ঠুল্লো (১)

ছোটবেলা থেকেই গ্রামের এক বড় ভাই নজরুলকে লেনিন নামে ডাকতো। ডাকার সময় স্লোগানের মতো করে বলতো, লেনিন লেনিন লেনিন চাই, লেনিন ছাড়া গতি নাই। তখনও নজরুল বোঝে নাই এই লেনিন কোন লেনিন? তখনও নজরুল জানেনা এই লেনিন নামক মানুষটিকে কেনো স্লোগানের মতো করে ডাকা হচ্ছে? কিংবা তাকে ডাকারই বা অর্থ কি? বড় হয়ে বুঝলো এই লেনিন কমিউনিস্ট পার্টির লেনিন। যার হাত ধরে কমিউনিজম বিস্তর বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু নজরুলকে লেনিন নামে সম্বোধন করে ডাকার মানেটা কি? তাহলে কি নজরুলের ঐ বড় ভাই নজরুলের ভেতর লেলিনের ছায়া দেখতে পেয়েছিলো?
নেতৃত্বের এক রূপ ছোটবেলা থেকেই তৈরি ছিল নজরুলের ভেতরে। সত্যিকার অর্থে ছোটবেলা থেকে নেতৃত্ব দিয়েও এসেছে জ্ঞাতে অজ্ঞাতে। কিন্তু সভ্যতা থেকে অনেক দুরে থাকা এ পাড়া মহল্লাতে কে বুঝবে কমিউনিজমের আদর্শ? যাদের জন্য কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করবে- যাদের জন্য লড়াই সংগ্রাম করবে তারাই তো নিজস্ব স্বার্থের মোহে ভিন্ন ভিন্ন দলে নাম লেখিয়েছে। যারা বুঝতেছে যে, হ্যাঁ, তাদের কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করা জরুরি তারা আরো আগেভাগে ভাগছে! কেননা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে তো তাদের পেট ফুলে ফেঁপে ডাবর করে তুলতে পারবেনা! আর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তা জীবন বাস্তবতার কারণে অনেকের পক্ষেই তা করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। ফলে, বেঁচে থাকার জন্য তারাও হয়ে যায় জনপ্রিয় দলগুলোর একেক ভৃত্য। একারণে অনেকের সব রাজনৈতিক জ্ঞান ভেতরে থাকার পরেও রাজনীতির মাঠে থাকা হয়না কিংবা রাজনীতিতে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে নজরুল। কিংবা এই অজ পাড়া গাঁয়ে কমিউনিজমের ভবিষ্যত নাই ভেবে নজরুলের রাজনীতিও নাই হয়ে গেছে। কিন্তু এটা তো চিরন্তন সত্য যে, কমিউনিজম কখনো শেষ হবার নয়। যতোদিন পৃথিবীতে মানুষ নামক প্রানী থাকবে ততোদিন কমিউনিজমও থাকবে। হয়তো সে আসবে ভিন্ন রূপে, নজরুলের মতো মানুষদের লড়াই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। নিপীড়িত, শোষিত মানুষেরা দেখবে তাদের পাশে কেউ না কেউ কাঁধের উপর হাত দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কমিউনিজমের পতাকাটা জ্বলজ্বল করছে মাথার উপর। সে যাই হোক, নজরুলের গ্রামের বন্ধুরা চায় নজরুল রাজনীতিতে দক্ষ খেলোয়াড় হয়ে উঠুক। আগামী নির্বাচনে ইউনিয়ন পরিষদের ভোটে দাঁড়াক। নজরুলের এতো এতো জনপ্রিয়তা নজরুলের বন্ধুদের খুব মোহিত করে।
-ইংকে জনপ্রিয় হলে তো হামি আকাশোত উড়নু হিনি বার‌্যা! নজরুলের এক বন্ধু নজরুলকে বলে।
ইউনিয়নের সেরা ক্লাবের সভাপতি নজরুল। দুইটা প্রাইমারি স্কুলের সভাপতি। একটা হাট ও মসজিদ কমিটির সভাপতি। নজরুল যদি আরেকটু আগ্রহ দেখায় তাহলে হিন্দুদের শ্মশান কমিটি ও মন্দির কমিটির সভাপতির পদে বসাতেও রাজি আছে তারা। এতো কম বয়সে নজরুলের ঈর্ষান্বিত জনপ্রিয়তা সবাইকে তাক্ লাগায়।
মুসলমান সম্প্রদায়ের আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বুঝতে পেরেছে যে, নজরুল অসাম্প্রদায়িক চেতনার লোক। তার হাতে যে কোনো ধর্মই নিরাপদ। তার কাছে সম্প্রদায়গত কোনো শ্রেনীবিভেদ নেই। একারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরাই বেশি আগ্রহ দেখায় নজরুলকে ভোটে দাঁড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু নজরুলকে খুব বেশি টানেনা তাতে। প্রচলিত রাজনীতির নোংরা বালুর উপর হাঁটতে ভালো লাগেনা তার। রাজনীতি যে ভালো লাগেনা তাও না আবার। ভালো লাগেও; কিন্তু সে রাজনীতির ভেতর পরিচ্ছন্নতা থাকতে হবে এবং তা হতে হবে নীতি নৈতিকতা নির্ভর। বর্তমান রাজনীতির মতো রাজনীতি চলতে থাকলে সে রাজনীতিতে টিকতে পারবেনা কিংবা সে রাজনীতিতে খাপ খাওয়াতেও পারবেনা নিজেকে। ফলে, এই রাজনীতির মাঠ থেকে নজরুল নিজেকে দূরেই রাখতে চায়। রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পেছনে আরো একটা কারণ আছে। সে কারনের পেছনে নজরুল লোকচক্ষুর আড়ালে প্রতিনিয়ত শুশ্রুষা করে যায়। কাউকে বুঝতে দেয়না, কাউকে জানাইও না ব্যাপারটা। এটা আসলে জানানোরও বিষয় না। সাধনার বিষয়। তাই ভেতরে ভেতরে আড়ালে আবডালে সাধনাটাই করে যায়। নজরুল বোঝে যে, প্রত্যক্ষ রাজনীতি করলে, মানে, মাঠের রাজনীতিতে ইনভলভ হইলে সে সাধনা মাঠে মারা যাবে। অর্থ্যাৎ, রাজনীতি ও লেখালেখি একসাথে দুটোই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবেনা তার পক্ষে। আর সম্ভব হইলেও দুটো ক্ষেত্রের কোনো একটা ক্ষেত্রেই পুরোপুরি সাকসেস হওয়া সম্ভব হবেনা তার। একারণে তাকে যেকোনো একটি ক্ষেত্র চুজ করে নিয়ে সামনে এগোতে হবে নজরুলকে। হয় রাজনীতি করতে হবে নয়তো লেখালেখি চালিয়ে যেতে হবে। পাড়ার মুরুব্বিরা বলে,
যেডে করব্যার চাবু বাপ; সেডের ভিতরে সান্ধাবু! তালে পরে তুই ঠিকানাত্ যাত্যা পারবু!
নজরুল চায় দেশের নামকরা শিল্পী-সাহিত্যিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে। তাকে রাজনীতিবিদ হিসেবে না জানুক লোকজন। অভাবের তাড়না মেটাতে এতোদিন যা গন্ধ ছড়িয়েছে সে পর্যন্তই থাক। স্বয়ংসম্পন্ন হওয়া গেলে সেন্ট মেখে সে দুর্গন্ধ তাড়ানো যাবে।
মানুষ আগলেনের কথা ভুলে যায় বার‌্যা। -দেকলুনো, কমিক হাজি হজ¦ করার আগে ক্যাংকা জাউড়া আছিলো। সুদ, ঘুষের ট্যাকা খায়্যা মাউর হয়ে গেছিলো। লোকেরা ওক দেকলেই ছ্যাপ ফালাচ্ছিলো! এখন হজ্জ্ব করে আস্যা মাথাত টুপি দিয়ে ঘোরে। আগের যত দুর্নাম আছিলো সেগলেন এখন আর কেউ মনোত থোয়নি। হামরা বাংলাদেশের মানষেরা ইংকেই। অকাম কুকামের কথা ঘড়িক পরেই ভুলে যাই!
ফলে নজরুল বোঝার চেষ্টা করে আগে যা হয়েছে তা হোক। কিন্তু এই সময়ে এসে তাকে নতুনত্বের দিকে আগাতে হবে। অর্থ্যাৎ সময়োপযোগী হয়ে উঠতে হবে তাকে। সমাজে যে বৈষম্য, শোষণ নিপীড়নের যন্ত্র চালু আছে তা থেকে জনগণকে মুক্ত করতে হলে রাজনীতিবিদ হিসেবে তা দুর করা সম্ভব হবেনা। কেননা, যে সিস্টেম সমাজ-রাষ্ট্রে চালু আছে তা একার পক্ষে দমন করা যাবেনা কখনোই। বরং দুষ্টচক্রের জালে পড়ে তাকেও ঐ পরিণতিই মেনে নিতে হবে। মানে, দেশে যে সিস্টেম চালু আছে সে সিস্টেমের ভেতর দিয়েই জট পাকাতে হবে তাকেও। অতএব, এ পথ নজরুলের জন্য নয়। সে যদি সত্যিকার অর্থেই জনগণের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতে চায় তাহলে তাকে লিখেই জনগণের পক্ষে থাকতে হবে। একারণে রাজনীতির চাইতে সাহিত্যকেই মূল উপজীব্য করে বাঁচতে চায় নজরুল। কিন্তু, বাঁধ সেধেছে অর্থনৈতিক বাস্তবতা। অর্থ্যাৎ, ২৪ ঘন্টার লেখক হিসেবে টিকে থাকতে হলে অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা খুবই জরুরি বিষয়। যদি হাতে টাকা না থাকে তাহলে কনসেন্ট্রেশন ভিন্ন দিকে যাবে। রোজগার করতে করতেই যদি দিন রাতের এক তৃতীয়াংশ সময় পার হয়ে যায় তাহলে লেখালেখি কিংবা সংসারধর্মই বা পালন করবে কখন? তাই বলে, সব লেখকই কি পেশাহীন? তারাও তো কর্মজীবি মানুষ। তারা তাদের কাজকর্ম করেও লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারে তো! কিন্তু নজরুলের ধারণা এরকম গতানুগতিক চিন্তায় আটকায়ে নেই। নজরুল মনে করে যা করতে হবে তার পুরাটাই করতে হবে। সে হিসেবে যদি সাহিত্য রিলেটেড কোনো কর্ম জোটে তাহলেও না হয়। কিন্তু নজরুলের আরেক মন বলে, নাহ্, সাহিত্য রিলেটেড কোনো সংবাদ পত্রেও তার চাকরি হলে চলবে না। মানে, সেখানেও যেহেতু তাকে সময় ইনভেস্ট করতে হবে সেহেতু ফলাফলও একই দাঁড়াবে। যা করতে হবে তা তার মতো করে স্বাধীন হতে হবে। নইলে, কতোজন সাহিত্যিক এলো আর গেলো- কিন্তু কয়জন দাঁড়াতে পারলো? নজরুল এই হিসাবটাও করে রেখেছে। শুধু নিছক সাহিত্যিকের লেবেল গায়ে দিয়ে হাওয়া খাওয়ার চাইতে মাঠে ভেড়া চড়ানো অনেক ভালো কাজ মনে করে নজরুল। কিন্তু এই মুহুর্তে অর্থ বিত্ত ছাড়া কে কাকে পোছে? নজরুল যতোই ভালো লেখুক না কেনো অর্থ ছাড়া তাকে কেউ এক পয়সার দামও দেবেনা। বলা যায়, ইহকালীন দুনিয়ায় এটাই জলজ্যান্ত বাস্তব সত্যকথা। হয়তো মহাকালের ছামিয়ানার নিচে তার জায়গা হবে কিন্তু ভোগবাদী দুনিয়া তাকে নেবেনা।
