কারণ ওর বুকে ব্যথা করায় ও সেদিন চুপচাপ মাঠের ধারে বসে পড়ে। সেদিন অনিরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তবে নিঃসন্দেহে ওদের ক্রিকেট টিমের অন্যতম সদস্য ধীমান। ধীমান না পারে ব্যাটিং না পারে কিপিং তবুও ওকে ওদের দলে রাখতে হয়। একদিন রাগ করে অনি বলেছিল, ‘তুই এবার বসে যা।’ তখনই ধীমান ওর ছয়খানা স্ট্যাম্প বোগলের তলে নিয়ে হাঁটা ধরেছিল।
অমন সুন্দর ছয়খানা স্ট্যাম্প ছাড়া ক্রিকেট খেলাটার জৌলুস কমে যায় বলে ওদের সবাইকে বাধ্য হয়ে ধীমানকে দলে রাখতে হয়। গত দুই ম্যাচ আগে স্থির হয়েছে, ধীমান বোলিং করবে, দ্বিতীয় ওভার থেকে। ধীমান রোজ বোলিং প্র্যাকটিস করে কিন্তু ধীমানের বোলিংয়ে ব্যাটসম্যানতো আউট হয়ই না বরং হতভাগা কিপার বিট না হয়ে বাই চার বাঁচাতেই অস্থির থাকে।
ধীমানের বোলিং স্টাইল দেখার মতো। সে দুই তিন পা হালকা চালে এসে তার ডান হাতটা কাঁধকে কেন্দ্র করে বৃত্ত আকারে ৩৬০ ডিগ্রিতে কয়েকবার ঘুরিয়ে তীব্র গতিতে বল ডেলিভারি দেয় যা কদাচিৎ ব্যাটসম্যানের মাথার নিচ দিয়ে যায়। ধীমান বল করলে বেশিরভাগ সময় ব্যাটসম্যানদের কাজই হয় সময়মতো ডানে বামে সরে গিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচানো। আর যদি ভুলে একটা বল স্যাম্প বরাবর সোজা চলে আসে তখন ব্যাটসম্যান উইকেট বাঁচানোর চেয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতেই অস্থির থাকে।
আজ তেমনিভাবে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে অনি যখন ঘাসের পাশে বসে হাঁপাচ্ছিল ঠিক তখনই বিপত্তিটা ঘটেছিল। আজমাইন ফিল্ড থেকে ছুটে এসে ধীমানের ঘাড়ে চড়ে বসেছিল। বন্ধুকে ছাড়াতে দৌড়ে গিয়েছিল অনি। তারপর আচমকা কী যে হলো, মাঠে থাকা প্রত্যেকে একে-অন্যের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে গেল। ধীমানকে রক্ষা করতে গিয়ে মার খেলো অনি।
কে অনিকে মেরেছে কীভাবে মেরেছে শত জেরা করেও মোহনা ছেলের মুখ থেকে কোনো জবাব বের করতে পারেন না। ছেলের সঙ্গে না পেরে উঠে তিনি রান্নাঘরে চলে যান।
শংকর বসার ঘরে সোফায় বসে ছেলেকে নিরীক্ষা করছেন। মাঠ থেকে মার খেয়ে এসে অনি এমনভাবে ঘাড় গুঁজে আছে যেন সে নিজেই অপরাধী।
‘কী রে, মার খেয়ে দেখি মুখে কথা ফুটছে না।’
‘বেশি লাগেনি বাবা।’
‘বন্ধুর দৃশ্যমান হাতে মার খেলে বেশি ব্যথা লাগে না, বন্ধুর অদৃশ্য হাতে মার খেলে ব্যথায় অন্তর পুড়ে যায়।’
‘তুমি খালি বই পড়ো, পত্রিকা পড়ো আর কঠিন কঠিন কথা বলো।’
শংকর উচ্চস্বরে হাসেন।
‘আজ মার খেয়েও কি জীবনটা তোর কাছে কঠিন লাগছে না?’
‘লাগছে। কিন্তু বাবা আমি বলতে চাই না কে আমাকে মেরেছে। এটা জানলে মা বাড়াবাড়ি করবে। ঐ ছেলের বাড়িতে বিচার নিয়ে যাবে। খেলতে গেলে এমন একটু আধটু হয় তুমিই তো বলেছ। বন্ধুর নাম বলে দিলে বন্ধু শত্রু হয়ে যাবে না!’
‘একদম ঠিক বলেছিল। একবার আমাদের অংক স্যার নিমাই স্যার ক্লাসে ঢোকার আগে বোর্ডে একজন স্যারের কার্টুন এঁকে রেখেছিল। স্যার তো জালি বেত নিয়ে ক্লাসে ঢুকতো। বেতের ভয়েও আমি বা আমরা কেউ স্বীকার করিনি কে অকাজটা করেছে। আমার পাশে বসতো সোহেল, পাক্কা দুষ্ট। আর স্যারও কম যেত না, কথায় কথায় জালি বেতের বাড়ি লাগাতো। আগের দিন সোহেলকে দুই হাতে বেতের বাড়ি দিয়েছিলেন স্যার। তো সোহেলের নাম না বলায় লাইন ধরে সেদিন সব কয়টা মার খেয়েছি। তবু কেউ ওর নাম বলিনি। আমিও না। সেই থেকেই তো তোর সোহেল কাকু আর আমি প্রাণের বন্ধু।’
‘ইস অমন করে স্যারেরা মারত তোমাদের। এখন তো আমাদের মারে না। এখন একদম নিষেধ ছাত্রদের গায়ে হাত তোলা।’
‘আমরা স্যারদের হাতে বেদম মার খেয়েছি, কানমলা খেয়েছি। ক্লাসের বাইরে নিলডাউন হয়ে থেকেছি, বেঞ্চের ওপরে কান ধরে দাঁড়িয়েছিল এসবের উপকারিতা ছিল, অপকারিতাও ছিল। তবে মার খেতাম বলেই হয়তো স্যারদের ভয়-ডর পেতাম, এখন তো উল্টো স্যারেরাই তোদের ভয় পায়।’
অনি বাবার কথা শুনে হাসে। ওর চোখে-মুখে এখন ব্যথার ছাপ নেই।
(চলবে)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত