পর্ব চার
দুপুরের জলখাবার বাড়িতে খাওয়ার কারো সময় নেই এখন। অনির বাবা সকালে অফিসে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে খাবার নিয়ে যায়। তার অফিস বাসার কাছেই, এস.এস.রোড। মিনিট দশেকের রাস্তা। চাইলেই বাড়িতে এসে খেয়ে যাওয়া যায়। আগে শংকরসহ অনেক অফিসার খাবারের সময় দুপুরে বাড়িতে এসে চটজলদি খেয়ে অফিস ছুটতেন। কিন্তু নতুন ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের কানে কেউ খবরটা দিতেই বিপত্তি ঘটেছে। লাঞ্চ আওয়ার পেরোতে না পেরোতেই তিনি চেয়ারের মাথা গুনতে আসেন। মোহনা অবশ্য সকালের নাস্তা তৈরি করার সময় অনির বাবার জন্য খানিকটা ভাত রাঁধেন আর আগের দিন আলাদা করে তুলে রাখা মাছ আর সবজি তরকারি গরম করে লাঞ্চ বক্সে তুলে দেন।
বেগুনভাজাগুলো থালায় সাজিয়ে খাবার টেবিলে রাখতে রাখতে দেয়াল ঘড়িতে চোখ রাখেন মোহনা। দেড়টা বাজে। অনির ছুটি হয় সোয়া একটায়। সকাল নটার দিকে অনির স্কুলের গেট বন্ধ হয়ে যায়। নয়টা পনেরোতে আ্যাসেম্বলি আর সাড়ে নয়টা থেকে ক্লাস শুরু হয়। অনির স্কুল হাঁটাপথে বারো থেকে পনের মিনিটের দূরত্ব। নতুন স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করার পর মোহনা ছেলেকে বেশ কয়েকদিন নিয়ে গেছেন।
স্কুলের বিশাল গেটের মধ্যে অনিকে ঢুকিয়ে হাত ছেড়ে দিতেই মোহনার বুকটা হাহাকার করে উঠতো। যেন কোনো রথের মেলায় ছেলেকে হারিয়ে ফেললেন। কতদিন চোখ মুছতে মুছতে তিনি রিকশায় উঠেছেন। ক্যাম্পাসের এত বিশাল গণ্ডিতে ছেলেকে ছাড়তে গিয়ে তার অনির প্রথম স্কুলের কথা মনে পড়তো।
সে কথা মনে হলে এখনও আবেগে মোহনার চোখ ভরে জল আসে। আনন্দ আর উৎকণ্ঠা মেশা ছিল দিনগুলো। ছোট্ট বাবাই স্কুলড্রেস পরে বয়সের তুলনায় ভারি গাম্ভীর্য মুখে এঁকে নিয়ে মায়ের হাত ধরে স্কুলে রওনা হতো। ছেলেকে স্কুলের গেটে ছেড়ে দিয়ে স্বস্তি পেতেন না। কর্তৃপক্ষের নিষেধ স্বত্ত্বেও স্কুল বারান্দায় হাতেগোনা কয়েকজন অভিভাবকের সাথে মোহনা দাঁড়িয়ে থাকতেন। স্কুল থেকে বলে দিয়েছিল, দুএক দিন থাকা যাবে। কিন্তু পরে বাচ্চাদের একা ছাড়তে হবে। অনিকে একা ছাড়তে মোহনার মন সায় দিতো না। দারোয়ানের গাল-মন্দ শুনতে শুনতে তিনি অনির ক্লাসের অদূরে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
অনি একটু পর পর ক্লাসরুম থেকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে মাকে দৃষ্টিসীমানার মধ্যে খুঁজতো। মোহনা হাত নেড়ে ইশারা করে ছেলেকে নিশ্চিন্ত করতেন, ‘আমি আছি বাবাই!’
সেই বাবাই-ই কিনা একদিন বললো, ‘মা আমি বড় হয়ে গেছি, আমি একাই স্কুলে যেতে পারবো।’ ছেলের কথা শুনে মোহনা তো হেসেই খুন। একরত্তি ছেলে কিনা বলে নিজেই স্কুলে যাবে!