নজরুলের চোখ মহাকালের দিকে তাকিয়ে আছে। যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহাররা দাঁড়িয়ে আছে। এর পাশাপাশি নজরুল চায় -ক্ষুধা থেকে, অভাবী চেহারা থেকে মুক্তি পেতে। সে দেখতে চায়না কোনো কবি, সাহিত্যিক ক্ষুধায় আচ্ছন্ন থেকে টগরবগর করে পথ হাঁটছেন। সুকান্ত যেভাবে ক্ষুধায় কাতর হয়ে চাঁদকে ঝলসানো রুটি মনে করে চাঁদের মনোরম সৌন্দর্য্যকে কুৎসিত ভাবে উপস্থাপন করেছেন; নজরুল সৌন্দর্য্যকে এভাবে নষ্ট করে দিতে চায়না। নজরুল মনে করে, সুন্দরকে তার প্রাপ্য মর্যাদাই দিতে হবে। সে মনে করে জাতিকে পথ দেখাবে শিল্পী সাহিত্যিকেরা- সেই শিল্পী সাহিত্যিকেরাই যদি পশ্চাতে থাকে তাহলে কিভাবে একটা জাতিকে বুঝবে এই জাতিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। কে জানি বলেছিল, যদি কোনো জাতিকে বুঝতে এবং চিনতে চাও তাহলে সে জাতির সে সময়ের সাহিত্য, শিল্পকলা পড়ে দেখো, তাহলেই বুঝতে পারবে সে জাতি; জাতি হিসেবে কেমন জাতি ছিল। সেকারণে যারা শিল্প সাহিত্য চর্চা করে তারা সর্বপ্রথমে মানুষ হিসেবে এগিয়ে থাকা মানুষ হতে হবে। আর মানুষেরা মানুষ হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে তার নিজস্ব অর্থবাহুর উপরে। তাহলে নজরুলকে এই দেয়ালটাকেই আগে টপকাতে হবে। কিন্তু চাইলেই কি দ্রুত টপকানো যায়? তার জন্য তো সময়ের প্রয়োজন আছে। ধীরে ধীরে বাইতে হবে নৌকা। তবে এ কাজটা যে খুব সহজ হবে তাও না। তবে দরজায় ধাক্কা দিতে হবে- ধাক্কা দিয়ে দিয়ে ভাঙ্গতে হবে দরজায় লাগানো তালাখানা। হয়তো ধাক্কা দিতে দিতে সমাজের চোখে হেয় প্রতিপন্ন হতে পারে। হতে পারে অসামাজিক- গাড়ল কোনো। তবু তো হাতে পাবে চাবিখানা, খুলতে পারবে জীবনের কারখানা।

এই চাবি কেউ তোমাকে দেবেনা। অথচ দেওয়ার কথা ছিলো কারো। দায় ছিলো কারো।

চাবি উদ্ধার করতে যেয়েই নজরুল সমাজের কাছে অপদস্ত- অপমানিত হয়। সমাজ তাকে অসামাজিক বলে প্রচার করে বেড়ায়। তাহলে সামাজিক কে? কেনো সামাজিক? এসব প্রশ্ন চলে আসে সামনে।
সমাজে শ্রমিক যদি তার প্রাপ্য কিংবা ন্যায্য চাওয়াটাকেই অধিকার মনে করে চায় তাহলে কি সমাজ ব্যক্তিকে অসামাজিক সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করবে? এসব নানান প্রশ্নের জটলায় নজরুল দড়ির মতো প্রতি প্রশ্নে প্রশ্নে গিঁট্টু মেরে রেখে দেয়। পরে যদি এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় তাহলে সে গিঁট্টুগুলোকে খুলে অন্য বাঁধনে কাজে লাগাবে। তার উদ্দেশ্য যেহেতু সৎ সেহেতু কাউকে তোয়াক্কা না করে নিজের মতো সশব্দ করে হেঁটে যায় মাইলের পর মাইল, মরুভূমির পর মরুভূমি, সমুদ্রের পর সমুদ্র। কিন্তু নজরুলকে অসামাজিক হওয়া চলবেনা। এটা নজরুলের প্রেমের শপথ। অর্থ্যাৎ নজরুল যাকে ভালবাসে তার প্রধানতম শর্ত এটাই। কেননা, নজরুল যদি অসামাজিক হয় তাহলে তার বাবা মার কাছে তার কথা বলতে পারবেনা। দারুণ এক ম্যাথ দাঁড়ায়া থাকে নজরুলের সামনে। কিন্তু এ পরিক্রমা থেকে তাকে এ অংক কঁষেই বের হতে হবে। অনেকটা এরকম যে, লাঠিও ভাঙ্গবেনা পরন্তু সাপটাও মারা পড়বে। কিন্তু তা চাইলেই যদি সম্ভব হতো; যে চাইলেই সবকিছু হাতের মুঠোতে চলে আসবে। তাহলে তো হতোই।
