পর্ব তিন
অনির ভীষণ জল ভীতি আছে। কিন্তু অনি দেখেছে পৃথিবীর বেশির ভাগ কাজকর্ম জল ছাড়া হয় না। জল ভীতির সাথে অবশ্যম্ভাবীভাবে জড়িয়ে থাকে স্নান ভীতি। ছোটবেলা থেকে অনিকে স্নানে নিতে মাকে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। বিশেষ করে শীতকালে মা আর অনির মধ্যে এই স্নান করা নিয়ে কম লুকোচুরি খেলা হয়নি। মায়ের আঁচলে সেই সব দিনের অনেক গল্প আছে। খাওয়ার টেবিলে মাঝে মাঝে মা অনির ছেলেবেলার গল্প করে আর হাসে।
বাবার স্টকেও অনি আর তোড়ার ছেলেবেলার অনেক গল্প আছে। মায়ের বকুনি না খাওয়া অবধি বাবার মুখে কোনো কথা আটকায় না। খাওয়ার টেবিলে মাঝে মাঝে বাবা খুব সিরিয়াস মুখে সেসব আনসেনসর্ড গল্প বলে। কখনো কখনো সেসব গল্পকথা শুনে অনির কান গরম হয়ে যায়। গতকাল রাতে খাবার সময়ও সেরকমই একটা গল্প বলেছিল বাবা যা নিয়ে তোড়াদি আজও মুখ টিপে টিপে হাসছে।
মায়ের একটা প্রিয় গল্প আছে অনির স্নান করা নিয়ে। অনি নাকি স্নানের সময় হলেই মাকে বলতো, মা আমার স্নান চাপেনি। কখনো কখনো মা অনিকে খুঁজে পেতো না। সারা বাড়ি ঘুরে ঠাকুরঘরের দরজার পিছনে বা বসার ঘরের সোফার নিচে অনিকে খুঁজে পেলে অনি কান্না জুড়তো, কেন আমাকে খুঁজে পেলে!
অনির এখন আর লুকোচুরি খেলার বয়স নেই। যদিও চৌদ্দ বছরের অনির জল আর স্নানভীতি ছেলেবেলার মতোই আছে। মা স্নানের জন্য গরম পানি দিয়ে ডাকছেন। অনেকক্ষণ হলো অনি স্কুল থেকে এসেছে। আলসেমি লাগছে খুব। তবু উঠতে হবে। না ওঠা পর্যন্ত মায়ের ডাকাডাকি বন্ধ হবে না। স্নানের ব্যাপারে মা একদম নাছোড়বান্দা।
অনি কোনোরকমে দু’তিন মগ পানি ঢেলে স্নান সেরে বাথরুমের বাইরে বেরিয়ে দেখে মা দাঁড়িয়ে আছে।
‘আজও সাবান দিলি না? ঘাড়ে কত ময়লা জমেছে দেখেছিস? আয় আমি সাবান ঘষে দেই।’
‘না মা শীত লাগছে। সাবান দিবো না।’
‘আয় তো!’
‘আমার চান শেষ মা। যাও তো তুমি!’
‘এমন করিস কেন বাবাই! এই সেদিনও তো তোকে চান করিয়ে দিতাম। আর আজ না করছিস! নাকি আমার হাতে সাবান দিতে লজ্জা পাচ্ছিস?’
মা ব্যাপারটা ঠিক ধরে ফেলেছে তবু জোর করছে। অনি রাগ হতে গিয়েও পারে না। মায়ের গলার আবদারটুকু অবহেলা করতে ইচ্ছে হয় না।
তবু অনি মাকে বাঁধা দেয়, ‘দুরো মা, আমি বড় হয়েছি না! তোমার সাবান দিতে হবে না। কাল আমি নিজে দিবো।’
‘হ্যাঁ, খুব তো বড় হয়েছিস। মাকে আর লাগে না। পিঠে ডানা গজিয়েছে। ইচ্ছে হলেই বাড়ি ছেড়ে যেতে পারিস।’
অনি এবার খেয়াল করে মায়ের কণ্ঠে কোনো অনুযোগ নেই। অভিমান আর দুশ্চিন্তায় মায়ের কণ্ঠস্বর অবসন্ন। নাহ্ সেদিন খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছিল মাকে। মনে মনে অনেক বকেছে নিজেকে। সেদিন বাড়ি ফেরার পর মা ওকে জড়িয়ে ধরে কত যে কেঁদেছে। বাবাও কেঁদেছে। বাবা-মাকে কখনো এত কাঁদতে দেখেনি অনি। তাই মনে মনে ও প্রতিজ্ঞা করেছে, আর কোনোদিন বাড়ি ছেড়ে যাবে না।
সেদিনের কথা মনে হতেই মায়ের জন্য মায়ায় অনির বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। এখন ওর ইচ্ছে করছে মাকে গিয়ে এক ছুটে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু কেমন একটা বাঁধো বাঁধো ঠেকছে।
নিজের সঙ্গে খানিকক্ষণ লড়াই করে অনি। তারপর মাকে কষ্ট দেওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে মায়ের কথার অবাধ্য হয় না আর। ছেলের সম্মতি পেয়ে খুশি মনে মোহনা বাথরুমে ঢোকে আর ছেলের ঘাড়ে পিঠে সাবান ঘষতে ঘষতে ঠাকুমার ঝুলি খুলে বসে, ‘খুব তো বড় হয়েছিল! নিজের শরীরে সাবান পর্যন্ত দিতে পারিস না। দ্যাখ দ্যাখ কেমন ছাতা বের হচ্ছে। শোন আজ থেকে সপ্তাহে একদিন নিয়ম করে আমিই তোকে সাবান দিয়ে দেবো। মাথায় লম্বা হলেই কি আর বড় হওয়া যায়! এই তো কদিন আগে অবধিও তো আমার কাছেই চান করতি। আর এখন ছেলে খুব সেয়ানা হয়েছে। হাইস্কুলে উঠে রাজ্যি জয় করেছে।’
বাথরুমের দরজার কাছে তোড়ার কাচভাঙা হাসির শব্দ শোনা যায়। তোড়া অনিকে ক্ষ্যাপাবার চেষ্টা করছে। অনি বোনকে পাত্তা দেয় না। সাবানের গন্ধ উবে গিয়ে মায়ের শরীরের গন্ধ অনিকে আজ ছোট্টটি করে দিয়েছে।
আহা কেন যে অনি বড় হচ্ছে! বড় না হলে তো রোজই মায়ের কাছে স্নান করতে পারতো। মাকে জড়িয়ে ধরে হাসনাহেনার গন্ধ নিতো!
‘ওর কথায় কান দিসনে বাবাই। যা এবার শরীরে জল ঢেলে নে। আমি যাচ্ছি।’
‘ওরে ন্যাকারে…।’
দিদিটা না দিন দিন বেশি পাজী হচ্ছে। তবে আজ আর অনি কিছু বলবে না। আজকের শোধটা আরেক দিনের জন্য তোলা থাক। তোড়াকে পাত্তা না দিয়ে অনি বাথরুমের দরজা আটকে দেয়।
স্নান সেরে অনি নিজের ঘরে ঢুকতেই দেখতে পায় বাবা ওর বিছানায় শুয়ে পত্রিকা পড়ছে। অনির মনে পড়ে আজ বাবার ছুটি। গতকাল ব্যাংকের ইয়ার ক্লোজিং ছিল। বাবাকে ঘরে পেয়ে অনির মন আনন্দে ভরে ওঠে। কতদিন হলো বাবার সাথে মন খুলে কথা বলে না! আজ অনেকটা সময় বাবাকে ঘরে পাওয়া যাবে। বাবার সঙ্গে গল্প করা যাবে।
অনি বাবার পাশে বসে।
‘বাবা একটা মজার ঘটনা বলা হয়নি তোমাকে। জানো আজ কি হয়েছে? আজ না আজমাইন মনির স্যারের কাছে রাম ধোলাই খেয়েছে। স্যার বলেছে কথায় কথায় ‘ডুড’ বলা চলবে না। আমাদের ‘ডুড’ ‘ডুড’ করতে করতে আজ ও স্যারকেই বলে ফেলেছে, ম্যাথ খাতাটা ভুলে আনিনি ‘ডুড’।
ছেলের কথার প্রতিউত্তরে এতক্ষণ হু হা করে যাচ্ছিলেন শংকর। ‘ডুড’ শব্দটা কানে বিঁধতেই তিনি পত্রিকার পাতা থেকে চোখ তুলে ছেলের দিকে তাকালেন। অনিও বাবার কৌতূহল বুঝতে পেরে গল্পের পুনরাবৃত্তি করতে শুরু করলো।
গল্প বলা শেষ হলে শংকর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আজমাইনটা কে রে? আগে তো নাম বলিসনি।’
‘এই তো গত মাসে ভর্তি হলো আমাদের সেকশনে। জানো বাবা, আজমাইন একদম আলাদা। ওর বাবা নাকি এডিশনাল এস পি তাই বছরের মাঝখানে আমাদের স্কুলে ভর্তি হতে ওর কোনো সমস্যা হয়নি। এতদিন আজমাইন ঢাকায় ছিল। খুব নাকি নামকরা স্কুলে পড়তো। ওর কথা বলার ভঙ্গিটা বেশ মজার। কথায় কথায় আমাদের ‘ডুড’ বলে।’
অনির মুখে হাসি।
‘বাবা, ডুড! এ আবার কি রে? বিদেশীদের মতো নাকি?’
‘না বাবা, টিভি নাটকের মতো। এখন তো নাটকগুলোতেও ডুড বলে, তুমি খেয়াল করোনি?’
‘নাহ্ তো!’
বাবা যেন ছেলে, ছেলে যেন বাবা-এভাবে ক্রমে আড্ডা জমে ওঠে। আর বাবার সাথে আড্ডা জমে গেলে অনির কথা খই ভাজার মতো ফুটতে থাকে। শংকর ছেলের সাথে আড্ডাবাজি খুব গুরুত্বের সাথে নেন। মোহনা মাঝে মাঝে বলে, ‘ছেলেটা তোমার সাথে কত সহজ! আমার সাথে কেন না?’
শংকর এই প্রশ্নের উত্তর জানলেও মোহনাকে অত ব্যাখ্যা করে বলেন না। কারণ, মোহনা অনির ব্যাপারে সামান্য ব্যাখ্যাও মানতে নারাজ। ভয় আর আশংকা মোহনার মন জুড়ে থাকায় অনির বেড়ে ওঠা মোহনা উপভোগ করতে পারছে না। তবু শংকর মাঝে মাঝে চেষ্টা করেন, মোহনার ভাবনার বৃত্ত ভেঙে ফেলতে কিন্তু ছেলে-মেয়ের ব্যাপারে কোনো ছাড় দিতে মোহনা নারাজ।
মোহনার ধারণা, পুরো পৃথিবী তোড়া আর অনিকে গ্রাস করতে হাঁ করে বসে আছে। তাই মোহনা সব কাজে ছেলে-মেয়েকে বাঁধার চেষ্টা করে আর ওদের সামনে তুলে দেয় নিষেধাজ্ঞার দেয়াল। কিন্তু শংকর জানেন, বাঁধনই সম্পর্ক আলগা করে।
অনির বেড়ে ওঠার সময় এখন। এখন অনির ভেতরে আলো ঢোকার সময়, অন্ধকার ঢোকার সময়। কথার মারপ্যাচ বা কথার গতিতে ওর মনের রথ থামবার না, সেটা মোহনা বুঝতে চায় না। মোহনার মুখনিঃসৃত মাত্র একটি শব্দ ‘না’ ছেলেকে মায়ের কাছ থেকে একটু একটু করে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে।
নিজের মনে ভাবছিলেন শংকর। হঠাৎ খেয়াল করলেন, অনি কথা বলেই যাচ্ছে।
‘ওর না বাবা স্মার্ট ফোন আছে। আমার আর ধীমানের ফোন নেই দেখে সে কী হাসাহাসি ওর! বলে কি না, ডুড, তোরা মফস্বলের ক্ষ্যাত! গাঁইয়া ভূত! আজমাইনের কথা শুনে ধীমান তো গতকাল খুব রেগে গিয়েছিল, বলেছে আরেকবার উল্টোপাল্টা বললে হেড স্যারকে নালিশ করবে।’
‘তুই ও কি নালিশ করবি?’
‘দুর বাবা, আমি ওসব নালিশে নেই। বললে বলুক। তবে আজমাইনের মোবাইলটা কিন্তু বেশ। সিম্ফনির সেট। আমাকে দু’একবার ধরতে দিয়েছে। টাচ স্ক্রিন। ছবি আসে খুব সুন্দর। আজমাইনতো ক্লাসের মধ্যেও সেলফি তোলে।’
‘তুই ও তো সেলফিকুলফি সব শিখে ফেললি। তোর ও কি স্মার্ট ফোন চাই ডুড?’
‘দুর বাবা, তোমার সবটাতেই ইয়ার্কি। আমি কি কখনো বলেছি আমাকে মোবাইল দাও? জানো বাবা আজমাইনের ফোনে ইন্টারনেটের কানেকশন থাকে সবসময়। চ্যাট করে। বাবা, এই বয়সে এসব কি ভাল বলো?’
‘তুই তো বেশ তোর মায়ের মতো কথা বলছিস? তাহলে কোন বয়সে ভাল?’
অনির দৃষ্টি এবার বিষণ্ন। বয়সের সমীকরণ মিলাতে ভাল লাগে না ওর। তবু কি করে যেন মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেল।
‘তোর বয়সেই তো সব ভাল। আমি কি আর এই বুড়ো বয়সে তোর নিত্যানন্দ কাকার পিঠ চাপড়ে বলবো, হাই ডুডু! কেমন আছিস?’
অনি হেসে ফেলে। শংকরও হাসেন। অনি আবার সহজ হয়ে যায়।
‘বাবা, আজমাইনের একটা জিনিস কিন্তু খারাপ। ও কী করে বলবো?’
‘বল।’
‘মাকে বলে দিবে না তো?’
‘বললেই কি? তোর মা কি আর আজমাইনের কাজেকর্মে কষ্ট পাবে?’
‘আরে না, মা বলবে, আজমাইনের সাথে মিশিস না! কিন্তু ওর সাথে মিশতে আমার ভালই লাগে।’
‘আচ্ছা ডুড! বলবো না।’
‘এক সপ্তাহ হলো আজমাইন তপন স্যারের কোচিং এ যাচ্ছে। আমাদের ব্যাচের পড়া শেষ হলে ও কি করে জানো?’
‘উহু।’
‘ও ইচ্ছে করে স্যারের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথম প্রথম আমি আর ধীমান বুঝিনি ব্যাপারটা। কাল টের পেলাম, আমাদের ব্যাচের পরেই তো মেয়েদের ব্যাচ শুরু। ও অযথাই দাঁড়িয়ে মেয়েদের দেখবে।’
শংকর ছেলের মতো গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন, ‘আমিও দেখতাম তোর বয়সে। তোর মাকে আবার বলিস না!’
‘দুর, তুমি খুব ইয়ে বাবা, মেয়েদের ওইভাবে দ্যাখে নাকি কেউ, বখাটে বলবে না সবাই?’
‘সেটাও অবশ্য ঠিক। তাহলে আর দাঁড়িয়ে থেকে দেখার দরকার নেই।’
‘আমি তো দেখি না। আজমাইন খুব স্টাইল মেরে দাঁড়িয়ে মোবাইল চাপতে থাকে। আমি আজ ওকে রেখেই চলে এসেছি। পথে শম্পার সাথে দেখা। ভাগ্যিস শম্পা আমাকে ওভাবে দেখেনি। তাহলে কি ভাবতো বলো! নির্ঘাৎ এসে কাকীকে বলে দিতো।’
‘তাই তো শম্পা কী ভাবতো বল তো!’
‘বাবা, তুমি কিন্তু আমার সাথে আবার মজা করছো!’
শংকর ছেলের কথা শুনে সশব্দে হাসেন। অনিও হাসে।
(চলবে)