মাস খানেকের মধ্যে অবশ্য অনি স্কুলের নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেল। মোহনাকে আর বারান্দায় দাঁড়াতে হতো না। কিন্তু ছেলে অভ্যস্ত হলে কী হবে, তিনি হলেন না। বারান্দার সামনে থেকে সরে এলেও মোহনা ঠিকই স্কুল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। অনির বাবা অবশ্য বলতো, ‘ছেলেকে ছেড়ে দাও, স্বাবলম্বী হতে দাও। তোড়াটা কেমন নিজে নিজে বড় হয়ে উঠছে দেখছো না?’
তোড়া আসলে বরাবরই অন্যরকম। তেজী, একরোখা।
মেয়েকে নিয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করে মোহনা। নিজেকে নিরাপদে রাখার কৌশলগুলো যেন দ্রুতই রপ্ত করেছে তোড়া। তবু কেন যে দুই সন্তানের মঙ্গলের চিন্তায় মোহনার বুকের ভেতরটা ক্ষণে ক্ষণে হিমশীতল হয়ে আসে। সেকেন্ডের জন্যেও নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার। সারাক্ষণ ভাবেন, কখন ফিরবে ওরা? বাইরে গেলে ঠিক থাকবে তো? মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে কোথাও যেতে না দিয়ে বুকের ভেতরে দুটোকে নিয়ে বসে থাকেন। তাই কী আর হয়!
আপনমনে হাসেন মোহনা। বাচ্চাদের তো স্বাবলম্বী হতেই হবে।
অনিও ক্রমশ স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। মা স্কুলে দিতে গেলেই অনি এখন লজ্জা পায়। মাথা নিচু করে বলে, ‘মা তুমি আর এসো না তো, বন্ধুরা হাসাহাসি করে।’
যেদিন অনি কথাটা বলে সেদিন মোহনার বুকের ভেতরে কুয়াশার মতো কিছু একটা ঘনীভূত হয়ে ওঠে। সেই যে অনি যেদিন বুকের দুধ খাওয়া ছেড়ে দিলো সেদিনের মতো। যেন কোনো অরূপ রতন হাত ফসকে মাটিতে পড়ে গেল! চাইলেই আর ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না।
মোহনা সামনের বারান্দায় এসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ছেলের শরীরের অংশবিশেষও যদি দেখা যায়। অনির ফিরতে দেরি হলে তিনি এভাবেই অপেক্ষা করেন। রাস্তার শোরগোলে তার মন অস্থির হয়ে ওঠে।
আজও তাই হচ্ছে। উল্লাসমুখর স্কুলফেরত নানা বয়সী ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরছে। অনিকে এখনো দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে ল্যাম্পপোস্টের নিচে একটা আধন্যাংটা মেয়ে পাগল দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন মেয়েটার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। কেউ কেউ মুখ টিপে হাসছে।
‘আহা! তুমি কাকে কী অবস্থায় যে রাখো!’
মোহনা ঠাকুরকে ডেকে চোখ ফিরিয়ে নেন।
রাস্তাজুড়ে ব্যস্ত সব মানুষ আর যানবাহনের কোলাহল। রিকশা আর গাড়ির যান্ত্রিক শব্দের ছন্দময়তায় মোহনা বিপন্ন বোধ করেন।
অনি দেরি করছে কেন? কোথায় গেল ছেলেটা? কোনো বিপদ হয়নি তো। মোহনা প্রায় প্রতিদিনই অনিকে মাথার দিব্যি দেন, ‘আমাকে না বলে কোথাও যাবি না। স্কুলফিরতি সোজা বাড়ি ফিরবি।’
অনি এসব কথা শুনলে রেগে যায়। বলে, ‘এসব দিব্যি দিও না মা, ভালো লাগে না। আমি তো সোজা বাড়িতেই আসি। তারপরে দুএকদিন বুঝি রাস্তাঘাটে দেরি হতে পারে না?’
ডোরবেল বাজছে। দুবার বাজলো। অনির বাবা। অনি তিনবার বাজায়। আর তোড়া দরজা না খোলা অবধি বাজাতেই থাকে। ঘরে পা দিতে না দিতেই শংকর মোহনার মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতরটা পড়ে ফেললেন, ‘ছেলে না মেয়ে, কে ফেরেনি?’
‘তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে এলে?’
‘শরীরটা ভালো লাগছিল না। স্যারকে বলে চলে এলাম। তোমার কী হলো?’
উৎকণ্ঠিত মোহনা শংকরের হাত থেকে ব্যাগ নেন।
‘কী হলো তোমার?’
‘তেমন কিছু না। কাজ করতে করতে শরীর ঘাম দিয়ে হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠলো।’
‘ব্লাডপ্রেসার বাড়ল বোধহয়!’
মোহনা ছুটে এসে শংকরের কপালে হাত রাখেন।
‘না জ্বর-টর বাঁধালে অসময়ে!’
‘আরে না। সকাল থেকেই কাজের চাপটা বেশি যাচ্ছিল। হিসেব মিলাতে মিলাতে কেমন যেন খারাপ লাগতে শুরু করলো। কম্পিউটার বন্ধ করে যেই অফিস থেকে বের হলাম সেই থেকেই শরীর ভালো লাগছে। এখন ভালো আছি। তুমি খাবার দাও।’
‘এমন তো হবেই। জায়গাসম্পত্তি নিয়ে যা দুশ্চিন্তা করছ আজকাল।’
‘তুমিও কি কম চিন্তা করছ?’
শংকর হাসেন। জামাকাপড় পাল্টে বিছানায় শরীর ছাড়তে ছাড়তে বলেন, ‘ওরা কোথায়?’
‘তোড়া তো শ্যামার বাসায়। ফিরবে না। আজ রাতে থাকবে। অনি ফেরেনি এখনো। পোনে দুটা বাজে।’
‘অনি ঠিক চলে আসবে। ফিরতি পথে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে মনে হয়। কিন্তু তোড়া পরীক্ষার আগে মাসির বাড়ি থাকতে গেল যে? অবশ্য তোমার মেয়ে তো বেশ বুঝদার। পড়াশোনা শেষ নিশ্চয়ই।’
‘বললো পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে গেছে। নীলার সাথে থাকবে। আর কোন কথাটা শোনে তোমার মেয়ে! কিন্তু আমি ভাবছি অনি দেরি করছে কেন! ও তো এমন করে না।’
‘আহা ফিরবে। স্কুল থেকে ফেরার পথে কোথাও গেছে বোধ হয়। হয়তো বন্ধুদের সাথে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলছে বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খাচ্ছে।’
‘মোটেও না। আমার অনি তো সেরকম ছেলে না। মাঝেমধ্যে ফেরার পথে ক্রিকেট খেলে। আমাকে জানিয়েই যায়। নিষেধ করি, এত রোদের মধ্যে মাঠে যাসনে। তবু যাবে।’
‘কেন গো, স্কুলফিরতি খেলাধুলা করা কি খারাপ? আমি তো রোজ খেলতাম। অতটুকু রোদে না পুড়লে বড় হতে পারবে না। আমরা তো ঐ বয়সে সন্ধ্যা না নামলে বাড়ি ফিরতাম না।’
‘আমি কি তাই বলেছি? অনি তো না বলে কোথাও যায় না। আর তোমাদের সময় আর এখনকার সময় এক হলো?’
‘সময় এক না হলেও মন কিন্তু কম-বেশি এক। আর বয়সের সাথে সাথে ছেলেমেয়ের পছন্দ অপছন্দ পাল্টায় না বুঝি?’
‘পাল্টায়ই তো।’
মোহনার কণ্ঠস্বর ভেজা ও অস্পষ্ট। তিনি বুকের ভাঁজে হাত রাখেন। কী আছে বুকের ভেতর? সমুদ্রের পাড়? না চাইলেও যেখানে শত শত রুপালি ঢেউ আছড়ে পড়ে? নাকি কুয়াশা ভেজা পাতাঘন সবুজ বন? যেখানে সামান্য হাওয়াতেও রাশি রাশি সবুজ পাতা কেঁপে কেঁপে ওঠে?
মোহনার দুশ্চিন্তাকে সত্যি করে মিনিট বিশ পরেই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ আসে।
অনি সময়মতো বাসায় ফিরছে না বলে মোহনার মতো শংকরও ক্রমে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলেন। হঠাৎ শংকরের ফোন বেজে ওঠে, ধীমানের বাবা ফোন করে খবরটা দেন। ক্রিকেট খেলার সময় ছেলেরা মাঠে মারামারি করেছে। অনির কপালে আধভাঙা ইট ছুঁড়ে মেরেছে কে একজন। ধীমানের বাবা অনিকে নিয়ে কাছাকাছি একটা ডিসপেনসারিতে আছেন।
(চলবে)