Ñতালে পরে ক্যাং করে সংসার করবু? কে বিয়ে করবি তোক? সালাম কালামও দেওয়া শিখিসনি তো কাকো! শ্বশুর গোষ্ঠিক যে সালাম-কালাম দেওয়া লাগপি সেডেও তো পারবু নো হিনি? এক বন্ধু বলে বসে।
শুধু বিয়ে শাদীর ব্যাপারেই যে সামাজিক হতে হবে তা নয় ব্যাপারটা। জীবনের প্রত্যেক জায়গাতেই সামাজিক হয়ে উঠা জরুরি। তা না হলে প্রতি পদে পদে পস্তাতে হবে। কিন্তু লেখালেখি করতে যেয়ে প্রচল যা কিছু তাকে অস্বীকার করতে গিয়ে সমাজ থেকে ডেসপারেট হয়ে গেছে নজরুল। সে নিজে নিজে এর উত্তর খুঁজতে গেলে এর টিকিইও খুঁজে পায়না।
Ñহ, ঠিকই তো!
একেবারে ডেসপারেট, অসামাজিক এবং আপোষহীন ব্যক্তি যারা; সমাজে কিভাবে ডিল করবে তারা? যদি ডিল করতে যায় তাহলে তো সমাজের প্রত্যেকটা ফাংশনের সাথে আপোষরফা করতে হবে নজরুলকে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? রাষ্ট্রের প্রত্যেক এরিয়াতেই তো সমঝোতা করা লোকের বসবাস। তাদের বিবেক বর্জিত কাজকে কিভাবে সমর্থন দেবে সে? নজরুল তো কখনোই সুবিধাবাদ জিনিসটাকে বোঝার চেষ্টা করেনি। কিংবা আয়ত্বে রাখারও লোভ দেখায়নি কখনো। তাহলে কিভাবে মেলামেশা, সমঝোতা করবে সে দুষ্টপরায়ন লোকেদের সাথে? সামান্য স্বার্থের জন্য কি অন্যের খারাপ কাজকে সমর্থন দিয়ে তার নিজের আখের গোছাতে হবে? এ কথা যাকে বলবে সে অন্যদিকে মুখ বেঁকা করে থাকে। বলে,
-থাক, তোমার যা মনে হয় তাই করো, নিজের মুরগী টিকনেত্ জবো করো! হামার কওয়া হামি কলাম। তুমি সেডে পালন করবা না করবা না সেডে তোমার ব্যাপার।
এইখানেও, মানে প্রেম করতে গেলেও নজরুলকে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হওয়া লাগে। সে ভেবে পায়না সবাই যদি তার দিক থেকে ক্রমে ক্রমে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে সমাজে টিকে থাকবে সে কি করে? নজরুল তবু আগাইতে চায়। সমাজের যা কিছু মন্দ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। সে মনে মনে ভাবে, সে নিজে বদলে গেলেই তার দেখাদেখি সমাজের অন্যরাও বদলে যাবে, হয়তো। আগামীর সমাজের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হলে তাকে বদল হতেই হবে। সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসাবে সে নিজেই জ্বলে উঠবে প্রথমে। কিন্তু সমাজ বদল করতে গেলে যে সমাজের মোড়লেরা তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে, তাকে নানা অপবাদে জর্জরিত করবে তাহলে সে কিভাবে আফসানাকে বিয়ে করবে? যাকে নিয়ে ঘর সংসার করার চিন্তা করে; সে আফসানাই তো নানান প্রশ্ন হাজির করে নজরুলের সামনে। সেখানে সমাজের অন্য লোকদের সে বোঝাবে কিভাবে যে, সে যা করছে তা সমাজ পাল্টানোর জন্য করছে। কিন্তু কেউ বোঝে না তাকে। একধরণের দীর্ঘশ্বাস সঙ্গী হয় নজরুলের।

আফসানার জন্য দিন দিন মন খারাপ হতে থাকে নজরুলের। নজরুল ভাবে, অন্তত আফসানা তো তাকে বোঝার কথা। সে না বুঝলে গোটা পৃথিবীই তো অবুঝ থাকবে। তাকে বোঝাতে না পারাটা কি নজরুলের ব্যর্থতা নাকি নজরুলকে বুঝতে না পারাটা সমাজেরই ব্যর্থতা? সে যাই হোক, অনেকদিন হলো আফসানার সাথে দেখা হয়না, কথা হয়না। ফলে, নজরুলের সামনে আফসানা নামটা উচ্চারিত হলেই ধ্বক্ ধ্বক্ করে উঠে বুকের ভেতরে। মনে হয়, ড্রামে স্টিকের বারি পড়তেছে একেকটা। মনে হয় আফসানার সাথে প্রেম করা আর নকশাল বাড়ির আন্দোলন করা একই কথা। মানে, আফসানার বাবা মা কে নজরুল সরকার পক্ষ মনে করে। আফসানার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা কিংবা আফসানার সাথে কথা বলা শুনতে পারলেই জেল জরিমানা হবে। কিংবা আফসানার বাবার এমন বৈভব, প্রতিপত্তি আছে যা খাটিয়ে নজরুলকে সমাজচ্যুৎ করারও ক্ষমতা রাখে। নজরুলের পরিবারও যে আফসানাকে মেনে নেবে এমন নয়। কেননা আফসানার ট্যামট্যামি ভাব আর বড়োলোকি স্বভাব একদমই সহ্য করেনা নজরুলের পরিবার। নজরুল তার পরিবারের সাথে একবার কথা প্রসঙ্গে আফসানা সম্পর্কে যা মন্তব্য পেলো তার ফলাফল দাঁড় করালে এমন রেজাল্টই দাঁড় হয়।
নজরুল যার জন্য এত উতলা হয়ে দিনরাত কাটায় সেই আফসানা কি এমনভাবে অনুভব করে নজরুলকে। যদি এমন ভাবেই অনুভব করতো নজরুলকে তাহলে তো আফসানা যেকোনো ভাবেই হোক খোঁজ নিতো নজরুলের। যেহেতু আফসানা নজরুলের খোঁজ নেয়না সেহেতু সে কি অন্য কারো সম্পর্কে জড়িয়েছে নিজেকে? হয়তো নজরুলের বোহেমিয়ান জীবনটাকে পছন্দ হয়নি আফসানার। সেকারণে অন্যত্র গমন করলে আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু থাকবেনা।
হয়তো আফসানা এখন পছন্দ করে মিডিয়া পাড়ার সেলিব্রেটি কাউকে। যেহেতু সে নিজেও মিডিয়ার সাথে যুক্ত ছিলো একসময়। তাই নজরুলের এমন ভাবনা অমূলক নাও হতে পারে। তার পছন্দের তালিকাতে থাকতে পারে টিভি সিনেমা জগতের তারকা কাউকে। ফলে তার ভাল লাগার কথা না ভ্যাগাবন্ড কোনো কবিকে। আর কবিরা পাগল; সমাজ বহির্ভূত মানুষ। তার কপালে দুঃখ- কষ্ট ছাড়া কিইবা আছে। ফলে, নগদ প্রাপ্তি বলতে যা বোঝায় তা ঐ মিডিয়ার তারকাদেরই আছে। নগদ অর্থ, ভোগবিলাসি জীবন, দামী গাড়ি, ফ্ল্যাট কি নাই তাদের? বছর বছর বিদেশে পাড়ি জমানো থেকে শুরু করে অবকাশ যাপন করতে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা যাদের কাছে তুচ্ছ; আফসানা তাদেরই বউ কিংবা গার্লফ্রেন্ড হয়ে আয়েশি জীবন যাপন করতে চায়। এক্ষেত্রে আফসানাকে দোষ দেওয়াটাও ঠিক হবেনা নজরুলের। কেননা নিরাপদ এবং আয়েশী জীবন কে না চায় এ জগতে। নজরুলের সাথে আফসানার সম্পর্ক বলতে গেলে জন্মের শুরু থেকেই। অর্থ্যাৎ, আফসানার ফ্যামিলি যা নজরুলের ফ্যামিলিও তা। অর্থ্যাৎ, আফসানাও চৌধুরী বাড়ির মেয়ে নজরুলও চৌধুরী বাড়ির ছেলে। আফসানার বাবা চাকুরি করার কারণে আফসানা জন্মের পর পরই গ্রাম থেকে ঢাকায় স্থানান্তর হয়ে যায়। আফসানা সেখানেই বড় হতে থাকে- পরিচিত হতে থাকে ঢাকার পপ কালচারের সাথে। এদিকে নজরুল ছোটবেলা থেকেই গ্রামে বসবাস করা ছেলে। বলা যায় গ্রামীণ কৃষ্টিকালচারেই সে পোক্ত হয়েছে। পড়াশোনায় খুব একটা মনোযোগ নাই। সারাক্ষন লেখালেখি আর বোহেমিয়ান জীবনযাপন করাটাই তার লাইফের পার্ট হয়ে ওঠে। মাঝখানে দুই তিন বছর ব্যবসা করতে গিয়েও ব্যবসায় সফল হইতে না পারা মানুষ। সফল না হবার পেছনে যতোটা না নজরুলের দায় আছে তার চাইতে বেশি দায় নজরুলের ব্যবসায়িক পার্টনারদের। ব্যবসা করতে গিয়ে নজরুল জীবন সম্পর্কে যে ধারণা পায় তা দিয়ে জীবনের বাকিটা সময় সে চলতে পারবে। এটা তার বিশ্বাস। নজরুল হাড়ে হাড়ে টের পায় যে মানুষ কতো হারামী। সমাজ কতখানি নোংরা ও স্বার্থপর। টের পায়, কিভাবে সমাজের স্বাধীন মানুষেরা বৃটিশদের চেয়েও শোষণপ্রিয়। নিজের ভাই হয়ে আরেক ভাইয়ের ঘাড়ের উপর বন্দুক রেখে কিভাবে শিকার করা যায় এবং অন্যকে ব্যবহার করে কিভাবে নিজের স্বার্থ হাসিল করা যায় তা এ ব্যবসাতে না এলে কিছুই বুঝতে পারতো না নজরুল। ব্যবসা করতে এসে সে আরো টের পায় বন্ধুত্ব নামক শব্দটি কিভাবে রেপড হয় একে অপরের কাছে। আর সম্পর্কগুলো হয়ে যায় জারজ। ফলে, নজরুল বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে একেবারে ডিনাই করে দিয়ে নিজেকে নিয়ে নিজের ভেতরে গুঁটিয়ে পড়ে। এছাড়াও লেখক স্বত্ত্বাকেও চায় বাঁচাতে। লেখালেখির সাথে যেহেতু ব্যবসা করা কিংবা কর্পোরেট জব করা কন্ট্রাডিকশন সেহেতু নিজেও আর এগোয়নি সেদিকে। একারণে নিজের সন্ধানে নিজেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে নজরুল। লাইফের সবটুকু সময় ব্যয় করে চলে নিজের পেছনে। কিন্তু এভাবে চলবে কেমন করে? বর্তমান জীবন ব্যবস্থা পরিচালনা করতে যেয়ে যে অর্থ ব্যয় হয় অন্তত সে উপার্জনটুকু থাকতে হবে তার। নয়তো এভাবে ভ্যাগাবন্ড হয়ে ঘুরতে থাকলে আফসানাকেই বা পাওয়া হবে কিভাবে তার?

ধারাবাহিক..

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত